#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-১২
“হা°রা°মজাদী মাইয়া কুনখানের! এত বেলা অব্দি কিয়ের ঘুম! উঠ, উঠ কইতাছি!”
টুম্পার চুলগুলো ধরে বিশ্রী ভাবে গালি দিয়ে কথাগুলো বলতে লাগে রাহেলা বেগম। আচমকা এরকম কন্ঠস্বর শুনে ঘুমের ভেতরই ধড়ফড়িয়ে উঠে টুম্পা! দু হাতে চোখ কচলাতে থাকে। রাহেলা বেগমের রোষানল দৃষ্টি এসে পড়েছে টুম্পার উপর! টুম্পা হতবাক হয়ে মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতেই রাহেলা বেগম পুনরায় বলে,
“এতক্ষণে সকাল হইছে! সাতটা বাজছে! আর অহন ও তোর খবর নাই!”
“ মা! আমি তো প্রতিদিনই এই টাইমে ঘুম থেইক্যা উডি, তাইলে আইজকা কি হইছে?”
“বাইরে যাইয়া দ্যাখ, সজীব নাস্তা করতাছে। একটু পরই রওনা দিব কইয়া!”
ঘুমঘুম চোখে শুয়ে ছিলো টুম্পা, মায়ের কথা কানে শ্রবণ হতেই ঘুম যেন এক নিমিষেই চোখ থেকে উড়ে পালিয়েছে! তড়িৎগতিতে উঠে বসে, মায়ের মুখপানে বিস্ময় নিয়ে জিগ্যেস করে,
“কি কও! তাগো তো তিনদিন পর যাওনের কথা!”
“সজীব নাকি আইজকাই যাইব!”
“তাইলে আমার কি হইব?”
কাঁদো কাঁদো মুখ করে টুম্পা মায়ের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো। ভেতরে একরাশ অভিমান জমা হয়েছে যেন, রাহেলা বেগম তখন পান চিবিয়ে চলেছেন, মুখে লাল রসে ভেজা ঠোঁটের কোণে এক ধরনের হাসি। তিনি ধীর কন্ঠে মেয়েকে বলে,
“আগে উইঠ্যা হাত-মুখ ধুইয়া নে। তারপর উঠানে আইয়া তোর খালারে ধইরা মরা কান্দা জুইড়া দে। বাহিডা জমেলাই কইরা লইব।”
মায়ের কথার বিপরীতে মুখে কিছু বললো না টুম্পা। কোনো দ্বিধা না করে একরকম যন্ত্রচালিতের মতো উঠে দাঁড়াল। কথামতো মুখ ধোয়ারও ফুরসত নিল না সোজা গিয়ে হাজির হলো উঠোনে। সেখানে গিয়ে দেখে, সজীব আর পারুল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।
টুম্পা এগিয়ে গিয়ে সজীবের সামনে দাঁড়ায় চোখে জমে থাকা কান্না, ঠোঁটে কল্পিত এক অভিযোগ। তারপর বলে ওঠে—
“তোমরা যাইতাছো গা? আমারে কইলাও না!”
“হ, আম্মা হের কাপড়চোপড় গুছাইয়া আনুক, হেরপর আমরা রওনা দিমু।”
“খালারে আমার কাছে রাইখ্যা যাও না কয়ডা দিন!”
“না টুম্পা, আমি বারবার আইতে পারুম না।”
টুম্পা এবার বেশ শব্দ করে কেঁদে দিলো! জমেলা বেগম ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতেই টুম্পা জমেলা বেগম কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো,
“ও খালা গো! তুমি যাইও না গো খালা।”
জমেলা বেগমও টুম্পাকে সাথ দিতে মিছিমিছি কান্নার ভান ধরলো,
“ছাইড়া দে মা, আমারে যাওন লাগবো।”
“আর কয়ডা দিন থাহো খালা, তোমার লাইগ্যা আমার পড়ান পড়বো বহুত!”
“আইচ্ছা তাইলে তুই আমার লগে যাবি? বাজান? টুম্পারে লইয়া লই আমগো লগে? মাইয়াডা ক্যামনে কানতাছে, তো দেখতাছোস!”
সজীব একটু চুপ থেকে তারপর উত্তর করে,
“এইডা কওন লাগে নি? আইচ্ছা টুম্পা তুই রেডি হইয়া নে, আমরা অপেক্ষা করি।”
টুম্পার চেহারায় খুশির ঝলক ফুটে উঠলো এক নিমেষেই। মুখে হাসি ফুটিয়ে উত্তর দিলো,
“আমারে কদ্দুর সময় দেও, আমি গুছাইয়া আইতাছি!”
টুম্পা ভেতরে চলে গেলো। টুম্পার সাথে রাহেলা বেগম। পারুল নিরব দর্শকের মতন সবটা দেখতে লাগলো। তার মোটেও ইচ্ছে করছে না টুম্পাকে তাদের সাথে নিয়ে যেতে, কিন্তু মানাও করার উপায় নেই! পড়েছে বেশ মুশকিলে।
“আয় আমরা ভেতরে গিয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি।”
“আইচ্ছা, চলেন।”
প্রায় এক ঘন্টা পর টুম্পা বেরিয়ে আসলো তার জামাকাপড়ের ব্যাগ নিয়ে। ব্যাগ দেখে অবাকই হলো পারুল! কে জানে কত দিনের জন্য যাচ্ছে, এত্ত বড় ব্যাগ! সাথে একটা বস্তা দেখতে পেলো।
“খালা? বস্তাত কি আছে?”
রাহেলা বেগম হাসতে হাসতে বলে,
“কিছু জিনিস দিছি আমার বইনেরে, হেইডাতে নিশ্চয়ই তোর আপত্তি নাই?”
“না খালা, তুমি তোমার বইনরে দিতেই পারো। কিন্তু এতবড় বস্তা কেমনে লইয়া যামু?”
“হেই ব্যবস্থাও আমি কইরা দিছি। ভ্যান ভাড়া কইরা দিছি ভ্যান দিয়া যাইবি!”
“খালা, ভ্যানে দিয়ে ঘুইরা যাইতে তো বহুত টেকা ভাড়া নিবো। কুনো দরকার আছিলো এত টেকা খরচা করার?”
“তোর লাইগ্যা এই খরচ আমার কাছে সামান্যই বাপ।”
“আইচ্ছা খালা, তই যাই। পারুল? খালার পা ছুইয়া সালাম কইরা আয়।”
স্বামীর কথামতন পারুল খালা শ্বাশুড়িকে সালাম দিতে যায়। সালামের উত্তর নিয়েই রাহেলা বেগম পারুলকে বলে,
“নিজের মতন কইরা, নিজেই নিজেরে ভালো রাহনের চেষ্টা করো।”
পারুল মাথা নত করে নীরব সম্মতির ভঙ্গিতে বিদায় নেয়, কিন্তু রাহেলা বেগমের কথার মধ্যে যেন কোথাও একটা কিছু ইঙ্গিত স্পষ্ট টের পেলো পারুল। মনের ভেতরে একটা খচখচে অস্বস্তি জন্ম নেয়। তার সঙ্গে টুম্পাও আছে। এই মেয়েটা যেন নিঃশব্দে কোনো ষড়যন্ত্রের ছায়া টেনে নিয়ে এসেছে। পারুল বুঝে যায়, তাকে সতর্ক থাকতে হবে। খুব সতর্ক।
জমেলা বেগম চোখের জলে ভিজে যাওয়া আঁচল দিয়ে বারবার মুখ মুছে বোনকে বিদায় জানান। ভ্যানের কাছে পৌঁছতেই সজীব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ব্যাগপত্র একে একে তুলে দেয় ভ্যানের ওপর। সামনে বসে জমেলা বেগম, তার পরের জায়গাটায় সজীব।
পারুল যখন শাড়ির পাড় সামলাতে সামলাতে ভ্যানে উঠছে, তখন ঠিক সেই মুহূর্তে একেবারে অনাহূতের মতো, টুম্পা এসে সজীবের পাশেই বসে পড়ে। দৃশ্যটা যেন পারুলের বেশ রাগ হয়! এই মেয়েটিকে সে কখনোই তার স্বামীর কাছাকাছি ঘেঁষতে দেবে না। মুখ ফুটে বলতে পারবেও না, পারুল বুঝে গেলো টুম্পাকে জব্দ করতে হবে কৌশলেই!
“টুম্পা? দেহো তো ওইখানে একশো টেকার একটা নোট পইড়া রইছে। মনে হয় তোমার টেকা?”
‘একশো টাকার একটা নোট পড়ে আছে’ কথাটা কর্নকুহুরে প্রবেশ হতেই, সেই মুহূর্তেই টুম্পা যেন বিদ্যুৎবেগে ভ্যান থেকে লাফিয়ে পড়ে। রাস্তার ধুলো মেখে, চোখের কোণে লোভের চকচকানি নিয়ে সে সামনে গিয়ে খুঁজতে থাকে হারিয়ে যাওয়া টাকার নোট, যেন তা হাতে পেলেই শান্তি! এই ফাঁকেই পারুল ভ্যানে উঠে বসে। সে গিয়ে ঠিক বসে সেই জায়গকয় যেখানে একটু আগেই জাঁকিয়ে বসেছিল টুম্পা, সজীবের পাশে।
টাকা খুঁজে না পেয়ে ক্লান্ত আর হতাশ মুখে টুম্পা যখন ফিরে আসে, তখন সে দেখতে পায় তার বসার জায়গা আর নেই। সজীবের পাশে বসে আছে পারুল। পারুলের সাদাসিধে মুখে যেন এক অনুচ্চারিত ঘোষণা টুম্পার জন্য
“সজীবের পাশের জায়গা আমার, এবং চিরকাল আমারই থাকবে।”
টুম্পার মুখ কালো হয়ে ওঠে, মন খারাপ করে বলে,
“ভাবী? আমনে মিছা কতা কইছেন ক্যান আমার লগে?”
“টেকা পাও নাই?”
“কুনো টেকা নাই হেনে!”
“তাইলে মনে হয় আমার চোখের ভুল হইছে টুম্পা।”
“আমারে হুদাহুদি ভ্যান থেইক্যা নামাইছেন!”
“নামছস তো কি হইছে? এহন উইঠ্যা ব জলদি।”
সজীবের তাড়াহুড়ো ভরা ডাক শুনে টুম্পা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে নিঃশব্দে ভ্যানে উঠে বসে। তবে তার মুখের রেখায় তখন স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। ভ্রু কুঁচকে আছে, ঠোঁট চেপে ধরে আনমনে তাকিয়ে আছে। আশেপাশের কেউ টুম্পার তাকানো না বুঝলেও কিন্তু পারুল ঠিক বুঝতে পারে এই অভিব্যক্তি কিসের জন্য। প্রায় এক ঘণ্টা ধুলোমাখা কাঁচা রাস্তায় দুলতে দুলতে ভ্যান চলতে থাকে। অবশেষে ভ্যান থামে তাদের গন্তব্যে।
____________
“কি’গো কামাল ভাই? মাইয়াডারে কি বিয়া শাদী কিছু দিবা না নাকি?”
বাজারের জন্য বেরিয়ে ছিলেন কামাল হোসেন, শেফালী বেগমের স্বামী মন্টু মিয়ার কথায় থেমে দাঁড়ালেন। ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিলো,
“মাইয়ারে কি বিয়া না দিয়া ঘরে রাহন যায়?”
“আমিও হেইডাই কই! কবে দিবা বিয়া? বয়স তো হইছে ভালোই!”
“হের বড় ভাইয়েরা যা ভালা মনে করে।”
মন্টু মিয়ার কামাল হোসেনের উত্তরটা পছন্দ হলো না। মুখটা গোমড়া করেই প্রতিউত্তর করলেন,
“ক্যান? তুমি তো অহনো বাঁইচ্যা রইছ, তুমি হইছো ঘরের কর্তা। তোমার কোনো সিদ্ধান্ত নাই?”
“কি আর কমু? হের ভাইয়েগো বড় আদরের বইন হইছে আমার মাইয়ায়। দেহো না, বইনেরে কষ্ট কইরা পড়ায়ও আবার!”
“এইসব মাইয়া মাইনষের কাম না কামাল ভাই। পড়াশোনা হেগো লাইগ্যা না।”
“আমার মাইয়াও কিন্তু পড়ালেহায় বহুত ভালা আছে।”
বেশ গর্ব নিয়েই কথাখানা বললো কামাল হোসেন, মন্টু মিয়া কিছুটা খোঁচা মেরেই বললেন,
“এসব করতে করতে কুনো বিপদ আপদ হইয়া গেলে? এমনেও তোমার মাইয়ার মতিগতি সুবিধার না! কেমন কেমন করে জানি!”
কামাল হোসেন আগ্রহভরা দৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন করেন,
“কেমন আবার?”
“এইডি বাদ দাও তো! আমার তো মনে অয় না, তুমি মাইয়া বিয়া দিবা।”
“আরে অবশ্যই বিয়া দিমু। হের লাইগ্যা তো ভালা পাত্র পাওন লাগব।”
এতক্ষণ ধরে এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন মন্টু মিয়া। মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার।
“আরে ভালা পাত্র নাই কে কইছে! আমার ছুডো ভাইয়ের পোলা আরমান আছে তো! পোলায় শহড়ে গিয়া ফ্যাক্টরীত কাম করে! ম্যালা টেকা বেতন পায় বুঝছো?”
“তুমি কি বিয়ার প্রস্তাব দিতে চাইতাছো মন্টু?”
“হয়, পোলা কইলাম দেখতেও মন্দ না। টেকাও ইনকাম করে ভালা। বেডা মাইনষের তো এই জিনিস হইলেই চলে কও? যদি কুনো বিয়ার দাগও থাকে, টেকার লাইগ্যা হেইডাও উইঠ্যা যাইবো!”
“মানে পোলার বউ আছে!”
“বউ আছে না আছিলো, এহন আর নাই! খেদায় দিছে ভালা না দেইখ্যা!”
কামাল হোসেন কন্ঠে কঠোরতা এনে বললো,
“পোলার বউ আছিলো, হেই পোলার কাছে আমি মাইয়া বিয়া দিমু? অসম্ভব! তুমি তোমার ভাইয়ের পোলার লাইগ্যা অন্য মাইয়া দেহো, আমার অমন মাইয়ারে আমি এরকম পোলার লগে বিয়া দিমু না।”
বলেই কামাল হোসেন হাঁটা ধরালো। মন্টু মিয়া পিছু ডাকলেও সাড়া না দিয়েই তিনি চলে গেলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে অপমানিত বোধ করে, রাগে গিজগিজ করতে লাগলো মন্টু। মনে মনে বললো, “ওমন মাইয়ারে কোন সুপাত্রের কাছে দিবা, আমিও দেখুম!”
#চলবে?