অর্ধাঙ্গ পর্ব-০৯

0
24

#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-৯

নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালো পারুল। সামনে বাঁধানো ঘাট, সেখানে ছোট ছোট নৌকা দুলছে নদীর নরম ঢেউয়ের তালে। একজন মাঝি সামনে নৌকা ঠেলে আনলো। নৌকার পাটাতনে পা রাখতেই হালকা দুলুনি লাগে, পারুল দুহাতে আঁচল চেপে ধরে সামলে নিল নিজেকে। দুলুনিতে তার গলা শুকিয়ে আসছে, মনে মনে দোয়া পড়ে ঠোঁটে ফুঁ দিলো। নৌকা ধীরে ধীরে মাঝ নদীতে এগিয়ে চললো। পাড়ের ঘরবাড়ি, তালগাছ, কাশবন সব যেন ঢেউয়ের আড়ালে এক একটা ঝাপসা ছবির মতো দুলে উঠছিলো। পারুল চুপচাপ বসে থাকে নৌকার মেঝেতে। চোখের কোণ দিয়ে কখনো তাকায় বিস্তৃত জলের প্রান্তের দিকে,
কখনো দৃষ্টি হারিয়ে ফেলে অদেখা ভয়ে। নৌকার মাথায় বাঁশের ছাউনি ঘষাঘষি করে বাতাসের সাথে।
মাঝি চুপচাপ বৈঠা চালিয়ে যায় কেবল বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ নদীর স্তব্ধতায় ক্ষীণ রেখা কেটে চলে।

নৌকা থেকে নেমে পারুল একটু থমকে দাঁড়ায়।
চোখের সামনে একটু দূরে জমেলা বেগমের বোনের বাড়ি। একতলা টিনের ঘর, উঠোনের একপাশে আম গাছের ছায়া, আর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন মানুষ। তখন সজীবকে বলতেই সজীব না করেনি পারুলকে সঙ্গে নিয়ে আসতে। পরদিন সকালেই রওনা দিয়ে দিয়েছে দু’জনে, চিন্তা কালকেই জমেলা বেগমকে নিয়ে বাড়িতে ফিরবে। হুট করেই পারুলের শাড়ির আচল গিয়ে আঁটকায় একটা গাছের গুঁড়িতে। পারুল হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেই সজীব পিছন ফেরে শুধোয়,

“খাড়াই রইলি ক্যা?”
“শাড়িটা মনে অয়, আঁটকাইছে।”
“আইচ্ছা তাড়াতাড়ি খুইল্যা আয়।”

বলেই পারুল কাপড়ের আচল ছুটাতে থাকে ততক্ষণে সজীব এগিয়ে গেছে। পারুলও গিট খুলেই সজীবের পিছু পিছু ছুটলো।

ঘরের চৌকাঠ পেরোতেই দেখতে পায় জমেলা বেগম সেখানেই বসে আছেন। চোখেমুখে যেন অচেনা রকমের প্রশান্তি, ছেলেকে দেখতে পেয়ে, যেন এই মুহুর্তের জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। পাশে দাঁড়িয়ে আছে সজীব। ছেলেকে চোখের সামনে দেখে জমেলা বেগমের মুখে ফুটে উঠেছে এক চওড়া হাসি—

জমেলা বেগম ছেলের হাত ধরে টান দিয়ে বললেন,

“ওরে আল্লা, সজীব আমার! আইছিস মা’য়ের কাছে! আহারে বাপ আমার, একেবারে শুকায়ে গেছিস রে!”

সজীব মাথা নিচু করে মৃদু হেসে কিছু বললো না।
তার চোখ একবার গেলো পারুলের দিকে। এমন সময় পাশের ঘর থেকে জমেলা বেগমের বড় বোন বেরিয়ে এলেন। বয়সের ভারে শরীর একটু ঝুঁকে গেছে, মুখে গভীর ভাঁজ,দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন,

“এই বউয়ের হাতের রান্নায় তোর পোলার শরীর কেমনে ঠিক থাকব? হের তো নিজেরই শরীরের ঠিক নাই!”

কথাটা শুনে পারুল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
কোনো প্রতিবাদ নয়, কোনো কথা নয়। শুধু মনে হলো, মাটির বুকের নিচে যদি লুকিয়ে থাকা যেতো, তবে বোধহয় এই অপমানের ভার সইতে হতো না। সে না হয় একটু চিকন, তেমন স্বাস্থ্য নেই, কিন্তু দেখতে তো এতোও খারাপ নয়! তার জন্য এভাবে বলতে হয়?
জমেলা বেগম তখন সজীবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলছিলেন,

“চিন্তা করিছ না, আম্মা সব ঠিক কইরা দিমুনে।”

সজীবের মুখে কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলো।
আর পারুল, একপাশে দাঁড়িয়ে, নিজেকে আগাছার মতো অপ্রয়োজনীয় মনে হতে লাগলো। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, মাথা নিচু করে। তার মুখে কোনো আলোর রেখা নেই। মনের ভেতর একরাশ খারাপ লাগা নিয়ে বুঝে যায়, শাশুড়ির আনন্দের উৎস তার উপস্থিতি নয় শুধু তার ছেলে, সজীব। সেই পরিস্থিতে দাঁড়িয়ে পারুলের মনে হয়, সে যেন এক অবাঞ্ছিত ছায়া, যার থাকা বা না থাকা কারও চোখে কোন দাম রাখে না।

সজীব পারুলের দিকে একবার তাকায়, অল্প একটু। চোখ দিয়ে সান্ত্বনার ইশারা দেয়, কিন্তু জমেলা বেগম তার দিকে ফিরেও তাকায় না। ছেলেকে ঘিরেই তার যত আদর, যত আবেগের উচ্ছ্বাস। এই ঠান্ডা আবহে পারুলের হৃদয়ের কোণে জমে উঠতে থাকে অজস্র অব্যক্ত দীর্ঘশ্বাস। জমেলা বেগম ছেলেকে জিগ্যেস করে,
“তোর বউরেও নিয়া আইবি, খবর দিবি না?”
“পারুল তো কুনো সময়, বড় খালার বাড়িতে আইয়ে নাই। হেই লাইগ্যাই নিয়া আইছি।”

জমেলা বেগমের বোন রাহেলা বেগম পারুলের দিকে তাকিয়ে মুখ কুঁচকে বললেন,

“সজীব এতো শুকাই গেছে ক্যান? খালি নিজে সেজেগুজে থাকলেই অইব নি?”

পারুল নত চোখে দাঁড়িয়ে থাকে। ভেতরে ভেতরে যেন ছোট ছোট কাঁটার জ্বালা ছড়িয়ে পড়ে বুকের ভেতর। এত সাজগোজ কই? সে তো কেবল নতুন কাপড় আর একটা চেইন দিয়েছে গলায়, আর চুলে ফুলের খোপা, চোখে মোটা করে কাজল। এইটুকুই তো!

বড় বোন আবার বললেন,

“জানছ নি জমেলা, আমাদের সময়ে ঘরের মাইয়ারা চুপচাপ কাজ করতো। কারো সামনে চোখ তুলে তাকাইতো না।”

বোনের কথা শেষ হতে তৎক্ষনাৎ জমেলা বেগম কথাটা কেঁড়ে নিয়ে উত্তর করে,

“আর এহনের মাইয়ারা তো চোখ্যের মণি!”

সজীব নির্বাক, নিশ্চুপ। ঠোঁট কামড়ে ধরে পারুল, অনুভব করে তার অস্তিত্ব এখানে যেন কেবল উপহাসের পাত্র মাত্র।

বড় বোন রাহেলা বেগম আবার কটুকণ্ঠে বললেন,

“মাইয়া মানুষ যদি সোয়ামীরেই দেখভাল না কইরা রাখতে পারে তাইলে কেমনে কিই!”

“তার ভিতরে অইতাছে না তার বাচ্চা!”

জমেলা বেগমের কথা শুনে পারুলের কান্না এসে গলা চেপে ধরে, কিন্তু সে নিজেকে শক্ত করে। চোখ তুলে তাকায় না শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, নিজের অশ্রু যেন মাটির গায়ে মিশে যায় চুপিসারে। এমন সময় সজীব একটু এগিয়ে এসে বলল,

“পারুল খারাপ মাইয়া না খালা, অয় ঘরের সব কাম হইতে সবার খেয়াল রাহে। এই কয়দিন টেকা পয়সার অভাবে চিন্তায় আছিলাম, হেই লাইগ্যা হয়ত এরম দেহা যাইতাছে, কিন্তু পারুলের কুনো দোষ নাই।”

জমেলা বেগমের কপালে ভাঁজ পড়ল।
বড় বোনের কণ্ঠে তীক্ষ্ণ তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বললেন,

“তুই তো তোর বউর পক্ষেই কতা কইবি!”
“আমনেরা যা কওয়ার কন, আমি জানি আমার বউ কেমন।”

সজীবের বলা এই ছোট্ট বাক্যটুকু যেন পারুলের বুকে জমে থাকা কান্নার পাহাড়ে একটা নরম ফাটল তৈরি হলো। সে আর মাথা তুলে কিছু বলল না, কেবল নিঃশব্দে সজীবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। এই মুহূর্তে পারুল মনে মনে টের পেল, সজীব তাকে পুরো দুনিয়ার বিরুদ্ধে না হোক, অন্তত নিজের জায়গা থেকে ছোট্ট একটা জায়গা জুগিয়েছে।

“আইচ্ছা বাপ, অহন ঘরে আয়।”

সজীবের পিছু পিছু পারুলও,ভেতরে ঢুকলো। চেয়ারে গিয়ে বসলো পাশাপাশি দু’জন। তখুনি রাহেলা বেগম গলা উঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন,

“টুম্পা! ও টুম্পারে কই গেলি, দেইখ্যা যা কে আইছে?”

রাহেলা বেগমের ডাকে কোনো সাড়াশব্দ আসলো না। সেজন্য তিনিই এগিয়ে গেলেন। পারুল ফিসফিসিয়ে সজীবকে প্রশ্ন করে,

“টুম্পা কে?”
“রাহেলা খালার মাইয়া হইতাছে টুম্পা।”

পারুলের মনে পড়ে যায়, এই বোধহয় তার শ্বাশুড়ি মায়ের পছন্দ করা সেই মেয়ে টুম্পা! যাকে পুত্রবধূ করতে না পেরে পারুলের প্রতি এত রাগ!

“আইচ্ছা সজীব একটু থাক, আমি আইতাছি।”

জমেলা বেগম ও সেখান থেকে চলে গেলো। পারুল আর সজীব বসে রইলো সেখানে।

“কিছু মনে করিস না খালার কতায়, আমারে বড্ড মায়া করে তো, হেই লাইগ্যা আমার শুকনা মুখ দেইখ্যা বাজে বকছে।”

পারুল উত্তর দিলো। আগের ন্যায় চুপচাপই বসে রইলো। একটু পরই কোমড়ে কাপড়ের আঁচল গুঁজে হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো একটি মেয়ে। পারুল অনুমান করলো, হয়ত এই সেই মেয়ে! মেয়েটি সালাম দিয়ে শরবতের গ্লাস প্রথমে সজীবের দিকে এগিয়ে দিতেই সজীব ঢকঢক করে পুরো শরবতটুকু খেয়ে নিলো। পারুলের হাতে তখনও শরবতের গ্লাস ধরা।

“বউ? শরবতখানা খাইয়া লও।”
“হু, খাইতাছি।”

পারুল শরবতের গ্লাসে এক চুমুক দেওয়া মাত্রই, মেয়েটি বলে উঠে,

“ভাবী, আমগো বাইত প্রথমবার আইছেন, আমনের লাইগ্যা স্পেশাল শরবত বানাইছি। খাইয়া লন।”

বিনিময়ে মুঁচকি হেঁসে পারুল শরবতের গ্লাসে মুখ দিতেই চোখমুখ কুঁচকে এলো। শরবতে চিনি একদম নেই বললেই হয়!

“তুমি চিনি দেও নাই?”
“ওমা কি কন ভাবী! আমনের সোয়ামী শরবতে চিনি কম খায় হেইডা কি জানেন না?”

পারুল ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কি প্রশ্নের কি উত্তর দিলো মেয়েটি! তাও উত্তর করে,

“জানমু না ক্যান?”
“জানলে জিগাইলেন যে? হেয় চিনি কম খায় দেইখ্যাই তো, শরবতে চিনি কম দিয়া বানাইছি। হেই লাইগ্যাই আমনের গেলাসেও কম অইছে চিনি।”

পারুল কথা এড়াতে ছোট্ট করে জবাব দেয়,
“ওহ্, বুঝছি।”
“নাইলে আমনেরে আরেক গেলাস আইন্যা দেই?”

পারুল উত্তর দেবার আগেই সজীব পাশ থেকে বলে,

“আর লাগতো না, কই আছিলি তুই? খালা তোরে কি জোরে জোরে ডাকলো!”

টুম্পা মুখে হাসি ফুটিয়ে উত্তর দেয়,

“ছাগল চড়াইতে গেছিলাম।”
“অহনো, গরু ছাগল নিয়া দৌড়াদৌড়ি করছ!”
“হ, আমার ভালা লাগে পশুপাখি।”
“এমনে আর কয়দিন? এইডি বাদ দিয়া, সংসার টংসার কর, দেখবি আরো ভালা লাগবো!”

সজীবের কথায় টুম্পার চোখেমুখে লজ্জা স্পষ্ট। লাজুক ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,

“করমু তো।”

সজীব আর কিছু বলে না, পারুল নীরব দর্শকের মতন সবটা দেখতে থাকে। জমেলা বেগমকে দেখে দেখে তার বোন কীরকম হবে সে সম্পর্কে ধারনা ছিলো মনে, কিন্তু মেয়েটিকে নিয়ে কিছু ঠাওর করতে পারছে না! মেয়েটি বললো চিনি কম দিয়েছে, অথচ পারুলের কাছে মনে হলো যেন চিনি কম নয় দেয়ইনি! সর্তক দৃষ্টিতে টুম্পার দিকে তাকালো কেবল।

#চলবে?