অরুণরাঙা প্রেম পর্ব-২৭

0
701

#অরুণরাঙা_প্রেম
#পর্বঃ২৭
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

অল্প কয়েকজন মানুষের উপস্থিতে আকাশ আর আরোশীর বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেলো।বিয়ের পুরোটা সময় আহির চুপটি করে আরোশীর পাশে তার শাড়ির আঁচল ধরে বসে ছিলো।বিয়েতে মিসেস সামিরা উপস্থিত ছিলেন না।আকাশ অনেকবার ডেকেও ওনাকে নিচে আনতে পারেননি।তবে ইলা ছিলো।আরোশী ইলাকে দেখে বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলো এবং অনুতাপ বোধ কাজ করছিলো তার মধ্যে এই ভেবে যে ইলার হয়তো আকাশের বিয়ে দেখে কষ্ট হচ্ছে।অভ্রকে দেখে আরোশী আজ আরো বেশি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে,অভ্রের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ আরো বেড়ে গিয়েছে।অভ্র কি সুন্দর সবদিকে ম্যানেজ করছে,যেন তার নিজের ভাইয়ের বিয়ে হচ্ছে।বিয়েতে রুদ্রকে দেখেনি আরোশী,হয়তো সে আসেনি।

আরোশী শাড়ি বদলে মাত্রই রুম থেকে বের হয়েছে তখনই কেউ তার দরজায় নক করলো।দরজা খুলে অভ্রকে দেখে হালকা হাসলো আরোশী।

” ভাবী আপনি এখানে কি?”

” আমি তো এখানেই থাকি ভাইয়া।”

” না না এখন আপনার বিয়ে হয়ে গিয়েছে,সো এখন থেকে আপনি আকাশের রুমেই থাকবেন।কোন কথা নয়,চলুন।”

অভ্র আরোশী জোড় করে আকাশের রুমে নিয়ে গেলো।আহির তখন সেখানেই ছিলো,আরোশীকে দেখে সে বিছানা থেকে নেমে তাকে জরিয়ে ধরলো।

” আহিরকে আমি নিয়ে যাচ্ছি ভাবী।আজ সে আমার সাথেই থাকবে।চলো আহির,আজকে তুমি আর আমি মুভি দেখবো।”

অভ্রের কথা শুনে আহির দ্বিমত করলো না কারণ তার সাথে আহিরের বন্ডিং ভালো তাই আহির ভালো ছেলের মতো তার সাথে চলে গেলো।আরোশীও আটকালো না,যেখানে আহিরের কোন সমস্যা নেই সেখানে তার না আটকানোটাই ভালো।আরোশী এবার ঘরটাতে চোখ বুলালো।না ঘরটা অন্যদিকের মতোই,বিশেষ কিছু নেই।আরোশী ধীর পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।

আরোশীর আজ তার বাবা-মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।প্রতিটা মেয়ের বিয়েতে তার বাবা-মা উপস্থিত থাকে,কত আয়োজন করে তারা,মেয়ের বিয়ে নিয়ে তাদের কত আনন্দ কিন্তু আরোশীর কপালটাই খারাপ।তার বিয়েতে বাবা-মা তো দূরে নিজের আপন,পরিচিত কেউ ছিল না।

” বাবা-মা তোমরা কেন আমাকে ফেলে চলে গেলো?বলো কেন আমাকে অনাথ আশ্রমে রেখে এলে?তোমরা কি আদো বেঁচে নাকি কোন কারণে আমাকে ফেলে চলে গিয়েছো?যদি বেঁচে থাকো তাহলে কেন আমাকে অনাথ আশ্রমে রেখে এলে?কেন আমার নামের আগে অনাথ শব্দটা লাগিয়ে দিলে?” এসব ভাবতে ভাবতে আরোশীর চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো।

” আরোশী।”

আকাশের কথা শুনে আরোশী তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলো।

” তুমি কি এই বিয়ের কারণে কান্না করছো?”

” না না,আসলে বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছিলো।”

আরোশীর কথা শুনে আকাশ স্বস্তির নিশ্বাস নিলো।

” মন খারাপ করো না।এখন আমি আর আহির আছিনা তোমার সাথে।তোমার আর একা থাকতে হবে না।”

আকাশের কথা শুনে আরোশীর মনে একটা ভালো লাগা কাজ করছে।তার মস্তিষ্ক বলছে ” হ্যাঁ এখন থেকে আমারো একটা পরিবার আছে,আমারো আপন বলতে কেউ আছে।”

” আরোশী।”

” হুম।”

” যেভাবেই হোক তুমি এখন আমার স্ত্রী।আমি চাই পাঁচটা দম্পতির মতো তোমাকে আর আহিরকে নিয়ে সুখে থাকতে।আমি জানি এসব মনে নিতে তোমার একটু সময় লাগবে তবে তাতে আমার কোন সমস্যা নেই।তবে আমি চাই আমাদের নতুন জীবন যেন কোন মিথ্যা বা ধোঁয়াশার মধ্যে যেন শুরু না হয়।আমি এখনই তোমার কাছে সব পরিষ্কার করে দিতে চাই,যেন পরে কোন ঝামেলা না হয়।”

আকাশের কথা আরোশী কোন উওর দিলোনা।সে শান্তদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে তার পরবর্তী কথা বলার অপেক্ষা করছে।

” আরোশী তুমি জানো আহির আমার ছেলে।আর শুরু থেকেই তোমার জানার ইচ্ছে ছিলো আমার স্ত্রী কোথায়?আহিরের মা কে?কিন্তু তুমি জেনে অবাক হবে যে আহির আমার ছেলে নয় আর না আমার কোন স্ত্রী আছে।আমার জীবনে তুমিই প্রথম নারী।”

আকাশ কথাগুলো বলে আরোশীর দিকে তাকালো কিন্তু আরোশীর হাবভাব দেখে আকাশ একটু অবাকই হলো কারণ আরোশীর মুখে হাসি লেগে আছে।আকাশের মনে কি চলছে আরোশী ঠিকই সেটা বুঝতে পেরেছে।সে হেসে বললো,

” স্যার আপনি হয়তো না না আপনি একটা বিষয় খেয়াল করেননি আমি কিন্তু বিয়ে নিয়ে কোন প্রশ্ন আপনাকে করিনি।আমি বিয়ের আগে এটা কিন্তু একবারো জানতে চায়নি আপনার স্ত্রী থাকা স্বত্তেও কেন আপনি বিয়ে করছেন?কেন আহিরের মাকে ছেড়ে অন্যকাউকে বিয়ে করছেন।এর কারণ কি জানেন?এর কারণ আমি বিয়েতে রাজি হওয়ার আগে থেকেই জানতাম আপনি কোনদিনই বিবাহিত ছিলেন না আর না আহির আপনার নিজের ছেলে।”

আরোশীর কথা শুনে আকাশের পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠলো।

” তার মানে তুমি……. ”

” হুম আমি আগে থেকেই জানতাম।সেইদিন আমি আপনার আর ম্যাডামের সব কথা শুনেছিলাম।আপনি জানেন কেন আমি বিয়েতে রাজি হয়েছি?মানুষ হয়তো ভাবছে আপনার টাকা আর নাম দেখে এক বাচ্চার বাবাকে আমি বিয়ে করছি।কিন্তু আমি তো জানি সত্যিটা।আপনার আমাকে বিয়ে করার মূল কারণ যেমন আহির আমারো ঠিক তাই।জানেন তো আমি অনাথ,বাবা-মায়ের ভালোবাসা কি তা জানিনা।আমার আপন বলতে কেউ ছিলোনা।আমি খেয়েছি কিনা,আমি ভালো আছি কিনা তা জানার জন্য কেউ ছিলো না আমার।আহিরের সত্যিটা জানার পর আমার সর্বপ্রথম নিজের কষ্টের,একাকিত্বের কথাগুলো মনে পড়েছিলো।এই কয়েকমাসে আহিরকে আমি বেশ আপন করে নিয়েছি আর আহিরও আমাকে নিজের কাছে কেউ মনে করে।আমি চাইনি আহিরও আমার কত কষ্ট পেয়ে বড় হোক।তাই আমিও আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গিয়েছি।”

কথা শুনে করে আরোশী পেছন ফিরে আকাশের দিকে তাকালো।আরোশী তাকাতেই আকাশ তাকে জরিয়ে ধরলো।

” আমি ভুল মানুষকে বিশ্বাস করিনি।আমি জানতাম তুমি আমার আহিরের কোন কষ্ট হতে দেবে না।এখন থেকে আর মন খারাপ করবে না তুমি।তুমি আমার আহিরের ভালো থাকার কারণ,আর আমি তোমাকে কোন কষ্ট পেতে দেবো না।এখন থেকে আমি আর আহির তোমার খুব করে খেয়াল রাখবো।”

আকাশের কথা শুনে আরোশীর চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো।

” স্যার আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

” হুম করো।”

” আহির আপনার ছেলে না হলে সে কার ছেলে?আর কেনই বা আপনি থাকে নিজের ছেলে বলে পরিচিতি দিয়েছেন?”

আরোশীকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে রেলিং এর কাছে গিয়ে আকাশ বলতে শুরু করলো,

” ৬/৭ বছর আগের কথা।তখন আমি বিজনেস শুরু করেছি কিছু মাস হবে।এক বৃষ্টির রাতে বাড়ি ফেরার সময় অসাবধানতার কারণে রাস্তায় আমি একজনের এক্সিডেন্ট করিয়ে দি,যিনি ৯ মাসের প্রেগনেন্ট ছিলেন।এক্সিডেন্ট এর কারণে সেইদিনই ওনার ডেলিভারি করাতে হয় আর আহির এই পৃথিবীর আলো দেখেছে।জানো আহিরকে সর্বপ্রথম কোলে আমিই নিয়েছিলাম।পরে আপুটার সাথে কথা বলে জানতে পারি ওনার স্বামী আর্মিতে জব করতো,একটা মিশনে উনি মারা যান।স্বামী মারা যাওয়ার পর শশুড়বাড়ির কেউ ওনাকে রাখেননি আর না বাবার বাড়ির কেউ।শহরে একটা জায়গায় উনি কাজ করতেন।আপুর কেন যেন মনে হচ্ছিলো উনি আর বেশিক্ষণ বাঁচবেন না।উনার সাথে যখন শেষ বার কথা হয়েছিলো উনি আমার কাছে বারবার অনুরোধ করেছিলেন আমি যেন আহিরের খেয়াল রাখি।পারলে যেন ওকে একটা ভালো অনাথ আশ্রমে রেখে আসি।পরেরদিনই আপু মারা যান।আহির প্রথম কয়েকদিন হসপিটালে ছিলো।মাকে বিষয়টা বলার পর মা একটু আফসোস করেছিলো আর বলেছিলো তাকে অনাথ আশ্রমে রেখে আসতে।আমিও তাই ভেবেছিলাম কিন্তু আমার মন তা মানতে চাইছিলো।আমার মন বারবার আমাকে বলছিলো আমার জন্য আহির নিজের মাকে হারিয়েছে,তার মায়ের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী।তার মা বেঁচে থাকলে হয়তো তার একটু কষ্ট হতো জীবনযাপন করতে কিন্তু সে তো তার মাকে পেতো কিন্তু আমার কারণে সে অনাথ হয়ে গেলো।আহিরকে অনাথ আশ্রমে রেখে আসলে আমি অনুশোচনায় শেষ হয়ে যেতাম,তাই আমি আহিরকে নিজের কাছে নিয়ে আসি।মায়ের এটা কোন কালকেই পছন্দ ছিলোনা।উনি ২/৩ বছর আমাকে বুঝিয়েছেন,এমনকি আহিরকে দত্তক নেওয়ার জন্য লোকও ঠিক করেছিলেন কিন্তু আমি আহিরকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে দিনি।আর এর কারণেই মা এতোটা বছর দেশের বাইরে ছিলো।”

কথা শেষ করে আকাশ পেছন ফিরে দেখলো আরোশী কান্না করছে।

” কান্না করছো কেন আরোশী?”

” জানেন আপনার কথা শুনে যেমন কষ্ট হচ্ছে,তেমনি ভালো লাগছে আবার কোথাও যেন হিংসে হচ্ছে এই ভেবে যে আহিরের মতো আমিও কেন আপনার মতো কাউকে ফেলাম না।কে বলেছে আহিরের কেউ নেই।আহিরের পুরো পরিবার আছে।আহির আমাদের সন্তান।আমাদের নিজের সন্তান।” কথাগুলো বলতে বলতে আরোশী কান্নায় ভেঙে পড়লো।আকাশের চোখে পানি জমে গিয়েছে।সে আরোশীকে জরিয়ে ধরে নিজের কান্না আরোশীর থেকে লুকানোর বৃথা চেষ্টা করছে।

চলবে…….