#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৭||
৪৪.
রহমত চাচার সাথে ফোনালাপ করে গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো ইভান। ইভানকে চিন্তিত দেখে আহনাফ তার কাঁধে হাত রেখে তার পাশে বসলো। ইভান আহনাফের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল, তারপর বলল,
“রহমত চাচা ফোন দিয়েছেন।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আজকে চার মাস হয়ে গেছে, উনি কোনো টাকা পাঠান নি। এখন ফোন করে অজুহাত দেখানো ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।”
“উনি অজুহাত দেওয়ার জন্য ফোন করেন নি।”
“তো, কেন ফোন দিয়েছেন?”
“এসব বাদ দে। আগে বল, জুবাইয়ের আংকেল সেই রাতে একটা কাগজ দিয়েছিল, মনে আছে?”
“কোন কাগজ?”
“যেই কাগজে সব তথ্য ছিল। উনি সেদিন দিয়েছিল কাগজটা। কোথায় সেটা?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিন্তু পাঁচ বছর আগের কাগজ তুই এখন খুঁজছিস?”
“কাগজটা কি তুই খুলে দেখিস নি? আরাফ, তাহমিদ কেউই দেখে নি?”
“আমি তো দেখি নি। বাকিদের জিজ্ঞেস করে দেখ।”
ইভান চেয়ার ছেড়ে উঠে সবাইকে ডাকলো। একই প্রশ্ন বাকিদেরও করলো৷ কিন্তু কারোই সেই কাগজটির কথা মনে ছিল না। তখন তূর্য কিছু একটা ভেবে বলল,
“আমার মনে পড়েছে। আংকেল কাগজটা আহনাফের হাতে দিয়েছিল। আহনাফ তুই কাগজটা কোথায় রেখেছিস?”
আহনাফ ভেবে বলল,
“পকেটেই রেখেছিলাম। কিন্তু এরপর তো আর বের করা হয় নি।”
আরাফ বলল,
“আমি তো সেই কাগজটির কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছি। চাচ্চু বলেছিলেন, ওখানে কিছু তথ্য আছে।”
আহনাফ মলিন মুখে বললো,
“প্যান্টের পকেটে ছিল। সিলেট যাওয়ার পর প্যান্টটা ধুয়ে ফেলেছিলাম। তারপর কলকাতায় আসার পর থেকে আর সেই প্যান্ট পরা হয় নি৷ আমি ড্রামেই রেখে দিয়েছিলাম হয়তো।”
তাহমিদ বলল,
“আর আমি সেই ড্রামে থাকা সব পুরোনো কাপড় বিক্রি করে দিয়েছি।”
সবাই তাহমিদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। তাহমিদ আবার বলল,
“সেই মাসে ঘর চালানোর মতো কোনো টাকাই ছিল না। অরুণিকা অনেকদিন ধরে মাংস খেতে চাইছিল। মাংস কেনার জন্যই আমি জামাগুলো বিক্রি করে দিয়েছিলাম। আর আমি তোদের জিজ্ঞেসও করেছিলাম। তোরাই বলেছিস এসবের প্রয়োজন নেই। আর জামাগুলো অনেক ছোটও হয়ে গিয়েছিল।”
ইমন মলিন মুখে বলল,
“তাহলে কি আমরা নিজেদের ভুলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হারিয়ে ফেলেছি?”
আরাফ এবার ইভানকে জিজ্ঞেস করলো,
“ইভান, তুই হঠাৎ কাগজটির কথা বলছিস কেন?”
ইভান বলল,
“পাঁচ বছর আগে আমবাগানে দাঁড়িয়ে রহমত চাচা বলেছিলেন, আমাদের বাড়ির কয়েকজন দারোয়ান, মৈত্রী গ্রুপের কিছু সদস্য, পরিচিত কিছু মানুষ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। তারপর সিলেটে যাওয়ার পর বলেছিলেন, অরুণিকার মামা আর আমাদের শত্রুপক্ষ মির্জা গ্রুপ এর সাথে জড়িত আছে। আজ বলছে, বাস্কার গ্রুপের মালিক রিয়াজুর রহমানও জড়িত আছেন।”
ইমন বলল,
“উনি কি আমাদের পাগল করে ফেলবেন নাকি?”
“এখানে আমাদেরই কিছু একটা বুঝতে ভুল হচ্ছে। এমনিতেই মির্জা গ্রুপ সেই সময় থেকেই আমাদের শত্রুপক্ষই ছিল। এর আগেও কয়েকবার তাদের সাথে অনেক ঝামেলা হয়েছিল। আমাদেরই কোম্পানির একজন মহিলা কর্মচারীকে অপহরণ করে ফেলেছিল। তাই মির্জা গ্রুপের উপর আমার শুরু থেকেই সন্দেহ আছে।”
আহনাফ বলল,
“রিয়াজুর রহমান তো আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন।”
তূর্য বলল,
“আমাদের বাড়িতেও এসেছিল। উনার সাথে বাবার অনেক ভালো বন্ধুত্ব ছিল।”
ইভান বলল,
“আর মৈত্রী গ্রুপের কাউকেই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে না। কারণ গ্রুপের সবাই আমাদের পরিবার থেকেই ছিল। আর সবাইকেই খুন করে ফেলা হয়েছে।”
আরাফ বলল,
“গ্রুপের দুইটা অংশ ছিল। প্রথম অংশটার দায়িত্ব জুবাইয়ের চাচ্চুর হাতে ছিল, দ্বিতীয় অংশটা ইমতিয়াজ আংকেলের হাতে ছিল।”
ইমন বলল,
“হ্যাঁ, বাবা দেখেশুনেই সব কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। আমি বাবার সাথে অনেক বার অফিসে গিয়েছিলাম। সবাই অনেক মিশুক ছিল। আমার তো কাউকেই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে না।”
ইভান বলল,
“আমার কথা তোরা কেউই ধরতে পারিস নি।”
সবাই ইভানের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। ইভান বলল,
“রহমত চাচা অনেক কিছুই জানেন, যা আমরা জানি না। উনি আমাদের সেদিন বাঁচিয়েছেন, অথচ অনেক কিছুই লুকাতে চাইছেন৷ আমি বুঝতে পারছি না, উনি আসলে কি করতে চান। আর কাগজটার ব্যাপারে উনিই আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন। উনি আমার কথা শুনেই বুঝেছেন, আমরা সেই কাগজ পাই নি। আমার কাগজটার কথা ফোন রাখার পর মনে পড়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে আমি একটা বিষয় খেয়াল করেছি।”
আরাফ বলল,
“কি বিষয়!”
“প্রথমত উনি কিভাবে জানলেন, আমাদের একটা কাগজ দেওয়া হয়েছিল? আর আরেকটা বিষয় খেয়াল করলাম, আমরা কাগজটা পাই নি জানার পর উনার কন্ঠে একটা স্বস্তি ছিল। আর এই স্বস্তির জন্যই আমার এখন রহমত চাচাকে সন্দেহ হচ্ছে।”
তূর্য বলল,
“তুই কি বোঝাতে চাইছিস, ইভান? উনিই এসবে জড়িত ছিল? কিন্তু উনিই তো আমাদের বাঁচিয়েছেন!”
“এটাই তো আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমরা একটা গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেছি। আরেকটা ব্যাপার আমি খেয়াল করলাম।”
“কি!”
“অরুণিকা আর ইমনের ব্যাপারেই উনার যতো মাথা ব্যথা। যতোবার ফোন দেয় অরুণিকার বয়স জিজ্ঞেস করেন। আর ইমন কি করছে এসব জানতে চান। বাকিদের কথা আলাদা ভাবে জিজ্ঞেস করেন না। কিন্তু কেন?”
ইমন ভাব নিয়ে বলল,
“আমরা বয়সে ছোট তাই হয়তো!”
“মোটেও না। এখানেও কিছু একটা আছে। যা আমি বুঝতে পারছি না।”
“এখন কি আমরা খুনিদের খুঁজে পাবো না?”
“অবশ্যই পাবো। কিন্তু পাঁচ বছর আগে যদি এতোটুকু বুদ্ধি থাকতো, পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে অনেক কিছুই আন্দাজ করতে পারতাম। আমাদের কি বিশ্বাস করার মতো কেউই নেই? আমাদের আত্মীয়-স্বজন সবাই তো আর সেদিন খুন হয় নি। অনেকেই তো ছিল বাইরে। তারাও কি এখনো বেঁচে আছে?”
তাহমিদ বলল,
“কাদের কথা বলছিস?”
“আরাফ, আহনাফ, অরুণিকা আর তোর নানার পরিবারের অনেকেই আছে। তূর্যের দাদার ভাইয়ের পরিবার আছে। ওরাও তো আত্মীয়! আমাদের না হয় নানার বাড়ির সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না। তোদের তো আছে।”
তূর্য বলল,
“ওদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। একদিন বিয়ের দাওয়ার দিতেই বাবার একজন চাচাতো ভাই এসেছিলেন। ওরা তিন ভাই ছিল। তার মধ্যে একজন অনেক আগেই মারা গিয়েছিল। বাকি দুইজনের মধ্যে যার বিয়ের দাওয়াত দেওয়ার জন্য তারা এসেছিল, সেও মারা গিয়েছে। ছোটটাকে আমরা কখনোই দেখি নি। উনি বাইরের দেশে থাকতেন।”
আহনাফ বলল,
“আমার নানার পরিবারে মায়ের একজন ফুফুই আছেন। আর তার ছেলে। ওদের সাথেও বিয়ের পর মা আর তেমন যোগাযোগ রাখে নি। রাখলেও আমি হয়তো জানি না। বাসায় তো কখনো আসতে দেখি নি। আর আমাদের পরিবারের কারোই তো বিয়ে হয় নি। একটা অনুষ্ঠান বা দাওয়াত পড়লে বোঝা যেতো কতো আত্মীয় আছে।”
আরাফ বলল,
“মায়ের মৃত্যুর পর নানুর পরিবারের কেউই আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখে নি। ওরা সবাই দাদু আর বাবাকে মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করতো। কারণ মা ঘরের বড় বউ ছিলো। তাই নিষেধ করার পরও অনেক কাজ করতো। আমার জন্মের সময় মা অনেক দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন। এখানে দাদু আর বাবার কোনো দোষ ছিল না। এরপর ওরা আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু বাবা আমাকে যেতে দেয় নি।”
এবার তাহমিদ বলল,
“আমার নানুর পরিবারের তো অনেকেই আছে। আমাদের তো প্রায়ই যাওয়া আসা হতো। কিন্তু হঠাৎ একদিন মায়ের সাথে মামার একটা ঝামেলা হয়। এরপর আর যাওয়া হয় নি৷”
ইভান জিজ্ঞেস করলো, “কি ঝামেলা?”
“জানি না। আমাকে তো জানানো হয় নি। আমি ওদের কথাবার্তা শুনে এতোটুকু বুঝেছি ঝামেলা একটা হয়েছে।”
“তাহলে তোর মামাও জড়িত থাকতে পারে।”
তাহমিদ রাগী কন্ঠে বললো,
“ইভান, কি বলছিস এসব? ওরা মানুষ খুন করার মতো হিংস্র নয়।”
সন্দেহের তালিকায় অনেকেই আছে। কিন্তু কারণগুলো মানুষের জীবন নেওয়ার মতো নয়। কারো জীবন কেঁড়ে নেওয়া এতোটা সহজ বিষয় না। হাসিমুখে কারা পিঠে ছুরি চালিয়ে দিতে পারে, তা বোঝা অনেক কঠিন।
চলবে-
#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৮||
৪৫.
ক্যাম্পাস থেকে বের হয়েই যতিকে দেখে থমকে গেলো আহনাফ। যতি তার কাছে এসে বলল,
“আহনাফ, আমি তোমাকে কতো খুঁজেছি, জানো?”
আহনাফ যতিকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে যাবে তখনই যতি বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
আহনাফ যতির দিকে ফিরে বলল,
“দেখো, যা করার করে ফেলেছো। আর শুনো, তোমার সেই মহান কাজের জন্য আমি কোর্ট থেকে লিখিতভাবে অরুর হবু বর হওয়ার অনুমতি পেয়েছি। অরুর আঠারো হলেই আমি ওকে বিয়ে করে ফেলবো। এখন শুধু আট কি নয় বছরের অপেক্ষা!”
“এভাবে অনুমতি দিলে হয় নাকি! অরুণিকা যদি না চায়।”
“কেন? আমার মধ্যে কি কোনো সমস্যা আছে যে চাইবে না?”
যতি আহনাফের পা ধরতে যাবে তখনই আহনাফ কয়েক পা পিছিয়ে বলল,
“এসব অভিনয় আমার সামনে না করে, কোনো ডিরেক্টরের সামনে করতে পারো। সিনেমায় ভালো একটা সুযোগ হবে তোমার।”
আহনাফ ক্যাম্পাস থেকে সোজা বাসায় চলে এলো। বাসায় এসেই যতির বাবাকে ফোন করে বলে দিলো, যতি বার-বার তাকে বিরক্ত করছে। যতির বাবা সব শুনে এবার মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। যতির কাজকর্ম তার আত্মীয়রা জানার পর যতির বাবা-মাকে কথা শুনাচ্ছে। সবাই যতির মাকেই দোষ দিচ্ছেন। বাসায় মেয়ের সাথে না থেকে বাইরে চাকরি করতে গিয়েই নাকি মেয়ের স্বভাব নষ্ট হয়ে গেছে। যতির মা এসব শুনে মেয়ের উপর আরো ক্ষুব্ধ হয়ে যান। তিনি আবার মেয়েকে ইচ্ছেমতো মারলেন। যতি এবার নিজেকে বাঁচাতে বলল, সে আর কখনোই আহনাফের সামনে যাবে না।
আহনাফ শুয়ে মুখে বালিশ দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। তখনই তার মনে হলো কেউ তার পায়ের উপর ভর দিয়েছে। সে বালিশ সরিয়ে দেখলো অরুণিকা তার পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“কি চাও?”
অরুণিকা ধপ করে লাফিয়ে এসে আহনাফের সামনে বসতেই আহনাফ মাথা তুলে উঠে বসলো৷ অরুণিকা বলল,
“তোমার ফোনটা দাও।”
আহনাফ পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
“আমার ফোন দিয়ে কি করবে?”
“আমার বন্ধুর সাথে কথা বলবো।”
আহনাফ ফোনটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। অরুণিকা উৎসুক দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ বলল,
“যাও। আমি ঘুমাবো।”
“ফোন দিবে না?”
“না।”
অরুণিকার হাসিমাখা মুখে মুহূর্তেই বিষন্নতা ভীড় জমালো। আহনাফ বলল,
“আচ্ছা, দেবো। আগে বলো, কোন বন্ধুর সাথে কথা বলবে?”
অরুণিকা আনন্দিত কন্ঠে বললো,
“আমার নতুন বন্ধু।”
“নাম কি?”
“বিয়োন। ও ক্লাসে নতুন এসেছে। আমাকে ফোন নম্বর দিয়েছে। বলেছে ফোন করতে।”
“ফোন দেওয়ার কারণ?”
“কথা বলবো, তাই।”
আহনাফ ফোন এগিয়ে দিতেই অরুণিকা নম্বরটি ফোনে তুলে নিলো। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুমি মুখস্থ করে ফেলেছো?”
“হ্যাঁ, বিয়োন মুখস্থ করে ফেলতে বলেছে।”
ততোক্ষণে অপর প্রান্ত থেকে একটা ছেলের কন্ঠ শুনা গেলো। অরুণিকা সেই কন্ঠের স্বর শুনেই উৎসুক হয়ে বলল,
“বিয়োন, আমি অরুণিকা।”
বিয়োন বলল,
“হাই, কেমন আছো?”
“ভালো। তুমি ফোন করতে বলেছো, তাই ফোন করেছি।”
“এটা কার নম্বর?”
“এটা আহনাফের নম্বর। আমার তো ফোন নেই।”
“আহনাফ কে, ওই তোমাকে সারাদিন বকা দেয় ওইটা?”
আহনাফ চোখ বড় বড় করে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা মনোযোগ দিয়ে বিয়োনের সাথে কথা বলে যাচ্ছে। অরুণিকা উত্তরে বলল,
“না, না। ও আমাকে এখন বকে না। ওর ফোন দিয়েই তো আমি গেইমস খেলি। ও আমার জন্য চকোলেট এনে দেয়। খেলনাও কিনে দেয়৷”
আহনাফ বিড়বিড় করে বলল,
“কতো আহ্লাদ, বাহ! আর এদিকে যত্তোসব বিয়োন-ফিয়োনের সাথে কথা বলতে গিয়ে এই মেয়ে আমার ব্যালেন্স শেষ করে দিচ্ছে।”
অরুণিকার কাছ থেকে ফোন কেঁড়ে নিয়ে আহনাফ বলল,
“আর কথা বলতে হবে না। অনেক বলেছো।”
কল কেটে দেওয়ার পর আহনাফ আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কে তোমাকে সারাদিন বকাঝকা করে?”
অরুণিকা মুখে হাত দিয়ে বলল,
“তুমি কিভাবে জানলে?”
আহনাফের ফোনের ভলিউম বড়, তাই স্পিকারে না থাকলেও সব শুনা যায়। আহনাফ বলল,
“জেনে ফেলেছি। এখন বলো কে তোমাকে বকা দেয়?”
“ইভান।”
আহনাফ মুচকি হেসে বললো,
“আর কে তোমাকে বেশি ভালোবাসে?”
অরুণিকা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আরাফ আর রকস্টার।”
আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো?”
“আরাফ আর রকস্টারকে।”
“আর আমাকে?”
“তোমাকেও ভালোবাসি। সবাইকে ভালোবাসি।”
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“রকস্টার, রকস্টার, সারাদিন রকস্টার।”
এবার অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
“শুনো অরু, ওর একটা নাম আছে। ওর নাম তূর্য৷ রকস্টার না।”
অরুণিকা বলল,
“না, আমি ওর টুংইকেল, ও আমার রকস্টার!”
কথাটা বলেই অরুণিকা ধিন ধিন করে চলে গেলো। আহনাফ সেখানেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে মনে বলল,
“বাচ্চা মেয়েটা বলে কি! এগুলো নিশ্চয় ওই তূর্যের বাচ্চাই ওকে শিখিয়েছে।”
৪৬.
চায়ের দোকানে ভীড় জমেছে। সবাই জড়ো হয়ে প্রেম নিবেদন দেখছে। তাহমিদ, আহনাফ আর তূর্য একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। আরাফের চোখ দুটি স্থির হয়ে আছে। আর ইভান অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাওশিয়াতের চোখ দুটি ছলছল করছে। হয়তো এখনোই অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। সায়ন্তনীর চোখ দু’টিও ভিজে যাচ্ছে। ইমন তার এক হাত এগিয়ে দিয়ে সায়ন্তনীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। ইমন সায়ন্তনীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হলো, চুপ করে আছো কেন? তুমি কি আমার হতে চাও না?”
সায়ন্তনী কাঁদোকাঁদো মুখে মাথা নেড়ে ইমনের হাত ধরলো। ইমন শক্ত করে সায়ন্তনীর হাত ধরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এরপর মাওশিয়াতের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“সেদিন তুমি আমার ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়েছ। আজ আমি তোমাকেই দূরে সরিয়ে দিয়েছি। তুমি আর ভাই, দু’জনই আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ। এখন আমি তোমাদের সামনেই সুখী হয়ে দেখাবো।”
আরাফ আহনাফকে এক পাশে টেনে এনে বলল,
“তুই ইমনের এমন কাজে তালি দিচ্ছিস?”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“সায়ন্তনী হ্যাঁ বলেছে, তো তালি দেবো না নাকি!”
“ইমন সায়ন্তনীকে ভালোবাসে না।”
“তো, কিছুক্ষণ আগে কি হলো এটা!”
“ছেলেটার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। ইভান আর মাওশিয়াতকে দেখানোর জন্য ও এমন অভিনয় করেছে।”
“ও!”
“ও কি! সায়ন্তনী এসব অভিনয় সম্পর্কে কিছুই জানে না। ও তো সব এখন সত্য ভেবেই বসে আছে।”
“তো বলে দিলেই তো সব জেনে যাবে।”
আরাফ রাগী কন্ঠে বললো,
“তুই বুঝতে পারছিস না আমার কথা?”
আহনাফ জোরেই বলল, “না।”
“সায়ন্তনী ইমনকে সত্যিই পছন্দ করে। আর ইমন ওর সাথে অভিনয় করছে, এটা শুনলে ও অনেক কষ্ট পাবে।”
আহনাফ চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“আপতত ইমনের মাথা থেকে মাওশিয়াত বের হলেই হবে। সায়ন্তনী মেয়েটা অনেক ভালো।”
আরাফ আহনাফকে এখনো কিছুই বোঝাতে পারলো না। ইমন এখন যা-ই করছে জেদের বশে করছে। জেদ কেটে গেলে সায়ন্তনী নিশ্চয় অনেক কষ্ট পাবে। কিন্তু ইমনকে এখন বুঝিয়েও লাভ নেই। কারণ সে কারো কথা শোনার মতো ছেলে না। সে নিজে যা বুঝে তাই করে।
এদিকে মাওশিয়াত বাসায় এসে ইচ্ছেমতো কান্নাকাটি করলো। আজ সে ভেবেছিলো ইমনকে বলবে, সেও ইমনকে পছন্দ করে। কিন্তু হঠাৎ ইমন এমন কিছু করে বসবে, তা মাওশিয়াত ভাবতেও পারে নি৷ সে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“যাকেই আমি ভালোবাসি, সেই আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়। কেন বার-বার আমার সাথে এমন হচ্ছে?”
কয়েক সপ্তাহ ধরেই সায়ন্তনী আর ইমনের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। সায়ন্তনী এখনো বুঝতে পারছে না, ইমন এসব মাওশিয়াত আর ইভানকে দেখানোর জন্যই করছে। আজ সে সেজেগুজে চায়ের দোকান খুলেছে। ক্লাস শেষে এক কাপ চা খাওয়ার জন্য আরাফ সায়ন্তনীর দোকানে এসেই অবাক হয়ে গেলো। সায়ন্তনী কোন পরিবেশে কেমন সাজ দিতে হয়, তা জানে না। তাই এই মুহূর্তে তাকে দেখতে মোটেও ভালো লাগছে না। আশেপাশের সবাই কেমন যেন বাঁকা চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। আরাফ পকেট থেকে টিস্যু বের করে, তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমাকে কেমন লাগছে দেখতে? তাড়াতাড়ি মুখটা মুছে ফেলো।”
সায়ন্তনী অবাক হয়ে বলল,
“কেন? অনেক সময় নিয়ে সেজেছি। ইমনের সাথে আজকে বাইরে ঘুরতে যাবো। ও বলেছে, আমাকে এসে নিয়ে যাবে।”
“আমি বলছি তো তোমাকে দেখতে ভালো লাগছে না।”
সায়ন্তনী আরাফের কথা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চাইছে না। তার মনে হচ্ছে আরাফ তাকে ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলছে। সে নিজেই বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আয়না দেখে এসেছিলো। তার মোটেও নিজেকে খারাপ লাগে নি। তখনই মাওশিয়াত তার দোকানে এলো। মাওশিয়াতকে দেখে সায়ন্তনী বলল,
“চা দেবো?”
মাওশিয়াত আরাফের দিকে তাকিয়ে সায়ন্তনীকে বলল,
“আমার তোমার সাথে কথা আছে।”
সায়ন্তনী বলল, “বলো।”
“ইমন, তোমাকে ভালোবাসে না। শুধু শুধু ওর পেছনে সময় নষ্ট করো না।”
সায়ন্তনী মাওশিয়াতের কথা শুনে আবার চা বানাতে লাগলো। মাওশিয়াত সায়ন্তনীর এমন গা ছাড়া ভাব দেখে বলল,
“তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছো না?”
সায়ন্তনী মাথা নেড়ে বলল,
“তোমার কথা বিশ্বাস করলে, সবাই ঠকবে। সেই স্কুল থেকেই দেখেছি, তোমার যা ভালো লাগে, তা তুমি অন্য কাউকে দিতে পছন্দ করো না। এখন তুমি ইমনকে পছন্দ করো, তাই আমাকে নিষেধ করছো। কাল ইভানকে ভালো লাগতো, তাই ইমনকে কষ্ট দিয়েছ।”
মাওশিয়াত মলিন হেসে বললো,
“আমি তখন বোকা ছিলাম। অনেক কিছুই বুঝতাম না। হ্যাঁ, আমার ইভানকে ভালো লাগতো। তাই ইমনকে কষ্ট দিয়েছি। আর আমার তোমার সাথে কোনো বন্ধুত্ব নেই, যার জন্য তোমাকে সাহায্য করতে চাইছি। আমি ইমনকে ভালোবাসি। তাই আমি চাই না, ও এমন কাজ করুক, যার জন্য ও নিজেই অনুতপ্ত হোক।”
ইমন তখনই সায়ন্তনীর দোকানের সামনে এসে মাওশিয়াতকে দেখে নেশা লাগানো কন্ঠে বলল,
“সায়ন্তনী, তোমাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।”
ইমন মাওশিয়াতের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মনে হচ্ছে কোনো রূপকথার রাজকন্যা।”
মাওশিয়াত দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুমি এসব অভিনয় কখন শিখেছো? তুমি মানুষের অনুভূতি নিয়ে তামাশা করছো।”
ইমন মাওশিয়াতের দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তুমি আর ভাই মিলে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ। তাই অনুভূতি নিয়ে অন্তত তুমি আমাকে কোনো ভাষণ দিও না।”
ইমন সায়ন্তনীকে টেনে দোকান থেকে বের করলো। এরপর একটা ছেলেকে দোকানে বসিয়ে দিয়ে সায়ন্তনীকে নিয়ে চলে গেলো।
আজ অরুণিকার দশ বছর পূর্ণ হয়েছে। ছ’জন মিলেই তার জন্মদিনের আয়োজন করেছে। শতাব্দী, সায়ন্তনী আর মাওশিয়াতও দাওয়াত পেয়েছে। সাথে সুরাইয়া খোকা আর ডুমুরকে নিয়ে এসেছেন। অরুণিকা অনেক জোরাজোরি করছিলো, তাই বিয়োনসহ তার দুই-তিন জন বন্ধুদেরও বিকেলে দাওয়াত দেওয়া হলো।
কেক কাটার পর উপহার নিয়েই অরুণিকার যতো আগ্রহ। সে সবার উপহার খুলে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে যাচ্ছিলো। শেষমেশ একটা একটা করে বক্স খুলতে লাগলো। ইমন তাকে একটা খেলনার গাড়ি উপহার দিয়েছিল। সেই গাড়িটা দেখেই শতাব্দী হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। ইমন রাগী কন্ঠে বললো,
“এভাবে হাসার কি আছে?”
শতাব্দী হাসতে হাসতে বলল,
“ছোট সখী, তুমি ইমনের দেওয়া গাড়িতে চড়ে স্কুলে যেও।”
শতাব্দী আবার হাসতে লাগলো। মাওশিয়াত তার দেওয়া উপহারটি এগিয়ে দিয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। কারণ সে বুঝেছিলো ইমনের উপহার দেখে অরুণিকা তেমন একটা খুশি হয় নি, আর তাই ইমনেরও মন খারাপ হয়ে গেছে। মাওশিয়াত অরুণিকাকে একটা ছোট ব্যাগ উপহার দিয়েছে। অরুণিকা সেটা কাঁধে ঝুলিয়ে বলল,
“সামনে ইদ আসলে আমি এই ব্যাগটাতে আমার সব টাকা রাখবো।”
মাওশিয়াত মুচকি হেসে ইমনের দিকে তাকালো। ইমন মাওশিয়াতের চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিলো। এবার অরুণিকা বাকিদের উপহারগুলো দেখতে লাগলো। সুরাইয়া অরুণিকার জন্য একটা জামা এনেছেন, তাহমিদ হাতের বালা কিনেছে, শতাব্দী দিয়েছে মেকাপ বক্স, আর আরাফ দিয়েছে বড় একটা পুতুল। অরুণিকা পুতুলটা দেখেই আরাফের কাছে দৌঁড়ে গেলো। আরাফ হাঁটু গেড়ে অরুণিকার সামনে বসে বলল,
“পছন্দ হয়েছে?”
“হ্যাঁ, খুব পছন্দ হয়েছে। আমি এখন থেকে ঘুমানোর সময় এটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো। কেমন?”
“আচ্ছা।”
ইভান তার উপহারটি এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমিও তোমার জন্য স্পেশাল গিফট এনেছি।”
অরুণিকা প্যাকেটটি খুলে দেখলো কয়েকটা বই। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে ইভানের দিকে তাকালো। ইভান বলল,
“এখানে ফল, ফুল, প্রাণি, পাখি, যানবাহন, পোকামাকড় সব কিছুর নাম আছে। এখন থেকে ছুটির দিনে তুমি এক পৃষ্ঠা করে শিখে আমাকে মুখস্থ দেবে।”
অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“না। আমি এটা নেবো না। তুমি নাও তোমার গিফট।”
“ভালো জিনিসের তো কোনো মূল্যই নেই। শুনো, এখন আর তোমার পুতুল খেলার বয়স নেই।”
তাহমিদ ইভানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আজ অন্তত এসব বন্ধ কর।”
শতাব্দী অনেক কষ্টে নিজের হাসি চাপিয়ে রেখেছে। আরাফ তার দিকে তাকিয়ে ইশারায় তাকে সরে যেতে বললো। শতাব্দীও একপাশে সরে হাসতে লাগলো। ইভান সেটা খেয়াল করে বলল,
“তুমি হাসছো কেন?”
শতাব্দী হাসি আটকে বলল,
“ভাবছি অরুণিকার বিয়ের দিন তুমি ওকে কি গিফট দেবে! কিভাবে সংসারে সুখী হওয়া যায়, এমন বই? মিষ্টি মশাই তাহলে রান্নাবান্নার বই পাবে, যেখানে অনেক ধরণের রেসিপি থাকবে৷ আরাফকে তুমি কঙ্কাল গিফট করবে আর তূর্যকে গানের বই। ইমনকে হয়তো ফুটবলের ইতিহাস আছে এমন বই দেবে। আর আহনাফকে কি স্ক্রু দেবে নাকি জিনিসপত্র ঠিক করার জন্য?”
ইভান ধমকের সুরে বলল,
“চুপ করো তুমি!”
শতাব্দী চুপ হয়ে গেলো। এরপর আহনাফ অরুণিকার হাতে একটা ঘড়ি পরিয়ে দিলো। বলল,
“তোমার গিফট পছন্দ হয়েছে?”
অরুণিকা কিছু বলার আগেই তূর্য এসে বলল,
“টুইংকেল, সারপ্রাইজ!”
তূর্য একটা সাইকেল অরুণিকার সামনে এনে রাখলো। অরুণিকা সাইকেলটি দেখেই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। সেটা নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আহনাফ চুপচাপ সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। আরাফ আহনাফের দিকে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্য অরুণিকাকে সাইকেলে বসিয়ে সাইকেলটা চালাতে তাকে সাহায্য করছে। অরুণিকাও উৎসাহ নিয়ে সাইকেলটা চালাচ্ছে। আহনাফ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে বারান্দায় চলে এলো। আরাফও তার পিছু পিছু এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ও এখনো ছোট! পুতুল, সাইকেল এসব জিনিসগুলো ওকে বেশি আকর্ষণ করবে। তোর ঘড়িটির মূল্য বুঝতে ওর অনেক বড় হতে হবে, আহনাফ।”
“তূর্য কি ইচ্ছা করে এসব করছে?”
“ও তো এতোকিছু জানে না। তুই কি কাউকে জানিয়েছিস এসব?”
“আমি কি ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানাবো? তাহমিদ কি ঢোল পিটিয়ে বলেছে ওর শতাব্দীকে ভালো লাগে? কিন্তু আমরা তো সবাই বুঝে ফেলেছি।”
“শতাব্দীর এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। অরুর মাত্র দশ বছর পূর্ণ হয়েছে। তোর ওকে ভালো লাগে, এটা সবাই কিভাবে বুঝবে?”
“তাহলে তুই কিভাবে বুঝেছিস?”
“কারণ আমি শুরুর গল্পটা জানি। আর বাকিরা এর মধ্যের অংশটা দেখছে। আর শুরুটা না জানলে, কেউ কিছুই বুঝবে না। তুই কেন অরুকে অপছন্দ করতি? কেন ওর সাথে অকারণে ঝগড়াঝাটি করতি? কেন যতির সাথে জোর করে সম্পর্কে জড়িয়েছিস? কেন এই চুক্তিতে বিনা দ্বিধায় সাক্ষর করেছিস? এসব আমি জানি, আহনাফ। কারণ আমি শুরু থেকেই এসবের সাক্ষী ছিলাম।”
“তুই সেদিন আমার জায়গায় থাকলে কি করতি?”
“বুঝতে পারছি না।”
“আমি অনেক খারাপ অবস্থায় আছি, আরাফ। বিশ্রী একটা চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। নিজেকে কেমন কীট মনে হচ্ছে! কি ভাবছি আমি? কি হচ্ছে আমার সাথে? আমার এই অবস্থার জন্য একমাত্র দাদা-দাদিই দায়ী।”
আরাফ আহনাফকে কিছু বলতে যাবে তখনই ইভান এসে বলল,
“তোরা দুই ভাই এখানে কি করছিস!”
ইভান আসায় আহনাফ নিজেকে স্বাভাবিক করলো। ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তূর্য অরুণিকাকে সাইকেল গিফট করেছে, এটা দেখে তুই বিরক্ত হয়েছিস মনে হচ্ছে!”
আহনাফ আর আরাফ দু’জনই ইভানের দিকে তাকিয়ে রইলো। আহনাফ মনে মনে ভাবল,
“এভাবে সামনে থেকে চলে আসা হয়তো উচিত হয় নি। কেউ যদি এসব জানতে পারে, তাহলে আমাকে নিয়েই হাসাহাসি করবে।”
চলবে-
#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৯||
৪৭.
মেঝেতে একটা ডায়েরী আর অনেকগুলো ছবি পড়ে আছে। পাশে একটা গ্লু আর কিছু রঙিন কলম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কানে হেডফোন গুঁজে এক হাতে একটা ছবি আকাশের দিকে তাক করে, অন্য হাতে একটা ফোন নিয়ে ছবি তুলছে উপমা। ছবি তোলার পর ছবিটি ভালোভাবে দেখে বিড়বিড় করে বলল,
“উফ! আমার স্টারকে তো এই ছবিতে ঝাপসা দেখাচ্ছে। এই ফোনটাও দিনদিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ভালোভাবে ফোকাসই হয় না। বাবাকে বলবো, নতুন ফোন কিনে দিতে।”
পরক্ষণই সে ইন্সটাগ্রামে ঢুকে আবার ইনবক্সে ঢুঁ মেরে এলো। দেখলো মেসেজটা এখনো দেখা হয় নি। ফোনটা একপাশে ফেলে উপমা চেঁচিয়ে বলল,
“একমাস ধরে মেসেজ দিচ্ছি, কিন্তু তার তো আমার জন্য সময়ই নেই।”
এসব ভাবতে ভাবতেই উপমা চিড়বিড় করে উঠলো। পাশ থেকে উপমার মা, মিসেস জুলেখা চেঁচিয়ে বললেন,
“সারাদিনেও কি তোর নাকি কান্না যায় না?”
তারপর জুলেখা মিনমিনিয়ে বলতে লাগলেন,
“পড়াশুনা বাদ দিয়ে মাথা ছাড়া ছেলে একটার ছবি কেটে কেটে ডায়রিতে লাগানো ছাড়া মেয়েটার আর কাজ নেই।”
উপমা রুম থেকে বেরিয়ে বলল,
“মা, আমি তোমার কথা শুনে ফেলেছি।”
জুলেখা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন,
“শুনে আমাকে উদ্ধার করেছিস। পরীক্ষা খারাপ হলে দেখিস, ডায়েরীটা আমি পুড়িয়ে ফেলবো।”
“মা, তুমি আমার স্টারের ছবি পুড়িয়ে ফেলতে পারো। কিন্তু আমার মন থেকে তার ছবি কখনো পোড়াতে পারবে না। কারণ ও আমার মনেই নিজের ছবি এঁকে ফেলেছে।”
মিসেস জুলেখা চুপ করে রইলেন৷ কোনো কথা বললেন না। তখনই উপমার বড় ভাই আদিল রুম থেকে বেরিয়ে বলল,
“মা, আমার মানিব্যাগ থেকে ২০০ টাকা উধাও হয়ে গেছে।”
মিসেস জুলেখা ছেলের দিকে তাকিয়ে, আরেকবার উপমার দিকে তাকালেন। তারপর নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। মায়ের চোখ অনুসরণ করে আদিল বোনের দিকে তাকালো। উপমা ভাইয়ের কথা শুনে পা টিপে টিপে সরে আসতেই আদিল তার সামনে এসে দাঁড়ালো।
উপমা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“ভাইয়া, তুমি না আমার লক্ষী ভাইয়া।”
তারপর ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমাকে বকা দিলে আমি কিন্তু মাকে তোমার হৃদি বাবুর কথা বলে দেবো।”
আদিল কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। উপমা বুকে হাত গুঁজে জোরে জোরে বলল,
“ভাইয়া আমিই নিয়েছিলাম। আমার স্টারের ছবিগুলো ফোন থেকে প্রিন্ট করে বের করিয়েছি। রঙিন ছবি বের করতে অনেক টাকা লাগে, জানো না?”
আদিল রাগী কন্ঠে বললো,
“আমার টাকা খরচ করে তুই কোথাকার গায়কের ছবি প্রিন্ট করছিস? তাও যাকে আজ পর্যন্ত কেউ দেখে নি।”
“সে কোথাকার গায়ক না। ও আমার স্টার। আর শুনো, ও অনেক ভদ্র, তাই নিজের ছবি দেয় নি। ওকে ভালোবাসার জন্য আমার ওকে দেখার প্রয়োজন নেই। ওর গিটার, ওর পরণের শার্ট, ওর চুলগুলোই আমার জন্য যথেষ্ট। আর ওর কন্ঠ! আমি তো ভাবতে গেলেই পাগল হয়ে যাবো।”
মিসেস জুলেখা মেয়ের কথা শুনে আদিলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“সেই বয়সে আমরাও স্টারদের প্রেমে পড়েছি। ক্রিকেটারদের পোস্টার লাগিয়েছিলাম। কিন্তু তোর বোন তো ডায়েরী ভর্তি ছবি লাগিয়েছে একটা মাথা ছাড়া ছেলের।”
উপমা বিরক্ত হয়ে বলল,
“মা ওকে মাথা ছাড়া ছেলে বলবে না। ও শুধু মুখটাই দেখায় না। ওর তো মাথা আছে।”
“মুখখানা হয়তো পেঁচার মতো, তাই দেখাতে লজ্জা পায়।”
উপমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। আদিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের সামনে এসে হাত এগিয়ে দিলো। মিসেস জুলেখা ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“হাত এগিয়ে দিচ্ছিস কেন? মার খেতে চাস?”
আদিল বলল,
“মা, তোমার মেয়ে আমার মানিব্যাগ খালি করেছে। এখন আমাকে টাকা দাও। আমি এখন আগ্রাবাদ যাবো। আমার কাছে গাড়ি ভাড়াও নেই।”
“তোর বাইক কোথায়?”
“তেল শেষ হয়ে গেছে।”
মিসেস জুলেখা বললেন,
“রুমে ব্যাগ আছে। ওখান থেকে নিবি। ২০০ টাকায় নিবি কিন্তু। এর বেশি না। তোর বাবা আমাকে এই মাসের খরচ চালানোর জন্য টাকাটা দিয়েছে।”
করিম সিদ্দিক আর জুলেখা হোসেনের বড় ছেলে আদিল সিদ্দিক আর তাদের ছোট মেয়ে উপমা করিম। এইটাই তাদের চারজনের ছোট্ট সংসার। করিম সিদ্দিক প্রবাসী। তিনি দুবাই থাকেন। মাঝে মাঝে দেশে আসেন। দেশে এলে বউ-বাচ্চা নিয়ে বাইরে ঘুরতে যান। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করা করিম সিদ্দিকের শখ। তার এই শখ আদিলও পেয়েছে। কিন্তু উপমা মায়ের মতোই ঘরকুনো স্বভাবের৷ তাদের দু’জনকে একপ্রকার টেনেই ঘর থেকে বের করতে হয়।
এদিকে ক্লাস শেষে কলেজের বাগানে চুপচাপ বসে রইলো মাওশিয়াত। ইভান দূর থেকেই তাকে দেখে তার পাশে এসে বসলো। মাওশিয়াত ইভানের দিকে এক নজর তাকিয়ে বসা থেকে উঠতে যাবে তখনই ইভান বলল,
“ইমন এসব ইচ্ছে করে করছে।”
মাওশিয়াত কোনো উত্তর দিলো না। ইভান আবার বলল,
“সবার মধ্যে কমবেশি জেদ থাকে। ইমন এখন যা করছে তা জেদের বশে। তোমার মধ্যেও এই জেদ ছিল। এখনো হয়তো আছে। কিন্তু আমাদের সামনে দেখাচ্ছো না। আর আগের চেয়ে তুমি অনেক পরিবর্তন হয়েছ।”
মাওশিয়াত বলল,
“পরিবর্তন হওয়ারই ছিল। এই জেদের বশে আজ পর্যন্ত আমার কোন বন্ধু হলো না। শতাব্দী কত মিশুক একটা মেয়ে! তোমরা ওকে কতো কথা বলো, তবুও কিছু মনে করে না। আর আমি সব কিছুতেই মন খারাপ করে বসে থাকি। আমি কারো সাথেই মিশতে জানি না। সায়ন্তনীও তো চুপচাপ থাকে, তবুও ওর কত বন্ধু! তূর্য, তাহমিদ, আহনাফ ওরা আমাকে পছন্দই করে না। শুধু আরাফই আমাকে কিছুটা বুঝে।”
“আমি বুঝি না তোমাকে?”
“অনেকদিন তো আমাদের কথাই হয়নি। তুমি তো আমার কাছ থেকে দূরত্ব রাখছো।”
“কারণ আমি চাইনা, ইমনের সাথে আমার আর ঝামেলা হোক। ইমন যা ভাবছে সেটা একদমই সত্য না। আমি সবসময় তোমাকে বন্ধুর চোখে দেখেছি। কিন্তু ইমন এই সম্পর্ককে অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ইমন তোমাকে ভালোবাসে, এটা আমি জানি। ও ভাবছে, এসব জানার পরও আমি তোমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইছি। ও এখনো ভাবছে, আমরা একজন আরেকজনকে পছন্দ করি, আর আপাতত ওর জন্যই আমরা দূরত্ব রাখছি।”
মাওশিয়াত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কেন যেন মনে হচ্ছে ইমনকে বোঝানো সম্ভব হবে না।”
“ওকে বোঝানো সম্ভব, যদি ও আমাদের মুখোমুখি হতো। ও তো আমার সাথে ঠিকভাবে কথাই বলে না। এখন একটাই উপায় আছে।”
“কি উপায়?”
“আগে আমার প্রশ্নের উত্তরটা দাও!”
“কি প্রশ্ন?”
“তুমি কি এখন ইমনকে পছন্দ কর? তোমার কি আমাকে নিয়ে এখনো দুর্বলতা আছে? দেখো মাওশিয়াত, কিছু মনে করো না, এটা আমার জানা জরুরি। তারপরই এই উপায়টা বাস্তবায়ন হবে।”
“ইভান তুমি আমার জেদ ছিলে। এটা ভালোবাসা ছিল না। তোমাকে আগেই বলেছি, আমি ভাবতাম ভালোবাসা বরাবরিতেই সম্ভব। তুমিও টপার ছিলে, আমিও টপার ছিলাম। ভাবতাম আমাদের ভালই মানাবে। কিন্তু ভালোবাসা এসব দেখে হয় না। ভালোবাসা তো আত্মার সম্পর্ক। এটা মুগ্ধতার সম্পর্ক। আর আমি ইমনের প্রতি মুগ্ধ হয়েছি। ওর প্রতি ভালো লাগা আমার কোন কারণ ছাড়াই চলে এসেছে। তাই আমার মনে হয় ভালবাসতে কোন কারণ লাগে না, কোন গুণ লাগে না, ভালোবাসা এমনিতেই হয়ে যায়। হুট করেই হয়ে যায়। আমি নিজেও জানিনা কবে থেকে আমি ইমনকে ভালবাসতে শুরু করেছি। কিন্তু যেদিন থেকে আমার ওকে বারবার দেখার ইচ্ছে জাগলো, ওর সাথে কথা বলার জন্য আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলাম, রাত-দিন শুধু ওকে নিয়েই ভাবতাম, তখন বুঝতে পেরেছি আমি অভিমানী ছেলেটিকে ভালোবেসে ফেলেছি।”
ইভান মনে মনে হাসলো। সে জানে, ইমন মাওশিয়াতকে এখনো ভালোবাসে। ইমনের ভালো থাকা মাওশিয়াতকে ঘিরেই। ইভান এখন তাদের এক করেই ছাড়বে। হয়তো সায়ন্তনী কষ্ট পাবে। কিন্তু এই মুহূর্তে দু’টো মানুষের ভালো থাকা এক জনের ভালো থাকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটা শুধু মাওশিয়াত আর ইমনের জন্য নয়। সে চায় ইমন আর তার সম্পর্ক যাতে ঠিক হয়ে যায়। শুধু কিছু ভুলের জন্য কি সে নিজের ভাইকে হারিয়ে ফেলবে?
অরুণিকা আজ স্কুলে যায় নি। সকাল থেকেই নিজের ঘরে বসে আছে। তূর্য তার ঘরে বসে গানের ভিডিও শুট করছে। আহনাফ আর তাহমিদ তাকে সাহায্য করছে। হঠাৎ তূর্য বলে উঠলো,
“টুইংকেল কোথায়?”
আহনাফ বলল, “দাঁড়া, আমি দেখে আসি।”
সে ঘরের বাইরে এসে দেখলো অরুণিকার ঘরের দরজা আটকানো। আহনাফ দরজায় দু’তিনবার ঠোঁকা দেওয়ার পরও অরুণিকা দরজা খুলছে না। তাই সে ঘরে ঢুকে পড়লো। দরজা খুলেই অরুণিকাকে দেখে আহনাফ চমকে উঠলো। অবাক হয়ে বলল,
“কি করছো তুমি?”
অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো। আহনাফ আবার বলল,
“এগুলো কি? তোমাকে দেখতে কেমন লাগছে!”
আহনাফের কন্ঠ শুনে তূর্য আর তাহমিদ এসে দেখলো পুরো ঘরে জামা-কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অরুণিকা দুই তিনটা জামা একসাথে প্যাঁচিয়ে রেখেছে। ঠোঁটের আশেপাশে লিপস্টিক লাগানো। তাহমিদ কাপড় গুলো মেঝে থেকে তুলে অরুণিকার সামনে বসে বলল,
“এগুলো কি করেছ?”
অরুণিকা মুখ নামিয়ে বলল, “বউ সেজেছি।”
অরুণিকার কথা শুনে আহনাফ আর তূর্য অবাক হলো। পরক্ষণেই তূর্য হেসে বলল,
“কার বউ সেজেছ?”
অরুণিকা কোনো উত্তর দিলো না। সে তূর্যের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। তাহমিদ বলল,
“যাও ওয়াশরুমে যাও। মুখ ধুয়ে আসো।”
অরুণিকা প্যাঁচানো জামা কাপড়গুলো খুলে ওয়াশরুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলো। তার মুখে এখনো লিপস্টিকের দাগ রয়ে গেছে। কাজল চোখের নিচে লেপ্টে রয়েছে। তাহমিদ তাকে আবার ওয়াশরুমে নিয়ে গেল। তারপর নিজ হাতে তার মুখ ধুয়ে দিল। যাওয়ার আগে তূর্য আর আহনাফকে রুমটা পরিষ্কার করে ফেলার জন্য বলল।
এদিকে সন্ধ্যায় অরুণিকা মন খারাপ করে বসে আছে। আহনাফ তাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে তার পাশে এসে বসলো। জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে? মন খারাপ কেন?”
অরুণিকা মলিন মুখে বলল,
“জানো, আমাদের স্কুলে একটা অনুষ্ঠান হবে। সবাই শাড়ি পরবে, বউ সাজবে, নাচবে, ছড়া বলবে। টিচার বলেছে ওদেরকে প্রাইজ দেবে। কিন্তু আমার কাছে তো শাড়ি নেই৷ আমি শাড়ি পরতেও পারি না, ভালো করে নাচতেও পারি না৷ আমার বান্ধবীরা কত সুন্দর করে নাচতে পারে। একদম শতু আপুর মতো করে। আমি তো ছড়াও বলতে পারব না।”
“ছড়া কেন বলতে পারবে না?”
“আমি যেই ছড়াগুলো জানি, সেগুলো বাকিরা বলবে। একই ছড়া দু’জন বলতে পারবে না।”
“আচ্ছা আমি তোমার জন্য একটা ছড়া খুঁজে আনব। তুমি মন খারাপ করো না।”
“কিন্তু আমি ছড়া বলবো না৷ আমি শাড়ি পরবো। আমার কাছে একটাও শাড়ি নেই।”
“বাচ্চাদের তো শাড়ি থাকে না। তুমি বড় হলে তারপর শাড়ি পরবে, ঠিক আছে?”
“না, আমি শাড়ি পরবোই পরবো।”
ইভান ঘরে ঢুকে অরুণিকার চেঁচামেচি শুনে বলল,
“ও চিৎকার করছে কেন?”
আহনাফ পুরো ব্যাপারটা বলতেই ইভান বলল,
“এসব ঢং করতে হবে না। নাচই তো পারো না, আবার শাড়িও পরবে!”
অরুণিকা ইভানের উপর কথা বলার সাহস পায় না। ইভানের ধমকটাই কান জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ভয়ংকর। তাই সে উঠে চলে গেলো।
পরের দিন আহনাফ শতাব্দীকে ফোন করে বাসায় আসার জন্য বললো। এরপর অরুণিকার জন্য দোকান থেকে একটা শাড়ি কিনে আনলো। বাসায় এসে অরুণিকাকে শাড়ি দিতে যাবে, তখন দেখলো অরুণিকা আগে থেকেই একটা শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছে। তূর্য আহনাফের কাছে এসে বলল,
“টুইংকেলের জন্য একটা শাড়ি কিনে এনেছি। দেখ কেমন হয়েছে?”
আহনাফের হাতের প্যাকেটটা দেখে ইমন বলল,
“তোর হাতে কি?”
আহনাফ নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“আমিও কিনে এনেছিলাম। থাক, ফেরত দিয়ে দেবো।”
ইভান ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ফেরত দিতে হচ্ছে কেন? একজনের দু’টো শাড়ি থাকতেই পারে।”
তূর্য আহনাফের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকাতেই বেল বেজে উঠলো। আরাফ দরজা খুলে দেখলো শতাব্দী এসেছে। শতাব্দীকে দেখে অরুণিকা দৌঁড়ে তার কাছে গেলো। আহনাফ বলল,
“আমি ওকে আসতে বলেছিলাম।”
তূর্য জিজ্ঞেস করল,
“তুই হঠাৎ শতাব্দীকে কেন আসতে বললি?”
“অরুকে নাচ শেখানোর জন্য।”
কথাটি শুনে অরুণিকা খুশি হয়ে বলল,
“ওয়াও, আমি নাচ শিখবো!”
অরুণিকা শতাব্দীকে টেনে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গেলো। শতাব্দী আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“মিষ্টিমশাইকে দেখছি না!”
ইমন বলল,
“ও তো এখনো বাসায় ফিরে নি। কিন্তু ওর তো আরো আগেই চলে আসার কথা ছিল।”
ইভান তাহমিদের ফোনে কল দিয়ে দেখলো, ফোন বন্ধ। আরাফ বলল,
“রেস্টুরেন্টে কল দিয়ে দেখ।”
ইভান সেখানে কল দিলো। ওপাশ থেকে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার ফোন উঠিয়ে বলল,
“কে বলছেন?”
“আমি ইভান বলছি। তাহমিদ কি এখনো বের হয় নি?”
ওপাশ থেকে কিছু হয়তো বলা হলো, যা শুনে ইভানের মুখটা জমে গেলো। ইভানকে এর আগে কেউ এভাবে দেখে নি। তার বিচলিত চেহারা দেখে সবাই ভীত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। শতাব্দী বলল,
“কি হলো ইভান?”
ইভান ফোন কেটে দিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমাদের এখনই হস্পিটালে যেতে হবে। তাহমিদের অবস্থা ভালো না। ওর একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
চলবে-
#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||
৪৮.
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে তাহমিদ যেই না ক্যাবে উঠতে গেলো, তখনই একটা মিনি মাইক্রো তার ক্যাবটাকে জোরে ধাক্কা দেয়। ক্যাবে এক পা থাকা অবস্থায় ধাক্কাটা লাগায় মাইক্রোটা ক্যাবটাকে যতোদূর টেনে নিয়ে গেছে, তাহমিদের শরীরটাকেও ক্যাবটা ততোদূর টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছে। ইটের রাস্তায় ঘষা খেয়ে তার মুখের বাম পাশ ছিঁড়ে গেছে। বাম হাতের অস্থি ভেঙে গেছে। পা দু’টো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছে, আপতত কয়েক মাস পর দুই পায়ে ভর দিতে পারলেও, সে কখনোই বেশিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে পারবে না, জোরে হাঁটা তো অসম্ভব। প্রায় পাঁচদিন পর তাহমিদকে রিলিজ দেওয়া হলো। হাস্পাতালের পাঁচদিনের বিল, অপারেশনের খরচ আর তাহমিদের ওষুধের পেছনে তূর্যের পুরো সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। আহনাফও বাইক কেনার জন্য অনেক মাস ধরেই টাকা জমাচ্ছিলো। সেই টাকাগুলোও তাহমিদের পেছনে খরচ হয়ে গেছে।
এখন পাঁচ জনই পড়াশোনা, কাজ সব বাদ দিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে তাহমিদকে নিয়ে ছোটাছুটি করছে। এদিকে ইভান মাইক্রোবাস চালকের উপর মামলা করে এসেছিলো। এখন এই মামলা চালাতে গেলে, আর কোনো টাকাই অবশিষ্ট থাকবে না। তাই শেষমেশ মামলাটা উঠিয়ে নিতে বাধ্য হলো। মামলা উঠানোর পর বাসায় এসে ইভান চুপ করে বসে রইলো।
মাইক্রোবাসের চালককে তার মালিক ঝামেলায় পড়তে দেন নি। তিনি সম্মানের সাথে তার চালককে ফিরিয়ে এনেছেন, আর ইভান কিছুই করতে পারলো না। মামলা উঠানোর পর থেকেই ঘরে নিরবতা বিরাজ করছে।
অরুণিকাও এখন সেই নিরবতা বুঝতে পারছে। সে ইদানীং তাহমিদের কাজগুলো কাঁচা হাতে করার চেষ্টা করে। অরুণিকা এখন প্রতিদিন সবার কাপড় ভাঁজ করে আলমারিতে তুলে রাখে, ঘরটাও ঝাড়ু দিয়ে ফেলে। এতোদিন তাহমিদই তাকে খাইয়ে দিতো। এখন সে নিজ হাতে খায়। আবার নিজের প্লেট নিজেই ধুয়ে ফেলে। তূর্য আর ইমন এসব দেখে প্রথম কয়েকদিন তাকে আটকাতে চেয়েছিল। আর নিজেরাই সেই কাজগুলো করতে চেয়েছিল। কিন্তু আরাফই তাদের বারণ করেছে। যদিও অরুণিকা এখনো ছোট, কিন্তু তাকে এখন থেকেই নিজের কাজ নিজে করা শিখতে হবে। কারণ আজ তাহমিদের সাথে অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। কাল বাকিরাও যে সুস্থ থাকবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন তো অরুণিকাকে একাই চলতে হবে। তাই এখন থেকেই তাকে কাজ শিখতে হবে। সংসারের কাজগুলো বুঝে নিতে হবে।
তাহমিদের পরিবর্তে এখন রান্নার কাজ আহনাফ আর আরাফ ভাগাভাগি করেই করে। মাঝে মাঝে সায়ন্তনী অথবা সুরাইয়া এসে রান্না করে দেন। আবার মাঝে মাঝে মাওশিয়াত আর শতাব্দী নিজেদের বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে আসে।
বিকেলে তূর্য বারান্দায় বসে ছিল। ইমন তার পাশে এসে বসলো। তূর্য ইমনকে দেখেই দুর্বল হয়ে পড়ল। সে ইমনের কোলে মাথা ফেলে দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ইমন তূর্যকে ঝাঁকিয়ে বলল,
“কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে?”
তূর্য চোখ মুছতে মুছতে বলল,
“তাহমিদের জন্য খারাপ লাগছে। এখনো ও দাঁড়াতে পারছে না। হুইলচেয়ারে বসে আছে। আর ওইদিকে ওর এই অবস্থা যেই করেছে, তার কোনো শাস্তিই হলো না!”
ইমন বলল,
“এটাই তো দুর্ভাগ্য। টাকার জন্য মানুষ অনেক নিঃস্ব হয়ে যায়।”
“আমাদের পরিবারের খুনিদেরও এখনো শাস্তি হয় নি। যেখানে আমরা তাহমিদের জন্য এতোটুকু করতে পারলাম না, সেখানে সেই খুনিদের কিভাবে শাস্তি দেবো? আমরা তাদের বিরুদ্ধে কখন প্রমাণ পাবো! কখন আদালতে তাদের শাস্তির রায় হবে? আদৌ রায়টা আমাদের পক্ষে হবে কিনা, এর নিশ্চয়তা নেই।”
তূর্যের কথা শুনে পেছন থেকে ইভান বলে উঠলো,
“কে বলেছে রায় আমাদের পক্ষে হবে না? যখন রায় আমরাই দেবো, সেখানে বিপক্ষে থাকার প্রশ্নই আসে না।”
তূর্য মাথা তুলে ইভানের দিকে তাকালো। ইমনও ইভানের কথা শুনে অবাক হলো। ইভান বলল,
“খুনিদের একমাত্র শাস্তি মৃত্যু। আর তা আমি নিজ হাতে ওদের দেবো। একটা একটা করে সবাইকে খুঁজে বের করে আমিই ওদের মারবো।”
ইমন বলল,
“ভাই, তুই খুন করবি?”
“এটাকে খুন বলে না। ন্যায়বিচার বলে। হত্যার বদলে হত্যা। এটাই তো বিচার। এখনকার বিচার বিভাগের উপর আমার কোনো আস্থা নেই। তাই আমি ওদের নিজ হাতে শাস্তি দেবো। আর ওই মাইক্রোবাস চালককে আইনগতভাবে শাস্তি দিতে পারি নি তো কি হয়েছে। ওর তো আপতত শাস্তি হয়েই গেছে।”
তূর্য বলল, “মানে? কেমন শাস্তি?”
আহনাফ পেছন থেকে এসে বলল,
“হত্যার বদলে হত্যা, আঘাতের বদলে আঘাত।”
ইমন বলল,
“ভাই তোরা কথাটা এভাবে ঘোরাচ্ছিস কেন? সোজাসুজি বল না।”
“আমি আর ইভান মিলে গতকাল ওই লোকটাকে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছি। লোকটা যেই নতুন মাইক্রোটা চালাচ্ছিলো, সেটাও ভেঙে দিয়ে এসেছি। তার লাইসেন্সও পুড়িয়ে ফেলেছি। তার পকেটে যা টাকা ছিল, সব রাস্তায় বসা ভিক্ষুকদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দিয়ে চলে এসেছি। ওই লোকটা অন্তত দুই-তিনদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না।”
“লোকটা তোদের দেখে নি?”
“না, আগে মুখে পিপার স্প্রে করেছি। তাই চোখ খুলতে পারে নি৷”
ইভান বলল,
“তাহমিদ যেই কষ্ট পাচ্ছে, সেটার তুলনায় এই শাস্তি খুবই নগন্য ছিল। কিন্তু তবুও এখন একটু শান্তি লাগছে।”
এদিকে শতাব্দী তাহমিদের ঘরে এসে তার পাশে বসলো। তাহমিদ কারো উপস্থিতি পেয়ে চোখ খুললো। শতাব্দীকে দেখে সে উঠে বসতে যাবে, তখনই শতাব্দী তার হাত ধরে বলল,
“দাঁড়াও, আমি সাহায্য করছি।”
শতাব্দী তাকে ধীরে ধীরে বসালো। তাহমিদ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“কখন এসেছো?”
“একটু আগে।”
তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হুইলচেয়ারটির দিকে তাকিয়ে রইলো। শতাব্দী বলল,
“মিষ্টিমশাই!”
“হুম!”
তাহমিদ শতাব্দীর চোখের দিকে তাকালো। শতাব্দী তাহমিদের হাত ধরে বলল,
“তুমি খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবে।”
“আমাকে আর মিষ্টিমশাই ডেকো না। আমি আর মিষ্টি তৈরী করতে পারবো না।”
“মিষ্টি তো হাতে বানায়। তাহলে কেন তৈরি করতে পারবে না? ব্যথা তো তুমি পায়ে পেয়েছো। হাতে তো এখন আর তেমন ব্যথা নেই।”
“আবার ঘরে বসে মিষ্টি বানানো, তারপর হুইলচেয়ারে বসে রাস্তায় নেমে বিক্রি করা, আমি তো এমন জীবন চাইনি। একটা রেস্টুরেন্টে চাকরি পেয়েছিলাম। ভালোই তো দিন কাটছিল। এখন চাকরিটাও হারিয়ে ফেলেছি।”
“তুমি অন্যের রেস্টুরেন্টে কাজ না করে, নিজেই একটা রেস্টুরেন্ট খুলে বসো।”
“এখন আর এসব সম্ভব না।”
“অবশ্যই সম্ভব।”
“শুধু শুধু মিথ্যে আশা দিও না।”
“আমি কোনো মিথ্যে আশা দিচ্ছি না। আজকালকার সবাই অনলাইনে ব্যবসা করছে। কে বলেছে তোমাকে রাস্তায় নেমে খাবার বিক্রি করতে হবে? তুমি ঘরে বসে রান্না করবে, তারপর ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়বে। সেখান থেকেই তোমার খাবারের অর্ডার আসবে। এভাবে একদিন তুমি অনেক বড় ব্যবসায়ী হতে পারবে।”
“এসব এতটাও সহজ না। কেউ টেস্ট না করেই কেন আমার থেকে খাবার কিনবে?”
“আরেহ, টেস্ট না করেই তো সবাই অনলাইন থেকে খাবার অর্ডার করে। তুমি একবার চেষ্টা করে দেখো।”
তাহমিদ মলিন হেসে বলল,
“আগে নিজের পায়ে দাঁড়াই। হুইলচেয়ারে বসে আমার আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখার সাহস নেই।”
শতাব্দী তাহমিদের গালে হাত রেখে বলল,
“আমি তোমার পাশে আছি। তোমার আকাশকুসুম স্বপ্নগুলো খুব শীঘ্রই হাতের নাগালে চলে আসবে।”
তখনই অরুণিকা রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে বলল,
“শতু আপু, তুমি কবে এসেছো?”
শতাব্দী হেসে বলল,
“এই তো একটু আগে। কেমন আছো সখী?”
“ভালো আছি।”
“শুনলাম, মিষ্টি মশাইয়ের ভাগের কিছু কাজ তুমিও করছো?”
অরুণিকা বিছানায় উঠে তাহমিদের পাশে বসে বলল,
“আমি সকালে উঠেই ব্রাশ করে নিজে নিজে স্কুলের ড্রেস পরি, নিজ হাতে নাস্তা করি। আরাফ এখন আর আমাকে জুতো পরিয়ে দেয় না। আমি নিজেই পরতে পারি। এরপর বাসায় এসে সব গুছিয়ে রাখি। আর তাহমিদকে দেখায়। ওর খুব পছন্দ হয়, তাই না?”
তাহমিদ হেসে বলল, “হ্যাঁ, অনেক পছন্দ হয়।”
অরুণিকা হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের উপর থেকে একটা ক্রিম নিয়ে তাহমিদের পায়ের কাছে এসে বসলো। শতাব্দী বলল,
“কি করছো সখী!”
“ডাক্তার বলেছে, প্রতিদিন তিন বেলা পুরো পায়ে এই ক্রিমটা লাগাতে হবে। বিশেষ করে, হাঁটুতে আর গোড়ালিতে। তারপর খুব তাড়াতাড়ি তাহমিদ হাঁটতে পারবে।”
তাহমিদ মুচকি হাসলো আর বলল,
“এই কাজটা অরুণিকা নিয়েছে। ও সময়মত আমাকে ওষুধ খাইয়ে দেয়। পায়ে ক্রিমটা মালিশ করে দেয়। আমাদের অরুণিকা অনেক সংসারী হয়ে গেছে।”
কিছুক্ষণ পর আহনাফ রুমে ঢুকে তাহমিদের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। তখন শতাব্দী বলল,
“আমি বাসায় বলেছি, কয়েকদিন এখানে থাকবো।”
তাহমিদ আর আহনাফ অবাক হয়ে শতাব্দীর দিকে তাকালো। তাহমিদ বলল, “তারপর!”
“কিন্তু মা অনুমতি দিচ্ছে না।”
আহনাফ বলল,
“অনুমতি দেওয়ার কথাও না। তুমি একা উপযুক্ত একটা মেয়ে একটা ব্যাচেলর বাসায় এসে থাকবে, এটা তো সুন্দর দেখায় না।”
অরুণিকা বলল,
“কেন সুন্দর দেখাবে না? আপু আমার সাথে থাকবে।”
“আপু তোমার বোন বা কাজিন হয় না, যে তোমার সাথে থাকতে দেবে।”
তাহমিদ শতাব্দীকে বলল,
“তুমি এখানে কেন থাকার কথা বলেছো?”
শতাব্দী বলল
“কেন আবার? তোমার দেখাশুনা করার জন্য।”
চলবে-