#অরুণরাঙা_প্রেম
#পর্বঃ১৩
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি
তাড়াতাড়ি তৈরি হচ্ছে আরোশী।বাইরে আকাশ আর আহির তার জন্য অপেক্ষা করছে।আজকে আহিরের স্কুলে বার্ষিক ক্রিয়া প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হবে।যেহেতু আহির পুরষ্কার পাবে এবং এবার আহিরও যেতে অনেক আগ্রহী তাই আকাশ আজ সব কাজ বাদ দিয়ে আহিরের সাথে সময় কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।তাদের প্লেন ছিলো শুধু আহির আর আকাশ যাবে কিন্তু শেষ মূহুর্তে এসে আহির বলে বসলো আরোশীকেও নাকি যেতে হবে।আরোশী না করলে আকাশ তাকে বললো,
” আরোশী প্লিজ মানা করবেন না।আহির আজ আপনার জন্য প্রথম কোন কিছুতে অংশগ্রহণ করেছে এবং বিজয়ী হতে পেরেছে।আপনি গেলে আহিরের ভালো লাগবে এবং আমিও খুশি হবো।”
আকাশের কথা শুনে আরোশী আর না করতে পারেনি।তাড়াতাড়ি রেডি এসে আরোশী বাইরে বেরিয়ে এলো।
” সরি সরি আমার জন্য দেরি হয়ে গেলো,চলুন।” হাতে ঘড়ি লাগাতে লাগাতে বললো আরোশী।আকাশ ঘাড় ঘুরিয়ে আরোশীর দিকে তাকাতেই কিছু সময়ের জন্য থমকে যায়।কালো থ্রি-পিস,একপাশ করে একটা বেনি,মুখে হয়তো ক্রিম মেখেছে তবে তা খু্ব একটা বোঝা যাচ্ছে না সব মিলিয়ে আরোশী অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশিই ভালোই লাগছে।আহিরের ধাক্কাতে আকাশ আরোশী থেকে চোখ সরিয়ে নিলো।
গাড়িতে আরোশী পেছনে বসতে চাইলে আহির তাকে বসতে দিলোনা।তার কথা তারা সবাই সামনে বসবে।তাই উপায় না পেয়ে আরোশী আহিরকে কোলে নিয়ে সামনের সিটে বসলো।
স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আহির আর আরোশী।আকাশ গাড়ি পার্ক করতে গিয়েছে।স্কুল আজ সাজানো দেখে আহিরের খুব খুশি লাগছে।সে আগে কখনোই এরকম সাজানো স্কুল দেখেনি।
” কি আহির,খুব খুশি লাগছে?”
” হুম ফেরি আন্টি,খুব খুশি লাগছে।জানো আমি এর আগে কোনদিন স্কুলের কোন অনুষ্ঠানে আসিনি।”
” মন খারাপ করোনা আহির।আগে আসিনি সমস্যা নেই,এরপর থেকে স্কুলের সব ফাংশনে তুমি আসবে।”
” সত্যি!”
” হুম তিন সত্যি।চলো এবার ভিতর যায় আমরা।”
এরই মধ্যে আকাশও চলে এলো।তারা তিনজনে একসাথে ভিতরে প্রবেশ করলো।গেস্টদের জন্য রাখা চেয়ারগুলোতে বসলো তারা তিনজন।আহির আশেপাশে দেখে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে আর আকাশ হাসি মুখে তার উওর দিচ্ছে।আরোশী চুপচাপ বসে আছে কারণ সে বাবা-ছেলের মধ্যে ডুকতে চাইনা।
” আরে তুমি সেই মেয়েটা না,যে ওই আহির নামের ছেলেটাকে মাঝেমধ্যে স্কুলে দিয়ে যাও?”
আরোশী ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলো এটা সেইদিনের মহিলাটা।
” কেমন আছো তুমি?আজ অনেক দিন পর দেখা তোমার সাথে।তো আজ হঠাৎ এখানে?তা তুমি এখনো ওই ছেলের দেখাশোনা করো?নাকি ছেড়ে দিয়েছো?”
” ছেড়ে কেন দেবো?আহির তো খুব ভালো ছেলে,আমার ওর সাথে থাকতে ভালোই লাগে।”
” ও আচ্ছা।তো তুমি এখানে কার সাথে এসেছো?”
” আহির এর সাথে।”
” ও বাবা আহির ফাংশনে এসেছে বুঝি!বাহ্ আজ প্রথম দেখলাম তাকে।তা কোথায় সে,দেখতে পাচ্ছিনা যে।”
” এইতো আমার পাশেই তো বসে আছে।”
আরোশী একটু পিছিয়ে গিয়ে ইশারায় আহিরকে দেখিয়ে দিলো।
” ওর পাশে ওটা ওর বাবা না?”
” হুম স্যারও এসেছেন আজকে।”
” হুম ভালো কিন্তু ওর মা কোথায়?উনি আসেননি?”
আরোশী কি বলবে বুঝতে পারছেনা কারণ সে নিজেও আহিরের মা সম্পর্কে কিছুই জানেনা।আরোশী কিছু বলবে তার আগেই মহিলাটি অন্য আরেকজনের স্যার কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।এই সুযোগে আরোশী কথাটাকে এড়িয়ে গেলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলো।একে একে ডিসপ্লে,মার্চ পাস,খেলা সব হচ্ছে।এবার অভিভাবকদের খেলার পালা।অনেক অভিভাবকই খেলা অংশগ্রহণ করছে।
” বাবাই তুমিও খেলোনা।”
” আহির দেখো এটাতো তিন পায়ে দৌড়।এখানে পার্টনার লাগে।আর আমি তো খেলতে পারিনা তাই আজ না অন্যদিন।”
” প্লিজ বাবাই খেলো।আর ফেরি আন্টি আছে না।তুমি ফেরি আন্টির সাথে খেলো।ও ফেরি আন্টি তুমি প্লিজ বাবাই এর সাথে খেলো না।দেখো সব আঙ্কেল আন্টিরা খেলছে তোমরাও খেলোনা।”
আকাশ আর আরোশী অনেক ভাবে আহিরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু এখন আহির কিছুতেই বুঝতে চাইছেনা।সে মুখ গোমড়া করে বসে আছে,তার একটাই কথা আহির আর আরোশী খেলায় অংশগ্রহণ করবে।অবশেষে আহিরের কাছে হেরে গিয়ে তারা দুজন রাজি হয়ে গেলো।এটা শুনে আহির যেন হাতে চাঁদ পেলো মতো অবস্থা।
আরোশী আকাশ সহ বাকিদেরও দুটো পা বেঁধে দেওয়া হলো।কিছুক্ষণ পরেই প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেলো।বাকিদের মতো আকাশ আর আরোশীও প্রাণপণ চেষ্টা করছে জেতার জন্য।আহির দাঁড়িয়ে তাদের চেয়ারআপ করছে।
” বাবাই,ফেরি আন্টি তাড়াতাড়ি দৌড়াও।বাকিরা পৌঁছে যাচ্ছে।তাড়াতাড়ি দৌড়াও।” তালি দিতে দিতে বললো আহির।তবে অনেক চেষ্টা করেও আরোশী আর আকাশ খেলায় জিততে পারেনি।
পায়ের বাঁধন খেলে তারা দুজন আহিরের পাশে এসে দাঁড়ালো।
” দৌড়ে আমার জান বেরিয়ে গেলো,হা…..” হাঁপাতে হাঁপাতে বললো আরোশী।
” ঠিক বলেছো।যে দৌড়টাই না দৌড়ালাম আমরা।গলাটাতে পুরো শুকিয়ে গিয়েছে।”
” কিন্তু যাই বলুন স্যার,খেলে কিন্তু মজাই লেগেছে।কি বলো আ…..।আহির কি হয়েছে তোমার?এভাবে মুখ গোমড়া করে আছো কেন?”
” তোমরা খেলায় জিতোনি কেন?আমার এটা ভালো লাগেনি।” মুখটা একটু দুঃখী দুঃখী করে বললো আহির।আহিরের কথা শুনে আরোশী হেসে তার মুখ নিজের দিকে করলো।
” শোন আহির সবকিছুতেই ভালো মন্দ দুটোই থাকে তেমনি থাকে হার জিত।সবাই যদি খেলায় জিতে তাহলে হারবেটা কে?যদি হার না থাকতো তাহলে জিতার যে আনন্দ যেটা কেউ বুঝতো না আর যদি হার না থাকতো তাহলে কেউ জিতার মূল্য বুঝতে পারতোনা।জিতার মধ্যে যেমন একটা আনন্দ থাকে তেমনি হেরের যাওয়ার মধ্যেও একটা সুপ্ত আনন্দ থাকে।তাই হেরে গেলো মন খারাপ করে নয় বরং সেই হার আমাদের কি শিখিয়েছে সেটা বিবেচনা করে আমাদের ভবিষ্যতে আরো ভালো কিছু করতে হবে।বুঝতে পেরেছো?”
” হুম বুঝতে পেরেছি ফেরি আন্টি।”
” এইতো গুড বয়।আচ্ছা তুমি বসো আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।স্যার আহিরের খেয়াল রাখবেন।”
আকাশ এতোক্ষণ মনোযোগ দিয়ে আরোশীর কথা শুনছিলো।আরোশীর ডাকে সে তার দিকে ফিরে তাকালো।
” আরে জানেন ভাবী ওই যে মেয়েটার সাথে প্রতিযোগিতায় খেলেছিলো সে তো ওকে দেখাশোনা করে।”
” কি বলছেন ভাবী আমি তো আরো ভেবেছিলাম ওটা ওর মা।”
” ওই ছেলের কি মা নেই নাকি?”
” কি জানি।মনে তো হচ্ছে নেই,থাকলে কি আর আসতোনা।”
” দেখুন গিয়ে ভাবী আবার এটা নয়তো যে মা ছেলে আর স্বামীকে ফেলে অন্যকারোর সাথে পালিয়ে গিয়েছে।”
” হতে পারে,আজকালকার যুগে এগুলোই তো হচ্ছে।ওই যে মেয়েটা আছে না,মেয়েটা কিন্তু ভালো।ছেলেটার যত্ন করে দেখলাম।”
” তাই নাকি!কিন্তু আমার মনে হচ্ছে মেয়েটারও কোন উদ্দেশ্য আছে।আজ কাল উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ কোন কাজ করেনা।”
” হুম হতে পারে ওর মা নেই আর মেয়েটা সেটাই সুযোগ নিচ্ছে।”
” কিন্তু আমার তো মেয়েটাকে দেখে সেটা মনে হয়নি।দেখে তো ভদ্র সভ্য মনে হয়েছে।কথাবার্তাও খুব সুন্দর।”
” আরে ভাবী এখন কার মনে কি চলে তা কি আর বোঝা যায়।দেখুন গিয়ে নাকি ওই মেয়ে আবার ওনার প্রেমিকা।”
” হুম হতে পারে এটা ওদের অবৈধ সন্তান।”
” আস্তে বলুন ভাবী,কেউ শুনে ফেলবে।”
” আর বাচ্চাটাও কিরকম নিজের মা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেই চুপ হয়ে যায়।বাচ্চাটাকে দেখলেই আমার ভুতুরে বাচ্চা লাগে।”
” তাই নাকি!বিশ্বাস নেই হতেও পারে কালোজাদু করে কিছু করেছে।”
” তার জন্যই তো আমি আমার বাচ্চাকে বলে দিয়েছি ওই বাচ্চা থেকে যেন সবসময় দূরে দূরে থাকে।”
” তাহলে আমিও আমার বাচ্চাকে বলবো।”
” আর আমিও।সাবধানের মার নেই,যদি আসলেই কোন ভুতুরে বাচ্চা হয়।”
আরোশী আর কিছু শুনলো না।সে চুপচাপ সেখান থেকে সরে গেলো।আরোশী ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে তারা আহিরের কথা বলছিলো।তাদের ভাবনা চিন্তা দেখে আরোশী ভিষণ অবাক।কেউ কারো সম্বন্ধে এরকমটাও ভাবতে পারে ভেবেই সে অবাক।
চলবে……