#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৪||
৪১.
সালেহ আলী বাঁধনকে পুরো মহল্লার সামনে পিটিয়েছেন। আহনাফ আর তূর্য এক কোণায় দাঁড়িয়ে এসব দেখতে লাগলো। তখনই মুরাদের বাবা কয়েকজন লোক নিয়ে তাদের মহল্লায় ঢুকলো। মুরাদের বাবা আহনাফকে দেখেই তার কলার ধরে বললেন,
“তোর এতো বড় সাহস আমার ছেলেকে মেরেছিস?”
আহনাফের কলার ধরতেই আরাফ আর ইভান তেড়ে এলো। তারা একপ্রকার টানাহেঁচড়া করে মুরাদের বাবাকে আহনাফের কাছ থেকে দূরে সরালো। মহল্লায় মুহূর্তেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে গেলো। শতাব্দীর বাবা তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বেরিয়ে সমস্যা মীমাংসা করার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু মুরাদের বাবা কোনোভাবেই তা মানতে চাচ্ছেন না। তিনি আহনাফ আর তূর্যকে হুমকি দিতে লাগলেন। তখনই চেঁচামেচি শুনে অরুণিকা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আরাফ অরুণিকাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
“অরু, তুমি বাসায় থাকো। বাইরে এসো না।”
অরুণিকা বারান্দায় এসে ভীড়ের মধ্যে শতাব্দীকে খুঁজতে লাগলো। শতাব্দী তার মা আর বোনের সাথে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে অরুণিকাকে খেয়াল করে নি৷ অরুণিকা মনে মনে ভাবলো,
“আমার জন্য কাল রকস্টার আর আহনাফ ওই ছেলেগুলোকে মেরেছিল। এখন ওদের যদি সত্যিই পুলিশ এসে নিয়ে যায়?”
এসব ভাবতে ভাবতেই অরুণিকার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে বারান্দার বাইরে আসলে তাহমিদ তাকে আবার টেনে ঢুকিয়ে দিতেই সে হাত ফসকে মুরাদের বাবার সামনে চলে এলো। তারপর চেঁচিয়ে বললো,
“ওরা ভালোই করেছে ওকে মেরেছে। মুরাদ সবসময় আমাকে বিরক্ত করে। আমার ব্যাগ টেনে নিয়ে ফেলে, আমি স্কুল থেকে আসার সময় আমার হাত ধরে রাখে। আমাকে ছাড়েই না। আমার চুলও ধরে রাখে, বেণি খুলে ফেলে। আমার এসব ভালো লাগে না। আমি কতোবার বলেছি, ওদের আমাকে ছেড়ে দাও। কেন বিরক্ত করছ? ওরা বলে আমাকে বিরক্ত করতে ভালো লাগে।”
অরুণিকার কথায় আশেপাশের সবাই চুপ হয়ে গেলো। এবার অরুণিকা বাঁধনকে দেখিয়ে বলল,
“বাঁধনও রাস্তা থেকে কুঁড়িয়ে আমার দিকে পাথর ছুঁড়ে মারে। আমি স্কুল থেকে ফেরার আগে বাইরে থেকে টনি ভাইয়ার ভয়ংকর কুকুরটা গেইটের সামনে বসিয়ে রাখে। ও জানে আমি কুকুর ভীষণ ভয় পাই, তাই।”
শতাব্দী অরুণিকার কথা শুনে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নামতেই তার মা তাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“আমারও কিছু বলার আছে। এইটা অরুণিকার একার সমস্যা না। ও ছোট হয়ে যদি আজ সব কথা বলতে পারে, আমি বা আমাদের এলাকার বাকি মেয়েরা কেন চুপ থাকবে? আহনাফ আর তূর্য কি বিনা অপরাধে শাস্তি পাবে? আর যারা মেয়েদের উত্যক্ত করে, তারা মার খেয়ে বাসায় মায়ের আঁচলের নিচে বিশ্রাম নিবে, এটা আমি মানবো না।”
শতাব্দী ভীড় ঠেলে অরুণিকার পাশে আসতেই মাস্টারমশাই মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
“শতাব্দী, তুই এখানে কেন এসেছিস?”
“বাবা, মুরাদ আমাকেও বিরক্ত করে। শুধু মুরাদ না, তার সাথে আরো কিছু ছেলে দাঁড়িয়ে আমার মতো শিলা, রিনি, দূর্গা ওদেরকেও বিরক্ত করে। গত মাসেই কোয়েলের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। অল্প বয়সেই ওর বাবা ওকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু কেন? কারণ মহল্লায় দাঁড়িয়ে থাকা এমন বদমাশ ছেলের জন্য যাতে তার মেয়ের সম্মান নষ্ট না হয়। দোষ করবে এরা, আর শাস্তি পাবো আমরা?”
এবার দূর্গার মা তাদের সামনে এলেন। তিনি বললেন,
“শুধু মহল্লার সামনে কেন? এই ছেলেগুলো আমার মেয়ের পিছু পিছু ওর স্কুল পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। এদের জন্য এখন মেয়েকে ওর দাদা আনা নেওয়া করে। আহনাফ আর তূর্য ওদের মেরে একদম ঠিকই করেছে।”
এরপর তিনি আহনাফ আর তূর্যকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“যাওয়ার আগে আমাকেও বলতে, আমিও কয়েক বেত লাগিয়ে দিয়ে আসতাম।”
মুরাদের বাবা চুপ করে রইলেন। তার সাথে আসা লোকগুলো ধীরে ধীরে বেরিয়ে যেতে লাগলো। মাস্টারমশাই তাকে বললেন,
“দেখুন মশাই, আমরা পাশাপাশি এলাকায় থাকি। আপনার ঘরেও মেয়ে আছে। ঠান্ডা মাথায় বসে ছেলেকে বোঝান। আহনাফ আর তূর্য যা করেছে তা মোটেও ঠিক হয় নি। কিন্তু এভাবে মারামারি করে কোনো সমাধান হবে না। আমাদেরই ওদের বোঝাতে হবে। এখন সমস্যাটা এখানেই শেষ করলে ভালো হয়।”
মুরাদের বাবা অরুণিকার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। আহনাফ অরুণিকার সামনে এসে তাকে আড়াল করে দিয়ে বলল,
“আংকেল, নিজের ছেলের দিকে এভাবে তাকালে হয়তো ছেলে মানুষ হবে। অন্যের বাচ্চাদের চোখ না দেখিয়ে নিজের সন্তানকে এই চোখ দেখান।”
মুরাদের বাবা রাগী কন্ঠে বললেন, “বেয়াদব ছেলে।”
“ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম। এবার যান।”
ভীড় কমতেই তাহমিদ শতাব্দীর সামনে এসে বলল,
“ধন্যবাদ, সামনে এসে সব কিছু বলার জন্য।”
শতাব্দী অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“ছোট সখীর সাহস দেখেই আমি সাহস পেয়েছি।”
অরুণিকা বলল,
“আমাদের ক্লাসে টিচার বলেছে, কোথাও ভুল দেখলে চুপ না থেকে ভুল শুধরে দিতে হবে, আর সত্য কথা কখনোই লুকিয়ে রাখা উচিত নয়।”
এবার আরাফ অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“আমাদের অরু তো দেখছি এখন অনেক কিছুই বুঝে।”
“হ্যাঁ, আমি তো এখন বড় হয়ে যাচ্ছি, তাই না?”
আহনাফকে অনেক বার কল দেওয়ার পরও যখন সে কল ধরলো না, তখন যতি সরাসরি বাসায় চলে এলো। বাসায় এসেই দেখলো আহনাফের পুরো মুখে দাগ। তার মুখ ফুলে লাল হয়ে গেছে। যতি আহনাফের হাত ধরে বলল,
“তোমাকে এভাবে কে মেরেছে?”
অরুণিকা বলল,
“জানো, আপু। আহনাফ গতকাল ছেলেগুলোকে অনেক মেরেছে। এখন ছেলেগুলো আমাকে আর বিরক্ত করবে না।”
যতি রাগী দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকালো। আর বলল,
“সব সমস্যার মূল তো তুমিই।”
আহনাফ যতির দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। যতি আহনাফের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওর জন্যই তুমি এতো মার খেয়েছো। আমার জন্য তো কখনোই তুমি এতোকিছু করো নি।”
আহনাফ যতির কাছ থেকে সরে বসলো। যতি আহনাফের বাহু চেপে তার কাঁধে মাথা রাখতেই আহনাফ তাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো। যতি বিষ্মিত হয়ে আহনাফকে বলল,
“তুমি আমার সাথে এমন করছো কেন? আমি তোমার জন্য বেশি চিন্তা করি, এটা কি আমার অপরাধ?”
আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি তো চিন্তা করতে বলি নি। আর বার-বার আমার বাসায় আসা বন্ধ করো। আমার এটা ভালো লাগে না। যখন থেকেই আমাদের সম্পর্ক শুরু হয়েছে, তুমি তো আমাকে ঠিকমতো শ্বাসই নিতে দিচ্ছো না।”
যতি কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমি তোমার দম আটকে রাখি? আমার সাথে থাকলে তোমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়?”
আহনাফ দুই হাত জোর করে মেঝেতে বসে চেঁচিয়ে বলল,
“আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে একা থাকতে দাও। আমাকে উদ্ধার করো। আমি নয়তো পাগল হয়ে যাবো।”
যতি আহনাফের কাছে আসতে যাবে তখনই আরাফ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি এখন যাও। ওর মাথা ঠান্ডা হোক আগে।”
যতি ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললো,
“আমি ওর গার্লফ্রেন্ড। আমি বুঝবো কিভাবে ওর মাথা ঠান্ডা করতে হবে।”
তূর্য যতির কথা শুনে ইমনকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“এমন টক্সিক মেয়ে আমি তো জীবনেও দেখি নি। আমার তো আহনাফের অবস্থা দেখেই প্রেম করার শখ পটল তুলতে গেছে।”
ইমন বলল,
“এই কথা ভুলেও মুখে আনিস না। আমাদের পীড়াপীড়িতেই আহনাফ এই মেয়ের সাথে সম্পর্কে গিয়েছিল। ওর তো এমনতেই এসবে আগ্রহ ছিল না।”
এদিকে আহনাফ যতিকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“তুমি আমাকে ছাড়ো। শুধু আজকের জন্য নয়, একেবারেই ছাড়ো। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তোমার সাথে সম্পর্কে যাওয়া, তোমার সাথে বন্ধুত্ব করা, আর দুর্ভাগ্য তোমাকে পড়াতে যাওয়া, তোমার সাথে দেখা হওয়া।”
যতি অরুণিকার কাছে এসে বলল,
“এই মেয়ে, তুমি ওর উপর কি করেছো, হ্যাঁ? জাদু করেছ, তাই না?”
আরাফ ধমকের সুরে বলল,
“এই তোমার মাথা ঠিক আছে? কি বলছো তুমি এসব?”
ইভান দরজা খুলে দিয়ে আহনাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই এই মেয়েকে এখনই আমাদের ঘর থেকে বের করে দিবি।”
আহনাফ কাছে আসতেই যতি বলল,
“একটা উঠতি বয়সী মেয়ে, তাও আবার আপন বোন নয়, ছয় জন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলের সাথে এক ঘরে থাকছে, এই কথা একবার মহল্লায় ছড়িয়ে গেলে কি হবে, ভাবতে পারছো?”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কি বুঝাতে চাইছো তুমি?”
“আজ যেই ছেলেগুলোর সাথে মারপিট করে তুমি মুখের বারোটা বাজিয়েছো, কাল তারাই তোমাদের প্রশ্ন করবে। কারণ এটা সুস্থ সমাজ। এখানে এমন নোংরা সম্পর্কের কোনো জায়গা নেই। কে বিশ্বাস করবে তোমরা ওর সাথে…”
আহনাফ যতিকে পুরো কথা শেষ করতে দিলো না। সে যতির গালে চড় লাগিয়ে দিলো। ইমন আহনাফের কাছে এসে তাকে আটকালো। তাহমিদ আর আরাফ যতিকে ঘর থেকে বের করে দিলো।
প্রায় দশমিনিট যে যার জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আরাফের কান গরম হয়ে গেছে। এমন কথা শোনার জন্য সে একদমই প্রস্তুত ছিলো না। অরুণিকা এক পাশে বসে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে সে যতিকে বকে যাচ্ছে। সে যতির কথা বুঝতে না পারলেও এতোটুকু বুঝেছে, যতি তাকে পছন্দ করে না। আর আহনাফকে অনেক বিরক্ত করে। তাই অরুণিকাও যতিকে পছন্দ করে না।
এদিকে রাতে কেউই কোনো কথা বললো না। তাহমিদ অরুণিকার দিকে ভাতের প্লেট এগিয়ে দিয়ে মেঝেতে বিছানা করে ঘুমিয়ে পড়লো। এরপর তূর্য অরুণিকাকে বিছানা করে দিলো। তারপর অরুণিকা বিছানায় উঠে যাওয়ার পর ঘরের বাতি বন্ধ করে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দিলো, কারণ অরুণিকা অন্ধকারে ঘুমাতে ভয় পায়। অরুণিকা বালিশে শুয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আরাফ শুয়ে পড়তেই সে বলল,
“আরাফ, তুমি এখানে বসবে না?”
আরাফ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“ঘুমাও। আমার ঘুম আসছে।”
“আমার ভয় লাগছে। তুমি পাশে বসো।”
তূর্য বলল,
“আলো জ্বালানো আছে তো। তুমি ঘুমাও। আমরা এখানেই আছি।”
“না, আরাফ তো প্রতিদিন পাশে বসে থাকে। এখন এখানে বসো। আমার ঘুম আসছে না।”
প্রতিদিন ঘরের বাতি বন্ধ করে দেওয়ার পর যতোক্ষণ অরুণিকা ঘুমাবে না, ততোক্ষণ আরাফ তার পাশেই বসে থাকবে। আর মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে না রাখলে অরুণিকা কান্নাকাটি করে। এই কয়েক বছরেও তার এই অভ্যাস যায় নি। এদিকে আরাফকে আসতে না দেখে অরুণিকা মশারি তুলে নিচে নেমে আরাফের পাশে এসে বসলো। আহনাফ মাথায় বালিশ চেপে ধরে চেঁচিয়ে বললো,
“প্রতিদিন এক একটা ঝামেলা! আমি এসব আর নিতে পারছি না। এখন কি কেউ আমাকে ঘুমাতেও দেবে না?”
আহনাফের কথায় অরুণিকা আবার বিছানায় উঠে বসলো। সে এবার একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ইভান অরুণিকাকে দেখে বলল,
“তুমি কি এখন ঘুমাবে নাকি বারান্দায় রেখে আসবো?”
অরুণিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“না, আমার ভয় লাগছে। এখানে এসে বসো, প্লিজ।”
তাহমিদ উঠে তার পাশে এসে বসলো। আর বলল,
“এখন ঘুমাও।”
অরুণিকা মশারির উপরই তাহমিদের শার্টের কোণা ধরে শুয়ে পড়লো। অরুণিকা ঘুমানোর পরই তাহমিদ বিছানায় শুতে গেলো।
সকালে চেঁচামেচির শব্দ শুনে দরজা খুললো আরাফ। বাইরে যতিকে দেখে সে অবাক হলো। শতাব্দী গেইটের কাছে এসে বলল,
“ও সবাইকে বলে দিয়েছে ছোট সখী তোমাদের বোন না, আর তোমরাও আপন ভাই না।”
আরাফ গেইট খুলে বের হতেই মহল্লার সব মহিলারা তার দিকে তাকিয়ে রইলো। সুরাইয়া এসে বললেন,
“বোন না তো কি হয়েছে? বোনের মতোই তো। এটা নিয়ে তামাশা করার কি আছে?”
বাকি পাঁচ জন বের হতেই মহিলাগুলো বলতে লাগলো,
“আমরা এদের এই বাড়িতে থাকতে দেবো না। এতোগুলো ছেলে একটা মেয়ের সাথে এক বাড়িতে থাকবে! আগে মেয়েটা ছোট ছিল, এখন তো বড় হচ্ছে। একটা সম্মানেরও ব্যাপার আছে।”
যতি বলল,
“ভালো হয় অরুণিকাকে যদি কেউ নিজের মেয়ে হিসেবে আইনগতভাবে দত্তক নেয়। সে মা-বাবাও ফিরে পাবে, আর ওর ভবিষ্যও উজ্জ্বল হবে।”
আহনাফ যতির হাত চেপে ধরে বলল,
“তুমি আজ যা করলে এটা মোটেও ঠিক করো নি।”
যতি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো না। আর আমি এতোটাও বোকা নই। আমি সব বুঝি। হয়তো অরুণিকা তোমাকে নিয়ে কোনো রকম চিন্তায় করে না। কারণ ওর এখনো এসব বোঝার বয়স হয় নি। কিন্তু আমি জানি, তুমি ওকে নিয়ে কি চিন্তা করো।”
“তুমি পাগল হয়ে গেছো, যতি।”
“পাগল তুমি ওই মেয়ের জন্য হয়ে গেছো। সারাদিন অরুণিকা আর অরুণিকা। আমার সাথে বাইরে ঘুরতে গেলেও তুমি অরুর জন্য এটা নিলে ভালো হবে, ওটা দেখলে খুশি হবে, এসবই বলো। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে, তোমার ওর জন্য আলাদা করে খাবার নিতে হয়, কেন? এতোদিন ভাবতাম ও তোমার আপন বোন। কিন্তু এখন জানলাম ও তোমার কাজিন। কাজিনের জন্য কেউ এতো কিছু কখন করে? কেন করে বলো?”
“ভালোবাসি তাই করি। কিন্তু এই ভালোবাসা তোমার মতো অসভ্য মেয়ে বুঝবে না। অরু, আমার কাজিন। আমার আপন চাচার মেয়ে। যেই চাচা মৃত্যুর আগে আমাদের ওকে দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। চাচার অবর্তমানে আমি ওকে আদর করবো, যত্ন নেবো, ভালোবাসবো, তাতে তোমার কি সমস্যা?”
যতি চোখের কোণে আসা পানিগুলো মুছে বলল,
“আমি তোমার মনে কখনোই ছিলাম না। আমি জানতাম, আমি তোমাকে কখনোই পাবো না। কিন্তু আমি মেয়ে, তাই অনেক কিছুই বুঝি। তুমি অরুণিকাকে নিয়ে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করো। শুধু চিন্তা করা আর অধিকার দেখানো আলাদা ব্যাপার। বাকিদের মধ্যে আমি ওটা দেখি নি, যেটা তোমার মধ্যে দেখেছি।”
আহনাফ অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“তুমি কি ভাবো না ভাবো আমার তাতে কোনো আসে যায় না।”
চলবে-
#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৫||
৪২.
সুরাইয়া আর সালেহ আলী মহল্লার লোকেদের শান্ত করিয়ে অরুণিকাকে নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। আরাফ অরুণিকার হাত ধরে সুরাইয়াকে বলল,
“বাঁধন এতো কিছু করার পর, আমরা অরুকে আপনাদের সাথে থাকতে দেবো না।”
সুরাইয়া কথাটি শুনে আরাফের দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ছেলের কুকর্মের জন্য এখন কেউই তাদের বিশ্বাস করতে চাইছে না।
তূর্য মহল্লার লোকেদের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমরা অরুর অভিভাবক। আমরা থাকতে ও ওই বাড়িতে কেন থাকবে?”
তূর্যের প্রশ্নের উত্তরে মহল্লার একজন মহিলা বলে উঠলেন,
“বাবা-মার অবর্তমানে চাচা-চাচীই অভিভাবক হয়। প্রাপ্ত বয়ষ্ক যুবক ছেলে নয়। আজ তোমরা থাকবে, কাল অন্য ছেলেরাও তার বান্ধবীদের নিয়ে থাকতে চাইবে।”
ইভান রাগী কন্ঠে আরাফকে বললো,
“এদের কি মাথায় সমস্যা আছে? আমাদের সম্পর্কটাকে কিসের সাথে তুলনা করছে?”
আহনাফ আরাফের কাছে এসে বলল,
“অরুকে হোস্টেলে দিয়ে দে, আরাফ৷ নয়তো ওরা অরুকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেবে৷ হোস্টেলে থাকলে অন্তত অরুকে হারিয়ে ফেলার ভয় থাকবে না। আমরা ওকে সপ্তাহে একদিন দেখতে যাবো। কিন্তু এখন যদি কোনো পরিবার এসে ওকে নিয়ে যায়? তখন ও অন্য কোথাও চলে যাবে। এরপর ওর নতুন পরিবার যদি আমাদেরকে ওর সাথে দেখা করতে না দেয়? আমি ওকে যেতে দেবো না। আরাফ, কিছু তো কর।”
আরাফ আহনাফকে ধাক্কা দিয়ে রাগী কন্ঠে বলল,
“সব তোর জন্য হয়েছে। তোর যখন যতিকে ভালোই লাগতো না, তাহলে ওর সাথে সম্পর্কে কেন গিয়েছিস?”
আহনাফ যতির দিকে একনজর তাকালো। যতি একপাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে আর আহনাফের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। আহনাফ মলিন মুখে বললো,
“আমি তো যেতে চাই নি। তূর্য, ইমন ওরা আমাকে বাধ্য করেছিল।”
“নিজের ইচ্ছে না থাকলে কেউ বাধ্য করতে পারে না। আর আমি জানি, তুই কেন যতির সাথে সম্পর্কে গিয়েছিস!”
আহনাফ আরাফের হাত ধরে তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। তূর্য ভ্রূ কুঁচকে একবার আহনাফের দিকে তাকালো, আরেকবার আরাফের দিকে। আরাফ আহনাফের হাত সরিয়ে দিয়ে বিড় বিড় করে বলল,
“তুই যা চেয়েছিস তাই হয়েছে। এখন আর অরুর ব্যাপারে তোর নাক গলানোর প্রয়োজন নেই।”
আহনাফ আরাফের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আরাফ ঠিকই বলেছে, জোর করে কোনো সম্পর্ক শুরু হয় না। যতির সাথে সম্পর্কে যাওয়াটা শুধুই ইমন আর তূর্যের জোরাজুরিতে হয় নি। এখানে তারও ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এই ইচ্ছেটা তো ভালোবাসা থেকে আসে নি। এই ইচ্ছের কারণটাই তো জটিলতায় ঘেরা। যেই জটিলতা তাকে কোনোভাবেই ভালো থাকতে দিচ্ছে না।
ছ’জনের কেউই রাতে ঘুমাতে পারে নি। আহনাফের কথায় বাঁধন আজ তাদের সাথেই ছিল। আর অরুণিকা সুরাইয়াদের বাড়িতে। মধ্য রাতে আহনাফ বিছানা ছেড়ে উঠে অরুণিকা যেই বিছানায় ঘুমায় সেখানে উঠে বসলো। আরাফ তাকে উঠে বসতে দেখে নিজেও বিছানা ছেড়ে উঠলো। তারপর আহনাফের পাশে বসে বললো,
“ভালোবাসিস ওকে?”
আহনাফ আরাফকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ভালোবাসি না। একদম ভালোবাসি না। কিন্তু কোথাও তো একটা মায়া আছে। আর আমি এই মায়া কাটাতে পারছি না। পারবো কিনা সন্দেহ।”
আরাফ বলল,
“কিন্তু তুই এটাই চেয়েছিলি।”
আহনাফ আরাফের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইলো।
আরাফ আবার বলল,
“অরু, আমাদের বংশের একমাত্র মেয়ে। দাদা-দাদী ওকে অনেক বেশি পছন্দ করতো। অরু বাড়ির সবার আদরের মেয়ে ছিল। ওকে এভাবে অন্য কেউ দত্তক নিয়ে যাবে, এটা অন্যায় হবে। ওর চৌধুরী বংশের পরিচয়েই বড় হতে হবে। কিন্তু এখন কি করবো সেটাই বুঝতে পারছি না।”
আহনাফ বলল,
“পালিয়ে যাই চল। আবার কোনো নতুন ঠিকানা খুঁজে নিবো। আচ্ছা, দেশে ফিরে গেলেই তো ভালো হয়, তাই না? এই শহরে কোনো প্রাণ নেই। দেশে গিয়ে অরুকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো। আমরা একটা বাসা নেবো। আবার সব নতুন করে শুরু করবো।”
আরাফ বলল,
“খবর রাখিস না, তাই এই কথা বলছিস।”
“কেন কি হয়েছে?”
“মির্জা গ্রুপের এমডি, এবারের ভোটে মন্ত্রী হয়েছে। তার এখন অনেক ক্ষমতা। আমাদের এখন জনসম্মুখে মেরে ফেললেও কেউ কিছু করতে পারবে না। অরুর মামার খবর নিলাম ওইদিন, শুনলাম হঠাৎ উনি আমেরিকায় যাচ্ছেন। ওখানে বাড়িও কিনেছেন।”
“থানার ওসির তো এতো সামর্থ্য থাকার কথা না। আর যতোটুকু জানি, উনিই ওই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা, অরুর মামা কি সত্যিই এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন?”
আরাফ বলল, “জানি না।”
“আমরা না হয় তার কেউই ছিলাম না। কিন্তু চাচী? নিজের বোনকে কি কেউ হত্যা করতে পারে?”
“ক্ষমতা আর টাকার লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়।”
আহনাফ কিছু একটা ভেবে বলল,
“উনি জড়িত থাকলে ওনার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয় নি কেন? কিন্তু রহমত চাচা বলেছিলেন, সবাই উনাকে সন্দেহ করছে।”
আরাফ বলল,
“হয়তো উনাকে ছাড়িয়ে এনেছে আর মিডিয়ার সামনেও এই খবর আসে নি। অনেক খবরই তো মিডিয়ার কাছে পৌঁছায় না।”
আহনাফ অরুণিকার বালিশে মাথা দিয়ে বলল,
“এখন শুধু অরু আবার এখানে ফিরে আসুক। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।”
পরের দিন থেকে সবকিছুই স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। কাজ, স্কুল কিছুই বন্ধ নেই৷ পার্থক্য শুধু অরুণিকা আর ছ’জনের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা যাচ্ছে না। অরুণিকা ছ’জনের সাথেই নিজেকে অভ্যস্ত করে ফেলেছে। সে সুরাইয়াদের বাসায় কোনোভাবেই থাকতে চাইছে না। ঠিক মতো খাচ্ছে না। রাতে ঘুমানোর সময় কান্নাকাটি করে। এদিকে ছ’জনেরও একই অবস্থা। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে আরাফ, তূর্য আর আহনাফের। তিন জনই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তারা কলেজ শেষে এখন অরুণিকার স্কুলে চলে যায়। সেখানেই তাদের অরুণিকার সাথে দেখা হয়। কারণ মহল্লায় এখন তাদের একসাথে দেখলেই লোকজন কানাঘুঁষা করে। তারা বুঝতে পারছে না, অরুণিকার সাথে কথা বললে, তাদের সমস্যাটা কোথায়। কিন্তু সমস্যাটাতে যে যতি মারাত্মক জট লাগিয়ে দিয়েছে। এখন এই জটের সমাধান একমাত্র সময়ই দিয়ে দেবে।
এক সপ্তাহ এভাবেই কেটে গেছে। এক সপ্তাহ পর এনজিও থেকে দুইজন মহিলা এলো। অরুণিকাকে তাদের তত্ত্বাবধানে রেখে দত্তক দেওয়া হবে। যতি জানতে পেরেছিলো সুরাইয়া আর সালেহ আলী তাদের আপন চাচা-চাচী নয়। তাই সে তার কাজিনের সাহায্য নিয়ে এই কথা এনজিওর লোকদের জানায়। তারা সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতিদের হাতেই অনাথ বাচ্চাদের দত্তক দেয়।
এদিকে অরুণিকাকে নিতে আসলেই ইমন এসে তাদের আটকায়। কিন্তু কোন সম্পর্কে সে অরুণিকাকে ধরে রাখবে? একজন বেকার অবিবাহিত ছেলে একটা আট বছর বয়সী মেয়েকে দত্তক নেবে, এটা তো সম্ভব না। অরুণিকাকে নিয়ে যাওয়ার সময় সে আরাফের হাত ধরে বলল,
“আমি ওদের সাথে যাবো না। তুমি অনেক পঁচা। তুমি আমাকে ওদের সাথে পাঠিয়ে দিচ্ছ।”
অরুণিকা কেঁদেই দিয়েছে। ওর কান্না ক্রমশ বাড়ছে। তার চোখে পানি দেখে আরাফ আর তূর্য ডুকরে কেঁদে উঠলো। আহনাফ নিজের অশ্রু গুলো আটকে রেখেছে। তার চোখ দুটি লাল হয়ে গেছে। ইমন আর তাহমিদ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা এখনো বুঝতে পারছে না, হঠাৎ সবকিছু এমন উলোটপালোট কেন হয়ে গেল? তবে ইভান শান্ত হয়ে বসে নেই। সে কাঁদছে না, বরং অরুণিকাকে আইনগত ভাবে এমন পরিস্থিতি থেকে বের করে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর ইভানকে সাহায্য করছে শতাব্দীর বাবা।
অরুণিকা এনজিওর মহিলাদের সাথে যাওয়ার পর থেকেই কান্নাকাটি করে পুরো আশ্রম মাথায় তুলে ফেলেছে। যতির কাজিনের বান্ধবী এনজিওতে কাজ করে। সে-ই অরুণিকাকে এই আশ্রমে নিয়ে এসেছে। এদিকে ইভান থানায় যতির বিরুদ্ধে মামলা করে এসেছে। তারা ঘটনা ভালোভাবে তদন্ত করবে বলে ইভান আর মাস্টারমশাইকে আশ্বস্ত করে বিদায় করলো।
এদিকে অরুণিকা কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। সে এতোদিন সুরাইয়ার সাথে থেকেছিল, কারণ সে ছোটবেলা থেকেই সুরাইয়াকে দেখে আসছে। কিন্তু এখন এখানের কাউকেই সে চিনে না।
যতি বিকেলে আশ্রমে এসে অরুণিকার সামনে বসলো। অরুণিকা ক্ষুব্ধ হয়ে তার পাশে থাকা ফুলদানিটি যতির দিকে ছুঁড়ে মারলো। যতি তাড়াতাড়ি সরে যাওয়াতেই অল্পের জন্য রক্ষা পেলো। সে অরুণিকার হাত চেপে ধরে বলল,
“আমি চাইলে অনেক কিছুই করতে পারি। আমার সেই ক্ষমতা আছে। দেখেছো, তোমাকে কোথায় নিয়ে এসেছি? আমি তোমাকে আহনাফ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছি।”
অরুণিকা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললো,
“তুমি অনেক খারাপ। আমি তোমার সাথে কথা বলবো না। যাও এখান থেকে। যাও, যাও।”
অরুণিকা আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকি উঠে গেছে। সেখানে কর্মরত একজন কর্মচারী দৌঁড়ে অরুণিকার কাছে এলেন। তিনি অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরতেই, সে মহিলাটির বুকে মাথা রেখে ফোঁপাতে লাগলো। যতি উঠে যেতেই অন্য শিফটে থাকা একজন কর্মচারী তার পথ আটকে বলল,
“তুমি এখানে কেন এসেছো? তোমাকে এখানে আসার অনুমতি কে দিয়েছে?”
যতি বুকে হাত গুঁজে বলল,
“তোশিবা, আমি ওর বান্ধবী। আমি আমার এক্স প্রেমিকের চাচাতো বোনের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
যতি আশ্রম থেকে বের হতেই আহনাফ আর ইভানের মুখোমুখি হলো। আহনাফ তাকে দেখে বলল,
“তুমি এখানে?”
যতি মুচকি হেসে বললো,
“অরুর সাথে দেখা করতে এসেছি।”
আহনাফ রাগী কন্ঠে বলল,
“তুমি আমাদের একা ছেড়ে দাও। আমি তোমার কাছ থেকে মুক্তি চাই। প্লিজ তুমি আমার জন্য অরুর কোনো ক্ষতি করো না।”
“তুমি কি চাও অরু আবার ওই ঘরে ফিরে যাক?”
ইভান বলল,
“অবশ্যই। আর খুব শীঘ্রই এটা হবে। তোমার এসব উদ্ভট ষড়যন্ত্র বেশিদিন ঠিকবে না। কারণ তোমার এই কাজগুলো খুবই অযৌক্তিক ছিল। আর অরুণিকাকে আমাদের সাথে রাখার অনেক যৌক্তিকতা আছে।”
“হ্যাঁ, তবে ভালো হবে যদি আহনাফ আমাকে বিয়ে করে ফেলে। এমনিতেই আইনগত ভাবে আমাদের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। আর বিয়ের পর অরুণিকা ভাইয়া-ভাবীর সাথে থাকতেই পারে।”
আহনাফ যতির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো। তারপর ইভানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই যে আজ সকালে বললি, অন্য উপায়ে অরুণিকাকে ফিরিয়ে আনা যাবে।”
“হ্যাঁ।”
“আমি উপায় পেয়েছি।”
যতি কথাটি শুনে হাসলো। আহনাফ যতির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে ধন্যবাদ, আমার মাথায় ভালো একটা বুদ্ধি ঢুকিয়ে দিয়েছ। এখন বাসায় গিয়ে তোমার মাথাটাকে বিশ্রাম দাও। এতো ঝামেলা সৃষ্টি করেছো, দেখা যাবে মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটবে।”
ইভান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“যার মস্তিষ্ক আগে থেকেই বিকৃত, তার আবার নতুন করে বিকৃতি হবে না।”
আহনাফ ইভানকে নিয়ে অরুণিকার সাথে দেখা না করেই বাসায় চলে এলো। সে অরুণিকাকে বের করে আনার সেই উপায়টি সবাইকে বলল। সব শুনে আরাফ ছাড়া সবাই অবাক হলো। ইমন বলল,
“অরুকে বিয়ের চুক্তিতে ফিরিয়ে আনা! তুই কি পাগল হয়ে গেছিস, আহনাফ?”
ইভান বলল,
“ও ঠিকই বলেছে। এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়। আর এটা সম্ভবও। এরকম অনেক ঘটনা ঘটে। তবে খুবই কম।”
তাহমিদ বলল,
“সব বুঝলাম। কিন্তু বিয়ের চুক্তি কার সাথে হবে?”
তূর্য বলল,
“আমাদের মধ্যেই কি কেউ একজন এই চুক্তি করবে? আর এটা তো কোর্টে গিয়ে জানাতে হবে। তারপরই তো সব সম্ভব হবে। কিন্তু টুইংকেল যদি বড় হয়ে এই চুক্তির জন্য আমাদের ছেড়ে চলে যায়? ওর তো একটা পছন্দ থাকতে পারে, তাই না?”
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ও চলে গেলে আটকাবো না। আমরাই ওর বিয়ে দেবো। চুক্তিটা শুধু ওকে ফিরিয়ে আনার জন্য হবে। বিয়ে তো আর করছি না। শুধু চুক্তি করছি। আর অরু এখানেই থাকতে চাইবে। এটা আমাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট। ও কোর্টে জানাবে ও আমাদের সাথেই থাকবে। ওর মতামত শুনে এই চুক্তির কথা উঠবে। তারপর আমাদের মধ্যেই কেউ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে। এরপরই সে আইনগত ভাবে অরুর দায়িত্ব নেবে।”
তাহমিদ বলল, “কিন্তু সে কে হবে?”
সবাই একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো। আরাফ তখন বলে উঠল, “আহনাফ।”
তূর্য কথাটি শুনে ভ্রূ কুঁচকে আরাফের দিকে তাকালো। ইমন বলল,
“আহনাফের প্রেমিকার জন্য এতোকিছু হয়েছে, ও কেন দায়িত্ব নেবে?”
আরাফ ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“তাহলে কি তুই নিতে চাস?”
ইমন ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“না, ভাই তো নিতে পারতো।”
ইভান ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুই আমার কথা কেন বলছিস? মাওশিয়াতের জন্য?”
ইমন আমতা-আমতা করে বলল,
“চুক্তি করলে বিয়ে হয়ে যায় নাকি!”
ইভান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আমি কোনো চুক্তি করতে পারবো না।”
তাহমিদ বলল,
“ভাই, তোরা দুই জন এখনো যুদ্ধ করবি? আর আমার মনে হয়, আরাফ ঠিকই বলেছে। আহনাফই এই চুক্তিতে আসুক। যতির একটা ভালো শিক্ষা হবে। আর চুক্তি মানে তো বিয়ে না। ওর তো বয়স হয় নি। আর অরুণিকার আঠারো বছর হওয়ার আগেই আমরা এই দেশ ছেড়ে বের হয়ে যাবো। আর মাত্র চার-পাঁচ বছর এখানে থাকতে হবে।”
পরের দিন মাস্টারমশাইকে সব জানাতেই তিনি অরুণিকাকে ফিরিয়ে আনার উপায়টি পছন্দ করলেন। তিন দিন পর কোর্টে গিয়ে লিখিত দরখাস্ত দেওয়া হলো। এবার যতির বাবা-মার কানেও এই খবর পৌঁছালো। আহনাফকে পাওয়ার জন্য তাদের মেয়ে এমন উদ্ভট কাজ করবে তারা সেটা কল্পনাও করতে পারে নি। যতির মা ইচ্ছেমতো মেয়েকে মারলেন। যতিকে বাসায় আটকে রাখা হলো। তার বাবা তার কলেজে যাওয়াও বন্ধ করে দিলেন। মেয়ের জন্য পুলিশ তার বাসায় এসেছে, এটা তার জন্য খুবই অপমানজনক ছিল। এদিকে মাওশিয়াত সব শুনে তার বাবাকে বলেছে ছয় জনকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে। মাওশিয়াতের বাবাও এগিয়ে এলেন।
এদিকে তদন্ত করে এনজিওর সদস্য তোশিবার বিরুদ্ধে জরিমানা করা হলো। কারণ সে ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে অরুণিকাকে নিয়ে এসেছে। আর এটা আরো সম্ভব হয়েছে অরুণিকা শারিরীক ভাবে অসুস্থ হয়ে যাওয়ায়।কারণ আশ্রমে গিয়ে অরুণিকা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর প্রশাসনিকে ভাবে মহল্লার লোকেদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেলো, অরুণিকাকে খাওয়া- পড়া আর ওর দেখাশুনার কোনো কমতি রাখে নি সেই ছয় জন যুবক। শেষমেশ বিয়ের চুক্তিতেই অরুণিকাকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো।
বিয়ের উপযুক্ত বয়স হলে অরুণিকাকে বিয়ে করে তার দায়িত্ব পুরোপুরি নিয়ে নেবে আহনাফ, এই চুক্তিতে আহনাফ স্বাক্ষর করলো। অরুণিকাকে তার নাম লিখতে বলা হলো। সে কাঁচা হাতে না বুঝেই স্বাক্ষর করলো। এরপর আইনগত ভাবে তারা অরুণিকাকে ফিরে পেলো। তবে এবার তারা আর পুরোনো বাসায় গেলো না। মাস্টারমশাই তাদের অন্য মহল্লায় তিন রুমের বাসা খুঁজে দিলেন। অরুণিকা বড় হচ্ছে, তাই এখন তার জন্য আলাদা ঘর থাকা প্রয়োজন। তারা কোর্ট থেকেই সরাসরি নতুন বাসায় উঠলো। নতুন বাসায় উঠে অরুণিকা অনেক খুশি। এখনো জিনিসপত্র না আসায় ঘরটা খালি খালি লাগছে। শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অরুণিকা সেই প্রতিধ্বনিত শব্দ শুনে মজা পাচ্ছে।
সমাজের নিয়মগুলো জটিল হয়। কিন্তু আত্মার সম্পর্কের কাছে সব জটিলতার পরাজয় ঘটে। এই কয়েক সপ্তাহ ছয়টা ছেলের অস্থিরতা, সেই বারান্দার সামনে নিঃস্ব মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকা, সকাল হলেই পানির জন্য ছোটাছুটি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ধৈর্য ধরে অরুণিকাকে খাওয়ানো, এখন সবই শূন্য। যারা তাদের বিরুদ্ধে ছিল, এখন তারাই সেই শূন্য ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“অরুণিকাকে ফিরিয়ে আনার জন্য ছেলেগুলো অনেক ছুটেছে। কিন্তু তারা হেরে যায় নি। তাদের কাছে সমাজই হেরে গেছে। তারা জয়ী হয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে আত্মার সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি গভীর হয়।”
চলবে-
#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৬||
৪৩.
নতুন বাসায় আসার পর থেকেই সবারই ভালো সময় যাচ্ছে। তাহমিদের বেতন বেড়েছে। তূর্যের শেষ গানটি ভাইরাল হয়ে গেছে। এখন ইউটিউবে তার গানগুলোতে ভালোই ভিউ হচ্ছে। সে এবার নিজের লেখা গানেও সুর দিতে যাচ্ছে। নতুন গানটি নিয়ে কাজ করা পুরোপুরি সম্পূর্ণ হলে সে একটা ছুটি নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। এদিকে আরাফ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে। পাশাপাশি অনেকগুলো ছাত্র-ছাত্রীকে সে একসাথে পড়াচ্ছে। ইভান এবং আহনাফ দু’জনই পড়াশুনার পাশাপাশি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে। আর ইমন বিভিন্ন ক্লাবে ফুটবল খেলে মোটামুটি আয় করতে পারছে। অরুণিকাও পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছে। তাদের ভালোই সময় কাটছে।
এদিকে তিন রুমের এই বাসায় পানির ট্যাংক থাকায় এখন আর তাদের পানি ধরার জন্যও ছুটোছুটি করতে হয় না। রান্নাঘরের পাশেই ড্রয়িংরুম। সেখানেই আরাফ আর ইভান মেঝেতে বিছানা করে থাকে। বাকি তিনরুমের একটি অরুণিকার। বাকি দুইটির একটিতে তূর্য আর ইমন, অন্যটিতে আহনাফ আর তাহমিদ থাকছে। তারা সিদ্ধান্ত নিলো, যেই কয়েক বছর তারা কলকাতায় থাকবে, এই বাসাটি আর পরিবর্তন করবে না। তাই তারা ঘরের জন্য আসবাবপত্র কেনার চিন্তাভাবনাও করলো। এখন তাদের একটি বড় ডায়নিং টেবিল, আর সাতটা চেয়ার প্রয়োজন। সেখানেই তারা বসে পড়াশুনাও করবে আবার খাওয়া-দাওয়ার কাজও সারবে। রান্নাঘরের জিনিসপত্র আগের বাসা থেকেই নিয়ে এসেছে। তবে এখন দুইটা আলমারি, আরেকটা ফ্রিজ কেনা প্রয়োজন। এতোদিন আলমারির পরিবর্তে বড় বড় ড্রামেই তারা কাপড় রেখেছিল। যেখানে কাপড়ের ভাঁজ একদমই ঠিক থাকতো না। তাই আলমারি অবশ্যই কিনতে হবে। এরপর বই রাখার জন্য একটা বুকসেল্ফ, আর অরুণিকার জন্য ছোট একটা খাট কেনার তালিকা করলো। এগুলো একটি একটি করে তারা প্রতিমাসে কিনবে।
এসবের তালিকা তৈরি করে বাজারের তালিকা করতে বসলো তূর্য। তখনই বেল বেজে উঠলো। ইমন দরজা খুলতেই শতাব্দী আর মাওশিয়াতকে দেখে অবাক হলো। ইমন মাওশিয়াতকে বলল,
“তুমি এতো সকাল সকাল?”
মাওশিয়াত কোনো উত্তর দিলো না। তারা দু’জনই বাসায় ঢুকলো। মাওশিয়াত পুরো ঘর ঘুরে ঘুরে দেখছে। আর শতাব্দী অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমার ছোট সখীকে দেখতে এসেছি। কেমন আছো সখী?”
অরুণিকাও শতাব্দীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি ভালো আছি। আপু, জানো আমি তোমাকে অনেক মিস করি।”
“আমিও। জানিস তুই চলে আসার পর থেকে মহল্লায় ভূত নেমে এসেছে।”
“কি বলো? সত্যি?”
“হ্যাঁ। কেউ কারো সাথে কথা বলে না। সবাইকে কেমন স্বার্থপর মনে হয়। তাই এখানে এসেছি। এখানে তো আর ভালোবাসার অভাব নেই।”
তাহমিদ নাস্তা বানিয়ে মেঝেতে রাখলো। শতাব্দীকে দেখে সে চমকে উঠলো। শতাব্দী তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“অনেকদিন পর দেখা হলো।”
তাহমিদ মুচকি হাসলো। শতাব্দী এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“মিস শতাব্দী আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি।”
তাহমিদ তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য বলল,
“বাণীতে তাহমিদ হোসেন।”
মাওশিয়াত বলল, “বাসাটা খুব সুন্দর।”
ইমন ততোক্ষণে নিজের ঘরে চলে গেছে। মাওশিয়াত এদিক-ওদিক তাকিয়ে ইমনকে খুঁজতে লাগলো। ইমনকে না দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আরাফ ছাড়া কেউই মাওশিয়াতের সাথে এতোটা কথা বলে না। কারণ তার জন্য ইমন আর ইভানের মধ্যে এখনো সব কিছু পুরোপুরি স্বাভাবিক হয় নি। ইভান তার দিক থেকে অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু ইমনই ভাইয়ের সাথে কথা বলতে আগ্রহ দেখায় না। তাই ইভান একপ্রকার মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। মাওশিয়াতকে দেখে সেও একপাশে সরে দাঁড়ালো।
সবাই শতাব্দীর সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলছে। মাওশিয়াত একপাশে চুপচাপ বসে আছে। ইমনকে নাস্তা করার জন্য ডাকা হলো। সে তাহমিদের পাশে বসে গেলো। একবারো মাওশিয়াতের দিকে তাকালো না। মাওশিয়াতের খুবই খারাপ লাগলো। যাদের বাসায় এসেছে, তাদের কেউই তার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নয়৷ শতাব্দী নিজের ঘরের মতোই সবাইকে খাবার প্লেটে তুলে দিতে লাগলো। মাওশিয়াতকে দিতে যাবে তখনই সে বলল,
“আমি খাবো না। আসলে বাবা আর মা বলেছিল একবার অরুণিকাকে দেখে আসতে। তাই এলাম। আমি চলে যাচ্ছি।”
কথাগুলো বলার সময় মাওশিয়াতের গলা কাঁপছিলো। ইমন তার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। মাওশিয়াত উঠতে যাবে, তখনই অরুণিকা তার হাত ধরে বলল,
“আপু, চলে যাচ্ছো কেন?”
মাওশিয়াত অরুণিকার থুতনি ধরে বলল,
“পরে আবার আসবো।”
আরাফ মাওশিয়াতকে আটকাতে যাবে তখনই আহনাফ তার হাত ধরে ফেললো। আরাফ ইশারায় বলল তাকে আটকাতে। আহনাফ ফিসফিস করে বলল,
“ওকে দেখে ইভান আর ইমন অনেক অপ্রস্তুত হয়ে গেছে৷ এখন ওর জন্য দুই ভাইয়ের মধ্যে আর ঝামেলা না হলেই ভালো। ওকে যেতে দেওয়া উচিত। কমনসেন্স থাকলে আর আসবে না।”
আরাফ বলল,
“অরুকে ফিরিয়ে আনার জন্য ওর বাবা আমাদের অনেক সাহায্য করেছিল।”
“হ্যাঁ, জানি। তাই ওর বাবাকে আমরা সম্মান করবো। ওকে নয়।”
শতাব্দী খাওয়া-দাওয়ার পর তাহমিদকে সাহায্য করার জন্য রান্নাঘর ঘুছিয়ে দিতে গেলো। তাহমিদ বারবার শতাব্দীকে চলে যেতে বলছিল। কিন্তু শতাব্দী কোনো ভাবেই শুনছে না। দু’জনই একপ্রকার ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিলো। শতাব্দীর মেজাজ খারাপ হতেই সে হাতে লেগে থাকা ফেনাগুলো তাহমিদের গালে লাগিয়ে রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে বেরুনোর সময় ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেলো। তাহমিদ সেখানে দাঁড়িয়ে শব্দ করে হাসতে লাগলো। তাহমিদকে হাসতে দেখে শতাব্দী বলল,
“তোমার জন্য আমি নিচে পড়ে গেছি, আর তুমি হাসছ?”
তাহমিদের হাসি বন্ধই হচ্ছে না। শব্দ শুনে বাকিরাও রান্নাঘরে এলো। দেখলো শতাব্দী মেঝেতে বসে আছে। তূর্য ওকে টেনে তুললো। তাহমিদ এবার নিজের হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো। তবে আপন মনে এখনো সে হাসছে। শতাব্দী তাহমিদের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে হঠাৎ কি ভেবে বাঁকা হাসি দিলো। তূর্যকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“গায়ক সাহেব, তোমাদের মিষ্টিমশাইয়ের বিছানাটা কোথায়?”
তাহমিদ কথাটি শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকালো। শতাব্দীর বাঁকা হাসি দেখে সে বুঝে ফেললো শতাব্দী কি করতে চাইছে। তাহমিদ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“না, না প্লিজ। এমন করো না। তূর্য, ওকে রুম দেখিয়ে দিস না।”
কিন্তু কে শুনে কার কথা। তূর্য শতাব্দীকে টেনে এনে বিছানাটা দেখিয়ে দিলো। তাহমিদ হাতে থাকা ফেনাগুলো পানি দিয়ে পরিষ্কার করে রান্নাঘর থেকে বেরুনোর আগেই শতাব্দী ধপ করে তাহমিদের বিছানায় শুয়ে পড়লো। তার পা দুটি উপরে উঠিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। তাহমিদ ঘরে এসে শতাব্দীর কান্ড দেখে দাঁতে দাঁত চেপে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। শতাব্দী বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে নিচে নেমে পড়লো। তারপর তাহমিদের সামনে এসে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“মিষ্টিমশাই তোমার বিছানাটা তো নোংরা হয়ে গেছে। আমার পায়ে কতো ময়লা ছিল, জানো। মহল্লায় খালি পায়ে হেঁটে পায়ে জুতো লাগিয়ে একেবারে এই বাসায় এসেছি।”
তাহমিদ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে রাখলো। শতাব্দী তার হাত তাহমিদের মুখের সামনে নাড়াতে নাড়াতে বলল,
“আচ্ছা, যাচ্ছি আমি। টা টা।”
তাহমিদ তূর্যের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তূর্য দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে তাহমিদের সামনে থেকে চলে আসলো।
বিকেলে আহনাফ নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে ফোন চালাচ্ছিল। বাসায় তখন অরুণিকা ছাড়া কেউই ছিল না। অরুণিকা টিভি বন্ধ করে এদিক-ওদিক উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলো বাসায় কেউ আছে কি না। আহনাফ আর তাহমিদের রুমে উঁকি দিয়ে দেখলো, আহনাফ বিছানায় শুয়ে আছে। সে আহনাফের সামনে এসে দাঁড়ালো। আহনাফ একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার ফোনে মনোযোগ দিলো। অরুণিকা বলল,
“তুমি আমাকে গেইম খেলতে দেবে?”
আহনাফ আঁড়চোখে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দেবো না।”
অরুণিকা মলিন মুখে চলে যেতে নেবে তখনই আহনাফ তার হাত ধরে তাকে পাশে বসালো আর বলল,
“কি গেইম খেলবে?”
অরুণিকা খুশি হয়ে বললো,
“ওই যে ইমন খেলে, একটা ছেলে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে, ওইটা খেলবো।”
আহনাফ প্লে স্টোর থেকে গেইমটি নামিয়ে অরুণিকার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিল। অরুণিকাও মনোযোগ দিয়ে খেলতে লাগলো। আহনাফ এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। মুহূর্তেই অতীতের স্মৃতিগুলো তার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো।
অরুণিকা যেদিন জন্মেছিল তখন তাকে দেখতে মায়ের হাত ধরে সে হাসপাতালে গিয়েছিল। মেয়ে হয়েছে শুনে দাদা-দাদী অনেক খুশি হয়েছিল৷ কারণ তাদের কোনো মেয়ে ছিল না। আর তাদের প্রথম চার জনই নাতি ছিল। তাই অরুণিকার জন্ম পুরো পরিবারেই খুশির বন্যা বয়ে আনে। আরাফ তখন থেকেই বাচ্চাদের খুব পছন্দ করতো৷ অরুণিকাকে যখন প্রথম তার কোলে দেওয়া হয়েছিল, আরাফের ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে উঠেছিল। আরাফ আহনাফকে বলল,
“আহনাফ, দেখ। বাবুটা আমার কোলে এসে চুপ করে ঘুমিয়ে আছে।”
আহনাফ বলল,
“তুই খুব বোরিং মানুষ তাই ওর তোকে দেখেই ঘুম পেয়েছে।”
আরাফ আহনাফের কথা শুনে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এরপর সে অরুণিকাকে হাসপাতালের বেডে শুইয়ে দিয়ে তার ছোট ছোট আঙ্গুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিলো। চাচী পেছন থেকে এসে আহনাফকে বলল,
“আহু, তুই নিবি না বাবুকে?”
আহনাফ দূরে সরে বলল,
“না না ও পিসু করে দিবে।”
আহনাফের কথা শুনে সবাই হাসতে লাগলো। এসব মনে পড়তেই আহনাফ আনমনে হেসে উঠলো। আহনাফকে হাসতে দেখে অরুণিকা তার দিকে তাকালো। আহনাফ তার হাতের আঙ্গুলে হাত বুলিয়ে বলল,
“অনেক বড় হয়ে যাচ্ছো।”
অরুণিকা বলল,
“তুমি এই জন্য হাসছো, আমি বড় হয়ে যাচ্ছি তাই?”
আহনাফ মুচকি হেসে মাথা নাড়লো। বলল,
“পুরোনো কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তাই হাসি পেয়েছে।”
মুহূর্তেই আহনাফের বুকটা কাঁপতে লাগলো। সেই মুহূর্তের সবার হাসিমাখা মুখটা তার আবার দেখতে ইচ্ছে করছে। সে বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিলের ড্রয়ারে রাখা ছবির এলবামটি বের করলো। এলবামের শুরুতেই একটা ছবি আছে। আহনাফের চৌদ্দতম জন্মদিনে সবাই একই ফ্রেমে দাঁড়িয়ে এ ছবি উঠিয়েছিল। এই ছবিটি তার ফোনে ছিল। সে ছবিটি ফোন থেকে বের করেছে। ছবি বাঁধানোর সময় পায় নি, তাই এখনো ছবিটি এলবামে রয়ে গেছে। অরুণিকা এলবাম বের করতে দেখে তার দিকে দৌঁড়ে এলো। বলল,
“দেখি দেখি, আমাকে দেখি। আমি কোথায়?”
আহনাফ চাচার কোলে অরুণিকাকে দেখিয়ে বলল,
“এই তো তুমি।”
অরুণিকাকে জুবাইয়ের চৌধুরীকে দেখিয়ে বলল,
“এটা আমার বাবা।”
আহনাফের চোখ ছলছল করে উঠল। সে অরুণিকার হাত ধরে বলল,
“আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবো না, অরু। তুমি আমার সাথে, মানে আমাদের সাথে, থাকবে তো সারাজীবন? আমাদের ফেলে চলে যাবে না তো!”
“আমি কেন চলে যাবো, বলো তো!”
আহনাফ বিড়বিড় করে বলল, “বিয়ে হলে!”
অরুণিকা আহনাফের কথা শুনতে পেলো না। সে বলল,
“আমি তোমাদের ফেলে যাবো না।”
আহনাফ মনে মনে বলল,
“এখন তো বলছো থাকবে, কিন্তু বড় হলে যদি তুমি থাকতে না চাও, অরু? এই মায়া তো একপাক্ষিক। তোমারও কি সেই মায়া থাকবে? তোমার কাউকে ভালো লাগতেই পারে। তখন? আগের কথা কি মনে রাখবে তুমি? যেই বাবাকে ছাড়া তুমি খাওয়া-দাওয়া করতে না, যেই মাকে ছাড়া তোমার ঘুম আসতো না, তাদের তো ভুলিয়েই দিয়েছি আমরা। অন্য কেউ এসে তখন যদি আমাদেরই ভুলিয়ে দেয়?”
অরুণিকা এলবাম থেকে চোখ উঠিয়ে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুমি কাঁদছো কেন?”
আহনাফ শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে নিলো। অরুণিকা কিছু একটা ভেবে বলল,
“ফোনাপুর জন্য? ও তো তোমাকে আর ফোন দেয় না।”
আহনাফের যতির কথা মনে পড়তেই রাগ উঠে গেল। সে ধমকের সুরে বলল,
“চুপ। যাও পড়তে বসো। সারাদিন টিভি, ফোন, নয়তো অন্য কিছু। যাও, পড়তে বসো।”
অরুণিকা এক ধমকে ভয় পেয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“এখন তো পড়ার সময় না।”
আহনাফ আরো জোরে ধমক দিয়ে বলল,
“তাও এখন পড়তে বসবে। যাও।”
অরুণিকা দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। আহনাফ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। হঠাৎ তার চুক্তিনামার কথা মনে পড়ে গেলো। চোখে ভেসে উঠলো, সেই কাগজটি যেটিতে তার স্বাক্ষরের পাশে অরুণিকার কাঁচা হাতের স্বাক্ষর আছে। সে বিছানায় মাথা ফেলে দিয়ে চলন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর মনে মনে বলল,
“অরু, আমার মনে অনেক প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর তুমি বড় হলেই আমাকে দিতে পারবে। এই উত্তর যতোদিন আমার কাছে আসবে না, আমি ততদিন মানসিক শান্তি পাবো না। কিন্তু সময় যতো বাড়ছে আমি ততোই দুর্বল হয়ে পড়ছি। আমি চাই না আমার এই দুর্বলতা তোমার জীবনে কোনো বাঁধা ফেলুক। আমি চাই, আমাদের অরু সুখে থাকুক। অতীতের সেই ভয়ংকর রাতের কথা যাতে কখনোই অরুর মনে করতে না হয়।”
এদিকে আরাফ সায়ন্তনীর পাশে বসে রইলো। সায়ন্তনী বলল, “কি ভাবছো?”
আরাফ বলল,
“কই! কিছু তো ভাবছি না।”
“আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি?”
“হুম করো।”
“ইমন কি এখনো মাওশিয়াতকে পছন্দ করে?”
আরাফ প্রশ্নটি শুনে সায়ন্তনীর দিকে তাকালো। সায়ন্তনী বলল,
“আমার আসলে ইমনকে জিজ্ঞেস করার মত সাহস নেই। ও যদি কিছু মনে করে।”
আরাফ বলল,
“ইমনের ব্যাপারে আমার চেয়ে ভালো তো সে নিজেই বলতে পারবে। তুমি ইমন কে জিজ্ঞেস করতে পারো। ও কিছুই মনে করবে না।”
“তোমাকে একটা কথা বলার ছিল!”
“হুম, বলো!”
“আমার না, ইমনকে ভালো লাগে।”
আরাফ এই কথা শুনে অবাক হলো না। সে আগে থেকেই জানতো সায়ন্তনী ইমনকে পছন্দ করে। কারণ তার হাবভাব দেখলেই বোঝা যেতো। সায়ন্তনী বাকিদের তুলনায় ইমনের ব্যাপারেই বেশি সচেতন ছিল। ইমনের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তার আলাদা সচেতনতা আছে, যা আরাফ লক্ষ্য করেছিল। চায়ে চিনি কম হলে ইমনের হাবভাব দেখে সায়ন্তনী চিনির পট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। অন্যদের ব্যাপারে এত উদ্বিগ্নতা সে কখনো লক্ষ্য করেনি।
সায়ন্তনী বলল, “তুমি কিছু বলবে না?”
আরাফ বলল,
“এখানে আমার বলার কি আছে? তোমার ভালো লাগতেই পারে।”
সায়ন্তনী মাথা নিচু করে মলিন মুখে বললো,
“ইয়ে মানে, আমি তো সাধারণ পরিবারের মেয়ে। চায়ের দোকান চালিয়ে আমাদের সংসার চলে। আমার বাবা নেই। একটা সময় মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতো। ভাই পড়াশোনার পাশাপাশি কারখানায় কাজ করে। আমার তো কোন যোগ্যতা নেই। স্কুল পর্যন্তই পড়েছি। বাকিটা হয়তো আর সম্ভবও না।”
আরাফ চুপ করে রইল। সায়ন্তনীর কোন যোগ্যতা আছে কি নেই তা সে কখনো ভেবে দেখেনি। হুট করেই তার ভালো লেগে গিয়েছিল মেয়েটিকে। ইমনেরও কি তার মতো সায়ন্তনীকে ভালো লাগতে পারে? এই প্রশ্নের জবাব আরাফ দিতে পারবে না। তাই সে আর কিছুই বলল না। শুধু সায়ন্তনীর দিকে তাকিয়ে রইল।
চলবে-