#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-২
“এইডা তুমি কি কইলা আম্মা? ভাবীর লগে আমারে জড়ায় এত বড় কথাডা কেমনে কইলা!”
জমেলা বেগমের দিকে প্রশ্নখানা ছুড়তেই জমেলা বেগমের চোখ মুখ পাল্টে গেলো। একবার বড় ছেলের দিকে তাকালো, নাহ্ সজীব এখনো নিরুত্তরই আছে! এই সুযোগ!
“আমি যেইডা কইছি খারাপ মানে বাইর করতাছোস ক্যান বাপ? তুই যে মা’র মুখে মুখে কথা কস, মা’র বুঝি খারাপ লাগে না, কষ্ট লাগে না বাজান?”
বলতে বলতেই যেন কেঁদে দিবে জমেলা বেগম! চেহারায় এরকম ভাব। অথচ চোখে এক ফোঁটা ও পানির চিহ্ন নেই! শুধু মুখেই কান্না কান্না ভাব। মা’য়ের উত্তরে অতি আবেগী হয়ে উঠলেন তার বড় পুত্র। এতক্ষণ নীরব থাকলেও এবার সে নীরবতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসলো!
“আম্মা তুমি মন খারাপ কইরো না তো! শরীফ তো ছুডো মানুষ। কি কইতে কি কয়, হেইডা হেয়ও জানে না।”
“হ বাজান, পোলাডা গায়ে গতরে বড় হইছে ঠিকই। কিন্তু এখনো ছুডোই রইয়া গেলো!”
“এই পারুল? যা থালাবাসন গুলা ধুইয়া আন। আম্মা আমনে ঘরে যান।”
জমেলা বেগম ছেলের কথায় সন্তুষ্ট হলেন। মুখে দেখা দিলো তৃপ্তির হাসি! তবুও মুখ খুললেন,
“না বাপ, আমিই ধুইতে পারমু। হেই শক্তি আমার অহনো আছে।”
“থাকলেও শক্তি পরে কামে লাগাইয়েন! অহন যান ভিতরে।”
বড় ছেলের জোরাজুরিতে জমেলা বেগম ভিতরে যায়। ঠোঁটের কোনে লেগে আছে বাঁকা হাসি। পরিস্থিতি হাতের মুঠোয় রাখতে সে বেশ ভালো করে রপ্ত করেছে! চুলে পাক তো আর এমনি ধরেনি কি-না
“কি হইলো? ওমন কইরা খারাড় রইছো ক্যান? তোমারে না কইছি বাসন মাজতে।”
পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা অবলোকন করছিলো নীরবে পারুল। স্বামীর কথা শুনে কিছুটা কেঁপে উঠলো!
“যাইতাছি।”
“আমি দেহি মন্টু গো বাড়িত যাই, হেয় কামের কথা কইছিলো।”
“আমনে না শুইলেন? দুপুরবেলাই কামের খোঁজে যাইবেন গা?”
কেমন করুন কন্ঠে স্বামীর উদ্দেশ্য কথাখানা বললো পারুল।
“শুইয়া আর কি করুম? ঘুম গেছে গিয়া চক্ষেত্তে!”
বলেই সজীব সেখান থেকে চলে গেলো। পারুলও বাসন গুলো গোছাতে লাগলো ধুতে নেবার উদ্দেশ্য। তখুনি শরীফ বলে উঠে,
“ভাবী! তুমি কিছু কইতে পারো না?”
পারুল মুঁচকি হেসে বলে,
“ওমা? আমি আবার কি কমু?”
“দেখলা আম্মা কেমনে পুরো বিষয় সবসময় নিজের দিকে টেনে নেয়!”
“এইডি বাদ দাও।”
“বাদ দাও কইরাই, ভাইজানও এহন এমন হইয়া গেছে।”
“আমি যাই গো ভাই, বাসন কয়ডা মাজি গিয়া।”
শরীফ জানে তার ভাবী কথা বাড়াতে চায় না দেখেই তাকে এড়িয়ে চলে গেলো কাজের নাম দিয়ে! কলপাড়ে সবগুলো থালাবাসন নিয়ে গেলো মাজতে। চুলা থেক একটু ছাই উঠিয়ে নিলো সাথে। ছাই দিয়ে পাতিলের কালি ঘষতে লাগলো বসে বসে। তারপর কড়াইগুলো ধুতে গিয়ে যেন হাত ধরে যাচ্ছে! জমেলা বেগম সবসময় তরকারি রান্না করলে কষানোর সময় তরকারি লেগে যায় কড়াইতে। আর আজকে তো গোশত ভূনা করেছে, সেজন্য বেশ কষ্ট হচ্ছে কড়াইটা পরিষ্কা করতে! দুপুরবেলা মাথার উপর সূর্য উঠে নৃত্য করছে! গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার! এমন সময় আর ইচ্ছে করছে না পারুলের, তারউপর কড়াইও লেগে রয়েছে। সিদ্ধান্ত নিলো কড়াইটা পানিতে কিছুক্ষণ ভেজানো থাক, তাহলে ডলতে সুবিধা হবে। তারও কষ্ট হবে না, আর রোদে জ্বলতে হবে না। সে মোতাবেকই কড়াই রেখে ঘরে গেলো। ঘরে যেতেই মনে পড়ে গেলো স্বামীর কথা! এইতো একটু আগেই তার স্পর্শে মুড়িয়ে ছিলো এতক্ষন! কেমস ফাঁকা ফাঁকা লাগলো ভেতরটা। তবুও বিছানায় গা এলালো। এই সংসারে কাজ তো আর কম না! আধা ঘন্টা পর! কানে কারো চিৎকারের আওয়াজ হতেই পারুল চোখ খুলে তাকায়,
এতক্ষণ পর চোখটা একটু লেগে আসছিলো আর ঠিক তখনই রিয়ার চেঁচামেচির আওয়াজ! পারুল বাধ্য হয়ে রুম ছেড়ে বাহিরে গেলো,
“কি হইছে রিয়া? এমনে চিৎকার করতাছো ক্যান?”
রিয়ার চোখেমুখে বিরক্তি! কপালের ভাঁজ স্পষ্ট বিদ্যমান।
“আম্মা কই গেছে ভাবী!”
“আম্মা কই গেছে হেইডা আমি কেমনে কমু কও? হের যহন যেইডা মনে চায়, হেইডা করে।”
রিয়া কিছুটা ব্যাঙ্গ করে বললো,
“কিহ্! তুমি এমনে কইলা! আম্মা কি এমন করে কও দেহি? খারাও আইজকা আসুক ভাইজান!”
রিয়ার কথা শুনে পারুলের বুকটা কেঁপে উঠে। মানুষটা যদি উল্টাপাল্টা ব্যবহার করে তার সাথে? সব মেনে নিতে পারে কিন্তু স্বামীর থেকে একটু খারাপ ব্যবহার সে নিতে পারে না, ! পারুল মনে করে সজীব তার স্বামী, তার অর্ধাঙ্গ!
সংসারের হাজার চাকা ঘুরলেও, এই মানুষটাই তার ঘূর্ণির কেন্দ্র। পারুল অনেক কিছু সহ্য করতে পারে, সংসারের যেকোনো কষ্ট, যে কোনো বোঝাও টেনে নিতে পারে দিনের পর দিন। কিন্তু যেটা একদমই পারে না, সেটা হলো স্বামীর খারাপ ব্যবহার। সজীব যদি কখনো রূঢ় হয়ে ওঠে, কণ্ঠে একটু তাচ্ছিল্য এসে পড়ে সেসব পারুলের হৃদয়ে খাঁড়া হয়ে বিঁধে যায়। বুকটা ফেটে যায় কষ্টে!
অথচ, এই একই মানুষটির ছোঁয়া পাওয়ার জন্য সে কতটা ব্যাকুল থাকে! কতটুকু আকুতি জমে থাকে তার দৃষ্টিতে, তার নিঃশ্বাসে! সজীবের একটু মনোযোগ, একটুখানি কাছে আসা, একটুখানি হাতের ছোঁয়া এই সবকিছুর জন্য পারুল যেন সারাক্ষণ অপেক্ষায় থাকে!
❝সজীব শুধু পারুলের স্বামী নয়, সে তার অর্ধাঙ্গ। শরীরের ঠিক অর্ধেক নয়, আত্মার ঠিক মাঝবরাবর ভাগ করা এক অংশ, যার না থাকায় নিজের অস্তিত্বই যেন ভেঙে পড়ে।❞
সজীবকে ছাড়া পারুল নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে না। অর্ধাঙ্গ মানেই এমন এক অস্তিত্ব, যার ভালোবাসা বুকে না পেলে ঘর-সংসার, হাজার সুখ সবকিছুই বৃথা মনে হয়। সংসারের হাজার সুখ, বাহ্যিক প্রাচুর্য, সবই তার কাছে অর্থহীন যদি না পাশে থাকে সেই মানুষ!
“ভুল বুঝতাছো রিয়া, তোমার কি দরকার আমারে কও দেহি!”
রিয়া এবার কিছুটা হলেও শান্ত হয়, তারপর বলতে আরম্ভ করে,
“চারটে বাজব আর একটু পর, আমার মাস্টার মশাই তো একটু পরই আইয়া পড়ব। হের নাস্তা পানির আয়োজন করছো?”
“ঘরে তো কিছু নাই আইজকা, বিস্কুটও শ্যাষ হইয়া গেছে রিয়া!”
কথাটা কিছুটা মন খারাপ করেই বললো পারুল। কিন্তু রিয়ার কন্ঠে রাগ!
“হেইডা আগে কইবা না তুমি! ভাইজানরে?”
“হের পকেট খালি রিয়া, কেমনে কইতাম?”
“আমার বেলায়ই টাকা শ্যাষ! ঠিকাছে!”
বলেই রিয়া হনহনিয়ে যেতে নিলে পারুল পিছু ডাকে,
“কই যাও রিয়া?”
“জাহান্নামে!”
রিয়া চলে যায়। পারুল তেমন কিছু ভাবেও না। মনে মনে জানে এই তো, একটু পরেই আবার ফিরে আসবে। স্বামীর হাতে টাকা না থাকলে, একজন স্ত্রী হিসেবে মুখ ফুটে টাকা চাইতে যাওয়ার যন্ত্রণা, লজ্জা আর অপমান সেটা কি রিয়া বোঝে? না, বোঝার মতো বয়স বা অভিজ্ঞতা কোনোটাই এখনো হয়নি তার।
তবুও পারুল উঠে রান্নাঘরে যায়। পুরনো একটা স্টিলের বাটিতে খানিকটা পানি ঢেলে ময়দা মেখে নেয়। কাঁটার মতো আলু কুচি করে, সেগুলো পুর হিসেবে গরম তেলে দিয়ে সিঙারা ভাজে। গন্ধে রান্নাঘর ভরে ওঠে, কিন্তু ঘরে কেউ নেই।
সজীব তো সকালেই বেরিয়ে গেছে, আর শরীফ? সে নিশ্চয়ই পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মাঠে ফুটবল খেলছে।
বাকি থাকেন শুধু জমেলা বেগম। তিনি কোথায় গেছেন, কে জানে! জমেলা বেগমের তিন সন্তান দুই ছেলে আর ছোট মেয়ে রিয়া খাতুন। সেই রিয়াই কিছুক্ষণ আগে চলে গেলো,
সিঙারা ভাজার পর রান্নাঘরের কোণায় রাখা ঝাড়ুটা হাতে নেয় পারুল। ধুলো জমেছে মেঝেতে। ধীর ভঙ্গিতে ঝাঁট দিতে দিতে হঠাৎ উঠোন থেকে ভেসে আসে মুরগির চিৎকার। সন্দেহ জাগে নতুন ফুটে ওঠা বাচ্চাগুলোকে কেউ আবার তাড়া করলো না তো?
চলন্ত ঝাড়ুটা থেমে যায়। এক ঝটকায় ছুটে যায় পারুল উঠোনে।
উঠোনে এসে দেখে, সাদা-কালো ছোপ ছোপ গায়ের একটা বিড়াল মুরগিটার পেছনে তাড়া করেছে। সদ্য ফুটে ওঠা ছানাগুলোর দিকে চোখ রক্তজবা করে তাকিয়ে আছে সে। মুরগিটা পাখা মেলে ছানাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ডাকছে হাউমাউ করে, কিন্তু তারপর হঠাৎই ছানাগুলোকে ফেলে দৌড়ে চলে যাচ্ছে বাড়ির পেছনের ঝোপঝাড়ের দিকে। হয়ত ভয় পেয়েছে!
পারুল থমকে দাঁড়ায়। তারপর জুতো না পরেই দ্রুত পা বাড়ায় মুরগির পেছনে।
“আহা, এই দিকে আয়! ওদিকে যাইস না!”
এখন এগুলোকে বাড়িতে আনতে না বারা মানে আবার সন্ধ্যায় খুঁজতে হবে, সাথে জমেলা বেগমের কথা! ছানাগুলোরও ক্ষতি হতে পারে। বিড়ালটা ততক্ষণে দেয়াল বেয়ে ওপারে চলে গেছে, কিন্তু মুরগিটা এখনো দিকভ্রান্তের ন্যায় দৌড়াচ্ছে!
কিছুটা খুঁজে খুঁজে অবশেষে পারুল মুরগি আর ছানাগুলোকে উঠোনের কোণার খাঁচার পাশে আনতে পারে। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলে,
“ভাগ্যিস ঠিক সময়ে দেখছিলাম!”
ঠিক তখনই কলপাড়ে এসে হাজির হন জমেলা বেগম। চোখে পড়ে, বাসনগুলো অগোছালোভাবে পড়ে আছে। কিছুতে আধভেজা , কিছু একেবারে শুকনো হয়ে গেছে। মুখটা কষে ওঠে তাঁর। বউমাকে তেতে কিছু বলতে যাবে দেখে বড় ছেলে বাড়িতে আসছে। সে দেখে জমেলা বেগম দ্রুত বাসন মাজতে লেগে পড়ে এমন সময়ই বাড়ির দরজায় দেখা দেয় শরীফ। পায়ে কাদা-মাখানো জুতো, গায়ে ক্লান্তি আর মুখে বিস্ময়। নিজের মা’কে বাসন মাজতে দেখে থমকে দাঁড়ায়।
“আম্মা? আমনে বাসন মাজতাছেন কেন!”
জমেলা বেগম চোখ তুলে তাকান না, শুধু বাসনে জল ছিটিয়ে দিয়ে বলেন,
“আধোয়া আছিলো! আমি তো আরো দুই ঘন্টা আগেই ধুইতে আইছিলাম, তুই দেস নাই। সেই আমারেই তো ধোঁয়া লাগলো। মাঝখান থেইকা বিকাল হইয়া গেছে! এমন করলে সংসারে লক্ষী থাকে নি ক তো বাপ?”
“তুমি রাইখা দিতা, পারুলই ধুইতো!”
“এতক্ষণ এইডি এমনে থাকতো? উঠোন জুড়ে! কেমন দেখা যায়?”
বলতে বলতে হুট করেই জমেলা বেগম আহ্ করে উঠলেন কোমড়ে হাত দিয়ে। তা দেখে সজীব উৎকন্ঠা হয়ে জিগ্যেস করে,
“কি হইলো আম্মা?”
“কিছু না রে, টিউবওয়েলডা তো শক্ত, হের লাইগা চাপতে গিয়ে কোমড়ে ব্যাথা হইছে মনে হয়!”
“তোমার কোমড়ের ব্যাথা জাইনাও কেন যে, এইসব কাম করতে যাও!”
সজীব এবার বিরক্তি নিয়ে সামনে এগিয়ে আসে, কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই, তখনই পারুল ফিরে আসে উঠোনের দিক থেকে। খাঁচার দরজা বন্ধ করে আসছে, হাতে এখনো ধুলো লেগে আছে, চেহারায় হালকা ক্লান্তি। পারুলকে দেখেই সজীব রাগত স্বরে বলে,
“শালী! তুই থাকতে আমার আম্মা কেন অহন বাসন মাজতে বইছে? আমি তোরে সেই দুপুরে কইয়া গেছিলাম না, আইডা বাসন সব ধুইয়া রাখতে!”
স্বামীর মুখ থেকে এরকম কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পারুল! সে তো সবই ধুয়ে গেছিলো শুধু কড়াই তিনটে বাকি ছিলো। জমেলা বেগমের দিকে তাকাতেই দেখে জমেলা বেগম সব কড়াই ধুয়ে ফেলেছেন, নিশ্চয়ই সেটারই শোধ নিলো ছেলেকে ফিরতে দেখে! পারুল উত্তর দেবার আগেই জমেলা বেগম এবার হালকা হেঁসে উত্তর দেয়,
“যে যার মতন ব্যস্ত, সংসারটা তো আমারই। তিল তিল কইরা সব গড়ছি। হেইলাইগ্যা আমারে তো দেখতে হইবই বাজান!”
সজীব আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখুনি সেখানে উপস্থিত হয় রিয়ার পড়ানোর লোক। তাকে দেখে আরেকটা চমকে উঠে পারুল, একটু আগেই সজীব যে তার সাথে বাজে ব্যবহার করলো সেটা বাহিরের মানুষটা দেখে ফেললো না তো আবার!”
#চলবে?