#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-১৯
নিশ্ছিদ্র বিকেলের আকাশে সূর্যটা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। বাড়ির উঠোনে সাজসজ্জার শেষ ছোঁয়া, চারপাশে কৌতূহলী চোখ আর হাসিমুখে আত্মীয়-স্বজনেরা। ধীরে ধীরে সবার নজর পড়ছে রিয়ার দিকে। রিয়া আজ একেবারে অন্যরকম। টকটকে লাল বেনারসী, হাল্কা স্বর্ণ এবং সিটি গোল্ডের গয়নায় সাজানো, হাতে মেহেদি রাঙা। রিয়ার চোখে-মুখে এক অপার লজ্জা আর আনন্দের মিশেল। মাথায় ঘোমটা টেনে নিচু চোখে সে ধীরে ধীরে পালকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পালকির গায়ে ফুলের মালা, রঙিন কাপড়, আর অলংকারে সাজানো। চারজন পালকিওয়ালা ধীরে ধীরে পালকী তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
নীরবতা ভেঙে আজ বাড়িটা ভরে উঠেছিল মানুষের কোলাহলে। রিয়ার বিয়ে হয়েছে। কনে সাজে সে যেন একদম স্বপ্নের মতো লাগছিল আজকের দিনটা। কিন্তু আনন্দের মাঝেও সময় থেমে থাকে না। সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত বিদায়।
বিদায়ের সময় পুরো পরিবেশটাই বদলে গেল। হাসিমুখগুলো কেমন যেন মলিন হয়ে পড়ল। রিয়ার ভাইয়েরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে, চোখে পানি জমে আছে, গলার স্বর কাঁপছে। ভাবী পাশে দাঁড়িয়ে রিয়ার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। একটুও ছাড়তে চাইছে না। চোখে দিয়ে তারও অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে কান্নারত অবস্থায়। বাবা যিনি সবসময় হাসিমুখে ছিলেন মেয়ের সামনে, সকলের অগোচরে তার চোখেও পানি। চোখ মুছলেন লুকিয়ে, তিনি শুধু বললেন,
“ভালা থাকিস মা। নিজের মতন কইরা সংসার গড়িস।”
জমেলা বেগম, যিনি বিয়েতে রাজি ছিলেন না, নিজের পছন্দের পাত্র নেই বলে। শক্তপোক্ত হয়ে ছিলো, বিয়ের কোনো কাজই করেনি। সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল সে থাকবে না কিছুতে! এতক্ষণ নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেও মেয়ের বিদায় বেলাতে তিনিও নরম হয়ে উঠলেন, রিয়া তার দিকে যেতেই হাউমাউ করে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
“তোর বাপ আর তোর ভাবী মিলে তোরে আমার বিরুদ্ধে লইয়া গেল রে মা! আমি চাইছিলাম তুই খালি সুখী থাকতি! হেইডা আর হইল না।”
রিয়ার স্বামী দূরে দাঁড়িয়ে থাকায় বেশি কিছু বললেন না আর জমেলা বেগম। পাছে মেয়ের সংসারে অশান্তি হবে! সেটা সে কিছুতেই চায় না। যতই তার অমতে বিয়ে হউক। মেয়ের খারাপ সে চাইবে না। রিয়া এবার এগিয়ে গেলো, অশ্রুসিক্ত নয়নে ভেতরে উঠে গেলো। পালকির দরজা বন্ধ হলো। ভেতরে বসে রিয়া জানালার ফাঁক দিয়ে শেষবারের মতো নিজের উঠোনটা দেখে নিল। পেছনে ফেলে যাওয়া শৈশব, খেলার দিন, মা, বাবা সকলকে দেখে নিলো। সব যেন এক ঝলকে চোখের সামনে। পালকী ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল, এক নতুন জীবনের পথে। পালকি ধীরে ধীরে দূরে চলে গেল। কেউ কিছু বলছে না, শুধু তাকিয়ে আছে—যেন বিশ্বাস করতে পারছে না, যে মেয়েটা এত বছর ধরে এই বাড়ির প্রাণ ছিল, সে আজ এভাবেই চলে গেল। বাড়ি যেন হঠাৎ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে।
এটাই হয়তো মেয়ের বিয়ে, যেখানে একসাথে আনন্দ আর বেদনা দুটোই থাকে, আর থেকে যায় কিছু ফাঁকা শূন্যতা।
হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেবার কারণে হাতে তেমন টাকাপয়সা ছিল না, সেজন্য তেমন পাড়া প্রতিবেশি কাউকেই দাওয়াত করা হয়নি, কোনোমতে ছেলের পক্ষ থেকে কয়েকজন এসেছিল তাতেই বিয়েটা হয়েছে। তবুও আশেপাশের প্রতিবেশীরা বিয়ে বলে ভীড় জমিয়েছিল। দেখার আশায়। কনে বিদায় হবার সাথে সাথে তারাও বিদায় নিয়েছে।
“মাইয়াডা চইল্যা গেল!”
স্বামীর দীর্ঘশ্বাসে জমেলা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর করে,
“শেফালীর দেবরের লগে বিয়াডা দিলে না হয় মনরে বুঝ দিতাম, রিয়া সুখে থাকব। দিছেন বিয়া গরীব, মাস্টারের লগে। হেয় কয় পয়সাই বা কামাই করব আর আমার মাইয়ারে খাওয়াইব কি? পড়ালেখার কুনো দাম আছে এহন?”
একে তো মেয়ের বিদায় তার উপর স্ত্রী’র এরকম কথা সহ্য হলো না কামাল হোসেন এর! সেজন্য চুপই রইলেন।
“আম্মা, রিয়া সুখেই থাকব দেইখেন।”
“কেমন সুখে থাকব, হেইডা আমিই জানি।”
“আমনে দেইখ্যা লইয়েন আম্মা!”
“তুই আর আমারে কুনোকিছু শিখাইতে আইবি না সজীব, তুই তোর বউর তালেই নাচ!”
বলেই জমেলা বেগম অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পারুলের দিকে। তারপর ভেতরে চলে যায়! সেদিন এক সপ্তাহ আগে জমেলা বেগম যখন পারুলকে শরীফকে নিয়ে ওরকম কুৎসিত প্রস্তাব দিয়েছিল ঠিক তখুনি বাড়িতে প্রবেশ করে কামাল হোসেন। জমেলা বেগম ভেবেছিল স্বামী বাড়িতে নেই, এই সুযোগে সে ভয়ভীতি দেখিয়ে পারুলকে দিয়ে বাড়ির সবাইকে বুঝিয়ে তার পছন্দসই পাত্রের সাথেই মেয়ের বিয়ে দিবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি হয় কামাল হোসেন আসার কারনে। তিনি এসে এসব দেখেই তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েকে সেখানেই বিয়ে দিবো। উনার সিদ্ধান্তের দু’টো কারণ ছিল, প্রথমত কবিরকে তার পছন্দই ছিল। কখনো খারাপ কিছু দেখেনি। তবুও মেয়ের বিয়ে বলে দ্বিধায় ছিলো। কিন্তু যখন দেখলেন তার স্ত্রী সীমানা অতিক্রম করে ফেলছে সেজন্য একপ্রকার স্ত্রী’কে শায়েস্তা এবং মেয়ের ভালো চেয়ে তিনি কবিরের সঙ্গেই রিয়ার বিয়ে ঠিক করেন। এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে হয়েও যায়।
“দেখলা খালা! তোমার পুতের বউ কেমনে তোমার উপরে দিয়া উইঠ্যা যাইতাছে!”
জমেলা বেগম থম মেরে বসে রইলেন। টুম্পা সুযোগ পেয়ে আরো বলতে লাগে,
“আইজকা পরের মাইয়া আইন্যা কি মাশুল দিতে হইতাছে দেখতেই তো আছো!”
জমেলা বেগম পুনরায় নিশ্চুপ দেখে টুম্পা বলে,
“খালা তাইলে আমি কাইল পরশু যামুগা?”
এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও যাওয়ার কথা শুনে জমেলা বেগম নড়েচড়ে বসলেন। প্রশ্ন করলেন টুম্পাকে,
“ক্যান যাবি?”
“তোমার পোলার বউ তো সবার উপরে! কি জানি কি হয়, তাই আমার যাওনই ভালা।”
জমেলা বেগম ধমকের স্বরে টুম্পাকে বলে,
“তুই চুপ থাক! আমার মাইয়ারে আমি পছন্দের পাত্রের লগে বিয়া দিতে পারলাম না, শুধু ওই মাইয়ার লাইগ্যা!”
কল পাড়ে যাওয়ার জন্য এসেছিল শরীফ, পাশ দিয়ে যাবার সময় কিছু কথা কানে আসতেই ভেতরে গিয়ে উত্তর করে,
“আম্মা, ভাবীর কি দোষ? আমনেই তো আমারে লইয়া অপবাদ দিয়া চাইছিলেন আমনের উদ্দেশ্য হাসিল করতে। কিন্তু আব্বা পানি ঢাইল্যা দিল! দোষ তো আমনের। আমনে এরম করছেন দেইখ্যাই, আব্বাও ওরম সিদ্ধান্ত নিছে। আর দোষ দেন এহন ভাবীর!”
আগুনে ঘি ঢালার মতন কথাগুলো গিয়ে পড়লো জমেলা বেগমের কানে!
“ভাবী ভক্ত দেওর যা আমার সামনেত্তে! রসের ভাবি রস দিয়া তোরে বশ করছে!”
এরকম কুৎসিত কথা শুনে শরীফের আর ইচ্ছে হলো না এক মুহুর্ত ও সেখানে দাঁড়ানোর। সে হাত মুখ ধুতে কলে চলে যায়। তারপর একটু বিশ্রাম নিবে। শরীফ যেতেই টুম্পা সুযোগ বুঝে পুনরায় বলে,
“দেখছ খালা? এই কারনেই আমি যামুগা! সবাইরে বশ কইরা ফেলছে তোমার পোলার বউ!”
“চুপ! তোরে যে কামে আনছি, হেই কামে না লাইগ্যা কিসের বাড়িতে যাবি তুই? ওই অলক্ষী, বন্ধ্যা মাইয়ারে খেদাইতে না পারলেও দরকার হলে আমার পোলার দ্বিতীয় বউ হবি তুই! তারপর পারুলরে খেদাবি। আমার মাইয়ারে ওইখানে বিয়া দেওনের শোধ আমি এবার নিমুই নিমু! না হইলে আমিও জমেলা না!”
টুম্পা বাঁকা হাসি হেঁসে জমেলা বেগমের রুম ত্যাগ করে। সে যে কারনে এসেছিল জমেলা বেগমের আগুনে ঘি ঢালতে সেটা হয়ে গেছে। এবার শুধু অপেক্ষার পালা, তার কার্যসিদ্ধি হবার।
একমাত্র ননদের বিয়ে বলে বাড়ির সব কাজই একা হাতে সামলেছে পারুল। ছোটো খাটো আয়োজন করলেও একা করতে গিয়ে, বেশ ধকল গিয়েছে তার উপর দিয়ে। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে ইচ্ছে করছে এখনি গা এলিয়ে দিবে বিছানায়, কিন্তু সে আর হলো কই? মেহমান যাবার পরও কিছু খাবার অবশিষ্ট আছে এখন সেগুলোকে গরম করে বোলের মধ্যে রেখে তারপর সব ধুতে হবে। তারপর ঘরের ভেতর এসে সব পাতিল গুলো রান্না ঘরে গিয়ে রাখলো। এবার আগুন ধরাবে। তার আগেই গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে পারুল! সেজন্য রান্নাঘরে যাবার আগে একটু জিড়িয়ে নিচ্ছে। তখনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো সজীব,
“এভাবে এনে দাঁড়ায় আছস ক্যান?”
পারুল কাপড়ের আচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে উত্তর দেয়,
“যা তরকারি আছে হেইডি সব গরম দিয়া, হাঁড়ি পাতিল ধোওয়া লাগব। গরম লাগতাছে হেই লাইগ্যা দাঁড়াই আছি।”
“কালকে করলে হইব না? তোর উপরেও তো বহুত ঝক্কি গেছে!”
পারুল উত্তর দেবার আগেই সেখানে এসে হাজির হয় টুম্পা, একটু আগেও বড় মুরগীর টুকরো দিয়ে এক প্লেট পোলাও খেয়ে ভরপেট হয়ে উঠোনে হাঁটতে নেমেছে, যাতে হজমে সমস্যা না হয়। তখনই আড়াল থেকে সজীব আর পারুলের কথা শুনে এখানে আসে। আর উত্তর করে,
“এত দরদ তোমার! কিন্তু দরদে তো খাওন আর ভালা রইব না, নষ্ট হইয়া যাইব।”
“আমি তো দেখতাছি দরদ তোর বেশি টুম্পা। তাইলে এক কাজ কর, তোর যেহেতু এতই দরদ তাইলে তুইই পোলাও মাংস গুলা গরম কইয়া দে ভাবীরে। আর ভাবী তো ক্লান্ত কালকে সকালে না হয় হাঁড়ি পাতিল ধুইব। যা বইন তুই চুলায় যা, সব গরম দে।”
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শরীফ টুম্পাকে কথাগুলো বলতেই টুম্পা রেগেমেগে চোখ দু’টি বড়বড় করে কিছু বলবে তার আগেই পারুল বলে উঠে,
“বাড়ির পেছন থাইক্যা পাতার বস্তা আইন্যা আগুন ধরাইবা, আর তরকারি ভালো মতন ফুটাইবা, অনেকক্ষণ জ্বাল করবা। নাইলে নষ্ট হইয়া যাইব। মাছের তরকারিতে ঝোল কম, কদ্দুর পানি দিয়া লইয়া না হইলে লাইগ্যা যাইব তরকারি। সব ঘরে আইন্যা ঢাকনা দিয়ে উপরে পিঁড়ি দিবা, যাতে ইন্দুর, পোকা নষ্ট করতে না পারে!”
“হ টুম্পা, তুই যা বইন সব গরম দিয়া সুন্দর মতন রাইখ্যা দিবি। বউ তুই আয়।”
টুম্পাকে নির্দেশ দিয়ে সজীবও সেখান থেকে পারুলকে নিয়ে চলে যায়। শরীফ মুখ টিপে হেঁসে টুম্পাকে বলে,
“যা বইন যা, কত সুন্দর কইরা তোরে কইলো ভাইজান এবার যা!”
টুম্পা রাগে গিজগিজ করতে করতে শরীফকে উত্তর দেয়,
“বইনের খেতায় আগুন!”
“হ, তোর তো আমার কিছু ভালা লাগেই না। আইচ্ছা তুই আমার বইন না, সজীবের বইন। তাইলে সজীবের বইন টুম্পা যা, এবার ঠিকাছে না?”
বেচারি টুম্পা’কে বউ হবার আকাঙ্ক্ষায় বোন সম্মোধন করে এক প্রকার কাঁদিয়েই দিলো! শরীফের কথা টুম্পা শুনলো কি না কে জানে। তবে শরীফ হাসতে হাসতে উঠোন ছেড়ে বেরিয়ে যায়, বাইরের দিকে।
#চলবে?