#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব_২৩
“টুম্পা কই বড় বউ?”
শ্বশুর মশাইয়ের প্রশ্নে পারুল উত্তর দেওয়ার আগেই শরীফ উত্তর দিলো,
“আব্বা টুম্পা ঘুমাইতাছে।”
ছেলের উত্তর যে পছন্দ হলো না কামাল হোসেনের, সেটা তার কপালের ভাঁজ দেখেই বোঝা হয়ে গেছে। কামাল হোসেন গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“যা হওয়ার হইছে, উপর ওয়ালার ইচ্ছা আছিল দেইখ্যাই হইছে। কেউ তো আর ইচ্ছা কইরা কিছু করে নাই! টুম্পা অহন তোর বউ। এই বাড়ির বউ। এডাই এহন তার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আর একটা বউর সংসারে যা দায়িত্ব থাকে হেইডা যেনো টুম্পা ভালোমতন পালণ করে।”
শরীফ বাধ্য ছেলের মতন মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বোঁধক উত্তর দিতেই কামাল হোসেন ফের বলে,
“এতদিন পারুল বড় বউ আছিল, একা সংসারটা দেইখ্যা রাখছে। এহন তার ভাগ, টুম্পারেও লওন লাগব।”
“ঠিকআছে, আব্বা।”
“আমি যাতে সবকিছু ঠিকঠাক মতন দেখি। আমার সংসারে যের কোনো অনাসৃষ্টি না হয়।”
নিজের কথা শেষ করেই কামাল হোসেন ব্যস্ত পায়ে সেখান থেকে চলে যায়। স্বামী চলে যেতেই জমেলা বেগম ছোটো ছেলেকে বলে,
“বাজান, মাইয়াডার উপরে দিয়া কাইলকা বহুত কিছু গেছে। অরে একটু সময় দে। এহনি কিছু চাপায় দিস না।”
মা’য়ের কথায় শরীফ কোনো প্রতি উত্তর করলো না। জমেলা বেগম আশাহত হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। স্বামীর উদ্দেশ্য বললেন,
“মাইয়াডা আওনের সময় হইছে, এসব দেইখ্যা ওর জামাইরে কি উত্তর দিমু কও তো?”
“যেইডা সত্যি ওইডাই।”
“মাইয়া বিয়া দেওনের পরের দিনই পোলার বিয়া! এই সত্যি? ”
কামাল হোসেন জমেলা বেগমের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দেয়,
“এই হউক, যাই হউক, সত্যি সত্যিই। সবই আল্লাহর ইচ্ছা।”
আর কথা বাড়ালেন না তিনি। চলে গেলেন বাহিরে। জমেলা বেগম আফসোরের সুরে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে ঘরে ঢুকলেন। এইসব যে তারই ইচ্ছের ফল! এ কথা পারছে না সইতে, না পারছে কাউকে বলতে!
চোখেমুখে ঠান্ডা পানি পড়তেই ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলো টুম্পা! চোখ দু’টি বড়বড় করে তাকিয়ে দেখে তার সামনে শরীফ দাঁড়িয়ে আছে! এই কান্ড যে শরীফেরই তার বুঝতে আর বাকি রইলো না টুম্পার। এক রাশ বিরক্তি আর রাগ দু’টো নিয়েই শরীফকে বলে,
“এইডা কি করলা সকাল সকাল!”
শরীফ ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দেয়,
“ঘুম থেইক্যা উঠানোর কাম করছি।”
টুম্পা চোখ কচলাতে কচলাতে বলে,
“এমনে?”
“তোর লাইগ্যা এর চেয়ে ভালা জানা আছিলো না।”
শরীফের কথায় টুম্পার মনে জমে থাকা রাগটা আরো গাঢ় হলো। নাক মুখ কুঁচকে বললো,
“তুমি যা করলা, এইডা কিন্তু মোটেও ঠিক না ভাইজান!”
“ভাইজনের পর্ব গতকাল চুকে গেছে। এখন আমি তোর স্বামী হই। আর তুই এই সংসারের বউ!”
টুম্পা সেই আগের মতনই জেদ বজায় রেখে উত্তর দেয়,
“তাতে হইছে কি?”
“হয় নাই এহনো হইব, হাত মুখ ধুইয়া তাড়াতাড়ি যা।”
“কই যামু?”
“বাড়ির বউরা সকালে ঘুমেত্তে উইঠ্যা কই যায়, জানছ না? তোর আম্মা কি করে দেখছ নাই জীবনে?”
“আমার আম্মা ঘুমেত্তে উইঠ্যা খানা খায়। কাজলী খালা আইনা দেয় সামনে।”
শরীফ এবার বেশ বিরক্ত হলো! তবে সেটা প্রকাশ করলো না। সে আগে থেকেই জানে টুম্পার স্বভাব। এজন্যই টুম্পাকে পছন্দ হলেও কখনো বিয়ের প্রস্তাব বা মনের কথা বলেনি। তবুও এই মেয়েটাকেই সে ভালোবেসে ফেলেছে! আর আজকে সে-ই তার সামনে দাঁড়ানো তার বউরূপে!
“আমার অত টেকা পয়সা নাই যে, তোরে কামের মাইয়া আইনা খাওয়ামু।”
টুম্পা শরীফের কথা শেষ করতে না দিয়ে খোঁচা মেরে বলে,
“অত ক্যান? তোমার আদতে কোনো টেকা পয়সা আছে?”
শরীফের মুখটা কালো আঁধারে ভর করলো। টুম্পার কথাটা বেশ ভালোভাবেই আঘাত করলো শরীফকে। বাবা কত বলতো একটু কাজে কর্মে মন দিতে তখন বাঁধ হয়ে দাঁড়াতো সজীব। সে বলতো শরীফের যখন দায়িত্ব নেবার সময় হবে সে আপনাই টাকা রোজগার করবে। শরীফ এখন উপলব্ধি করতে পারছে, সময় এগিয়ে এসে দায়িত্বের ভাড়ে তাকে এখনি টাকা রোজগার করতে হবে। কিন্তু টুম্পাকে আয়ত্তে আনতে হলে তাকে দুর্বল হওয়া যাবে না, সে মোতাবেকই এগোতে থাকলো শরীফ।
“টেকা হইলেও আমি কামের মাইয়া আনমু না।”
চোখ বড়বড় করে জিগ্যেস করে,
“ক্যান, আনবা না?”
“অযথা পয়সা খরচের পিছে আমি নাই।”
টুম্পা আগের ন্যায়ই তারা ভাবভঙ্গি বজায় রেখে বসে রইলো। তা দেখে শরীফ বুঝলো টুম্পা সহজে মানার মেয়ে না। আর শরীফও দমে যাবার পাত্র না! সে গিয়ে টুম্পার হাত টেনে ধরলো। টুম্পাকে উঠে দাঁড় করালো,
“আগে আমার নাস্তা ভাবী আইন্যা দিত, এহন তুই আইন্যা দিবি!”
“ক্যান? ভাবী আনলে কি জাত যাইব?”
“তুই আমার বউ, তাই তুই আইন্যা দিবি!”
“আমি পারমু না!”
“পারবি না?”
“না!”
টুম্পার একরোখা উত্তরে শরীফ টুম্পার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। একদম কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। একতটাই কাছে যে শরীফরের গরম নিঃশ্বাস টুম্পার নাকেমুখে আছড়ে পড়ছে! টুম্পা কিছুটা ভয় পেয়ে বলে,
“কি করতাছো!”
“তুই না পারলে, আমারেই করন লাগব যা করার!“
শরীফের কথার পূর্নাঙ্গ অর্থ বুঝতে বেগ পেতে হলো না টুম্পার। এক ছুটে শরীফের কাছ থেকে একদম ঘরের বাইরে উঠোনে বেরিয়ে পড়লো। শরীফ তখন টুম্পার এরম ভর্য়াত চোখমুখ দেখো মুখ টিপে হাসছে। ওদিকে টুম্পাকে দেখেই পারুল জিগ্যেস করলো,
“কি হইলো? এম্নে বাসি মুখে খাড়ায় আছো ক্যান?”
টুম্পা তখন ভ্রু কুঁচকে হাল্কা রাগ দেখিয়ে বললো,
“তোমার দেওরের লাইগ্যা নাস্তা বানাইতে আইছি।”
পারুল মুঁচকি হেঁসে টুম্পাকে বলে,
“দেখো মাইয়ার কান্ড! গোসল বাদে কিয়ের কাজে হাত লাগাইবা তুমি?”
“এত সকাল সকাল গোসল করে, জ্বর আনমু নি?”
উত্তর শুনে পারুল পুনরায় মৃদু হেঁসে বলে,
“ওমা! তুমি জানো না? বাসর রাইতের পর, সকালে ফরজ গোসল কইরা কাম কাইজ করতে হয়? না হইলে তো গুনাহ্ হইব!”
টুম্পা মুখ বেঁকিয়ে উত্তর দেয়,
“ওসব গোসল টোসলের কোনো প্রয়োজন নাই।”
সোজাসাপটা টুম্পার উত্তর শুনে পারুলের কপালে ভাঁজ পড়লো। জিগ্যেস করতে অস্বস্তি লাগলেও প্রশ্নটা করেই ফেললো,
“গোসল ফরজ হয় নাই?”
“না।”
আর কিছু বললো না পারুল। মনে মনে ভেবে নিল হয়ত টুম্পা এসব মেনে নিতে পারেনি বলে তাদের মধ্যে দাম্পত্য জীবন শুরু হতে সময় লাগবে।
“থাক টুম্পা, তুমি এনে খাড়াও। আমি পাকঘর থেইকা শরীফের নাস্তার প্লেট আইনা দিতাছি।”
পারুলের কথা মতন টুম্পা পিছু পিছু গেলো। গিয়ে নাস্তার প্লেটটা হাতে নিতেই পারুল বলে,
“শরীফ পরোটা পছন্দ করে, মাঝেমধ্যে ওরে পরোটা বানাইয়া দিবা, খুশি হইয়া যাইব!”
“আমার খুশি কাইড়া নিয়া তারে খাওয়াইয়া খুশি করুম? আর কাম নাই!”
টুম্পার ইচ্ছে হলো মনের কথাটা মনে চেপে না রেখে সরাসরিই বলে দিতে। কিন্তু পরিস্থিতি সাপেক্ষে নির্বাকভাবে প্লেটটা হাতে নিতে ঘরে গেলো। গিয়ে দেখে শরীফ চৌকিতে আঁধশোয়া হয়ে আছে।
“তোমার নাস্তা আনছি।”
শরীফ চৌকি থেকে উঠে মুঁচিকি হাসি দিয়ে টুম্পাকে বলে,
“এত তাড়াতাড়ি বানাইয়া আনলি কেমনে?”
শরীফের প্রশ্নে টুম্পা নিশ্চুপ, তা দেখে শরীফ পুনরায় বলে উঠলো,
“তুই যে নাস্তা বানাছ নাই, হেইডা আমি জানি।”
“তাইলে আর জিগাও ক্যান?”
“জিগাইলে ক্ষতি?”
“হ!”
এক হাতে রুটি ছিঁড়ে আলু ভাজি দিয়ে মুখে দিয়ে খেতে খেতে শরীফ প্রতি উত্তর করে টুম্পার কথায়,
“শোন, আমি শরীফ, সজীব না যে সব মাইনা নিমু। কথাডা মাথায় ঢুকাইয়া নিছ, ভালা মতন। তাইলে তোরই ভালা হইব।”
শরীফ খাওয়ায় মনোযোগী হয়। কালকে রাতের ঝামেলায় খাওয়া হয়নি, বেশ জোরে ক্ষিদে পেয়েছে তার।
#চলবে?
#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব_২৪
সকালের আলোটা যেনো আজ একটু বেশিই উজ্জ্বল। উঠোনে জাম গাছটার ডালে ডালে দোল খাচ্ছে হালকা বাতাসে ভেজা পাতারা। রান্নাঘরের চুলোয় হাঁড়ি চাপা, আর সেই চুলোর পাশে দাঁড়িয়ে ঘেমে-নেয়ে একহাতে কড়াই নাড়ছে পারুল। ভোর হতেই সে উঠে গেছে। কাঁথা-বালিশ না গুটিয়েই রান্নাঘরে এসে পড়েছ। আজকে তো রিয়া আসবে জামাই নিয়ে! খালি হাতে তো বোনজামাইরে আপ্যায়ন করা যায় না! তিন পদের ভর্তা, সরষে ইলিশ, বেগুন পোড়া, পোলাও, মাংস রসুন-মরিচ কইরা একরকম যুদ্ধ লাগায়া বসে আছে পারুল। ডালেও পিঁয়াজের বাগার দিয়েছে আর শেষে থাকবে নারিকেল দিয়ে পায়েস। এইসব করতে করতেই ঘাড় ঘামছে তার, কপালের চুল বেয়ে ঘামে লেপ্টে আছে। এই সময় রান্নাঘরের চৌকাঠে এসে ভর দিয়ে দাঁড়ায় সজীব
“তুই তো একেবারে বড়লোকের হোটেল বানাইয়া ফেলছত! যহন খাইতে আইমু, মনেই হইব না গরিব ঘরের খাওন খাইতাছি!”
পারুল না তাকিয়েই বলে,
“খাওন মজা হইলেই আমার কষ্ট স্বার্থক!”
সজীব একটু গা চুলকায়। তারপর বলে
“রান্ধা শেষ হইলে আমার লগে বসে খানিক বিশ্রাম নিস। আমি তোর হাতে এক কাপ চা বানাইয়া দিমু?”
পারুল এবার তাকায়, চোখে-মুখে হাঁসি, কিন্তু মুখে বলে,
“চা বানাইতে আইলে বাড়ি মাথায় ওঠব, আর আমনের চা বানানো মানেই দুধ পুড়া, চা-পাতা, নষ্ট!”
দুজনের এই খানিক কথাবার্তা জমে উঠতে না উঠতেই জমেলা বেগম পিছন দিয়ে আসে। তার মুখখানা কঠিন, চোখে একরাশ অশান্তি।
“তুই বাড়ির রান্নাঘরে এইডা কি নাটক শুরু করছোস সজীব!”
সজীব চমকে উঠে, তারপর বলে,
“আম্মা, খালি তো পাকঘরে আইসা, বইছি। নাটক কি করছি?”
জমেলা বেগম সজীবের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“মাইয়া আইতাছে, জামাই লইয়া। তার আগে তুই পাকঘরের দরজায় মুখ দিয়া বইয়া থাকলে কেমনে হইব! ঘরের বড় পোলা পাকঘরে বউর আচল ধইরা বইয়া আছে! মান সম্মান থাকব? উঠ এহান থেইক্যা!”
কিছু না বলে, সজীব বাধ্য ছাত্রের মতো মায়ের পেছনে পেছনে হেঁটে যায়। আবারও একাকী দাঁড়িয়ে পড়ে পারুল। বুকের মধ্যে হালকা একটা চাপা কান্না দানা বাঁধে—এ সংসারে তার হাসিও যেন জমেলা বেগমের পছন্দ হয় না। কিছু সময় না যেতেই তখুনি সেখানে আসে শরীফ, হাতে চিনির প্যাকেট নিয়ে। পাকঘরের সামনে এসে পারুলকে ডাকে।
“ভাবী? তোমার চিনি আনছি।”
পারুল ভেতর থেকে এগিয়ে এসে চিনির প্যাকেটটা নেয়।
“দেরি হইয়া গ্যাছে না ভাবী? আসলে দোকানদার ব্যস্ত আছিলো।”
“না ভাই, এখনো পায়েস চুলায় দিই নাই। মাংস, মাছ, বেগুন আর পোলাও বাকি আছে।”
শরীফ অবাক হয়ে বলে,
“এহনো এত পদ বাকি!”
“হ, আসলে কাটাকাটি কইরা, ধুইয়া আনতেই যা সময় যায়। নাইলে তো চুলায় দিলে তাড়াতাড়িই হইয়া যায়।”
কথা গুলো বলতে বলতে পারুল কপালে হাত দিলো। ঘাম তার কপাল গড়িয়ে পড়ছে। কাপড়ের আঁচলটুকু দিয়ে মুছে নিলো সেটা। শরীফ দেখে বলে,
“তুমি একলা পারবা কেমনে এতকিছু? তোমার তো সাহায্য দরকার!”
পারুল মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“সামলায় নিতে পারমু।”
“রিয়ারা তো কয়েকদিন থাকব। ওর জামাইর জন্য এমনে পদে পদে রান্না সহ, নাস্তা বানানো এতকিছু একলা করতে গেলে তোমার কষ্ট হইয়া যাইব ভাবী!”
“আহা শরীফ! সামলায় নিমু।”
শরীফ সন্তুষ্ট হলো না পারুলের কথায়। সে গিয়ে চিৎকার করে টুম্পাকে ডাকতে লাগলো। টুম্পা বের হয়ে উঠোনে আসতেই শরীফ একনজর টুম্পাকে দেখলো। তারপর বললো,
“রঙিন শাড়ি পইড়া সাজগোজ কইরা বইয়া থাকলে চলব?”
টুম্পা মুখ ভেঙ্গিয়ে বলে,
“না চললে নাই!”
“এক থাপ্পড় দিয়া তোর তর্ক বাইর কইরা দিমু! ভেতরে কি? জানছ না আইজকা রিয়া আইব? বাড়িতে কাজ বেশি! ভাবী সকাল থেইক্যা একা কাম করতাছে, তুই সাহায্য করলে কি হয়?”
“আমি এডি পারি না!”
টুম্পার কথায় শরীফের রাগ বাড়লো। যতই চাইছে সবটা ঠিক করতে কিন্তু টুম্পা যেন তার বিপরীতে গিয়ে কিছুই ঠিক করবে না! কিন্তু শরীফও হার মানার ছেলে না!
“পারছ কি? কূটনামী করতে!”
শরীফের কথায় টুম্পা এবার ক্ষেপে উঠলো! মিথ্যা কান্নার নাটক করে বলে,
“বিয়া হইতে না হইতেই আমারে মাইরের ডর দেহায়! ও আম্মা গো! তুমি কই আছো গো!”
টুম্পার চিৎকারে বেরিয়ে আসে জমেলা বেগম। এসেই ছোটো ছেলেকে শাষাতে লাগলো,
“মাইয়াডার বিয়া হইছে সবে! এহনি এমন করতাছস? একটু সময় দিবি না?”
“এত সময় নাই আম্মা!”
শরীফের কথা শুনে টুম্পা এবার আগের বেশি জোরে চিৎকার করে বলে,
“খালা আমনে আমার আম্মারে খবর দেন। আমি যামুগা।”
বলতে বলতো টুম্পা ভেতরে চলে গেলো। জমেলা বেগমের মনে ভয় জেঁকে বসলো। নতুন জামাই আসবে, এর মধ্যে তার বোন আসাটা মোটেও সুবিধাজনক পরিস্থিতি হবে না তার জন্য।
“মাইয়াডারে কান্দাইয়া দিলি তো! শুন শরীফ, আমি যেন আর এসব না দেহি। টুম্পা যাতে কোনোকিছুতে কষ্ট না পায় কইলাম। কথাডা মনে রাখবি!”
বলেই জমেলা বেগম চলে গেলেন। পারুল কেবল চেয়ে চেয়ে দেখলো সবটা। শরীফ তখন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পারুলকে বলে,
“এই টুম্পা আমার আম্মার লাইগ্যা নষ্ট হইয়া যাইব বুঝছো ভাবী? হেইডা হইতে দেওয়া যাইব না! বিয়া যহন করছি, তহন অরেই আয়ত্তে আনমু আমি। দেইখ্যো কি করি।”
শরীফের পুরো কথা পারুলের কানে গিয়ে পৌঁছালো কি-না কে জানে! টুম্পা তার বোনের মেয়ে বলে কত ছাড়! অথচ সে বিয়ে করে আসার পর দিনই জমেলা বেগম তাকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। সকালে উঠে ত্রিশটা রুটি থেকে দুপুরের ছয় সাত পদের রান্না সে নিজে করেছে। সাথে ঘরের কাজও! কারন সে জমেলা বেগমের পছন্দের পুত্রবধূ ছিলো না। এসব মনে করে পারুলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসলো দীর্ঘশ্বাস!
“ভাবী! কই আছো?”
রিয়ার কন্ঠে মিষ্টি মায়া, সাথে জামাইও—চোখেমুখে একরাশ লাজ। পারুল দৌড়ে গিয়ে তাদের কাছে যায়। মুখে হাসি ফোটে
“আরে, রিয়া! কেমন আছো?”
“ভালা আছি দেইখ্যাই তো বাপের বাড়ি আইয়া পড়ছি।”
“ভেতরে আইও।”
রিয়া স্বামী সমেত ভেতরে ঢুকতে নিচ্ছিলো তখুনি চোখে লাগে টুম্পাকে। বউদের মতন কাপড়ের আচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়েছে। নাকে নাকফুল। কেমন যেনো বউ বউ দেখতে লাগছে তাকে। রিয়া এগিয়ে গিয়ে টুম্পাকে বলে,
“কি’রে? তোরে তো একদম বউ বউ লাগতাছে!”
“কারন হেয় বউ, তার লাইগ্যা!”
পারুলের উত্তর শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকায় রিয়া। জমেলা বেগম তখন ঘর থেকে সব শুনছিলো। জামাইর সামনেই টুম্পার এভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়াতে বেশ রাগ হলো তার মনে। কিন্তু পরিস্থিতি সাপেক্ষে কিছু বলতে পারছে না। দাত কিড়মিড়িয়ে সব শুনতে লাগলো।
“কিয়ের বউ! আমি গেলাম আর তিনদিনের ভিতরে টুম্পার বিয়া হইয়া গ্যাছে? তাইলে টুম্পার তো স্বামীর বাড়ি থাহনের কথা! আমগো বাড়িত কি করে ভাবী?”
একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো রিয়া পারুলের উদ্দেশ্য। পারুল জানতো এরকমই হবে। এর উত্তরও সে সাজিয়েই রেখেছিলো, কারন সাথে কবীর আছে। এখন সেই কবীর পুরনো কবীর নেই। এখন এই বাড়ির জামাই। সেই সাথে জড়িয়ে আছে বাড়ির সম্মানও।
“টুম্পা এই বাড়িরই বউ! খুব তাড়াহুড়ায় শরীফের লগে টুম্পার কোনোমতে বিয়া হইছে, আব্বার ইচ্ছামতন কেবল কাজী আইনা।”
অবাকের শেষ সীমানায় গিয়ে পৌঁছালো রিয়া। তার ভাইজানের সাথে শেষমেশ টুম্পার বিয়ে? মনে হচ্ছে কেউ যেন তার সাথে মজা করছে! পারুল বিষয়টা বুঝে ফের বলে,
“পরে অনুষ্ঠান হইব নে। এহন কোনোমতে বিয়াডা হইলো আর কি। এবার ঘরের ভিতরে ঢুকো! বাকি কথা পরে কইও।”
রিয়া জামাই সহ ভেতরে ঢুকলো। বাড়ির ভেতর পারুল খাটে আসন পাতায়া বসায়, বায়ু দিলো হাতপাখায়। খোঁজখবরের পর্ব চলে খানিকক্ষণ, তারপর খাবার বেড়ে দেয় পারুল নিজে হাতে। জামাই পোলাওয়ে প্রথম গ্রাস তুলতেই বলে,
“খাবার দারুণ হইছে ভাবী!”
বিনিময়ে পারুল মুঁচকি হাসে। বেশ তৃপ্তি নিয়েই রিয়া আর কবীর খাওয়া সম্পন্ন করে। ভরপেট খেয়ে কবীর এবার ঘুম দিয়েছে।
বিকেল গড়াতেই, বাড়ির পেছনের মাঠে আম গাছটার ছায়ায় বসেছে রিয়া, চুল খোলা,আর তার পেছনে বসে পারুল, নারকেল তেল দিয়ে রিয়ার মাথায় আলতো করে তেল দিতেছে। রিয়া আরামে চোখ বুঁজে আছে।
“ভাবী, আগে যদি বুঝতাম, তোমার লগে এরম করতাম না!”
“রাখো তো পুরান কথা, তোমার চুলডা বেশ পাতলা হইয়া গেছে, এই কয়দিনে।”
রিয়ার কন্ঠে চাপা ক্লান্তি।
“হ, চুল উইঠ্যা যাইতাছে সব।”
পারুল আবারো রিয়ার মাথায় তেল দিতে থাকে, যত্ন সহকারে। একসময় আলতো কইরা প্রশ্ন করলো,
“রিয়া একটা কথা জিগাই?”
“কও ভাবী।”
“তোমার পেটে বাচ্চা কবীরের আছিলো তাই না? তাই কবীর তোমারে বিয়ার প্রস্তাব দিছে?”
পারুলের এরকম প্রশ্নে রিয়া যেনো থমকে গেলো। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ। তারপর বলে,
“এইডা মনে করলা ক্যান?”
“কারণ তুমি নির্দ্বিধায় বিয়াতে রাজি হইছো। দুইয়ে দুইয়ে চার করলে তো এডাই দাঁড়ায়, যে কবীরের বাচ্চাই তোমার পেডের মইধ্যে আছে!”
“না।”
রিয়ার প্রশ্নে পারুল চমকে উঠে। অবাক দৃষ্টি নিয়ে রিয়াকে শুধোয়,
“তোমার পেডে বাচ্চাডা কবীরের না?”
রিয়া আবারো একই উত্তর করলো,
“না।”
এবার কেঁপে উঠলো পারুল। সে যা ভেবেছিলো তা নয়! তবে সত্যিটা কি? আবারো রিয়াকে প্রশ্ন করার জন্য প্রস্তুত হতেই, রিয়া তার সামনে ঘুরলো। কিছু বলার চেষ্টায়।
#চলবে?