#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-৩৬||
#নতুন_মোড়
৫৯.
সায়ন্তনীর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরাফ। সায়ন্তনীর ভাই সায়ান দোকান থেকে সকালের নাস্তা কিনে বাসায় ফিরে আরাফকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আচমকা তাকে জড়িয়ে ধরল৷ আরাফ ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো। সায়ান চেঁচিয়ে মাকে ডেকে বলল,
“আম্মা, দেখো না কে এসেছে।”
তারপর আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আসো না ভাইজান। ভেতরে আসো।”
সায়ন্তনীর মা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আরাফকে দেখে তার চোখের পানি উপচে পড়লো। তিনি ভেতর থেকে একটা চাটাই এনে মাটিতে বিছিয়ে একটা ময়লা উড়না দিয়ে তা মুছে দিতে লাগলেন। আরাফ তাকে থামিয়ে বলল,
“আন্টি, আমি সায়ন্তনীর সাথে দেখা করতে এসেছি।”
সায়ন্তনীর নাম শুনে তার মায়ের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল৷ তিনি আরাফের হাত ধরে বললেন,
“আমি কতো খুঁজেছি তোমাদের, জানো, বাবা? ছোট বাবু কোথায়? ও আসে নি?”
কথাটি বলেই সায়ন্তনীর মা এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। আরাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“ছোট বাবু!”
সায়ান বলল,
“ইমন ভাইজান! উনি আসবে না? আপা বলল, ভাইজান দেশের বাড়ি গেছে। এখনো কি আসে নি?”
আরাফ কোনো উত্তর দিতে পারলো না। সায়ন্তনীর মা বললেন,
“বাবুর কথা মেয়েটা সারাদিন বলে। হায়রে আমার মেয়েটা! আল্লাহ আমাদের এতো কষ্ট দেখাচ্ছেন কেন?”
কথাটি বলতে বলতেই তিনি কেঁদে দিলেন। সায়ান বলল,
“ভাইজান, আপা অনেক অসুস্থ। ডাক্তার বাবু বলেছেন, আপা আর ভালো হবে না। তুমি তো ডাক্তারি পড়ছো, তাই তোমার কলেজের ওখানে গিয়ে তোমাকে অনেক খুঁজেছি। আপার দোকানেও আসো না এখন। গেল এক সপ্তাহ ধরে আপা দোকানেও যায় নি। আমিই বসেছিলাম। কিন্তু তোমাদের কাউকে দেখি নি। ইমন ভাইজান দেশের বাড়ি থেকে কবে আসবে? আপা ভাইজানকে দেখলে অনেক খুশি হতো।”
আরাফের গলায় কথা আটকে গেছে। সে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“কি হয়েছে সায়ন্তনীর?”
“ডাক্তার বাবু বলল ক্যান্সার হয়েছে। এই রোগ নাকি ঠিক হয় না। অনেক টাকা লাগে।”
আরাফ আর শব্দ করতে পারলো না। এবার সায়ন্তনীর মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“বাবা, একটা টাকাও কেউ দেয় না। যাদের বাসায় ঝি’র কাজ করি, তাদের অনেক টাকা আছে। তবুও দেয় না। আমার মেয়েটা কি বাঁচবে না, বাবা?”
আরাফ বলল, “ও কোথায়?”
সায়ান বলল, “আপা ঘরে আছে।”
সায়ান তার হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে গেলো। আরাফ সায়ন্তনীকে দেখে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সায়ন্তনী পাশ ফিরে আরাফকে দেখে মলিন হাসলো। আরাফ সায়ন্তনীর পাশে এসে বসলো। সায়ন্তনী ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“কেমন আছো, আরাফ?”
আরাফ কোনো উত্তর দিলো না। সে এখনো সায়ন্তনীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার সবকিছু খারাপ স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। সায়ন্তনী মাথা তুলে বলল,
“আমি তো ভেবেছি কেউই আসবে না৷ আর তোমরা ছাড়া আমার কোনো ভালো বন্ধু হয় নি। এখন তোমাদেরও হারিয়ে ফেলেছি।”
আরাফ সায়ন্তনীর হাত ধরতে গিয়েও ধরলো না। সায়ন্তনী বলল,
“আল্লাহ, আমাকে পাপের শাস্তি দিচ্ছে। ইমনকে ভালোবেসে পাপ করে ফেলেছি হয়তো। আরাফ, নিজেকে খুব কলুষিত মনে হচ্ছে। নিজের উপরই নিজের বিরক্ত এসে গেছে। সারাদিন জ্বর, মাথা ব্যথা, কাঁশি। এতো রোগ কি ভালো লাগে, বলো? এখন মরে গেলেই এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো।”
আরাফ কোনো কথায় বলছে না। সায়ন্তনী আবার বলল,
“এই রোগ আল্লাহর নেয়ামত হয়ে এসেছে। আমি এতোদিন মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি চেয়েছি। আল্লাহ আমাকে শারীরিক কষ্ট দিয়ে মানসিক যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছে।”
কথাগুলো বলতে বলতেই সায়ন্তনীর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আরাফ পাশে পড়ে থাকা রিপোর্টগুলো দেখে বুঝলো, সায়ন্তনীর এখন লাস্ট স্টেজ। আরাফ বলল,
“এতোদিন ধরে তুমি অসুস্থ ছিলে, অথচ কাউকে জানাও নি!”
“আমি বুঝতে পারি নি, আরাফ। এতো বড় রোগ হবে ওটা কল্পনাও করি নি। আমি তো ভেবেছিলাম, অনেকদিন বাঁচবো। মা-ভাইয়ের জন্য আমার বাঁচা উচিত। এখন আমি মরে গেলে ওদের কে দেখবে?”
সায়ন্তনীর কথায় আরাফের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। সায়ন্তনীর মা চাটাইয়ের উপর পান্তা ভাত মেখে ছেলেকে খেতে দিলেন৷ আরাফ বেরুতেই তিনি বললেন,
“বাবা, আজ ইদ। তুমি এসেছো অথচ তোমাকে কিছু খাওয়াতে পারছি না। ভাত ছাড়া বাড়িতে কিছু নেই। মেয়েটা অসুস্থ। ওকে দেখতে হচ্ছে, তাই বাজার-সদাই করতে পারি নি।”
এবার তিনি আঁচলের বাঁধন থেকে পঞ্চাশ টাকা বের করে দিয়ে বললেন,
“কিছু খেয়ে নিও। ইদে এসেছো, কিছু খেতে দিতে পারলাম না।”
আরাফ সায়ন্তনীর মায়ের মলিন হাসিটা দেখে টাকাটা নিয়ে বলল,
“ইদ মোবারক, আন্টি। এখন চলি।”
আরাফ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টাকাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। আর তার চোখ দুটি ছলছল করছে। অর্ধেক পথ যেতেই সে রাস্তায় বসে পড়লো। তার এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। এদিকে ফোনে রিং বাজলো। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো আহনাফের কল। আরাফ কল ধরতেই আহনাফ বলল,
“কোথায় তুই? আসবি না?”
আরাফ ফুঁপিয়ে উঠলো। আহনাফের আশেপাশে মাওশিয়াত ও তার কাজিনরা বসে আছে। সে একপাশে এসে বলল,
“কি হয়েছে আরাফ?”
আরাফ ভেজা কণ্ঠে বলল,
“আমি অলক্ষুণে, আহু। অলক্ষুণে আমি।”
আরাফ কথাটি বলেই ফুঁপিয়ে উঠলো। আহনাফ ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“তুই এখন কোথায়?”
আরাফ রোডের নাম বলতেই আহনাফ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লো। তূর্য ইভানকে বলল,
“আহনাফকে দেখে মনে হলো কিছু একটা হয়েছে। ও এভাবে হুট করে কোথায় গেলো?”
ইভান সাথে সাথেই আহনাফকে ফোন করলো। আহনাফ ফোন ধরতেই ইভান বলল,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
আহনাফ বলল,
“আমি তোদের পরে বলবো। আমি এখন রাখছি।”
আহনাফ রিক্সায় উঠে আরাফের বলা জায়গায় চলে গেলো। কাছাকাছি আসতেই রাস্তায় আরাফকে বসা দেখে আহনাফ ভয় পেয়ে গেলো। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দৌঁড়ে আরাফের কাছে গেলো। আরাফ আহনাফকে দেখেই তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। আহনাফ তার পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল,
“কি হয়েছে বল? এভাবে কাঁদছিস কেন? আরাফ, কি হয়েছে, ভাই। বল না।”
আরাফ আহনাফের হাত ধরে বলল,
“মামা ঠিকই বলেছিল, আমি অলক্ষুণে।”
“হঠাৎ তোর মামার কথা কেন বলছিস?”
“জন্মের তিন বছর পর মাকে হারিয়ে ফেললাম। এরপর রুহানি, এরপর বাবা, আর আমার সম্পূর্ণ পরিবার, এখন সায়ন্তনীও। এভাবে কেউ সব হারায়? একটা মানুষই কেন সবকিছু হারাবে? তার জন্য কি কিছুই বাকি থাকা উচিত না?”
“সায়ন্তনীর কি হয়েছে?”
“ক্যান্সার।”
আহনাফ মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর আরাফকে উঠিয়ে বাসায় নিয়ে গেলো। তূর্য ফোন দিতেই আহনাফ বলল,
“আরাফের শরীর ভালো না। আমি ওর সাথে আছি।”
তূর্য বলল,
“কিছু একটা তো হয়েছে। বল কি হয়েছে।”
“আরাফ সায়ন্তনীর বাড়িতে গিয়েছিল। ওখানে গিয়ে জানলো, ও অসুস্থ। ওর ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ।”
তূর্য অবাক হয়ে বলল,
“কি বলছিস এসব? একমাস আগেও তো ও ঠিক ছিল।”
“ঠিক ছিল না। ঠিক থাকার চেষ্টা করতো। টাকার জন্য ডাক্তার দেখায় নি।”
“মেয়েটা কি পাগল! এটা কোনো কথা?”
“কি বলবো আর ভাই! এখন ওর চিকিৎসার জন্য টাকা লাগবে। আরাফ ওর সিনিয়রকে ফোন দিলো একটু আগে। বিকেলে সায়ন্তনীকে নিয়ে যেতে বলেছে। তারপর ট্রিটমেন্ট শুরু করবে।”
ইভান তূর্যকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? কার কথা বলছিস?”
তূর্য কল কেটে রাগী কন্ঠে বললো,
“তুই তো আর কথায় বলিস না।”
মাওশিয়াত বলল, “কি হয়েছে, তূর্য?”
“সায়ন্তনীর ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ চলছে। অথচ আমরা কেউই জানি না।”
ইমন কথাটি শুনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মাওশিয়াত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাহমিদ বলল,
“আমাদের এখন ওখানে যাওয়া উচিত।”
সবাই চলে যাওয়ার পর মাওশিয়াতের মা এসে বললেন,
“কি হয়েছে মৌ। ওরা সবাই চলে গেল কেন?”
মাওশিয়াত তার মাকে সবটা খুলে বলতেই তিনি মাওশিয়াতকে সায়ন্তনীর বাসায় যেতে বললেন।
মির্জা বাড়িতে বড় বড় ইনভেস্টার আর ব্যবসায়ীদের ভীড়। মির্জা গ্রুপের এমডি সাহিল মির্জা ব্যবসায়ীদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করছে। সাহিল মির্জার বাবা, শাহেদ মির্জা গ্রুপের চেয়ারম্যান, তিনি সোফায় বসে ব্যবসায়ীক আলাপ-আলোচনা করছেন। তখনই সিঁড়ি দিয়ে হনহনিয়ে নেমে পড়লো তার কনিষ্ঠ কন্যা সানায়া মির্জা। মেয়েকে বের হতে দেখে তিনি বললেন,
“এই অসময়ে কোথায় যাচ্ছো?”
সানায়া বুকে হাত গুঁজে ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললো,
“আমি বাসায় কখন আসছি, কখন যাচ্ছি, এই বিষয়ে আপনি কবে থেকে প্রশ্ন করা শুরু করেছেন?”
শাহেদ মির্জা তার পাশে থাকা অতিথিদের দিকে এক নজর তাকিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বাবাকে উঠতে দেখে সাহিল অতিথিদের একপাশে বসতে বলে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো। সানায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যেতে নেবে, তখন সাহিল তাকে বলল,
“তুই বাবাকে কি বলেছিস?”
সানায়া বলল,
“তা তুমি তোমার বাবার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করো।”
কথাটি বলেই ভাইয়ের হাত ছাড়িয়ে সানায়া ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। সাহিল সানায়াকে থামাতে যাবে তখনই একজন ইনভেস্টর তাদের সামনে এসে বলল,
“কি অবস্থা শাহেদ সাহেব?”
শাহেদ মির্জা বললেন,
“জ্বি, ভালো।”
“মিস্টার সাহিল তো এবার আপনার কোম্পানিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। এবারের সেরা কোম্পানিগুলোর তালিকায় মির্জা গ্রুপের নাম প্রথমে।”
সাহিল কথাটি শুনে হাসলো। তখনই লোকটি আবার বলল,
“কিন্তু একটা সময় ছিল মৈত্রী গ্রুপের উপরে কোনো গ্রুপই ছিল না।”
শাহেদ মির্জা কথাটি শুনে অন্য প্রসঙ্গ তুলে বললেন,
“ওহ, আপনি ফাইভ নাইন প্রজেক্টের কাজটা দেখবেন না?”
তারপর তিনি সাহিলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“সাহিল, তুমি উনাকে আমাদের প্রজেক্টের কাজটা দেখিয়ে আনো।”
সাহিল লোকটাকে নিয়ে সামনে এগুতে লাগলো। লোকটা হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“সবাই জানে মৈত্রী গ্রুপের আসল শত্রু কে? কিন্তু যেদিন সেই ঘটনা প্রমাণিত হবে, মির্জা গ্রুপের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।”
সাহিল বলল,
“দেখুন মিস্টার। শত্রু আর খুনীর মধ্যে অনেক পার্থক্য। সব শত্রু খুনী হয় না, তবে সব খুনীরাই শত্রু হয়। এখন মির্জা গ্রুপকেই আলাদাভাবে টার্গেট করাটা ভালো দেখাচ্ছে না। আর যখন প্রমাণিত হওয়ার প্রশ্ন আসবে, তখন দ্বিতীয় প্রশ্নটা বরং আমিই করি।”
“কি প্রশ্ন!”
“মৈত্রী গ্রুপের আর কোন উত্তরাধিকারী জীবিত আছে যে সেই রাতটা আবার পুনরুদ্ধার করবে? সেই রাত এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। আর ইতিহাসে সাসপেন্স থাকা ভালো।”
এদিকে সানায়া গাড়ি নিয়ে তার বান্ধবী রাহির বাসায় চলে এলো। রাহি সানায়াকে দেখে বলল,
“এভাবে চলে এলি যে! ইদের জামাটাও পরে এলি না।”
সানায়া চেঁচিয়ে বললো,
“ইদ? আমার জন্য কোনো ইদ আসে নি। প্রতিবছর ইদের আগে টাকা দিয়ে বলবে যাও ইদের কেনাকাটা করে আসো। নিজে তো কখনো আমাকে শপিংয়ে নিয়ে যায় নি। আবার ইদের দিন কোনো ডাকাডাকি নেই। ঘর ভর্তি ওদের ফার্মের মোরগ-মুরগিদের ভীড় থাকবে। ভাইয়া আর মিস্টার মির্জা সেই ফার্মের মোরগদের নিয়েই এখন ব্যস্ত।”
রাহি সান্ত্বনার সুরে বলল,
“সানায়া, ঠান্ডা হয়ে বস। চল, আমার সাথেই ঘুরতে যাবি।”
“প্রতিবছর তোর সাথেই তো যাই।”
“আচ্ছা, আচ্ছা। আগে কিছু খেয়ে নে। আমি নাস্তা নিয়ে আসছি।”
“না, খাবো না আমি। মিস্টার মির্জা কি একবারো আমি খেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করেছে? তার তো ছেলে খেলেই চলবে। আমি তো তার কেউই না।”
সানায়া এসব বলতে বলতেই পা ধাপিয়ে কাঁদতে লাগলো। রাহি তাকে শান্ত করার জন্য তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আংকেল তোকে অনেক ভালোবাসে। আর মাঝে মাঝে বাবারা ভালোবাসা প্রকাশ করে না। কিন্তু সন্তানদের তা বুঝে নিতে হয়। সাহিল বলেছিল…”
সানায়া রাহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“সাহিল ভাইয়ার কথা আমাকে বলিস না।”
“এভাবে বলিস না। সাহিল তোকে অনেক ভালোবাসে।”
“প্লিজ, রাহি। তোর প্রেমিক তাই তুই ওর পক্ষ নিচ্ছিস। তুই বায়াস হতে পারিস। আমি না। আই হেইট দেম।”
রাহি চুপ করে বসে রইলো। সানায়া আবার বলল,
“তোর চোখে সমস্যা ছিল, নয়তো তোর পছন্দ তো এতোটাও খারাপ ছিল না।”
বেল বেজে উঠায় রাহি বসা থেকে উঠে বলল,
“তুই বসে থাক। আমি আসছি।”
রাহি দরজা খুলতেই সাহিলকে দেখে চমকে উঠলো। সাহিল দরজায় হেলান দিয়ে রাহির পা থেকে মাথা অব্ধি দেখে বলল,
“গর্জিয়াস। বিনা সাজেই যাকে এতো সুন্দর লাগে, মির্জা গ্রুপের এমডির ওয়াইফ হলে তাকে তো রাণির মতো লাগবে।”
রাহি কোনো উত্তর না দিয়ে সাহিলকে বাসায় ঢোকার জন্য দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। সাহিল ঘরে ঢুকেই বলল,
“সানায়া এখানেই এসেছে, তাই না?”
“হুম।”
“আংকেল-আন্টি কোথায়?”
“বাবা বাইরে গেছে চাচাদের সাথে। মা রান্নাঘরে আছেন, নাস্তা বানাচ্ছে।”
“দাদী কোথায়?”
“তোমার অপেক্ষায় বসে আছে।”
সাহিল দাদীর ঘরে চলে গেলো। দাদীর পাশে বসে গল্প জুড়িয়ে দিলো। সানায়া ভাইয়ের কন্ঠ শুনে বিড়বিড় করে বলল,
“উফ! মিস্টার মির্জার ফ্রি বডিগার্ড এখানেও চলে এসেছে।”
রাহি রুমে ঢোকার আগেই সানায়া দরজা আটকে রাহির বিছানায় শুয়ে পড়লো।
রাহি আর সানায়া ছোট বেলার বান্ধবী। আর সাহিল সানায়ার বড় ভাই। সাহিল, সাবা আর সানায়া শাহেদ মির্জার তিন সন্তান। তাদের মা মিসেস মির্জার স্বামীর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তিনি একই বাসায় থাকেন৷ পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে তারা তালাক নেন নি। মূলত সমস্যাটা মিস্টার শাহেদেরই ছিল। তিনি পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। তবে এখন আর সেই সম্পর্ক নেই। এরপর থেকেই সাবা আর সানায়া বাবাকে খুব অপছন্দ করে। তবে সাহিল খুবই বাবা-মা ভক্ত। তার বাবা তার মানসিক শক্তি, আর মা তার দুর্বলতা। সাহিল রাহিকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো। তবে রাহি যখন নবম শ্রেণিতে উঠেছিল, তখন এই সম্পর্কটা পুরোপুরি শুরু হয়৷ রাহির সাথে সম্পর্কে যাওয়ার পরই সাহিল মির্জা গ্রুপের এমডি নিযুক্ত হয়। সাহিল আর রাহির বয়সে পনেরো বছরের পার্থক্য৷ বর্তমানে রাহি আর সানায়া একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছে৷
অন্যদিকে সাহিল সোজাসুজি কথাবার্তা বলতে পছন্দ করে, তাই রাহি যখন কলেজ পাশ করে ফেলল, তখনই সে রাহির পরিবারকে তাদের প্রেমের ব্যাপারে জানিয়ে দিলো। তবে মিডিয়ার কাছে রাহি সানায়ার বান্ধবী মাত্র। দুই পরিবারের সম্মতি থাকলেও তারা বিষয়টা এখনো কারো সামনেই প্রকাশ করে নি।
৬০.
জীবনটা যুদ্ধ ক্ষেত্র৷ এখানে টাকার জন্য যুদ্ধ করতে হয়। যার যতো টাকা, সে-ই জয়ী হয়।
তূর্য সেদিন তার জমানো টাকা দিয়ে সায়ন্তনীর মা, ভাই আর সায়ন্তনীকে জামা কিনে দিয়েছিল। আহনাফ আর ইভান নিজেরাই গিয়ে বাজার-সদাই করে সায়ন্তনীর বাড়িতে দিয়ে গিয়েছিল। শতাব্দী আর তাহমিদ তাদের বাসায় খাবার-দাবার রান্না করে পাঠিয়েছিল। আরাফ আর ইমন সায়ন্তনীকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ছুটাছুটি করেছে। মাওশিয়াত তার ক্লাসমেটদের নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে সায়ন্তনীর চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করেছে।
তিন মাস কেটে গেছে। চিকিৎসা চলছে, তাই হয়তো সায়ন্তনী এখনো বেঁচে আছে। আজ ডাক্তার বলে দিয়েছে, চিকিৎসা বন্ধ করে দিলেই সে মারা যাবে। আর চালালে আল্লাহ যতোদিন তাকে বাঁচায়, তবে তার হাতে বেশিদিন সময় নেই।
সায়ন্তনী কেমোথেরাপি দেওয়ার পর হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। মাওশিয়াত তার পাশে এসে বসলো। সায়ন্তনী মাওশিয়াতের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
“পৃথিবীতে সবাই সব পায় না। আমিও হয়তো এই জীবনে যা চেয়েছি, পাই নি। কিন্তু এখন আর আমার কোনো আক্ষেপ নেই। কেন জানো?”
মাওশিয়াত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। সায়ন্তনী বলল,
“অনেক ভালো বন্ধু পেয়েছি। যারা জীবনের শেষ মুহূর্তে আমার বন্ধু হয়েছে, তারাই প্রকৃত বন্ধু। আমার তোমাদের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।”
মাওশিয়াত ভেজা কণ্ঠে বলল,
“আই এম সরি। আমি তোমাকে অনেক অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছি।”
“ওসব আগের কথা। আমি সব ভুলে গেছি। এখন এতোটুকু জানি, আমার ভাই একটা বোনের পরিবর্তে তিনটা বোন পেয়েছে। আমার মা এক মেয়ের পরিবর্তে তিন তিনটা মেয়ে, আর ছ’টা ছেলে পেয়েছে। আমার মা আর ভাইকে তোমরা দেখবে তো?”
মাওশিয়াত মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”
এদিকে আরাফ শুকনো মুখে হাসপাতালে বসে আছে। অনেকদিন সে নিজের দিকেই তাকায় নি। তূর্য তার পাশে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে সে আরাফকে এতোটা বিধ্বস্ত কখনোই দেখে নি। তূর্য আরাফের কাঁধে হাত রাখতেই আরাফের বুক ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এখন শুধু নিশ্চুপ অপেক্ষায় দিন কাটছে। প্রতিটি সেকেন্ডই ভীতি নিয়ে আসছে, যদি এখনই কোনো খারাপ খবর আসে?
অন্যদিকে তাহমিদ এখন ক্রাচের উপর ভার দিয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারে না। ক্রাচের সাহায্যে হুইলচেয়ারে বসতে পারে। তাই এখন আর কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। থেরাপি দেওয়াতে অনেক লাভ হয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছে আরো দুই-একমাস পর পুরোপুরি হাঁটতে পারবে। শুধু নিয়মিত ওষুধটা খেতে হবে।
রাত দুইটা। ইমন জায়নামাজে বসে কাঁদছে। ইভান মেঝেতে বসে আছে। আর তাহমিদ তাদের পাশেই বসে রইলো। ইমন মোনাজাত শেষে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাই, ওর কিছু হবে না তো?”
ইভান কোনো উত্তর দিলো না। ইমন জায়নামাজে কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে। কিন্তু আজ তার ইচ্ছেটা যেন পূর্ণ হওয়ার নয়। হঠাৎ সায়ন্তনীর শরীর বেশি খারাপ হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। আরাফ, তূর্য আর আহনাফ সেখানেই গিয়েছে। রাত আড়াইটায় আহনাফ বাসায় ফোন দিলো। ইমন ফোনের শব্দ শুনেই সব বুঝে গেলো। সে জায়নামাজে বসেই কেঁদে দিল। ইভান কাঁপা হাতে ফোনটা হাতে নিয়ে তাহমিদের দিকে এগিয়ে দিলো। তাহমিদ রিসিভ করতেই আহনাফ বলল,
“সায়ন্তনী আর নেই। তাহমিদ, আমরা আরাফকে সামলাতে পারছি না। ও এভাবে কাঁদছে কেন ভাই? কি করবো এখন?”
তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আর বলল,
“ওকে হাসপাতাল থেকে কখন আনবি?”
“একটু পর। এখানেই দাফন করাবে ফজরের নামাজের পর।”
“আমরা আসছি।”
ফোন রেখেই তাহমিদ বলল,
“সায়ন্তনীকে ফজরের নামাজের পর দাফন করাবে।”
তাহমিদ শতাব্দীকে মেসেজ দিয়েই অরুণিকাকে ঘুম থেকে উঠালো। তারপর সবাই সায়ন্তনীদের বাড়িতে গেল। আশেপাশে অনেক মহিলা এসে ভীড় জমিয়েছে। মাওশিয়াত জানার পর সায়ন্তনীদের বাসায় আসার জন্য অনেক কান্নাকাটি করছিল। শেষমেশ মাওশিয়াতের মা তার সাথেই এলেন৷ সায়ন্তনীকে বাড়িতে ঢুকানো হলো। আরাফ একপাশে বসে কাঁদছে। আহনাফ তার পাশে বসতেই সে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“আমি ওকে বলতেই পারলাম না, যে আমার ওকে ভালো লাগে। আমি ওকে আমার অনুভূতির কথাটাই জানাতে পারি নি। এখন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আহু।”
আহনাফ আরাফকে জড়িয়ে ধরলো। তূর্যও আরাফের মাথায় হাত রাখলো। তার মনে পড়ে গেলো রুহানির মৃত্যুর কথা।
সেদিন রুহানি আরাফের সাথে প্রতিদিনের মতো মাঠে ফুটবল খেলছিল। রুহানির ফুটবল খেলতে খুব ভালো লাগতো। তারা খেলা শেষে মাঠের একপাশে এসে দাঁড়ালো। তখনই দুইজন প্রাপ্ত বয়স্ক যুবক, তাদের দেখে মাঠে এলো। এরপর তারা রুহানিকে আরাফের সামনেই টেনে নিয়ে গেল। আরাফ তাদের আটকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় আরাফ তাদের সাথে পেরে উঠতে পারে নি। তারা এক ধাক্কায় আরাফকে দূরে সরিয়ে দিলো। এরপর পাশের একটা নির্মাণরত বাড়ির তিনতলায় নিয়ে গিয়ে রুহানিকে ধর্ষণ করলো। আরাফ তাদের আটকানোর জন্য আশেপাশের অনেকজনকে ডাকলো। কিন্তু কেউই এগিয়ে এলো না। আরাফ তখন নিজেই গেলো। কিন্তু রুহানির অবস্থা দেখে সে নিজেও আর তাদের আটকানোর সাহস পেলো না৷ সে অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এরপর সেই অবস্থায় সে একটা গাড়ি নিয়ে বাসায় এসে বাবা-চাচাদের জানালো। তারা পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে শুধু রুহানিকেই পেলো। সেই ছেলে দুইটাকে আর পেলো না। এরপর রুহানিকে হাসপাতালে ভর্তি করার চারদিন পর সে মারা গেল। পরে অবশ্য সেই ছেলে দুইটাকে গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে আরাফ নিজেকে রুহানির অপরাধী ভেবে এসেছে। আরাফ এতোটা বছর রুহানিকে মনপ্রাণ দিয়েই ভালোবেসেছিল। আর এখন দ্বিতীয় বারও কাউকে ভালোবেসে হারিয়েছে।
জীবনে সবাই সবকিছু পায় না। আর এই না পাওয়ার মাঝেই জীবনের সমাপ্তি ঘটে যায়। জীবনে আক্ষেপ রেখে লাভ নেই, কারণ সৃষ্টিকর্তা হয়তো সেই আক্ষেপের মাঝেই কোনো মুক্তি রেখেছেন। দিনশেষে মুক্তিটাই আক্ষেপের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অভাগী সায়ন্তনী তার দুর্ভাগ্য নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। আর এই জীবনসংগ্রাম থেকে নিজেকে মুক্তি দিয়েছে। তার গুরুত্বটাও মানুষকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেছে।
চলবে–
#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০১||
৬১.
খুব সাদামাটাভাবেই একটা বছর কেটে গেলো। এই একটা বছর ব্যস্ততার মাঝেই নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিল আরাফ। এখন সে পড়াশুনা নিয়েই খুব ব্যস্ত। কলেজ থেকে টিউশন, টিউশন থেকে বাসা, এভাবেই তার দিন কাটছে। টিউশনের অর্ধেক টাকা সে সায়ন্তনীর মায়ের হাতে দিয়ে দেয়। সায়ানকেও স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে আরাফ। তাদের ভালো বাসায়ও নিয়ে এসেছে। এখন সায়ন্তনীর মা তার ছেলেকে নিয়ে শতাব্দীদের মহল্লায় থাকেন। তারা এখন আগের তুলনায় স্বচ্ছল জীবনযাপন করছেন।
কাছের মানুষকে হারালে, অনেকেই পাথর হয়ে যায়৷ আর আরাফ গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হয়ে গেছে। সে হাসে না, কারো সাথে আড্ডাও দেয় না। সে কেমন যেন চুপসে গেছে। তবে সায়ন্তনীর মৃত্যু শুধু আরাফকে পরিবর্তন করে নি, ইমনকেই হয়তো সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন তার মধ্যে আর চঞ্চল ইমনকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আগের সেই ইমন এখন পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। এখন সে পড়াশুনায় খুবই মনোযোগী হয়েছে। পাশাপাশি ছোট একটা ব্যবসা করছে। তবে মাওশিয়াতের সাথে তার সম্পর্কটা ভালোই চলছে। মাওশিয়াত তার বাবা-মাকে ইমনের ব্যাপারে জানালে তারাও আর আপত্তি করেন নি। আর তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, মাওশিয়াতের পড়াশুনা শেষ হলেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেবেন। তবে ইমন মিস্টার মিরাজ আর মিসেস তিশাকে জানিয়ে দিয়েছে, বিয়ের পর মাওশিয়াত তার সাথে বাংলাদেশেই থাকবে। তবে ছুটিতে তাকে কলকাতায় নিয়ে আসবে৷ ইমনের এ প্রস্তাবে মিরাজ হোসেনের একটু আপত্তি ছিল। কারণ মাওশিয়াত তাদের একমাত্র মেয়ে। কিন্তু শেষে মেয়ের অতিরিক্ত ইচ্ছে দেখে তিনি আর কিছু বললেন না।
আর মাত্র এক বছর, এরপর ইভান আর আরাফ ছাড়া বাকী চারজনেরই পড়াশুনা শেষ হয়ে যাবে। এদিকে রহমত চাচাকে তারা জানিয়ে দিয়েছে আগামী বছর দেশে ফিরবে। ইমন এসেই মৈত্রী গ্রুপের দায়িত্ব নেবে। যদিও মৈত্রী গ্রুপটির এখন আর কোনো অস্তিত্বই নেই। শুধু কোম্পানির সেই পুরোনো ফ্যাক্টরি আর ভবনটি এখনো পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। এখনো জায়গাটা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়া হয় নি। আর কেউ সেই জায়গার দাবী নিয়েও আসে নি। তবে এতোবছরেও যেহেতু জায়গাগুলো অক্ষত আছে, তাহলে আরো এক বছর অক্ষত থাকবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিকেলে রান্নাঘর থেকে চায়ের ট্রে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এলো অরুণিকা। ইভান, ইমন, আহনাফ আর তূর্য সোফায় বসে আছে। তাহমিদ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“আরাফ কোথায়?”
আরাফ গোসল সেরে চুপচাপ সোফায় বসে চায়ের কাপ হাতে নিলো। সবাই চুপচাপ চায়ে মনোযোগ দিলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই৷ এদিকে অরুণিকা একপাশে বসে আহনাফের ফোনে গেইমস খেলছে। সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে এবার আহনাফ বলল,
“আমি এই সপ্তাহে আমার শখের বাইক কিনতে যাচ্ছি।”
আহনাফ কথাটি বলেই সবার মুখের দিকে তাকালো। অরুণিকা উৎসুক কন্ঠে বলল,
“আমিই কিন্তু প্রথম তোমার বাইকে চড়বো।”
আহনাফ হেসে বলল, “আচ্ছা।”
এবার তূর্য বলল,
“আমার একটা ভালো প্ল্যান আছে। আমরা তো আগামী বছর দেশে ফিরবো। ইভান আর আরাফই হয়তো এখানে আরো এক বছর থাকবে৷ এখন এখান থেকে যাওয়ার আগে আমাদের একটা ট্যুর দেওয়া উচিত।”
আহনাফ বলল,
“তুই আমার মনের কথা বলেছিস।”
তাহমিদ বলল,
“আমার তো সমস্যা নেই। কিন্তু বাকীরা….”
সবাই আরাফের দিকে তাকালো। অরুণিকা সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে আরাফের পাশে এসে বসলো। আরাফ অরুণিকার দিকে একনজর তাকিয়ে আবার চায়ে মনোযোগ দিলো। অরুণিকা বলল,
“আরাফ, তুমি যদি না যাও, তাহলে আমিও যাবো না। তুমি আমাকে স্কুলের পিকনিকে যেতে দাও নি। বলেছ তোমরা ঘুরতে নিয়ে যাবে। এখন তোমরাই সারাদিন বাসায় বসে থাকো।”
আরাফ বলল,
“অরু আমাকে জোর করো না। আমার পড়াশোনা আছে।”
“এতো পড়াশুনা করে কি হবে? শেষমেশ তো ডাক্তারই হবে, তাই না? তো ডাক্তার যেহেতু কাল পরশু হবেই, তাহলে এখন কেন রোগীদের মতো আচরণ করছো?”
“আমি রোগীদের মতো আচরণ করছি?”
“হ্যাঁ, তুমিই তো বলেছ একা একা থাকা একটা মানসিক রোগ।”
আরাফ চুপ করে রইলো। অরুণিকা বলল,
“এখন যাবে কি যাবে না, তা-ই বলো।”
আরাফ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আচ্ছা, যাবো।”
করিম সিদ্দিক ছেলের সাথে বসে এই বছর কোথায় ঘুরতে যাবেন, তাই ভাবছেন। একমাস হলো তিনি দেশে ফিরেছেন। প্রতিবারের মতো এবারও তিনি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশে ডুব দিতে চাচ্ছেন। আদিল বাবাকে বলল,
“আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল দার্জিলিং যাওয়ার। এবার বরং আমরা সেখানেই যাই।”
করিম সিদ্দিক ছেলের মতামতে সম্মতি দিয়ে স্ত্রীকে ডেকে বললেন,
“কই শুনছো। এবার আমরা দার্জিলিং যাবো ভাবছি।”
মিসেস জুলেখা রুম থেকেই চেঁচিয়ে বললেন,
“তোমরা বাবা-ছেলে মিলে ঘুরাঘুরি করে টাকাগুলোই শুধু নষ্ট করবে, আর তো কোনো কাজ নেই।”
করিম সিদ্দিক এবার মেয়েকে ডেকে বললেন,
“মা, কোথায় তুমি?”
উপমা বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার স্টারের গান শুনছে। কানে হেডফোন থাকায় সে বাবার ডাক শুনতে পায় নি। আদিল বোনের রুমে এসে দরজা ধাক্কা দিতেই উপমা নড়েচড়ে বসলো। আদিল রুমে এসে চেয়ার টেনে বসলো। উপমা বলল,
“জানি এখানে কেন বসেছ। তোমরা দু’জন ঘোরার প্ল্যান করে, এখন আমাকে মায়ের কাছে পাঠাবে রাজী করানোর জন্য। শুনো, আমি কোথাও যাচ্ছি না, ভাই।”
“তুই এতো নিরামিষ কেন বল তো?”
“দেখ, ভাই। আমার ঘুরতে ভালো লাগে না। আর ওখানে নেটওয়ার্ক না থাকলে আমি আমার স্টারের কোনো আপডেটই পাবো না।”
আদিল বিরক্ত হয়ে বলল,
“মানুষ ট্যুর দেওয়ার জন্য সঙ্গী পায় না, আর তুই স্বয়ং নিজের বাবার কাছ থেকে অফার পেয়ে মানা করে দিচ্ছিস! তোর মতো মেয়েকে জেলখানায় বন্দি করে রাখলেও কোনো সমস্যা হবে না।”
“হ্যাঁ হবে না। আমাকে শুধু আমার স্টারের গান শুনতে দিলেই হবে। আমার আর কিচ্ছু লাগবে না।”
আদিল উপমাকে রাজি করাতে না পেরে একরাশ হতাশা নিয়ে বাবার কাছে ফিরে এলো।
এদিকে তূর্য আর আহনাফ অনেক চিন্তাভাবনা করে দার্জিলিং যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। সবাই তাতে মত দিতেই অরুণিকা বলল,
“আমি যদি পাহাড় থেকে পড়ে যাই?”
আহনাফ বলল,
“বেহুশের মতো হাঁটলে তো পড়বেই।”
“দেখো আমি বেহুশের মতো হাঁটি না। তোমরাই তো সব জিনিসপত্র এদিক-ওদিক ছড়িয়ে রাখো।”
“হ্যাঁ পাহাড়েও তোমার জন্য সব কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়েই রাখা থাকবে। সোজাসুজি রাস্তা তুমি কোথাও পাবে না। তাই তোমাকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।”
অরুণিকা বুকে হাত গুঁজে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আমি ওখানে যাবো ঠিক আছে, কিন্তু আমার তো কোনো ভালো জামা নেই।”
এবার তূর্য বলল,
“আজই তোমাকে শপিংয়ে নিয়ে যাবো।”
“কিন্তু আমি বাইকে করেই শপিং করবো।”
“আচ্ছা, তাহলে আহনাফ নিয়ে যাবে।”
“না ওর সাথে যাবো না। ও অনেক কিপটে৷ দোকানদারের সামনে আমাকে বকাঝকা করে।”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আর তুমি মার্কেটে গেলে আমার পুরো মানিব্যাগ খালি করে আসো। আর আমি দর কষাকষি করবো না? দর করি দেখেই একটার পরিবর্তে চারটা জিনিস কিনতে পারো।”
তূর্য অরুণিকাকে বলল,
“দর কষাকষি করতে হয়, টুইংকেল।”
অরুণিকা বলল, “তুমি তো করো না।”
আহনাফ বলল,
“লাখপতি তাই। একটা এলবাম বের হলেই তো ও লাখপতি হয়ে যায়। তুমি বরং লাখপতির সাথেই ঘুরো। আমার বাইকের দিকে নজর দিও না।”
অরুণিকা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“আমি তো মজা করেছি। সত্যি সত্যি বলি নি তো।”
আহনাফ বাঁকা হেসে সোফায় গিয়ে বসলো। অরুণিকা আহনাফের পাশে বসে বলল,
“আমি কিন্তু প্রথম তোমার বাইকে চড়বো বলেছি। আর ছোটদের দিয়ে কিছু শুরু করলো বরকত আসে।”
আহনাফ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“তুমি ছোট?”
“অবশ্যই। আঠারো বছরের নিচে সবাই শিশু।”
অরুণিকা কথাটি বলেই দাঁত বের করে হাসি দিলো। পরের দিন আহনাফ তার বাইক বের করলো। অরুণিকা গ্যারেজে এসে বাইকটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। আহনাফ বুকে হাত গুঁজে অরুণিকার সেই হাসিটাই দেখছে। এবার সে নিজে হেলমেট পরে অরুণিকাকেও ছোট একটা হেলমেট পরিয়ে দিলো৷ তারপর বাইকে উঠে বসলো। বাইক সোজা করে চাবি ঘুরিয়ে বলল,
“উঠে বসো।”
অরুণিকা বলল,
“আমি উঠতে পারবো না।”
“এই হাতলের ভার দিয়ে উঠো।”
অরুণিকা হাতলের উপর পা দিয়ে সিটের উপর ঝুলে পড়লো। তার পা দু’টি একপাশে ঝুলছে, মাথাটা অন্য পাশে ঝুলছে। ইমন দূর থেকে অরুণিকাকে দেখে হেসে দিলো। আহনাফ পিছু ফিরে দেখলো অরুণিকা বাইকের উপর ঝুলে আছে। সে বিরক্তির সুরে বলল,
“বানরের মতো ঝুলে আছো কেন? সোজা হয়ে বসো।”
অরুণিকা আবার হাঁটু দুইটা বাইকের উপর উঠিয়ে পেছন দিক থেকে আহনাফের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“আহনাফ, আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। আমি পড়ে গেলে?”
ইমন তাদের কাছে এসে অরুণিকাকে ধরে সোজা ভাবে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“এভাবেই বসতে হয়।”
অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“আমি কিভাবে বুঝবো, আমি আগে কখনো বাইকে উঠেছি, বলো?”
আহনাফ বাইক স্টার্ট দিয়ে বলল,
“শক্ত করে ধরে বসো।”
অরুণিকাও আহনাফের কথামতো তাকে এতো শক্ত করেই চেপে ধরেছে যে তার শার্টটাই নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“অরু, আমার শার্টের ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি তো তোমাকে এভাবে চেপে ধরতে বলি নি।”
“তোমার এই শার্ট বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাকি আমি?”
আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা বলল,
“আরেহ এভাবে চোখ দুইটা জোঁকের মতো না বাঁকিয়ে বাইক সামনে নিয়ে যাও। এখনো এক জায়গায় বসে আছো কেন?”
আহনাফ বাইক চালিয়ে গ্যারেজ থেকে বের হতেই অরুণিকা বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“রোলারকোস্টারের মতো টানছো কেন? আস্তে চালাও।”
“এটা রিক্সা না যে আস্তে চলবে।”
“এইটা কেমন বাইক! দুইপাশে হ্যান্ডেল রাখবে না? এখন আমি পড়ে গেলে?”
“আজব তো! তোমার জন্য নতুন পদ্ধতিতে কে বাইক তৈরী করবে? বাইক এমনই হয়। চড়লে চড়ো, নয়তো নামো। আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করো না।”
অরুণিকা আহনাফের কথায় চুপ হয়ে গেল। কিন্তু অর্ধেক যেতে না যেতেই সে চিৎকার করতে লাগলো। আহনাফ বাইক থামিয়ে বলল,
“তোমার কি মাথায় সমস্যা আছে?”
অরুণিকা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
“তোমার বাইক তো রোলারকোস্টারের চেয়েও বেশি ভয়ংকর। আমি যাচ্ছি না তোমার সাথে।”
অরুণিকা বাইক থেকে নামার আগেই আহনাফ বলল,
“আচ্ছা, তুমি সামনে বসো। তখন আর ভয় পাবে না।”
আহনাফ অরুণিকাকে সামনে বসিয়ে আবার বাইক স্টার্ট দিলো। অরুণিকা যদিও এবার চুপচাপ বসে রইল, কিন্তু সে তার হাত দুইটা আহনাফের হাতের সাথে পেঁচিয়ে রেখেছে। এরপর শপিং শেষে ফেরার সময় অরুণিকা আহনাফের দিকেই ঘুরে বসলো। আহনাফ বলল,
“এভাবে বসেছো কেন, সোজা হয়ে বসো।”
অরুণিকা বলল,
“রাস্তার দিকে তাকাতে ভয় লাগছে।”
“তাহলে চোখ বন্ধ রাখো।”
“না।”
অগত্যা আহনাফ রাজি হলো। অরুণিকা যদিও নিজের সুবিধামতো বসলো। কিন্তু আহনাফের খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। অরুণিকা আহনাফের মনের অবস্থা বুঝতে পারলো না। এই বয়সে তার বোঝার কথাও না। ছোটবেলা থেকেই সে ছ’জনের কোলে কোলেই বড় হয়েছে। তাই সে বুঝতে পারছে না, সে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।
আহনাফ দাঁতে দাঁতে চেপে রেখেছে। বাইকের হাতলটাও শক্ত করে ধরে রেখেছে, তার দৃষ্টি একদম সামনের দিকে। যতোটুকু সম্ভব বাইকের স্পিড বাড়িয়ে সে বাসায় পৌঁছালো। অরুণিকা নামতেই সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এদিকে অরুণিকা প্যাকেটগুলো নিয়ে ধিন ধিন করে উপরে চলে গেলো। আর আহনাফ বাইক গ্যারেজে পার্ক করিয়ে সামনের দোকান গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো৷ ইদানীং তার এই বাজে অভ্যাসটা বেড়ে যাচ্ছে। ইমন থেকেই মূলত এই অভ্যাস তার কাছে এসেছে। সায়ন্তনীর মৃত্যুর পর থেকেই মানসিক চাপ মুক্ত থাকার জন্য ইমন সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে। কারণ তার মনে হচ্ছে, একটা অসুস্থ মানুষকে সে অনেক বড় আঘাত দিয়েই এই পৃথিবী থেকে বিদায় দিয়েছে। আর ইমনের দেখাদেখি এখন আহনাফও সিগারেট খায়। দু’জনই মানসিক চাপে আছে। ইমনের মানসিক চাপের যথাযথ কারণ আছে, কারণ আরাফ সায়ন্তনীর মৃত্যুর পর থেকেই চুপচাপ হয়ে গেছে, আর তার সাথে অনেক কম কথা বলে। অন্যদিকে আহনাফ অরুণিকার কাছে আসা, দূরে যাওয়া, তূর্যের সাথে সখ্যতা, তার অভিযোগের কারণ হওয়া, মোটামুটি অরুণিকার সব বিষয়েই সে মানসিক চাপে পড়ে যায়। এখন অরুণিকা যতোই বড় হচ্ছে, আহনাফ ততোই পাগল হয়ে যাচ্ছে। তাকে হারানোর ভয় আগে থেকে আরো বেশি বেড়েছে। আর অনুভূতিগুলো দিন দিন গাঢ় হয়ে যাচ্ছে।
চলবে —
#অরুণিকা
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব-০২||
৬২.
উপমা ফোন হাতে নিয়ে খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। পাশেই তার ভাই আদিল দাঁড়িয়ে আছে। বোনকে লাফাতে দেখে সে বলল,
“এভাবে ক্যাঙ্গারুর মতো লাফাচ্ছিস কেন?”
“ভাইয়া, রিকি নতুন গান ছেড়েছে। ওয়াও।”
উপমা হেডফোন লাগিয়ে ফোনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলো। আদিল বোনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলো। ভিডিওটা একটা কটেজের সামনে করা হয়েছে। সামনে একটা উঁচু ঢিপিতে পা রেখে গিটার হাতে নিয়ে রিকি দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনের ঢালু বেয়ে নেমে গেছে ছোট ছোট ঘাসের সারি। নিচে আরো কটেজ দেখা যাচ্ছে, আর মুখোমুখিতে অনেকগুলো পাহাড়। সব পাহাড়ের গায়ে লেগে আছে সাদা সাদা মেঘ। ভিডিওটা পেছন দিক থেকে করা হয়েছে। আর রিকি গিটার বাজিয়ে তিনটা গানের মিশ্রণে ভিডিওটি বানিয়েছে। উপমা চোখ বন্ধ করেই সেই গান শুনছে।
“ইয়ে দোস্তি…হাম নাহি তোরেঙ্গে,
তোরেঙ্গে দাম আগার, তেরা সাথ না ছোড়েঙ্গে
.
ধারকান ইয়ে কেহতি হে,
দিল তেরে বিন ধারকে না,
এক তুহি ইয়ার মেরা
মুঝকো কিয়া দুনিয়া সে লেনা….
.
উড়ি একসাথে নীলে নীলে,
উড়ি একসাথে মিলে ঝিলে।
চল বন্ধু চল, চল বন্ধু চল, চল বন্ধু… চল।
.
তেরি জিত মেরি জিত,
তেরি হার মেরি হার
শুন ইয়ে মেরা ইয়ার
তেরা গাম মেরা গাম
তেরি জান মেরি জান
এইসে আপনা পিয়ার
জান পে ভি খেলেঙ্গে
তেরা লিয়ে লে লেঙ্গে
সাবসে দুশমানি
ও…
.
উড়ি একসাথে নীলে নীলে,
উড়ি একসাথে মিলে ঝিলে।
চল বন্ধু চল, চল বন্ধু চল, চল বন্ধু… চল।
.
লাগলে বলিস,
জায়গায় বসে আওয়াজ দিস।
কলিজাটা ছিঁড়ে তোকে দেবো
লবণ মাখিয়ে নিস।
একা লাগলে বলিস,
মনে মনে আমার নামটা নিস,
তোর মুড অন করে দেবো,
একটা ট্রিট দিয়ে দিস।
উড়ি একসাথে নীলে নীলে,
উড়ি একসাথে মিলে ঝিলে।
চল বন্ধু চল, চল বন্ধু চল, চল বন্ধু… চল।”
ভিডিওটা শেষ হওয়ার পর উপমা একটা প্রশান্তির হাসি হাসলো। মনে মনে বলল,
“যার কন্ঠ এতো মিষ্টি, সে দেখতে কেমন হবে? তার মনটা কেমন হবে? রিকি, দা স্টার… না, না, মাই স্টার। আমি তোমাকে না দেখেই ভালোবেসে ফেলেছি। এটা কি সম্ভব? কাউকে কি না দেখে ভালোবাসা যায়?”
এদিকে তূর্য পেছন ফিরে তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। আহনাফ এতোক্ষণ বসে বসে তার ভিডিও শুট করছিল। তূর্য আরাফ আর ইমনের মাঝখানে বসে বলল,
“শুনেছি বন্ধুরা পরিবারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কখনোই হয় না। কিন্তু আমরা পরিবার হারিয়ে যেই পরিবার পেয়েছি, সেটা আমাদের বন্ধুত্ব থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ছোটবেলা থেকেই বন্ধু। কিন্তু পরিবারের মতো আছি আজ আট বছর ধরে। অতীতে যা হয়েছিল, সব ভুলে আমাদের একটা নতুন জীবন শুরু করা উচিত। প্লিজ, আগের সবকিছু ভুলে যা।”
তূর্যের কথা শুনেও আরাফের কোনো হেলদোল দেখলো না ইমন। এখনো আরাফ চুপ করে বসে আছে। এবার ইমন শুকনো হাসি দিয়ে পকেট থেকে একটা সিগারেটের পকেট বের করলো। তারপর ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট রেখে বলল,
“পাপীদের সাথে কোনো বন্ধুত্ব হয় না। আমি তো পাপী। আমি তো খুনী।”
আরাফ রাগী দৃষ্টিতে ইমনের দিকে তাকালো। ইমন সিগারেট জ্বালানোর আগেই সে সিগারেটটা টেনে নিয়ে বলল,
“এমন শান্তির পরিবেশটা কি দূষিত করবি?”
ইমন বলল,
“আমার একটা সিগারেটে এই পরিবেশ দূষিত হবে না।”
“এখানে অরু আছে। তোর জন্য অরুর সমস্যা হবে।”
অরুণিকা নিজের নাম শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাদের দিকে তাকালো। এতোক্ষণ সে অন্যদিকে তাকিয়ে মানুষের যাওয়া-আসা দেখছিল। এবার ইমন বলল,
“অরুণিকার এতো আহামরি ক্ষতি হবে না৷ ক্ষতি হলে আমি অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি।”
ইমন উঠতে যাবে তখনই আরাফ বলে উঠলো,
“সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।”
“আমাকে তোর ডাক্তারি জ্ঞান দিতে আসিস না।”
তূর্য হাত উঁচু করে তাদের মাঝখান থেকে উঠে একপাশে এসে দাঁড়ালো। তাহমিদ তার পাশে এসে বলল,
“আগুনে ঘিঁ ঢেলে দিয়েছিস।”
“থাক, এই ঘিঁ যদি এখন পানিতে রূপান্তর হয়, তখনই আবার সব ঠিক হবে।”
অনেকক্ষণ ধরেই ইমন আর আরাফের বাকবিতণ্ডা চললো। এক পর্যায়ে দু’জনই শান্ত হয়ে দু’দিকে চলে গেলো। ইভান বলল,
“শতাব্দীকে আনলাম না, মাওশিয়াতকে আনতে পারবো না তাই। আরাফ আবার মাওশিয়াত আর ইমনকে দেখলে আরো মন খারাপ করে ফেলবে। কিন্তু শতাব্দী আসলে ভালোই লাগতো। মেয়েটা ভালোই রসিক।”
তূর্য বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
“বাহ, ইভান দেখছি শতাব্দীকে খুবই মিস করছিস!”
তাহমিদ ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই ওকে মিস করছিস?”
আহনাফ, তূর্য আর ইভান তাহমিদের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে দিল। তাহমিদ বলল,
“তোরা হাসছিস কেন? অদ্ভুত তো!”
তাহমিদ উঠে একপাশে চলে গেলো। সে এখন হাঁটতে পারে। তবে বেশিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে তার হাঁটুতে ব্যথা করে, এমনকি সে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকতে পারে না।
এদিকে উপমা রিকির সেই ভিডিওটির কমেন্ট বক্সে ঘুরে এলো। সবার কমেন্ট দেখে সে বুঝলো, রিকি দার্জিলিং থেকেই এই ভিডিওটি ছেড়েছে। সে শুধু রিকিকে একনজর দেখার জন্য দৌঁড়ে বাবার কাছে গিয়ে বলল,
“আমি দার্জিলিং যেতে চাই।”
উপমার কথা শুনে আদিল আর করিম সিদ্দিক অবাক হয়ে উপমাকে দেখছে। আদিল কি ভেবে তার ফোনটা হাতে নিলো। তারপর কিছুক্ষণ পর বলল,
“আচ্ছা, তা-ই?”
করিম সিদ্দিক বললেন, “কি তাই?”
আদিল বলল,
“তোমার মেয়ের সেই রিকি দা স্টার এখন দার্জিলিংয়ে।”
“তুই কিভাবে জানলি?”
“আরেহ, তোমার মেয়েই তো জোর করে আমাকে সেই রিকির পেইজ আর ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করিয়েছে। এখন সেই ছেলের সব আপডেট আমার ফোনেও আসে।”
মিসেস জুলেখা নাক সিঁটকে বললেন,
“রিকি! কেমন জঙ্গলি নাম! নাম শুনেই মনে হচ্ছে কোনো বখাটে ছেলে।”
উপমা রাগ দেখিয়ে বলল,
“মা, রকস্টারদের নাম এমনই হয়।”
এবার উপমার জোরাজুরিতে মিসেস জুলেখাও রাজি হতে বাধ্য হলেন। করিম সিদ্দিক আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। কারণ তিনি স্ত্রী-কন্যাকে আজকেই রাজি করিয়ে দার্জিলিং যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেন। কিন্তু এখন উপমা নিজ থেকেই রাজি হয়ে গেছে, তাই তাকে আর কষ্ট করতে হয় নি। পরেরদিন উপমা তার বাবা-মা আর ভাইয়ের সাথে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্য রওনা দিলো।
৬৩.
রাস্তার দু’পাশে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আছে এক একটা কাঠের তৈরী কটেজ। পাশাপাশি দুইটা রুমের একটা কটেজে তারা উঠলো। সামনের কটেজে তাহমিদ, তূর্য আর ইভান। এর পাশের কটেজে আরাফ আর অরুণিকা। দূরের আরেকটা কটেজে ইমন আর আহনাফ উঠেছে। তারা সকালে নাস্তা করেই পাহাড়ের রাস্তা বেয়ে চা বাগানের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগল। একপাশে ঢালু রাস্তা নিচে নেমে চমৎকার দৃশ্য তৈরি করেছে, অন্যপাশে সবুজ ঘাসে ছেয়ে থাকা ছোট ছোট টিলার মতো উঁচু রাস্তাগুলো সরু হাঁটার পথটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। অরুণিকা আহনাফের টি-শার্টের কোণা ধরে পাহাড়ের নিচের দিকে পা উঁচিয়ে দেখছে। আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“তুমি আমার টি-শার্টটা নষ্ট করে ফেলছো। এভাবে ভাঁজ করে ফেলছো কেন? ছাড়ো তো।”
অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে আরো শক্ত করে টি-শার্টটা আঁকড়ে ধরলো। টি-শার্টের অনেকখানি অংশ অরুণিকার হাতের মুঠোয় চলে আসায়, আহনাফের টি-শার্টের গলাটা নিচের দিকে নেমে গেছে। যার ফলে তার অনেক অস্বস্তি লাগছিল। সে অরুণিকার হাতের মুঠো থেকে তার টি-শার্টের অংশটি ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে শান্তিতে হাঁটতে দাও।”
অরুণিকা মুখ বাঁকিয়ে সামনে গিয়ে তূর্যের শার্ট খামচে ধরে বলল,
“রকস্টার, আমার ভয় লাগছে। আমি তোমার শার্ট ধরে রাখি?”
তূর্য মুচকি হেসে বললো, “আচ্ছা।”
অরুণিকা মুচকি হেসে পেছনে ফিরলো। আহনাফ ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে সামনে ফিরলো। আহনাফ তাদের পাশ কেটে আরো সামনে এগিয়ে গেলো।
এদিকে উপমা তার পরিবারের সাথে ভারতে চলে এসেছে। করিম সিদ্দিক ট্রেনের টিকেট কেটে নিলেন। এরপর তারা ট্রেনে উঠে বসলো। ট্রেনটি শুকনো বনের ভেতরে দিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনের গতি সাধারণ গতির তুলনায় কম। আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে ট্রেনটি যাচ্ছে। উপমা জানালার বাইরে তাকিয়ে রিকির ভাবনায় ব্যস্ত। প্রতিটা রাস্তা পার করতেই তার মন তাকে বলছে,
“এই রাস্তা দিয়েই হয়তো রিকি এসেছে। এই রাস্তাটা রিকির পরিচয়ের সাক্ষী হয়ে আছে। এই পথ, তুমি কি আমার সাথে একটু কথা বলবে? তুমি কি বলবে রিকি দেখতে কেমন? ও যখন গানের ফাঁকে হাসে, তখন ওর হাসিটা কল্পনায় আমার কাছে স্বপ্নে দেখা ঝর্ণার মতো, একদম চঞ্চল, আর দুর্লভ। ও বাস্তবেও কি ঠিক আমার স্বপ্নের মতোই হাসে?”
উপমা এসব ভাবছে, আর আনমনে হাসছে। আদিল বোনকে ধাক্কা দিতেই উপমা নড়েচড়ে বসলো। আদিল বলল,
“একা একা হাসছিস কেন? মাথা কি আউট হয়ে গেছে?”
উপমা হেসে বলল,
“হ্যাঁ। জানো, আমার ভাবতেই অনেক ভালো লাগছে যে আমি রিকিকে দেখবো।”
“এতোগুলো মানুষের মধ্যে তুই রিকিকে কিভাবে চিনবি? তুই তো ওর চেহারায় দেখিস নি।”
“ভাইয়া, মাঝে মাঝে তো একটু বুদ্ধিমানের মতো কথা বলো। রিকি একজন স্টার৷ ওর মধ্যে আলাদা একটা ভাব থাকবে। হাতে গিটার থাকবে। আশেপাশে ভীড় থাকবে।”
“ওকে তো কেউই দেখে নি। ভীড় কেন থাকবে?”
“আমার মনে হচ্ছে ভীড় থাকবে। স্টাররা এমনই হয়। কেউ না চিনলেও সবার কাছে পরিচিতি পায়।”
আদিল বোনের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকালো। দার্জিলিং পৌঁছে তারা একটা রিসোর্টে উঠল। তূর্যরা যেই রিসোর্টে উঠেছিল, সেটা ওতো বেশি উন্নতমানের না। আর উপমারা এখানকার সবচেয়ে উন্নত রিসোর্টেই উঠেছে।
রাতে কটেজের বাইরে বসে দাঁড়িয়ে গান গাইছে তূর্য। ঘুমানোর আগে সেই গানটিও পেইজে আপলোড করেছে সে। উপমা রুমে শুয়ে শুয়ে সেই গানটি শুনছে। গান শুনার পর সে কমেন্টে লিখল,
“তোমাকে দেখার ইচ্ছেটা কি স্বপ্নই থেকে যাবে?”
এদিকে আহনাফ বসে বসে তূর্যের পেইজের কমেন্ট পড়ে সবাইকে শুনাচ্ছে। তাহমিদ এসব কমেন্টগুলো শুনে বলল,
“শুনেছি, ছেলেরাই মেয়েদের পিছনে ঘুরতে থাকে। কিন্তু মেয়েরাও যে কম না, আজ এই কমেন্টগুলো দেখেই বুঝেছি।”
ইভান বলল,
“সবকটাই ছ্যাঁচোর। ভদ্র মেয়েরা এমন উদ্ভট কমেন্ট করবে না।”
তূর্য বাঁকা চোখে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর তো মন বলতে কিছুই নেই। তাই তোর এসব উদ্ভট লাগছে। এগুলোকে বলে ভালোবাসা। দেখ, রিকি দা স্টারকে ভালোবাসে না এমন মেয়ে খুঁজে পাবি না। তোকে ক’জন বাসে?”
“আমার এতো ভালোবাসার প্রয়োজন নেই।”
পরের দিন সকালে তারা আবার ঘুরতে বেরিয়ে পড়লো। তারা ক্যাবল কারে উঠলো, যা মাটি থেকে প্রায় সাত হাজার ফুট উঁচুতে। ক্যাবল কারটি মেঘের ভীড়ে চলছে। অরুণিকা উৎসুক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। আর আহনাফ অবাক হয়ে অরুণিকাকে দেখছে। তার চাহনী দেখে আরাফ তাকে হালকা ধাক্কা দিতেই সে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। আরাফ ইশারায় তাকে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে বলল। ক্যাবল কার থেকে নেমে আরাফ আহনাফকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বলল,
“আহু, কি করছিলি তুই?”
আহনাফ আমতা-আমতা করে বলল,
“কি করছিলাম আমি?”
“তোর চোখ-মুখ দেখে সব বোঝা যাচ্ছে। অরু থেকে একটু দূরত্ব রাখার চেষ্টা কর।”
“কেন দূরত্ব রাখবো? তুই তো জানিস….”
আরাফ আহনাফকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ওর প্রেম করার বয়স হয় নি। ও এখন সব বুঝে। দেখিস না ইমন আর মাওশিয়াতকে একসাথে দেখলে কিভাবে হাসে। আর শতাব্দীও বাসায় আসলে ও তাহমিদকে শতাব্দীর সাথে ব্যস্ত রাখার ফন্দি আঁটে। এখন তোরটা বুঝলে তুই ঘরে থাকতে পারবি?”
“ঘরে থাকতে পারবো না কেন?”
“অস্বাভাবিক লাগবে দেখতে৷ বুঝিস না কেন এসব?”
“তো, তুই কি বলতে চাচ্ছিস? আমি ওকে ভুলে যাবো?”
“না আহনাফ। আগে ওর আঠারো হোক। এরপর আমি তোদের বিয়ে দিয়ে দেবো৷ এখন বাকিরাও এসব জানে না। ইভান হয়তো একটু আধটু বুঝে। কিন্তু ও নিজেও এটা নিয়ে কথা উঠাচ্ছে না। কেন বুঝতে পারছিস নি?”
“কেন?”
“দেখ, এখন ইমন আর মাওশিয়াত একটা সম্পর্কে আছে। কিন্তু তারা আলাদা বাসায় থাকছে। তাই বিষয়টা দেখতে ওতোটা খারাপ লাগছে না। আর তুই এখন আগাতে চাইলে এক ঘরে থাকলে সুন্দর দেখাবে না৷ সারাদিন তখন একসাথে সময় কাটাবি। তখন কোনো কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ হারালে, এসব আমরা নিতে পারবো না। ও আগে বড় হোক। এরপর একেবারে বিয়েই হবে। এর আগে কিছুই না।”
আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“ওতো আমাকে পছন্দ করে না।”
আরাফ এবার জোর গলায় বলল,
“ওর এখন এসবের বয়স হয় নি। বারো বছরের মেয়ের সাথে কি প্রেম করবি তুই? মাথা ঠিক আছে তোর?”
আরাফের ধমক খেয়ে আহনাফ চুপ হয়ে গেলো। বাকি সময়টা সে অরুণিকার আশেপাশেও যায় নি। দূর থেকেই তাকে দেখেছে।
এবার তারা চুন্নু সামার ফল পার্কে টিকেট কেটে ঢুকলো। তারা ঢোকার একটু পরই আদিল চারটা টিকেট কাটলো। করিম সিদ্দিক তার স্ত্রী জুলেখার হাত ধরে একপাশে হাঁটছেন। আদিল ক্যামেরা হাতে আশেপাশের ভিডিও ধারণ করছে। আর উপমা এখনো কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনায় ব্যস্ত। সে গান শুনে শুনে হাঁটছে।
এদিকে তূর্য ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ঝর্ণার পানি উপর থেকে বেয়ে পাথরের ফাঁক দিয়ে ধেয়ে চলছে। আর পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে সেই পানি ধারার চমৎকার ধ্বনি সৃষ্টি হচ্ছে। তূর্য মনে মনে ভাবছে, গিটার সাথে থাকলে এখানে বসে একটা ভিডিও শুট করা যেতো। তখনই একটা শব্দ কানে আসতেই সে পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলো, ভেজা রাস্তায় পা ফেলতে গিয়ে একটা মেয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেছে। মেয়েটার ব্যথায় কাতর মুখ দেখে কেন যেন তূর্যের অনেক হাসি পেলো। যদিও সে এতোক্ষণ হাসি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছিল, কিন্তু মেয়েটি তার দিকে তাকানোর পরই সে শব্দ করে হেসে দিলো। মেয়েটি তূর্যকে হাসতে দেখে লজ্জায় একেবারে নুইয়ে পড়েছে। সে আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে লাগলো। তখনই একটা ছেলে দৌঁড়ে এগিয়ে এলো।
উপমা আদিলের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। আদিল ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“ব্যথা পেয়েছিস?”
উপমা কিছু বললো না। সে আঁড়চোখে তার সামনে থাকা ছেলেটির দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“কি অসভ্য ছেলে! একটা মেয়ে দুর্ঘটনাবশত নিচে পড়ে গেছে, আর সে দাঁত দেখিয়ে হাসছে?”
উপমা নিজের ভাব ধরে রাখার জন্য ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে জোর গলায় বলল,
“আপনার তো দেখছি বিন্দুমাত্র বিবেক নেই। রাস্তায় চলার পথে কতো এক্সিডেন্ট হয়। তখন কি আপনি এভাবে খিকখিক করে হাসেন?”
উপমার কথা শুনে তূর্যের এবার আরো বেশি হাসি পেলো। সে নিজের হাসি আটকাতে অন্যদিকে ঘুরে হাঁটতে লাগল। উপমা পিছু যাবে তখনই আদিল বলল,
“বাদ দে না। পাগল নাকি তুই? ছেলেটা হাসলে তোর সমস্যা কি?”
“ভাইয়া ওই বদমাশটা আমাকে দেখে হাসছিল।”
আদিল উপমাকে শান্ত করে তার সাথে নিয়েই হাঁটতে লাগলো। এদিকে তূর্য হাসি থামিয়ে পেছন ফিরে উপমাকে খুঁজতে লাগলো। ইভান তার সামনে এসে বলল,
“কাকে খুঁজছিস?”
“একটা আপন মানুষকে খুঁজছি।”
“মানে?”
“একটা মেয়েকে খুঁজছি। কথাবার্তার ধরণ দেখে মনে হলো আমাদের দেশের। কতো বছর পর বাংলাদেশী কন্ঠ শুনেছি!”
“কেন আমাদের কন্ঠ কি বিদেশী নাকি!”
“তা না। কিন্তু মেয়েলী কন্ঠ আট বছর পর শুনেছি৷ আর টুইংকেল তো রিমিক্স ভাষায় কথা বলে। সেই ভাষায় না আছে পুরোপুরি কলকাতার এক্সেন্ট, না আছে চট্টগ্রামের স্পর্শ। ওর কথাবার্তা শুনলে একেবারে জগাখিচুরি মনে হয়।”
ইভান হেসে বলল,
“ওর এই জগাখিচুরি ভাষাটার জন্যই ওর কথাগুলোর মধ্যে আলাদা মাধুর্য আছে। নয়তো ও যা ক্লু লেস কথা বলে, কেউ এক সেকেন্ডও শুনতে চাইবে না!”
তূর্য আরেকবার পেছন ফিরে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো,
“মেয়েটা আমাদের চট্টগ্রামের মেয়ে!”
তূর্য পুরো পার্কে শুধু উপমাকেই খুঁজেছে। সে ভাবছে, দেখা হলে হাসার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেবে৷ কিন্তু সে আর উপমাকে পেলো না।
চলবে—