#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-২১
“জমেলা? ও জমেলা! কই গেছো তাড়াতাড়ি ঘর থেইক্যা বাইর হও।”
আছরের নামায শেষ করে মসজিদ থেকে চলে এসেছেন কামাল হোসেন। বাইরে দাঁড়িয়ে স্ত্রী’কে ডাকছেন, স্ত্রী’র কোনো হেলদোল নেই। সে তখনো দুপুরের ভাত ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কামাল হোসেন আরো কয়েকবার ডাকতেই ঘুমঘুম চোখে বেরিয়ে আসলেন জমেলা বেগম। হাই তুলতে তুলতে স্বামীর মুখপানে তাকালেন। কেমন খুশির ঝলক দেখা দিচ্ছে।
“কি হইছে? এমনে ডাকতাছো ক্যান?”
“এহনো তোমার ঘুম ভাঙ্গে নাই!”
“ক্যান ডাকছো?”
“মসজিদ থেইক্যা বাইর হওনের পরপরই আমার বন্ধু আজাদের লগে দেহা হইছে, মেলা দিন পর! ছুডো কালের বন্ধু আমার।”
জমেলা বেগম কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলে,
“অহন কি হইছে?”
কামাল হোসেন আগ্রহ নিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন,
“এতদিন পর দেহা হইছে, তাই আমি আজাদরে কইছি আইজকা যেন আমার লগে থাহে। হেয় রাজিও হইছে। এহন দোকানে চা খাইতাছে।”
“তো লইয়া আইও।”
“আনমু, কিন্তু তার আগে তুমি আমগো ঘর থেইক্যা বাইর হও।”
স্বামীর কথা শুনে জমেলা বেগম চোখ দু’টি বড়বড় করে বলে,
“কি কও! মাথা ঠিক আছে নি?”
“আরে আজাদ কইছে হেয় আমার লগে থাকব। হেই লাইগ্যাই তুমি আইজকা আমগো ঘর থেইক্যা বাইর হইয়া অন্য ঘরে থাকবা।”
“কোন ঘরে থাকুম?”
“রিয়ার ঘর তো খালি!”
জমেলা বেগম মুখ কালো করে উত্তর দেয়,
“রিয়ার ঘরের চৌকিতে তোষক নাই, শক্ত কাঠে আমার ঘুম ধরে না।”
“তাইলে টুম্পারে রিয়ার ঘরে পাঠাইয়া দেও।”
“মরন! টুম্পা না মেহমান?”
“তাইলে, আইজকা কষ্ট কইরা ঘুম যাও! আমি যাই আজাদের কাছে। ফিরতে একটু দেরী হইব নে।”
কামাল হোসেন তার কথা শেষ করেই চলে যায়। পানসে মুখ নিয়ে জমেলা বেগম উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকে। শক্ত চৌকিতে শুতে হবে ভেবেই তার কান্না পাচ্ছে এরকম ভাব! আরাম আয়েশ ছাড়া যেন কিচ্ছু দরকার নেই তার। চলে যাচ্ছিলেন ভেতরে ঠিক তখুনি শরীফের গলা শুনে থমকে দাঁড়ায়। পারুল তখন উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিলো, শরীফ পারুলকে দেখেই বলে,
“ও ভাবী?”
শরীফকে দেখে পারুল গায়ের কাপড়টা আরো টেনে এনে ঘোমটাটা লম্বা করে নিলো,
“কি হইছে?”
“আইজকা ঘরে না-ও ফিরতে পারি ঠিক নাই, হেইডাই কইতে আইছি। যাতে চিন্তা না করো।”
“ক্যান? কই যাইবা?”
“গোসাইগো বাড়ির উঠোনে আমরা আড্ডা আর লগে রান্না বান্না করতাছি আর কি। ক্লান্ত লাগলে গোসাইর বাড়িতেই শুইয়া পড়মুনে।”
পারুল মাথা নুইয়ে উত্তর দিতেই শরীফ সেখান থেকে চলে যায়। সবটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন জমেলা বেগম। দুইয়ে দুইয়ে চার করে তার মনে যা আসলো তার ছক কষে নিলেন বেশ ভালো ভাবেই। ভাবেনি সুযোগ এভাবে চলে আসবে! সে তড়িঘড়ি করে টুম্পার কাছে গেলো।
মাগরিবের আজান দিয়ে দিয়েছে। পারুল নামাজের জন্য অযু করে নিজের রুমে এসে দেখে জমেলা বেগম সটান হয়ে তার বিছানায় শুয়ে আছে! ভ্রুঁ কুঁচকে শ্বাশুড়ি মায়ের দিকে এক পলক তাকায় পারুল। জিগ্যেস করবে কি করবে না ভেবে জিগ্যেস করেই ফেলে,
“আমনে আমাগো ঘরে আম্মা?”
জমেলা বেগম বরাবরের মতনই তার তেজ বজায় রেখে উত্তর দেয়,
“আমার ঘর, আমার সংসার আমি আইতে পারমু না?”
“আমি তা কই নাই আম্মা!”
“তুমি যে কি কইতাছো বুঝতে বাকি নাই। যাকগে তোমার শ্বশুড়ের বন্ধু আইব একটু পর, হেয় আমগো ঘরে থাকব। রিয়ার ঘরের বিছানা শক্ত, আমার কষ্ট হইব থাকতে। হেই লাইগ্যা আমি আইজকা তোমগো ঘরে ঘুমামো। তুমি সজীব আইলে শরীফের রুমে পাঠাইয়া দিবা, দুই ভাইয়ে এক বিছানায় ঘুম যাইব। এতে তোমার কোনো আপত্তি আছে নি?”
জমেলা বেগমের কথায় পারুল সরল মনে উত্তর দেয়,
“না আম্মা, কি সমস্যা! এক রাইতেরই তো ব্যাপার!”
পারুল নিজ মতন নামাজে ধ্যান দেয়। একবার জমেলাকে বলতে ইচ্ছে করলো নামাজের কথা। কিন্তু বললো না। পাছে আবার কি বলে অশান্তি শুরু করে দেয় তার ঠিক নেই। উনার ইচ্ছে হলে মাঝেমধ্যে নামাজে মন দেয়। কিংবা স্বামীর কথা শুনলে নামাজে দাঁড়ায়। নামাজ পড়ে পারুল পাকঘরের দিকে যায়। কালকে বিয়ে বাড়ির কাজ আজকেও ছিল যার দরুন কাজ শেষ করতে দেরি হইয়া যায়! কূপি জ্বালিয়ে পারুল পাকঘরের দিকে হাঁটা ধরে। ঘরের দরজা খোলাই আছে, কিছুক্ষণ শোবার পর জমেলা বারবার দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে কেউ আসছে কি-না। কিন্তু তার আশায় পানি ঢেলে বেশ কয়েকবার তাকানোর পরও কাউকে দেখতে পেলো না। হুট করেই দেখে তার ছেলে বাড়ির দিকেই আসছে। সজীব কলপাড়ে হাত মুখ ধুয়ে ঘরের দিকে আসছিলো ঠিক তখুনি পাকঘরে গিয়ে পারুলকে দেখতে পেতেই পারুল সজীবকে বলে দেয় শরীফের ঘরে যেতে। জমেলা বেগম সেটা দেখে চুপটি করে শুয়ে ছিল। যেন অপেক্ষা করছিলো কোনো কিছুর!
“আল্লাহ্ গো! আমার ইজ্জত শ্যাষ কইরা দিলো গো। কে কোন জায়গায় আছো তাড়াতাড়ি আমারে বাঁচাও। না হইলে আমার ইজ্জত শ্যাষ কইরা দিব আইজকা!”
চিৎকার করতে করতে ভেতর থেকে পাগলের বেশে বেরিয়ে আসে টুম্পা। জমেলা বেগম দ্রুতপায়ে উঠোনে যেয়ে দেখে টুম্পার চুল এলোমেলো, বুকে ওড়না নেই। মুখে কেমন ভয়ের ছাপ! টুম্পার চিৎকারের আওয়াজে পারুলদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী ভানু বিবি হাজির হয়ে গেছে! টুম্পাকে এরকম অবস্থায় দেখে সঙ্গে সঙ্গে জমেলা বেগম ও চিৎকার করে উঠে,
“আয়হায় গো! আমার টুম্পার এতবড় সর্বনাশ কে করলো গোওও! আমনেরা কে কই আছেন আমার বাড়িতে আইয়েন, ও শেফলী গো, ও শেফালী! দেইখ্যা যাও আইয়া আমার বইনঝির এত বড় সর্বনাশ কে করলো! ওরে আল্লাহ্ আমি অহন কি করুম।”
মাথায় হাত দিয়ে জমেলা বেগম বিলাপ করতে লাগে। টুম্পা আর জমেলার চিৎকারে তখন আরো কয়েকজন প্রতিবেশী চলে এসেছে। উৎসুক দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে আছে টুম্পার দিকে। টুম্পা সবাইকে দেখেই বলতে লাগে,
“আমার ইজ্জত শ্যাষ শেফালী চাচী! বিকালে আমি আলতা দিছিলাম পায়ে। আলতা না শুকাইলে নষ্ট হইয়া যাইব হেই কারনে শুইছিলাম। কখন যে চোখ লাইগ্যা আইয়ে আর সন্ধ্যা হইয়া যায় টের পায়নাই। যহন টের পাইলাম দেহি আমার উপরে! আমার সব শ্যাষ গো চাচী। অহন আমার মরণ ছাড়া কুনো উপায় নাই। আমনেরা এর বিচার করেন না হইলে আমার মরণ ছাড়া গতি নাই।”
পুরো কথা শেষ না করে কান্না করতে লাগলো টুম্পা। প্রতিবেশী থেকে একজন জিগ্যেস করলো,
“কে আছিলো টুম্পা?”
টুম্পা উত্তর দেওয়ার আগেই ঘর থেকে খালি গায়ে বেরিয়ে আসে শরীফ। এসেই টুম্পাকে বলে,
“এই টুম্পা এমনে কানতাছস ক্যান? আমি তোরে কিছু করি নাই!“
“তাইলে তুইই এই আকাম করছস শরীফ! ছিহ্! জমেলা? তোমার ছুডো পোলায় এরকম! আগে জানা আছিলো না।”
প্রতিবেশীদের একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় জমেলাকে! জমেলা বেগম তখন অবাকের চরম পর্যায়। পারুল অবাক দৃষ্টিতে শরীফের দিকে একদৃষ্টে কেবল তাকিয়ে আছে। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না! চোখের সামনে যা দেখছে তা যেন মিথ্যা হয়ে যাক!
“কিগো জমেলা? অহন কথা কও না ক্যান!”
জমেলা বেগম নিশ্চুপ, এক প্রতিবেশী মহিলা খোঁচা মেরে বলতে লাগে,
“কথা কেমনে কইব? জমেলা ভাবছিলো কি আর দেখলো কি! বুঝে নাই হের ঘরেই কালসাপটা আছিলো!”
“চুপ একদম চুপ করেন! আম্মা, আমি কিছু করি নাই আম্মা!”
“কি চুপ করতাম শরীফ! টুম্পার গায়ে কাপড়ের ঠিক নাই, আর তোর গায়ে তো কাপড়ই নাই। তালুপরে এমনে চিল্লানি! খালি ঘর পাইয়া মাইয়াডারে কি করছস বুঝতে বাকি নাই!”
শরীফের রাগ এবার শেষ পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। গোঁসাইয়ের বাড়িতে তার বাবা ব্যাগড়া দেওয়ায় মেজাজ গরম করে বাড়িতে চলে এসেছে। অন্যদিন বাড়িতে এসেই ঘরে কূপি জ্বলতো, আজকে পারুল ঘরে আলো দেয়নি। ভেবেছিল হয়ত শরীফ আসবে না। শরীফও রাগে বিরক্তিতে ঘরে আলো দেয়নি। রেগে থাকার কারনে ঘেমে গিয়েছিল, সেজন্য গায়ের শার্ট খুলে অন্ধকারেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তখনই টুম্পার সাথে শরীরের স্পর্শ হতেই টুম্পা ওভাবে চেঁচিয়ে বাইরে নামে! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই প্রতিবেশি হাজির হয়ে যায়। কি থেকে কি হয়ে গেলো শরীফ বুঝতে পারছে না কিছুই। টুম্পা কেনই বা এসব বললো তার বিরুদ্ধে! যেখানে এতকিছু ঘটেইনি! এখনই থামানো প্রয়োজন না হলে গ্রামের মহিলারা কি থেকে কি রটাবে ঠিক নেই।
“চাচী, চুপ করেন কইতাছি। আমার কথা বিশ্বাস না হইলে টুম্পারেই জিগান!”
শেফালীর মেজাজ বিগড়ে গেলো শরীরের এরকম গলার আওয়াজ শুনে।
“চোরের মায়ের বড়গলা! টুম্পা তো সব কইয়াই দিছে আর কি কইব?”
শরীফ এবার রাগে টুম্পার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। শরীফের চোখ দিয়ে তখন রাগে আগুন ঝড়ছে! টুম্পা শরীফের দিকে এক পলক তাকিয়েই জ্ঞান হারালো।
শরীফ বোকার মতন তাকিয়ে রইলো টুম্পার দিকে।
“দেখছো জমেলা! মাইয়াডা কেমন ডরাইছে যে জ্ঞান হারাই ফালাইছে!”
শরীফ তখন নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো,
“আমি কিছু করি নাই চাচী!”
“না করলে টুম্পা মিছা কইছে?এমনে এমনে জ্ঞান হারাইছে! খুব তো বড় গলায় বাহাদুরি করলি! নাহ্ গ্রামের ভেতর এরকম অনাসৃষ্টি হইতে দেওন যায় না, তোমরা এহনি মাতব্বররে খবর দিয়া আনো, হেয়ই একটা বিহিত করবো!”
জমেলা বেগম তখন অসহায় দৃষ্টিতে পারুলের দিকে তাকালেন।
“বউমা? সজীব কই? সজীবরে না আইতে দেখলাম?”
“আম্মা, আমনের পোলায় তো বাজারে গেছে, চিনি শ্যাষ হইয়া গেছিল।”
জমেলা বেগম বিনিময়ে কোনো প্রতিউত্তর করলো না। গ্রামের লোকেরা শরীফকে জড়িয়ে নানান রকম কথা বলতে লাগলো। পারুল তখন টুম্পার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। শেষমেশ গ্রামবাসীর কটু কথা সইতে না পেরে শরীফ হাঁটা ধরছিল ঠিক তখুনি মন্টু মিয়া বাকিদের বলে,
“ওই দেখো শরীফ পালাইতাছে! একটা মাইয়ারে নষ্ট কইরা সে পালায় যাইতাছে! অরে ধরো তোমরা!”
মন্টু মিয়ার আদেশে গ্রামবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে শরীফকে ধরে আমগাছের সাথে বেঁধে ফেলে। জমেলা বেগম তখন কাঁদো কাঁদো অবস্থায় সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো,
“আমার পোলার লগে তোমরা এরম কইরো না!”
“তহন তো চিৎকার কইরা বিচার চাইলা, যেই দেখলা আকাম নিজের পোলায় করছে ওমনি সাত খুন মাফ? তোমার পোলারেও সাজা ভোগ করন লাগব, না হইলে তোমগোরে একঘরে কইরা দিমু!”
“একঘরে করন লাগতো না! আমার পোলারে নিয়াই যহন টুম্পারে এত বদনাম। তাইলে টুম্পারেই বিয়া করব শরীফ।”
কামাল হোসেন এর কথায় সবার মনোযোগ সেখানে গেলো। কামাল হোসেন দেখে শরীফ করুন কন্ঠে বলে,
“আব্বা আমি এসব কিছুই করি নাই!”
কামাল হোসেন কিছু বলার আগেই মন্টু মিয়া প্রতি উত্তর করে,
“ছেলেরে বাঁচানোর লাইগ্যা মিথ্যা আশ্বাস দিতাছো! আমরা এইডা মানমু না মানে না-ই!”
বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কামাল হোসেন। চায়ের দোকানে এক মুরুব্বির মারফত ছেলের এহেনো কীর্তী শুনে জলদি বাড়িতে আসেন। আর এসেই ছেলের এই করুন পরিস্থিতি নিজের চোখের সামনে দেখতে পায়। অতঃপর মন শক্ত করে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েই নিলেন।
হারিকেনের আলো নিভু নিভু। রাতের অন্ধকারেই মহিলা গুলো একজোট হয়ে যে যার বাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছে। কয়েকজন পুরুষ কেবল রয়ে গেলেন ভেতরে। সেখান থেকে একজন বলে উঠলেন,
“কামাল ভাই এক কথার মানুষ, নিজের পোলা দেইখা ছাড় দেয় নাই! অন্যায় অন্যায়ই। আমরা এইবার নিশ্চিন্তে যাই কামাল ভাই।”
কামাল হোসেন কিছু বললেন না। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। শরীফ থম মেরে বসে আছে টুম্পার পাশাপাশি। টুম্পা যেন একটা পাথর! শুধু নিঃশ্বাস পড়ছে এটুকুই। জমেলা বেগম একদৃষ্টে কেবল তাকিয়েই আছে! কি থেকে কি হয়ে গেলো কেবল এটাই ভাবছে মাথায় হাত দিয়ে। সবার ভাবনায় ছেদ পড়লো কামাল হোসেনের গম্ভীর কন্ঠের আওয়াজ শুনে,
“বিয়া যখন ইসলামিক নিয়মে হইছে, তহন আইজকা নিয়ম মতন ওগো বৈবাহিক জীবনের প্রথম রাইত। আশা করি তোমরা এখানে থাইক্যা সময় নষ্ট করবা না। জমেলা ঘরে আইও!”
জমেলা বেগম স্বামীর পেছন পেছন ঘরে চলে গেলেন। পারুলও চলে গেলো। চিনি আনতে গিয়ে মানুষটা যে সেই গেলো তো গেলো এখনো ফেরার নামই নেই। মাঝখান দিয়ে এতকিছু হয়ে গেলো! পারুল বাহিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বামীর জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে। ঠিক তখুনি বাইরে আসতে দেখে শরীফকে। কোথাও একটা চলে যাচ্ছিলো পারুল ডাক দেয়,
“কই যাইতাছো ভাই?”
“যেদিকে দুই চোখ যায় ভাবী!”
“যা হওনের হইয়া গেছে শরীফ। ঘরে যাও, এহন আর খামখেয়ালীপনা করলে চলবো না। এহন তুমি আরেকজনের স্বামী। দায়িত্ব নেওয়া শেখা লাগব।”
শরীফ বিরক্তি নিয়ে উত্তর দেয়,
“সহ্য হইতাছে না আর ভাবী!”
পারুল মৃদু হেঁসে শরীফকে বোঝানোর প্রয়াসে বলে,
“তুমি যে মনে মনে টুম্পারে পছন্দ করতা, ভালোবাসতা সেই খবর কি আর আমার অজানা? যাই হউক, বিয়া তো হইছে ভালোবাসার মানুষের লগেই। রাগ না কইরা ঘরে যাও।”
শরীফ অবাক নয়নে পারুলের দিকে তাকায়। এতকিছু সে কীভাবে বোঝলো? পারুল তখন কাপড়ের আঁচল মুখে নিয়ে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।
#চলবে?
#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-২২
হারিকেনের ক্ষীণ আলো টিমটিম করে জ্বলছে। কেরোসিনের তেল ফুরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে, দূরের ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে সুর, আজকের রাত অন্যদিনের মতো দগদগে নয়, গরমটা কিছুটা কম হলেও বাতাসে ভারী অস্বস্তি। আকাশজুড়ে এক রহস্যময় গুমোট ভাব, বাতাস থমকে আছে। যেন বৃষ্টি নামার প্রতীক্ষায় সব কিছু থমথমে হয়ে আছে। এই নিস্তব্ধ রাতের মধ্যেই টুম্পা বসে আছে একা, মাটির ঘরের কোণ ঘেঁষে। চারপাশে নেমে এসেছে গাঢ় নীরবতা, শুধু হারিকেনের কম্পিত আলোতে মাঝে মাঝে তার ছায়া উঠে আসছে দেয়ালে। আজ তাদের বাসর রাত, তবে শরীফ নেই পাশে। একরাশ আতঙ্ক আর অসহ্য ক্লান্তি নিয়ে টুম্পা তাকিয়ে থাকে ঝাপসা আলোয়।
গ্রামের লোকজন, নিজের আপনজনও মিলেমিশে ঠেলে দিয়েছে তাকে এই সম্পর্কে। শরীফের চোখেমুখে ছিল অনিচ্ছার ছাপ, কিন্তু কেউ শোনেনি কারো কথা। সমাজের লোকলজ্জার দোহাই দিয়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এই বিয়ে। যেন কারও চাওয়া-পাওয়া, ভালোবাসা বা সম্মতির কোনো মূল্য নেই। সবটা ভেবে টুম্পা বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো! চেয়েছিলো কি আর হলো কি? এসব ভাবতে ভাবতে দরজা খোলার আওয়াজে চোখ মেলে তাকাতেই দেখে শরীফ ঘরে ঢুকেছে। শরীফকে দেখে টুম্পার কেমন যেনো করে উঠলো। গুটিশুটি হয়ে চুপটি করে বসলো। শরীফ এগিয়ে গিয়ে ঘরের টেবিলে রাখা মাটির কলস থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে নেয়। তারপর টুম্পার সামনে বসে। টুম্পার পড়নে তখন ছিমছাম লাল একটা শাড়ি। গায়ে কোনোরকম কোনো গয়না নেই। শুধু আগের ছোট্ট একজোড়া দুল আর কিছু নেই। চুলগুলো শুধু খোঁপা করা আর শাড়ি দিয়ে ঘোমটা দেওয়ানো। ব্যস এটুকুই তার বিয়ের সাজ।
“তুই মিছা কথা ক্যান কইলি সবার সামনে! আমি তোরে কিছু করছিলাম?”
টুম্পা ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলে। যা ভেবেছিলো তাই। এখণ শরীফকে কীভাবে উত্তর দিবে? এ তো শরীফ সজীব নয় যে সামলে নিবে! নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মেরে আফসোসের শেষ হচ্ছে না তার, এর ভেতর শরীফের প্রশ্ন!
“তুমি তো আমার গায়ের উপর উঠছো! আমি চিল্লামু না? আমার কি তখন অতকিছু হুশ আছিলো না-কি? নিজের ইজ্জত বাঁচাতে এ ছাড়া কোনো পথ আছিলো?”
শরীফ ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে বলে,
“তোর গায়ের উপর উঠছি কই! আমার কোলবালিশ জড়ায় ধইরা ঘুম যাওনের অভ্যাস, সবসময় আমার ঘরে আইয়া আমি কোলবালিশ জড়াই ধইরা শুই। আইজকাও কোলবালিশ জড়াইয়া ধরতেই তুই চিল্লাইয়া আমার বদনাম করলি!”
“কোলবালিশ মনে কইরা আমারে ধরছো!”
“তাতে এমনে চিল্লানি দিলি ক্যা?”
শরীফের প্রশ্নে টুম্পা এবার কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না, দ্রুত মাথা খাটিয়ে উত্তর করে,
“আমি কি জানি না-কি আমারে কোলবালিশ মনে কইরা ধরছো! তার উপরে আইজকা নাকি তুমি আইতা না, খারাপ চিন্তা আইছিলো মনে হেই লাইগ্যা নিজেরে বাঁচাইতে ডরাইয়া গেছিলাম!”
“তাইলে গ্রামবাসীর সামনে সত্যি না কইয়া অজ্ঞান হইয়া গেলি ক্যান?”
টুম্পা এবার ভয়ে নিশ্চুপ, সে যে পরিকল্পনা মোতাবেক এসব করেছিলো। এখন এগুলোর উত্তর কিভাবে দিবে? তার খালাই শিখিয়ে দিয়েছিলো শরীফের ঘরে আজকে সজীব আসবে। আর রাতের অন্ধকারে সজীব আসলেই মিথ্যা বলে বদনাম ছড়াতে। যাতে জমেলা বেগম সেটার উছিলায় টুম্পাকে সজীবের বউ করতে পারে। টুম্পাও সে আশায় নোংরা খেলায় যোগ দেয়। কিন্তু এভাবে যে সব ঘুরে যাবে সেটা সে নিজেও বুঝতে পারেনি! নিজে ভুক্তভোগী হয়ে এখন প্রশ্নের বানে জর্জরিত হচ্ছে! মিথ্যা উত্তর দিতে দিতে কি বলবে সেটাও যেন খুঁজে পাচ্ছে না আর!
“কি’রে কথা কছ না ক্যা?”
শরীফের ভয়ে টুম্পা কেঁপে উঠে। আমতা আমতা করে কোনোমতে বলে,
“ভয়ে অজ্ঞান হইয়া গেছিলাম। যহন জ্ঞান ফিরলো দেখলাম বিয়া করা ছাড়া উপায় আছিলো না। খালুও কইলো৷ আর না করতে পারি নাই।”
টুম্পার উত্তরে শরীফ সন্তুষ্ট হলো কি না কে জানে! নির্বাক রইলো,কিছুক্ষণ। তা দেখে টুম্পা ভয়ে ভয়ে বসে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করলো দু’জনে। তারপর শরীফ উঠে দরজাটা বন্ধ করতেই টুম্পা আতংকিত কন্ঠে বলে,
“দরজা বন্ধ করতাছো ক্যান ভাইজান?”
শরীফ বিরক্তি নিয়ে টুম্পাকে বলে,
“কেউ কি দরজা খুইল্যা ঘুমায়? তুই ঘুম না যাইতে চাইলে যা বাইরে যা।”
টুম্পা চুপ হয়ে গেলো। অন্ধকারে তার ভয় ছোটো থেকেই! কিছু বললে যদি শরীফ তাকে বের করে দেয় তখন? সবাই তো ঘুমাচ্ছে কেউ তো টুম্পাকে জায়গা দিবে না, দিলেও শরীফের কাছেই পাঠাবে। খামোখা অশান্তি করে নিজের কপালে দুঃখ না এনে টুম্পা চুপই রইলো। শরীফ এসে পাঞ্জাবীটা খুললো। গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি।
“উঠ এখান থেকে!”
শরীফের কথায় টুম্পা ফের ভয়ে কেঁপে উঠে! এত রাতে তাকে বের করে দিবে? টুম্পাকে স্থির থাকতে দেখে শরীফ আবারো বলে,
“উঠবি?”
ভয় পেয়ে টুম্পা এবার উঠে দাঁড়ায়। শরীফ সে সুযোগে চৌকির এক পাশে শুয়ে পড়ে। মাথার উপর হাত দিয়ে টুম্পাকে বলে,
“ঘুমাইলে ঘুমাইয়া যা। না হইলে যা ইচ্ছা কর।”
এই বলেই শরীফ তন্দ্রায় নিমজ্জিত হয়। এদিকে টুম্পা দ্বিধা দ্বন্ধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শরীফের সাথে এক বিছানায় শোবে? ভাবতেই অসম্ভব লাগছে। বাস্তবে কীভাবে করবে সে?
প্রভাতের ছোঁয়ায় গ্রামটা জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। দূরে কোথাও মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙছে কৃষকের, নদীর ধারে পাখির দল কলরব করছে, যেন নতুন দিনের আগমনে গান গাইছে তারা। এমনই এক শান্ত সকালের পরশে শরীফের ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে প্রথমেই পাশে তাকায় টুম্পা নেই। হঠাৎ বুকের ভিতর কেমন খালি খালি লাগে। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে সেটাও বন্ধ। মনে ভয় জাগে,তবে কি টুম্পা পালিয়ে গেছে? নাকি তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার ভয়ে সব ছেড়ে পালিয়ে গেলো?
হৃদয়ের গভীরে কাঁপন জাগিয়ে শরীফ ধীরে ধীরে উঠতেই নিচে চোখ রাখে পাটি বিছানো মাটির ওপর ঘুমিয়ে আছে টুম্পা, শান্ত, নিস্তব্ধ। টুম্পাকে দেখে বুক থেকে স্বস্তির শ্বাস বেরিয়ে আসে। কিছু না বলে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে শরীফ। বাইরে এসে দেখে, উঠোনে তার ভাবী দাঁড়িয়ে আছে, হাতে কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ কুটছে। শরীফ একটু দাঁড়িয়ে থেকে নিচু স্বরে বলে ওঠে,
“ভাবী? আমারে একটু লেবুর শরবত কইরা দিও। চিনি কম টক বেশি কইরা।”
পারুল পেঁয়াজ কাঁটতে কাঁটতে উত্তর দেয়,
“সকাল সকাল লেবুর শরবত খাইবা?”
“হ, মাথাডা কেমন ঘুরতাছে!”
পারুল উদগ্রীব হয়ে বলে,
“ক্যান? রাতে ঘুম হয় নাই?”
“এসবের ভিতরে ঘুম আইয়ে ভাবী?”
“তা ঠিক, আর টুম্পা কোনো অশান্তি করছে?”
“নাহ্! টুম্পা কেমন ডরাইয়া আছে। মনে হয় অহনো সবকিছু মানতে পারে নাই।”
শরীফের কন্ঠস্বরের আভাস বুঝলো পারুল। টুম্পার আচরণের মানে সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। কিন্তু স্বামী হিসেবে এই আচরণ শরীফের পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টের। তারউপর শরীফ মন হারিয়ে বসেছে টুম্পার উপর! আশ্বাস্ত স্বরে বলে,
“আস্তে আস্তে সব ঠিক হইয়া যাইব ভাই।”
শরীফ কোনো উত্তর করে না। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় কলপাড়ে। হাত মুখ ধুতে থাকে। তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে জমেলা বেগম। চেহারায় আগের মতন তেজ নেই। কেমন শুকনো চোখমুখ! তিনি এসেই পারুলকে জিগ্যেস করে,
“সজীব অহনো আইয়ে নাই?”
“আইছে, অনেক রাইত কইরা।”
পারুল আর জমেলা বেগমের কথোপকথনের মাঝখানেই সজীব ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এসেই মা’কে বলতে লাগে,
“এত বড় অঘটন ঘটাইয়া এহন আমারে খুঁজতাছো ক্যান?”
ছেলের কথায় ভয়ের ঢোক গিললো জমেলা বেগম। সবকিছুর পেছনে যে সে-ই দায়ী! এটা কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। কন্ঠ নরম করে বলে,
“আমি অঘটন ঘটাইছি বাপ?”
“না হইলে আর কে!”
বেশ রাগত কন্ঠেই প্রতি উত্তর করলো সজীব। তা দেখে জমেলা বেগমের মনে ভয় কেবল বেড়েই যাচ্ছে! অসহায়ের মতন মুখ করে বলতে লাগে,
“আমি কিছু করি নাই বাজান? সব তো গ্রামের মাইনষে আর তোর বাপে করছে!”
“বাপে না করলে পোলারে চক্ষে দেখতা? না পাইতা পোলা আর কইরা দিতো একঘরে! হেই লাইগ্যা আমি না পারতে এই সিদ্ধান্ত নিছি।”
কামাল হোসেনের কথায় জমেলা বেগম চুপ গেলেন। বুঝলেন এখন তার রাজত্ব খাটবে না, কন্ঠ নরম করে কিছুক্ষণ পরেই বলে,
“তুই কালকে কই গেছিলি বাপ? তুই থাকলে তো আইজ এত বড় ঘটনা ঘটতো না!“
সজীব কিছু বলার আগেই পারুল জমেলা বেগমকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
“হেয় থাকলে কিছু হইত না মানে কি আম্মা?”
পারুলের প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলেন জমেলা বেগম। কথাবার্তা বুঝে শুনে বলতে হবে, না হলে কখন নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে যাবে সে। হা হুতাশ করতে করতে সে পারুলকে বলে,
“মানে যদি সবটা সামাল দিবার পারতো!”
“আর কিচ্ছু করার নাই! আমি একটু কামে আঁটকে গেছিলাম। গভীর রাইতে আইছি, হেই লাইগ্যা কারো লগো কথা হয়নাই। সবাই তহন ঘুমে আছিলেন, ফেরার পর এসব হুইন্যা অপেক্ষা করতাছিলাম কোনসময় সকাল হইব। এহন আমরা খালারে কি জবাব দিমু আম্মা?”
ছেলের প্রশ্নে জমেলা বেগম চুপ! সত্যিই তো সে কি জবাব দিবে নিজের বোনকে? নিজের পাতানো ফাঁদে যে সে-ই পা দিয়েছে! কীভাবে সামাল দিবে জমেলা এবার তার বড় বোন রাহেলাকে? আপাতত জমেলা বেগমের সবকিছু একদিকে আর রাহেলা বেগম কে সামলানোর কাজ আরেকদিকে হয়ে গেছে!
#চলবে?