#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-২৫
“আমাগো বাড়ির লগে যে মিনু? পোয়াতি হইয়া গেছিল আর ওর বাপ মা’য় একটা বুড়া বেডার লগে বিয়া ঠিক করছিলো, আর মিনু পুকুরে ঝাপ দিয়া মরলো? মনে আছে তোমার সেই ঘটনা?”
পারুল মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করলো। ফলাফল ব্যর্থ! তার কিছুই মনে পড়লো না। তা দেখে রিয়া পুনরায় বলে,
“আমি শুনছি আম্মার থাইক্যা। দুনিয়ার সব খবরই হের কাছে পাওয়া যায়।”
পারুল খুব আগ্রহ নিয়ে শুধালো,
“তারপর?”
“তারপর আর কি? মিনু মইরা গেলো! কিন্তু আমার মাথায় তখন একটা বুদ্ধি আইছিলো।”
“কি?”
“আমার জামাই যহন আমারে পড়াইতো আইতো না? আমার অরে খুব পছন্দ হইতো।”
“এইডা আমি বুঝতামই, এহন আসল ঘটনা কও?”
রিয়া একটু দম নিয়ে বলতে শুরু করে,
“তারপর ওর হাবভাবে ও আমি বুঝি সেও আমারে পছন্দ করে। আমরা দু’জনে মনের কথা খুইলা বলি, একে অপরের কাছে। আমি জানতাম আম্মা কখনো মাইন্যা নিব না, তার লাইগ্যাই মিনুর মরার কাহিনী শুইনা মাথায় বুদ্ধি আইয়ে, আমিও মিথ্যা পোয়াতী হওনের নাটক করমু। তখনই কবীর প্রস্তাব নিয়ে আইব। আর সবাই না পারতে সে প্রস্তাবে রাজি হইয়া যাইব। আর দেহো, হইছেও একই ঘটনা।”
সবটা বলা শেষ করে রিয়া বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। পারুলের চোখেমুখে কেমন আঁধার আঁধার ভাব। কিছুটা গম্ভীর হয়েই রিয়াকে বলে,
“সবাই অনেক কষ্ট পাইছে রিয়া। এইডা উচিত হয় নাই।”
“আমি যে সুখে আছি? এইডা দেখলে সবাই যে কষ্ট পাইছে তা দূর হইয়া যাইব।”
“তাও, তুমি ভুল করছো।”
“ভালো থাকার লাইগা একটু ভুলই না হয় করলাম ভাবী।”
পারুল নিশ্চুপ হয়ে রইলো। রিয়া ফের বলতে আরম্ভ করে,
“আর না করলে আম্মা আমারে শেফালী চাচীর দেওরের লগে বিয়া দিয়া দিতো। এইডা নিশ্চয়ই আমার লাইগ্যা ভালা হইতো না? এসব কারনেই আমি এমন করছি।”
সবটা শুনে পারুলের আর এই বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। রিয়ার যুক্তি শুনেও তার মন গললো না। কারন রিয়ার কি হবে ভেবে ভেবে সেদিন বাড়ির যে অবস্থা হয়েছিলো, বিশেষ করে সজীবের। সেই মুহুর্ত পারুল কখনো ভুলবে না। তাই সত্যিটা জানার পরও পারুলের মনে রাগ রয়ে গেলো।
“পারলে সবাইরে সত্যিডা কইয়া দিও।”
বলেই সেখান থেকে চলে যায় পারুল। রিয়া করুন দৃষ্টি নিয়ে পারুলের যাওয়া দেখলো। সে তো হাল্কা হতে চেয়েছিলো সেজন্যই পারুলকে সত্যি বললো। এখন পারুলের প্রতিক্রিয়া দেখে তার মনে হচ্ছে না বললেই ভালো হতো। না হয় একটু ভুলই হতো! ভালোবাসার জন্য কত কত ভুল ফুল হয়ে যায়!
~~~~~~~
সকালের রোদ্দুর তখনো মধ্য গগনে ওঠেনি, কিন্তু চারদিক যেন আগুনে পুড়ছে। বাতাস নেই বললেই চলে। ভোরের স্নিগ্ধতা’কে অনেক আগেই গিলেছে একটা ঘামচাপা ভ্যাপসা গরম। গাছপালার পাতাগুলো একটুও নড়ে না। এই গরমের মধ্যেই পারুল কাজ করছে নিঃশব্দে। কাঁধে শাড়ির আঁচল বাঁধা, কপাল ভিজে গেছে ঘামে, তবু হাত থামে না। এক হাতে ডাল বাটছে, অন্য হাতে চাল বেছে নিচ্ছে। মাঝে মাঝে মুখের ঘাম কনুই দিয়ে মুছে নিচ্ছে, আবার চুলের গোড়ায় পিঁপড়া কামড়ানোর মত অস্বস্তিতে এক চিলতে বিরক্তি ছুঁয়ে যাচ্ছে মুখের রেখা। চুলোর পাশে আগুন এখনো টিমটিম করে জ্বলছে, তার তাপে যেন চারপাশ আরও ঝিমিয়ে পড়ছে। কড়াইয়ে ডালের ফোটার শব্দ, ধোঁয়ার তাপে চোখ জ্বলে উঠে, কিন্তু তবু থামে না পারুলের হাত। ঘরে নতুন জামাই, বড় বউ হিসেবে তার যে অনেক কাজ!
এই গরমে যেন ঘর, উঠোন, শরীর সব একসাথে ঘেমে গেছে। অথচ পারুলের মুখে কোনো অভিযোগ নেই। কেবল মাঝে মাঝে থেমে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায়, সেখানে কোনো মেঘ নেই, কোনো বৃষ্টির চিহৃ নেই। তার ঠোঁটের কোণে একফোঁটা ক্লান্তির দাগ জমে, কিন্তু সে দাগ মুছে ফেলে নিজের মত করে। সংসারের কাজের মতই ঘাম ঝরে, দেহ পোড়ে, তবুও চলতে হয়। হুট করেই সেখানে এসে উপস্থিত হয় কামাল হোসেন। পারুল তৎক্ষনাৎ মাথায় ঘোমটা দেয়। তিনি গম্ভীর সুরে পারুলকে বলে,
“পারুল! টুম্পারে লইয়া আমার ঘরে আইসো।”
পারুল চমকে উঠে। গোটা বাড়ির মত তারও এখন একেকটা ডাকে একেকটা পূর্বাভাস মনে হয়। টুম্পা তখন উঠোনে বসে বসে ভেজা জামাকাপড় মেলে দিচ্ছিলো, টুম্পা চুলার আঁচ কমিয়ে বেরিয়ে এসে, চোখে-মুখে জিজ্ঞাসু অভিব্যক্তি নিয়ে টুম্পার দিকে তাকায়।
“চলো, আব্বা ডাকছে।”
টুম্পা একটু থমকে দাঁড়ায়।
“ক্যান? আবার কি হইলো?”
পারুল একরকম ফিসফিস করে বললো,
“বোধহয় জরুরী কিছু, কামের কথা।”
টুম্পা মুখ শক্ত করে বললো,
“আমি যামু না! কোনো কামে আমি নাই।”
পারুল বিরক্ত হয়ে বলে,
“তুমি কইবা, তোমার কথা। আর আব্বা যা কয় তাই করা লাগব!”
টুম্পা কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলে,
“আমি কি হ্যাঁ? কইলে সব ঠিক হইয়া যাইব? যে কাজ আমি স্বেচ্ছায় করি না, জোর করে করলে হইব?”
পারুল বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো,
“টুম্পা, এই সংসারটা যদি তুমি নিজের না মনে করো, তাইলে এই ঘরও তোমার না।”
চোখেমুখে আগুন নিয়ে টুম্পা দাঁড়িয়ে পড়লো।
“তুমি কি কইতাছো? আমি কি চাইছিলাম এই ঘরে আসতে?”
পারুল বুঝলো টুম্পা একবার শুরু করলে আর থামবে না! সেজন্যই বলে,
“তুমি যাও,আব্বার সামনে দাঁড়ায় নিজের কথা নিজেই কও।”
টুম্পা দরজা পর্যন্ত এসে আবার থেমে গেল। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আজ যাইতাছি, কাল থেইকা আমি কারও কোনো হুকুম শুনুম না।”
পারুল কিছু না বলে সরে গেল। কামাল হোসেন বসে আছেন গামছা পেতে রাখা চেয়ারটায়। টুম্পা ঢুকতেই কামাল হোসেন তাকালেন। মুখে সেই চিরাচরিত গাম্ভীর্য।
“বসো।”
টুম্পা বসলো। কোনোরকমে। চোখে মুখে অবাধ্যতার ছায়া।
হঠাৎই কণ্ঠে একরাশ চাপা ক্ষোভ এনে বললেন,
“এই বাড়িত সব কাজ পারুল করবো? মেয়ে জামাই আইছে, গরমে এত কাজ সব কি পারুল করব? টুম্পা কি শুধু গল্প করবার লাইগ্যা আইছে?”
টুম্পা চুপ। মাথা নিচু। তার মুখে কথার বুনট হারিয়ে গেছে। কামাল হোসেন এবার মুখ ফিরিয়ে বলেন,
“ছোট-বড় যাই হও, সংসার মানে দায়িত্ব। পারুল না থাকলে এই ঘর চলতো না। টুম্পা, তুই নিজের কাজ নিজে বুঝিস না ক্যান? সময় হইছে এখন থেকে নিজের দায়িত্ব পালন করবি। সব করবি ঠিকাছে?”
টুম্পা গলায় বিরক্তি নিয়ে বললো,
“আমনেরা যেইটা ঠিক মনে করছেন, সেইটা কইরা ছাড়তাছেন। আমি তো কিছু করতেই পারি না।”
কামাল হোসেন এবার চোখ তুলে সোজাসুজি বললেন,
“তুই চাইলে অনেক কিছু পারছ, টুম্পা। কিন্তু তুই চাস না। এইটা তোর জিদ। আর এই জিদে তুই হারবি, তহন শরীফ না, তুইই নিঃস্ব হবি। পরে মাইনষের কথা শুইনা বাপের বাড়ি পার করা লাগব! একূল ওকূল কোনো কূলই পাবি না!”
টুম্পা চুপ। একদম নীরব। শুধু চোখের দৃষ্টিটা একটু নরম হলো।
“দেখ, এই সংসার আমি অনেক কষ্টে গড়ছি। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়া কিছুই হইব না এই বাড়িতে। তুই এখন এই ঘরের বউ। শরীফের বউ। এইডা তুই না মানলেও। পারুল যেই দায়িত্ব এতদিন একা সামলাইছে, এখন তার ভাগ তোর উপর পড়ব। কাল থেইকা তুই পাকঘরের দায়িত্ব নিবি।”
কামাল হোসেনের কথাগুলো শুনে টুম্পা পারছে না এখুনি চলে যায়! তখনি মনে আসলো, স্বামী ছাড়া বাপের বাড়ি পরে থাকা শিলার কথা। সবাই তারে উঠতে বসতে খোঁটা মারে। টুম্পা না মানলেও সবাই জেনে গেছে সে শরীফের বউ! আর এই নতুন অবস্থায় শরীফ যদি টুম্পাকে ছাড়লে টুম্পার অবস্থা যে শিলার মতন হবে সেটা সে ভালো মতনই টের পেলো। সেজন্যই টুম্পা মৃদু কণ্ঠে বলে,
“আমি যদি না পারি?”
“তাহলে সময় নিয়া শিখবি। আর যদি তাও না পারছ তাইলে তোর আর কোনো মানে নাই এই ঘরে।”
টুম্পা থমকে গেলো। সে জানে, তিনি যা বলেন, তাই করেন। দু’জনে বের হয়ে গেলো। পারুল রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলো আর টুম্পা দাঁড়িয়ে ছিলো আনমনে। তখুনি সেখানে শরীফ আসে। এসেই টুম্পাকে বলতে আরম্ভ করে,
“আব্বা কি কইছে মনে থাকে যেন?”
বিনিময়ে টুম্পা মুখ বেঁকিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। শরীফ পারুলকে বলে,
“দেখছো ভাবী? কইছি না এহন থেইকা তোমার কাম কমবো! টুম্পায়ে আমি আয়ত্বে আনমু? আমি আমার কথা রাখতাছি।”
“আব্বা তো খুব রাগী শরীফ। তুমি আব্বারে দিয়ে টুম্পারে কামের ভাগ না দেওয়াইলেও পারতা!”
“ভাবী! এই ভালো মানুষী ছাড়ো। টুম্পা আমার বউ, আর বউ মানে সব দায়িত্ব কর্তব্য পালন করবো। একা তুমি খাঁটবা কেন? আর তাছাড়া টুম্পারে সোজা পথে আনতে হইলে এমনই করতে হইব!”
“যা ভালা মনে করো।”
পারুল চলে যায় রান্নাঘরে। শরীফ সেখানে দাঁড়িয়ে টুম্পার মুখটা মনে করতে থাকে। যতবারই টুম্পার মুখটা মনে আসে ততবারই তার হাসি পায়। টুম্পাকে সে বড্ড ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষটির ভালোর জন্যই করছে সে এতসব। এটাই বিশ্বাস করে। সেজন্যই তো সকালে কামাল হোসেনকে নিজে গিয়ে বলে সবকিছু।
ঐদিকে ভিতরের ঘরে জমেলা বেগম বসে ছিলেন একা। হাতের কাজ বলতে পুরনো থলে ভরা সুতা; কিন্তু মন তার অতীত আর বর্তমানের হেঁয়ালিতে আটকে। কি হবে ভেবে কূল পাচ্ছে না! তেমন সময়েই হঠাৎ উঠোনে পা ফেলে ঘরে ঢোকে তার বড় বোন, রাহেলা। বোনকে দেখে জমেলা যেন চমকে ওঠে। বিস্ময়ে চোখ দু’টি ইতিমধ্যে বড়বড় হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে যেন ভুল দেখছে! অবাক স্বরে জিগ্যেস করে,
“আপা আমনে হঠাৎ? কোনো খবর না কইয়া?”
রাহেলা বেগম একটু হেসে বলেন,
“খবর দিমু কি? তরাই তো আমারে খবর দিয়া আনলি?”
রাহেলার কথায় জমেলা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মানে বুঝতে না পেরে জিগ্যেস করে,
“আমি?”
“হ, তোর জামাই তো খবর দিয়া আনলো। কইছে জরুরী কথা আছে। তোর দুলাভাইরে লইয়া আইতে।”
এই কথা শুনে জমেলার মুখ থমকে যায়। মনে হচ্ছে এখুনি কামাল হোসেন কে চিবিয়ে খেতে! তিনি যে টুম্পার বিয়ের কথা বলতেই রাহেলাকে খবর দিয়ে এনেছে, সেটা আর বুঝতে বাকি নেই! সে কীভাবে এখন সবটা সামাল দিবে? তারউপর ঘরে নতুন জামাই! কোনো কিছু তো ভাবেওনি যে আবোলতাবোল বুঝিয়ে দিবে বড় বোনকে চোখেমুখে একরকম চিন্তার ছায়া। রাহেলা বেগম তখন হাসি মুখে জমেলা বেগমের কাছে আসে। জমেলার বুঝতে বাকি রইলো না, রাহেলার সেই হাসির মানে। তার বোনের রূপ মনে করে মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ে নিচ্ছে! সব জানার পর কি হবে ভাবতেই এখুনি জ্ঞান হারাবেন তিনি এমন ভাব চোখেমুখে!
#চলবে?
#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-২৬
জমেলা বেগমের মুখ থমকে আছে। ভিতরে ভিতরে আগুন জ্বলছে, কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। রাহেলা বেগম নরম গলায় বললেন,
“কিরে, কইলাম তো খবর দিয়া আনছিস, আর তুই অমন মুখ বানাইলি ক্যা?”
জমেলা তখনো নিজের মধ্যে অচল। একটু চমক ভাঙতেই বললো,
“না না, আপা, তুমি আইছো দেখে ভালা লাগলো। তুমি না আইলে আমিই কইতাম আইতে।”
“হ, জামাই তো এমনই কইলো। বললো, বড় ভাইরে লইয়া আসেন, জরুরী কথা আছে।”
জমেলা বেগম চোয়াল শক্ত করে ফেলেন। তার মাথায় তখন দপদপ করছে একটাই কথা, এই সময়েই নতুন ঝামেলা কেন? তিনি সামাল কিভাবে দিবেন! সেই মুহূর্তে কামাল হোসেন ঘরে ঢোকেন। দেখে মনে হয় যেন সব ঠিকঠাকই সাজানো তাঁর ছকে।
“আসসালামু আলাইকুম, আপা। কেমন আছেন?”
গম্ভীর অথচ সম্মান মেশানো কণ্ঠে বললেন।
রাহেলা বেগম হেসে উত্তর দেন,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, ভাই। ভালোই আছি। তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর রহমতে ভালো। আপা, কিছু কথা আছিলো আপনার লগে। ভাবলাম সামনে সামনিই বলা হোক।”
জমেলা থম মেরে চুপচাপ বসে থাকলেও তাঁর চোখে মুখে অসহায়তা ঘনীভূত হচ্ছিলো। রাহেলা বললো,
“বেশ, কথা কও। কি এমন কথা?”
“দেখেন আপা, এখন আপনার মেয়ে বাড়িতে। শরীফ আর টুম্পার বিয়া হইছে। আমরা শরীফের বিয়ের পর আনুষ্ঠানিক কিছু করিনি। ঘরোয়া পরিবেশে বিয়েটা হইছে, কিন্তু আমনেগো সমাজের সামনে এখনো সম্পর্কটা স্বীকৃত নয়। আমি চাই ঈদের আগেই ছেলের বউরে নিয়ম করে একটুআধটু শাড়ি দিয়া আনুষ্ঠানিকতা করি। আর লগে আমনেগো কাছ থেইকা একটা ছোট মিষ্টির হাঁড়ি আসুক। সমাজ কি না দেখে বলেন?”
রাহেলা বেগম প্রথমে বেশ হাসি মুখেই ঢুকেছিলেন ঘরে। কিন্তু মুহূর্ত কয়েকের মধ্যেই কামাল হোসেনের কথায় তার মুখের সেই হাসি যেন খসে পড়লো পাতাঝরা গাছের পাতার মতো। অবাক স্বরে জিগ্যেস করে,
“কি কইলেন? আমার মেয়ের বিয়া দিয়া দিছেন! আর আমি জানলাম না?”
কণ্ঠে রুদ্ধশ্বাস বিস্ময়। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। কপালের ভাঁজে ভরে উঠছে অবিশ্বাস। জমেলা বেগম ঠোঁট চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে এক পাশে। এমন পরিস্থিতির জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। সে জানতো রাহেলা রাগ করবে, কিন্তু এমন অবাক আর কাঁপা কণ্ঠে প্রতিক্রিয়া দেবে, তা কল্পনায় ছিল, না।
কামাল হোসেন গলা খাঁকারি দিয়ে ধীর স্বরে বলেন
“আপা, আগে বসেন। কাহিনীটা শুনেন। তারপর রাগ করেন।”
রাহেলা বেগম বসে পড়েন ঠিকই, তবে সেই বসা যেন আগুনের উপর। চোয়াল শক্ত করে বসে আছেন, চোখে মুখে রাগ। কামাল হোসেন গলা নামিয়ে শান্তভাবে বলতে শুরু করেন। সবটা শুনো রাহেলা বেগম বললেন,
“তাইলে বিয়া দিয়া দেওনের সময় তোমার মনে পড়লো না ওর মা আছেন?”
রাহেলার কণ্ঠ কাঁপে রাগে। রাগের চোটে কথাই বলতে পারছে না!
“আপা, এইটাই যদি না করতাম, হেইদিন যেইদিন ধইরা বিয়া দিলাম,লোকে কইতো , ‘রাহেলার মাইয়া দুনম্বর”
এইবার একটু থেমে, তারপর ভারী নিঃশ্বাস ফেলে তিনি বলেন,
“আমি তো পুরুষ মানুষ আপা, আমি যদি এসব কতা কই, আমনের গায়ে লাগবে। এখন লোক জানে, টুম্পা তার স্বামীর ঘরে আছে, শরীফের বউ হইয়া আছে, সে রক্ষা পাইছে। আমনে কি চান আমনের মেয়েরে লোকে শিলার মতো গাল পাড়ুক?”
রাহেলা নরম হয়। সে জানে, কামাল হোসেন মিথ্যে বলেনি। এই সমাজে মেয়েদের চরিত্র ঢাল দিয়ে বাঁচাতে হয়, সত্য দিয়ে না। তবু বুকে বাঁধে। নিজের অমন কোমল মেয়ে, তার ভবিষ্যত, এমন সিদ্ধান্তে বন্দি করে দেওয়া মায়ের মনে কেমন করে না লাগে? তারউপর উনার পছন্দ ছিলো সজীবকে! কিন্তু দমে যাবার পাত্রী উনিও না। রাহেলা নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে,
“টুম্পা রাজি আছিল?”
জমেলা বেগম এইবার মুখ খোলে। গলা ভারী করে বলে,
“না আপা. শুরুতে তো রাজি আছিল না। চিল্লাচিল্লি, কান্নাকাটি কত কিছু হইছে। কিন্তু তখন উনি কইল—সমাজ দেখবে, তারা কথা কইবে। যদি বিয়া না হয়, তো মুখ দেখাইতে পারবো না।”
“তাহলে জোর কইরা বিয়া?”
“না, ঠিক জোর কইরা না। শরীফ তো সম্মানের লাইগা নিজ ইচ্ছেয় রাজি হইছে, বিয়া করলে টুম্পা অন্তত নিরাপদে থাকবো। আর তাই আছে।”
রাহেলার চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ বললো,
“তোমরা এইটা ভালো কইরা করছো মনে করো?”
এইবার কামাল হোসেন একটু রুক্ষভাবে বলে ওঠেন,
“দেখেন আপা, আমি যদি এহন না করতাম, কাল তো পস্তাইতে হইতো। আমি যা করি, বাড়ির মানসম্মানের লাইগাই করি। মেয়ে আমার ঘরে আছে, বিয়াও হইছে, এখন যদি এইসব নিয়া আর ঘাঁটা হয়, তাহলে তো আমনের মাইয়ারই সর্বনাশ হইবে। এই সমাজে টুম্পার আর বিয়া দিতে পারতেন না! এখন জামাইর পরিচয় লইয়া সুখে আছে বিয়াডা না দিলে বদনাম লইয়া বাঁচতো!”,
একটা থেমে গিয়ে তিনি এবার জমেলার দিকে ঘুরে বলেন,
“তুমি তোমার আপারে বুঝাও। আমি পুরুষ মানুষ, বুঝানোর ঢঙ ভালা না। এইডা তো তোমার ঘরের বিষয়। তুমিই ভালা বুঝবা। আমার চাইতে তোমার মুখের কথা ওনার কাছে অনেক বেশি কাজ করব।”
জমেলা বেগম চুপচাপ মাথা নাড়ে। রাহেলার চোখে তখনো জিজ্ঞাসার ছায়া। মুখে লেগে থাকে একরাশ চাপা রাগ। তার মেয়ের ভবিষ্যৎ, নিজের অজান্তেই লেখা হয়ে গেছে। এখন শুধু তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কারন সমাজ ব্যবস্থাই এরকম।
“আপা আমি তোমারে আরেকটা কথা কই? যেইডা কেউ জানে না!”
“কি?”
তারপর জমেলা বলতে আরম্ভ করলো তার সেই কুৎসিত পরিকল্পনার কথা। কীভাবে সজীবের জায়গায় ভুলক্রমে শরীফ আসে! সবটা শোনার পর রাহেলা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বোনকে বলে,
“চিন্তা তো তুই জমপেশ করছিলি! কপালের দোষে কাজে লাগে নাই।”
জমেলা বেগমের মুখে এবার হাসি ফুটে উঠে। যাক বোনকে তবে তিনি বোঝাতে পেরেছেন! কিন্তু সেই হাসি ঠোঁটে বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। রাহেলা বেগম পুনরায় বাঁজখাই কন্ঠে বললেন,
“কিন্তু তোর ছুডো পোলায় তো মহা পন্ডিত! হের মতন পোলার লগে আমার মাইয়া কেমনে সংসার করব?”
“তুমি চিন্তা কইরো না আপা, আমি আছি না? আমি টুম্পারে আমার মাইয়ার মতন দেইখ্যা রাখুম!”
“তুই আছস দেইখাই আমি তোর বিয়াত্তা পোলার লগে আমার মাইয়ারে বিয়া দিতে চাইছিলাম। কারন তুই টুম্পারে দেইখ্যা রাখবি আর সজীবের মতন আলাভোলা পোলাই খুঁজতাছিলাম। কিন্তু কপালে জুটছে তোর পন্ডিত পোলায়!”
“পোলা তো আমারই আপা। তুমি চিন্তা কইরো না! টুম্পা যেমন সজীবের বউ হইলে যেমনে রাখতাম এহনো তেমনেই রাখমু!”
রাহেলা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“কথাডা মনে রাহিস, আমার মাইয়ার দেখভাল তোর হাতে দিয়া দিলাম! এবার ছাড় দিছি কিন্তু পরের বার ছাড় দিমু না!”
জমেলা বেগম রাহেলাকে নিশ্চিন্ত করতেই মেয়ের সাথে কথা বলতে চাইলেন। টুম্পা আসলো। মা’কে দেখেই কাঁদোকাঁদো মুখ করে মনের সব কথা উগড়ে দিলো!সব শুনে রাহেলা বেগম টুম্পাকে বলে,
“আমার বইনে আছে দেইখা চুপচাপ মাইন্যা নিছি। কিন্তু এক্কেবারে চুপচাপ তা মানমু না! হুন মাইয়া, শরীফ সজীবের মতন নরম না, হেয় গরম আছে। হেই লাইগ্যা তোরে শরীফরে আয়ত্তে আনতে হইব। এই সংসারো সবার চক্ষের মনি পারুল না? তারে চক্ষের বিষ কইরা চোখের মনি হইবি তুই! আর আমার বইনে তো আছেই। আশা করি আম্মার পরামর্শ হুনলে তুই অসুখী হইতি না।”
মায়ের কু পরামর্শে মাথা দুলিয়ে সম্মতি প্রকাশ করলো টুম্পা। জমেলা বেগম সবটা দেখে বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে টুম্পাকে বলে,
“আপা আইছে, ভালা মন্দ যা আছে, সব আইনা দে পাতে!”
রাহেলা বেগম গম্ভীর হয়ে বললেন,
“কুনো দরকার নাই! আমি কিচ্ছু খামু না। যা কইলাম তা যেন মনে থাহে!”
বোনের কথার পৃষ্ঠে কথা বাড়ানোর সাহস হলো না জমেলার। টুম্পা হুট করেি মা’কে জড়িয়ে ধরলো, রাহেলা বেগম ও আগলে নিলো মেয়েকে।
~~~~~~~~~
“টুম্পা? ওই টুম্পা! বাঁইচা আছস?”
উঠোনে দাঁড়িয়ে টুম্পাকে ডাকছে শরীফ। শরীফের ডাক শুনেই টুম্পা বেরিয়ে এসে বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলে,
“কি হইছে?”
শরীফ রসিকতার সুরে বলে,
“অহ্, বাইচা আছস দেহি!”
“ক্যান? মইরা গেলে তুমি খুশি হইতা?”
“না, ভাবছিলাম মাইকিং করন লাগব, তোর নিখোঁজ সংবাদে!”
শরীফের এরকম কথা টুম্পার ভালো লাগলো না। রাগ হয়ে ভেতরে চলে যাচ্ছিলো ঠিক তখুনি শরীফ টুম্পার হাত ধরে বসে। টুম্পা হাত টানাটানি করতেই শরীফ তৎক্ষনাৎ টুম্পার হাত ছেড়ে দেয়! তারপর আমতা আমতা করে বলে,
“এইনে সন্দেশ আছে। তোর না খুব পছন্দ? তোর লাইগা আনছি।”
মুহুর্তের মধ্যে সব রাগ উবে গিয়ে টুম্পার মুখে হাসি ধরা দিলো। হাসি মুখে শরীফরের হাত থেকে কাগজে মোড়ানো সন্দেশের পোটলা নিজের হাতে নিলো। খুশি হয়ে শরীফকে জিগ্যেস করে,
“আমার লাইগা আনছো! তুমি জানো আমার সন্দেশ পছন্দের!”
শরীফ মৃদু হেঁসে জবাব দেয়,
“নাহ্, আমার আরেকটা বউ আছে। তার লাইগা আনছি।”
“ঢং না কইরা, দেও তো।”
উঠোনের এক পাশে দাঁড়িয়ে পারুল এই দৃশ্য দেখে। একটা চাপা হাসি তার ঠোঁটে ধরা দেয়। হয়তো সব টানাপোড়েনের মাঝেও কিছু কিছু সম্পর্ক ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে—টান, সময়, বোঝাপড়া দিয়ে। যদিও সব ঠিক হতে এখনো সময় লাগবে, কিন্তু আশার ছায়া এখন অন্তত দেখা যাচ্ছে।
#চলবে…