#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-২৭
“টুম্পা? আমার লাইগা এক কাপ চা বানাইয়া আনো তো।”
শ্বশুড় মশাইয়ের আদেশ কানে পৌঁছাতেই ইচ্ছে না হওয়া সত্বেও টুম্পা রান্নাঘরে গেলো। পাতা দিয়ে, ধোঁয়ায় কোনো মতে আগুন ধরিয়ে তিন কাপ পরিমাণ চা জ্বাল দিয়ে কামাল হোসেনকে দিলো। কামাল হোসেন চা মুখে নিয়ে টুম্পার দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“চা’য়ে চিনি কম হইছে।”
উত্তর শুনে টুম্পার বিরক্ত লাগলেও বলে,
“চিনি দিয়া আইনা দিমু?”
“না, ততক্ষণে চা ঠান্ডা হইয়া যাইব।”
“আইচ্ছা।”
টুম্পা রান্না ঘরে গেলো। চিনির বয়াম থেকে তিন চামচ চিনি মিশিয়ে নিলো। তারপর ভালো করে চায়ের মধ্যে মিশিয়ে মনের সুখে চা খেতে লাগলো। পরপর তিনকাপ চা সে একাই খেয়ে শেষ করলো। তারপর ঘরের দিকে যাচ্ছিলো হুট করেই দেখে কামাল হোসেন উঠোনে বসা। টুম্পাকে দেখেই আবারো বলে,
“পারুল কই?”
“ভাবীরে দেখছি জামাকাপড়ের বালতি লইয়া, পুকুরপাড়ে গেছে।”
“তাইলে তো, হের আইতে দেরি হইব।”
“হ, খালু।”
কামাল হোসেন ভ্রু কুঁচকে বলে,
“খালু?”
টুম্পা তৎক্ষনাৎ জিহ্বায় কামড় দিয়ে ফেলে। কামাল হোসেন ফের বলে,
“আমি না তোর শ্বশুড় হই সম্পর্কে? কিয়ের খালু?”
“আসলে ভুল হইয়া গেছে।”
“মনে রাখিছ, না হইলে মাইনষে হাসবো।”
টুম্পা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝাতেই তিনি বললো,
“পারুল যেহেতু নাই, তুই তো আছিস। এক কাম কর, সংসারের কাম যেহেতু দুই বউ মিইল্যা করবি, তয়লে পারুল যহন নাই, তুই গিয়া ভাত বসায় দে চুলায়।”
রাগে দাত কিড়মিড় করতে করতে জবাব দিলো,
“আইচ্ছা, যাইতাছি।”
পাকঘরে গিয়ে টুম্পা চাল ধুয়ে ভাত বসিয়ে দিলো। চাল কতটুকু পরিমানে নিবে, সেটা জানে না। ফলস্বরূপ আন্দাজিই ভাত বসিয়ে দিয়েছে। ভাত চুলায় ফুটছে আর টুম্পা বিরক্ত হয়ে চুলায় পাতা ঠেলে ঠেলে আগুন দিয়ে যাচ্ছে। পাতা দেওয়া বন্ধ করলেই আগুন নিভে যাচ্ছে, সেজন্য পাতা ঠেলতে লাগলো বসে বসে। গরমে, ঘেমে, চুলায় বস একপ্রকার বিরক্ত টুম্পা! সেই সময়ই সেখানে আসলো জমেলা বেগম। হাই তুলতে তুলতে কলপাড়ে যাচ্ছিলো চুলায় টুম্পাকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। অবাক নয়নে তাকিয়ে থেকে বলে,
“ওমা, টুম্পা! তুই পাকঘরে করোস কি?”
“শ্বশুড় আব্বায় কইছে, সংসারের কাম দুই বউ ভাগ কইরা করতো। এডাই হের শ্যাষ কতা। আর উনার কথামতন আমি অহন রানতে বইছি।”
কন্ঠে বেশ ঝাঁঝ মিশিয়েই কথাগুলো বললো। জমেলা বেগম হা হুতাশ করতে করতে বলে,
“কি আর করমু ক? সজীবের বাপের এক কথা। এডা আসলেই সত্যি!”
“হ, এই কারনেই তো কাম করতাছি!”
“গরমের মইধ্যে তোর অনেক কষ্ট হইতাছে না? কি করবি ক! কিছুই করনের নাই।”
“করার আছে তো খালা।”
জমেলা বেগম ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করে,
“কি করনের আছে?”
“এই যে, আমার গরমের ভেতর কষ্ট হইতাছে, তুমি তো বুঝছো! আমার কষ্টটা না হয় তুমিই কমাও।”
জমেলা বেগমের টুম্পার কথা বুঝে উঠতে কষ্ট হলো না, তবুও শুধোয়,
“আমি কেমনে কমামু?”
“ক্যান? আব্বা কইছে সংসারের সব কাম বাড়ির বউরা ভাগ জোক কইরা করে। তুমিও তো বাড়ির বউই। আর তাছাড়া তোমার যেহেতু আমার লাইগা কষ্ট হইতাছে, তাই তুমিই বও চুলার কাছে আমি গেলাম।”
জমেলা বেগমের উত্তরের আশা না করে টুম্পা দ্রুত হেঁটে ঘরে চলে গেলো। জমেলা তখন চোখ দু’টি বড়বড় করে টুম্পার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। অগত্যা! কোণো উপায় না পেয়ে তিনিই ঢুকলেন রান্নাঘরে। পাতা দিয়ে আগুন ঠেলতে ঠেলতে গরমে নাজেহাল তিনি! একটু থামলেই পাতা শেষ হয়ে আগুন নিভে যায়, ফলে জিড়োবারও ফুরসুত নেই। এই কয়েক মিনিটেই গরমে জমেলা কপাল চুইয়ে চুইয়ে ঘাম পড়ছে! সে রান্নাঘরে এসেছিলো আরো চার বছর আগে। তাও তিনি লাকড়ি দিয়ে রান্না করতেন, পাতার জ্বাল ছেড়ে দিয়েছেন সে কবেই, ধোঁয়ায় আর গরমে বসে থাকতে কষ্ট হয় বলে। কিন্তু পারুল আসায় সেই পুরনো নিয়ম আবার চালু করেছে। লাকড়ির বদলে এনেছে পাতা। বলেছে দুটো পয়সা আয় হবে। পারুলও এত বছর যাবত বিনা বাক্যে তাই করে এসেছে। ভাত হয়ে আসলে ভাতের ফেল গালতে গিয়ে গরম ফেন পড়লো জমেলা বেগমের হাতে! গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে পাকঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসলেন। বাড়িতে তখন কেউই নেই, শুধু টুম্পা ছিলো। সে এসে দেখে জমেলা বেগম হাত ধরে আছে।
“খালা! মানে শ্বাশুড়ি আম্মা! ধুরো, আম্মা আমনের কি হইছে?”
“কি হইছে, চক্ষে দেখোস না মাইয়া!”
যন্ত্রণায় উত্তর দিলেন জমেলা বেগম, তা শুনে টুম্পা ভ্রুঁ কুঁচকে বলো,
“চোখে দেখলেই কি সব বুঝা যায়?”
“আরে কানী, হাতে গরম ফেন পড়ছে। চাইয়া না থাইক্যা, যা তাড়াতাড়ি ঠান্ডা পানি লইয়া আয়!”
জমেলা বেগমের এরকম কথাবার্তায় টুম্পার মনে মনে রাগ হলো। সে পানি আনলো না। উল্টে পানি আনার নাম করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে অন্যদিকে চলে গেলো। জমেলা বেগম তখন জ্বালা হাত নিয়ে নিজেই কল চিপে পানি দিলো। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তিনি চলে গেলেন, তার শেফালীর কাছে। সেখানে গিয়ে পারুলের নামে কতক্ষণ গালমন্দ করলে তবেই যেন শান্তি মিলবে! নিজের মেয়েটা চলে গেছে কোথায় মন খারাপ তার এমনিতেই তার ভেতর এসব!
পারুল পুকুরপাড় থেকে এসে সব জামাকাপড় মেলে দিলো। জামা গুলো আসলে শরীফ আর সজীবের। এতদিন রিয়ার ঝামেলা থেকে শরীফের বিয়ে এসব করে করে কতগুলো কাপড় জমে ছিলো। পড়ার মতন একটাও পরিষ্কার জামা নেই! এখন না ধুয়ে দিলে শুকাতে দেরি হতো। সেজন্যই ধুয়ে দিয়েছে! তারপর রান্নাঘরে যেতেই দেখে বেহাল দশা! বুঝতে বাকি নেই কেউ এসেছিলো।
এরা পারুলের কাজ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে এসে। কাপড় ধুয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে এমনিতেই। এখন আবার এসব দেখে বিরক্ত হলেও কিছু না বলেই চুপচাপ রান্না করে নিলো। এরই ভেতর ঘরে আসলো টুম্পা। পারুল টুম্পাকে দেখেই জিগ্যেস করে,
“কই গেছিলা টুম্পা?”
“গরম লাগতাছিলো, তাই নদীর কাছে গিয়ে বইয়া আছিলাম।”
ক্ষেতের কাজ সেড়ে ঘরে ফিরলো সজীব। ঘেমে নেয়ে পারুলের একাকার অবস্থা তখন! পারুল আর টুম্পার কথোপকথন সজীব শুনতে পেয়ে বলে,
“টুম্পা? গরম তোর একাই লাগতাছিলো?”
“ওমা? গরম একলা কারো লাগে না-কি!”
“তাইলে পারুলের গরম লাগে নাই? আব্বা কওনের পরও তুই কামে ফাঁকি দিয়া গেছস, হাওয়া খাইতে!”
টুম্পা রাগ দেখিয়ে সজীবকে বলে,
“ভালোই বউর পক্ষ লইয়া কথা কও ইদানীং! আমি কাম করি নাই? সকালে চা বানাইছি, ভাত রানছি তারপর গেছি।”
সজীবকে বলার অবকাশ না দিয়ে টুম্পা ঘরে চলে গেলো। পারুল তখন অবাক হয়ে সজীবের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটা দিনদিন কেমন অচেনা হয়ে উঠছে তার কাছে। তবে এই অচেনা পুরুষটাকেই এতোদিন মনে মনে চেয়েছিলো পারুল। যে সবসময় পাশে থাকবে। কিন্তু সজীব ছিলো মায়ের বাধ্যগত ছেলে। বিয়ের এতোগুলা বছর ধরে সে তাই দেখে আসছে। আর আজকে কয়েক মাসে, সজীব একটু একটু করে বদলাচ্ছে। সেটা খুব ভালো ভাবেই টের পেলো পারুল। এই বদলই তো সে চেয়েছিলো।
“ও ছুডো বউ! আর আমি বড় বউ। তাছাড়া বিয়া হইছে নতুন, বয়স অল্প। এহনো এতকিছু বুঝে না।”
“তোরও অল্প বয়সেই বিয়া করছি আমি।”
“হইছে হইছে, কথা বাড়াইয়েন না তো। হাত মুখ ধুইয়া খাইয়া লন।”
সজীব কল চিপে চোখে মুখে পানি দিয়ে আসতেই পারুল তার আঁচল দিয়ে সজীবের চোখমুখ পরম যত্নে মুছে দিলো। ওদিকে টুম্পা ঘরে গিয়ে দেখে গরমের ভেতর শরীফ কেমন সটান হয়ে শুয়ে আছে! টুম্পার মাথায় রাগ চড়েছে, আর এদিকে শরীফ মনের সুখে শুয়ে আছে! টুম্পার যখন বারো বছর বয়স, একটু একটু বুঝের হয়েছে। তখনই তার মা আর খালাকে গল্প করতে দেখতো। জমেলাকে বলতে শুনতো তার বড় ছেলের সাথে টুম্পার বিয়ে দিবে। বড় বউ হবে টুম্পা। মা আর খালার কথাগুলোই যেনো টুম্পার কানে গেঁথে গেছিলো, সেই থেকেই সে সজীবের প্রতি দৃষ্টি অন্যরকম করে ফেলেছিলো। সজীব যখন পারুলকে বিয়ে করে আনে, তখন অবশ্য সে স্বপ্ন ভেঙেচুরে ধূলিসাৎ হলেও তার মা-খালাই তাকে আশা জুগিয়েছিলো এখনো সময় ফুরায়নি। তার নিভে যাওয়া আশার প্রদীপ যেনো তখন আবার জ্বলে উঠেছিলো। কিন্তু এবার শরীফের সাথে বিয়ে হবার পর টুম্পা নিজেই বুঝেছে আর কোনে আশা নয়! এবার তাকে সংসারটা শরীফের সাথেই করতে হবে। তবে আগুনে ঘি ঢালার মতন মা’য়ের কথাগুলোও টুম্পা ভুললো না। এর মধ্যেই শরীফ ডেকে উঠলো। কন্ঠ কেমন ঘোর লাগানো,
“টুম্পা আইলি?”
“হ, আইছি। কিন্তু তুমি কেমনে বুঝছো?”
“তোরে বুঝমু না? এহন তো তুই আমার বউ।”
এখনো মন থেকে শরীফকে মানতে পারেনি বলে, টুম্পার ভালো লাগলো না শরীফের কথা। শরীফ আবারো বললো,
“একটা কাম করবি?”
“কি?”
“আমার টমেটো ভর্তা দিয়া গরম গরম ভাত খাইতে মন চাইতাছে। বানাইয়া আনতে পারবি?”
রান্নায় যে টুম্পা একেবারেই অষ্টরম্ভা সেটা শরীফও জানে। তবুও আবদার করে বসলো! টুম্পা আনমনেই বলে উঠলো,
“হ, পারমু!”
উত্তর দিয়ে টুম্পা নিজেই হতবাক। সে তো পারে না, তাও মুখ দিয়ে পারব কথা বেরিয়ে গেছে! শরীফ শুয়ে থেকেই টুম্পার দিকে এক পলক তাকালো। মৃদু হেঁসে বলে,
“এরকম লক্ষী বউ হইয়া উঠ, তাড়াতাড়ি বুঝলি?”
#চলবে?
#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব-২৮
টুম্পা চুপচাপ উঠলো। মনে মনে ভাবলো,
“লক্ষ্মী বউ হইতে গেলে টমেটো ভর্তা পারতে হইবো!”
এমন কঠিন কিছু না হয়তো? মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলতে লাগলো—আসলে সে কী সত্যিই এই সংসারটাকে নিজের করে নিতে চাইছে, নাকি শুধু পারুলের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে সবাইকে আয়ত্বে আনার, একটা উপায় খুঁজছে?
পাকঘরে গিয়ে দেখে, আগের পাতার ভাঁড়ারে আর কিছুই নেই। ঝুড়ি খালি। কিছু কুড়াতে হবে। চুলার আশেপাশে দুই-চারটে শুকনো পাতা পড়ে ছিলো, টুম্পা তা দিয়েই শুরু করলো। একহাতে পিঁয়াজ কাটছে, আরেকহাত দিয়ে পাতার আগুন ধরে রাখতে গিয়ে নিজেই গরমে হাঁসফাঁস করছে। এই সময় এলো পারুল। চুপচাপ কিছুক্ষণ টুম্পাকে দেখে বলে,
“টমেটো ভর্তা বানাইতাছো?”
“হ।”
“তোমার খাইতে মন চাইলে আমারেই কইতা তহন!”
টুম্পা বিরক্তি নিয়ে উত্তর দেয়,
“আমি না, তোমার দেওর খাইতে চাইছে।”
“টমেটোর খোসা ভালো কইরা পুরাইয়া নিও। আর একটু সরিষার তেল দিয়া ভালো মতন, পিঁয়াজ কুটে লবণ-ঝাল ঠিক রাখবা, তাহলেই টেস্ট হইবো।”
টুম্পা মাথা নিচু করে শুনলো। কিছু বললো না। পারুল চলে গেলো, তবে যাওয়ার আগে একটু থেমে, হালকা কন্ঠে বলে গেলো,
“শরীফের মন টানতে হইলে তার পেট আগে টানবা। পেট ভর্তি থাকলে মানুষ রাগ কম করে।”
পারুলের কথা মতন টুম্পা অনেক কষ্টে রান্না শেষ করলো। ভর্তা বানানো শেষ হতেই শরীফের জন্য থালায় ভাত তুলে দেয় টুম্পা। পাশে একটুখানি সরিষার তেলে ভাজা শুকনা মরিচ আর খুন্তি দিয়ে কুচানো ভর্তা। তারপর শরীফকে খেতে দেয়,
শরীফ খাবার মুখে দিতেই বলে,
“হ, ঠিক এইরকম ভর্তা আমি খাইতে চাইছিলাম! বাহ! তুই তো আসলেই পারলি!”
টুম্পার মুখে লেগে গেলো হালকা হাসি। শরীফের মুখে প্রশংসা শুনে হঠাৎ মনে হলো—হয়তো সে একটু একটু করে সত্যিই ‘বউ’ হয়ে উঠছে। শরীফ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে, টুম্পার বানানো ভর্তা দিয়ে। টুম্পা সেটা চোখ ভরে দেখছে। একটু পরই শরীফ খাওয়া শেষ করে বসে আছে উঠোনে। টুম্পাকে শরীফ বলে,
“চল, একটু নদীর ধারে যাই? তোর সাথে কিছু কথা কইতে মন চাইতাছে।”
টুম্পা চমকে ওঠে।
“নদীর ধারে?”
“হ, সেই জায়গাটা আগে তোরে নিয়ে যাইতাম, মনে পড়ে?”
টুম্পা কিছু বললো না। শুধু হ্যাঁ বোঝায় মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালো। শরীফও উঠে দাঁড়ালো—সাথে করে একটা পুরোনো গামছা নিয়ে নিলো, নদীর পাশে বসা যাবে ভেবে। পথে হাঁটতে হাঁটতে শরীফ বলে,
“তুই যদি একটু চেষ্টা করিস, আজকের মতন। ভাবীর মতন হইয়া যাইবি!”
টুম্পা থেমে গেলো। এতক্ষণ ভালো লাগলেও এবার আর ভালো লাগলো না। হুট করেই টুম্পা উঠে চলে গেলো। শরীফ থ হয়ে তাকিয়ে রইলো! বুঝতেই পারলো না, কোনো কিছু।
বিকেলের দিকে রান্নার পালা এসে পড়ে টুম্পার ভাগে। দুপুরের হালকা বিরক্তি এখনো জমে আছে তার মুখে। পারুল তখন পাতা কুড়াতে ব্যস্ত, আর টুম্পা ধীরে সুস্থে ঘুরঘুর করছে জমেলা বেগমের ঘরের আশেপাশে। যেন এক বিশেষ উদ্দেশ্য আছে তার।
জমেলা বেগম খাটের এক পাশে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। টুম্পা ঢুকেছে দেখেও মুখ ঘোরালেন না। সকালের অপমানের রেশ এখনো টাটকা, টুম্পা পানি আনার নাম করে গা ঢাকা দিয়েছিলো, সেই দুঃখ এখনো রয়ে গেছে জমেলার মনে। নেহাৎ বোনের আদুরে মেয়ে, না হলে তিনি এতক্ষণে এর জবাব বেশ ভালো করেই দিতেন! টুম্পা কয়েকবার এদিক সেদিক করে জমেলার নজর কাড়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু কোন কাজ হলো না। শেষে মুখে একটা রহস্যময় ভাব এনে বলে উঠলো,
“আম্মা জাােন? এই বাড়ির অনেক কিছুই এখন আমার চোখে পড়তাছে।”
জমেলা এবার মুখ ঘোরালেন, কিন্তু মুখে বিরক্তির রেখা স্পষ্ট।
“কী চোখে পড়তাছে তোর? রান্নাঘরের কাজ তো তোরই ভাগে পড়ছে আজ। ঘুরোছ ক্যান?”
টুম্পা মুচকি হাসলো।
“তাই তো কই, সব কাম তো আমাকেই কইরা যাইতে হয়। পারুল ভাবীও কিন্তু এখন একটু ফাঁকি দিতে শিখতাছে মনে হয়। সকালেও পুকুরঘাটে যাইছিল, এখনো পাতা লইয়া ব্যস্ত। রান্নার কতা কেউ কইলো না।”
জমেলা বেগমের চোখে যেন একঝলক আগুনের ঝিলিক।
“আল্লারে!এই বউটা নতুন আইছে, তাও ফাঁকি দিতাছে বুঝি? এর একটা বিহিত করন লাগব!”
টুম্পা মুখ ছোট করে বললো,
“তাই তো কইতাছি, আম্মা। আমি না থাকলে সব লাটে উঠতো আইজকা।”
“তাইলে খাড়াইয়া রইছত ক্যান? যা চুলায়!”
“হ, যাইতাছি। কিন্তু আমনে যদি আমার লগে আইতেন?”
জমেলা বেগম মুখ কালো করে উত্তর দেয়,
“আমি ক্যান যামু?”
“আমারে শিখাইয়া দিবেন, আমি তো রান্না পারি না ভালা মতন। হেই লাইগ্যা। আর তাছাড়া আমনে তো আমার আম্মারে কইছেন আমারে দেইখ্যা রাখবেন, তাইলে কথা রাখবেন না?”
নিজের প্যাঁচে নিজেই পড়লেন জমেলা বেগম। অগত্যা ইচ্ছে না হলেও এগিয়ে গেলেন। টুম্পা তখন পাকঘরে গিয়ে দেখে পারুল সব ধুয়ে কেটেকুটে রেখে দিয়েছে। এটা টুম্পা বেশ ভালো করেই বুঝেছে, কিন্তু সেটা প্রকাশ না করেই বলে,
“আম্মা দেহেন? আমি সব জোগার যন্ত কইরা রাখছি। এহন এই রান্নার কাম যদি আরেকটু সামলাইতেন, আমি একটু বাজারের দিক দিয়া ঘুইরা আসতাম।”
জমেলা কপাল কুঁচকে বললেন,
“আবার কই যাওন লাগবো তোর?”
“চাচাতো ভাইটা আইছে, ছোটখাট হাটে গেছে। ওরে কইছিলাম একটা কসমেটিকস নিবো। আমি ঘুইরা আই, খালা, এই রান্নাটা একটু আমনে সামলান।”
জমেলা বেগমের মনে তখনো সকালের ক্ষোভ রয়ে গেছে, এর উপর এখন আবার! মুখে কিছু না বললেও মনে মনে রাগ টগবগ করছিল।
“চুলার ধোঁয়া আবার আজ আমারেই পোড়াইবো, কপাল পোড়া বুড়ি আমি।”
পাকঘরে ঢুকেই পাতায় আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে মনে মনে পারুলকেও এক ধমক দিয়ে রাখলেন।
“কাম করতেও পারে না, আবার মুখে শুনি কি বক্তৃতা সারাদিন! বন্ধ্যা মাইয়া একটা!”
ধোঁয়ার মধ্যে কোনোমতে রান্না শেষ করলেন, তারপরে তরকারি গরম থেকে ভাত রান্না সবই করলেন। পারুল তখন ঘরে শুয়ে সজীবের শার্টে বোতাম লাগাচ্ছিলো।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। সবাই খাওয়ার জন্য পাত পেতে বসেছে। গরম ভাত আর ডাল, সাথে আলুভর্তা আর ছোটো মাছের চচ্চড়ি। টুম্পা মুখে বেশ গর্বের হাসি নিয়ে ভাত বেড়ে দিচ্ছে। সজীব মুখে ভাত পুরে বললো,
“আজকে তো চচ্চড়ি’টা একেবারে মায়ের হাতের মতন হইছে। এইটুকু রান্নায় এত স্বাদ আসছে কেমনে!”
জমেলা বেগম মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন, চোখে মুখে লেগে ছিল খুশি। এমন সময়ই টুম্পা বলে উঠলো,
“আমি তো আছিলাম রান্নাঘরে, তাই স্বাদ হইছে। সবজিটা আমি কাইটছিলাম, ডালেও আমি লবণ দিছি।”
সজীব মাথা নাড়িয়ে হেসে বললো,
“নতুন বউ হইলেও রান্নার হাত খারাপ না তোর!”
জমেলা বেগম একটু কেশে বললেন,
“হ, ও আছিল রান্নাঘরে। তবে কাম—”
পুরো কথা বলতে না দিয়ে, টুম্পা তাড়াতাড়ি কথা কেটে দিয়ে বললো,
“আমি যে পাকঘরে আছিলাম, সব কইরা দিছিলাম এইটাই তো আসল কথা আম্মা। মিলে-মিশেই তো রান্না হইছে। একলা কেউ কি আর সব কিছু পারে?”
জমেলা চুপ করে গেলেন। এতদিনের রান্নাবান্না তার অভ্যাস, কিন্তু এখন দেখছেন কেউ নাম দিয়ে দিলেও তাতেই বেশি দাম! মুখে কিছু বললেন না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা দীর্ঘশ্বাস বয়ে গেলো। যেন সংসারের এই খেলায় তিনি এখন টুম্পার কাছে হেরে গেলেন!
রাত গভীর হয়ে এসেছে। সারা বাড়ি জুড়ে একরকম নিস্তব্ধতা। শুধু রান্নাঘরের কোণে একটা চুলো নিভে যাওয়ার শব্দ। মাঝে মাঝে দূরে কুকুরের ডাক শোনা যায়। মাথার উপর মিটি মিটি করে জ্বলে ওঠা কূপি বাতির আলোয় ঘরটা কেমন ঘোলাটে দেখায় জমেলা বেগম আজ সারা বিকেল রান্না করে হাঁপিয়ে গেছেন। সকালেও করেছেন, তার উপর কোমরটায় আবার সেই পুরোনো ব্যথাটা শুরু হয়েছে। বয়স বেড়েছে তো, গাঁটের ব্যথা এখন ঠিক সময় বুঝে টের দেয়ায়।
তিনি পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। মুখে চাপা একটা কষ্ট। হাত দিয়ে কোমরের জায়গাটা টিপে যাচ্ছেন আস্তে আস্তে। মুখ থেকে মাঝেমধ্যে একটা অল্পস্বরে “উফ্” শব্দ বের হয়ে আসছে। এই সময়েই ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকে এলো একটা মৃদু গন্ধ—রসুন ভাজার।
পারুল হাতের তালুতে সেই রসুনতেলটা নিয়ে খুব সন্তর্পণে ঘরে ঢুকেছে। সন্ধ্যায় যখন সে ঘরে ছিলো তখনই দূর থেকে শুনেছিলো জমেলা বেগম নিজের মনে বলতে বলতেই হাঁটছিলেন—
“এই গাঁটে আবার শুরু হইলো গো মরার ব্যথা!”
এসব শোনামাত্র সে নিজের মতো করেই ব্যবস্থা নিয়েছে। আগুনে রসুন ভেজে সরিষার তেলে দিয়ে ঘষে একটা তেল তৈরি করেছে। যাতে আরাম পান।কিন্তু ভাগ্য! দরজার বাইরে বেরুতেই টুম্পার সাথে দেখা। টুম্পা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল যেন কোথাও যাওয়ার কথা ভাবছে, চোখ পড়তেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“এই কী তেল-মাসলা নিয়া ঘুরতাছো ভাবী?”
পারুল হাসিমুখে বললো,
“নাহ, আম্মার কোমরে ব্যথা। একটু রসুন তেল গরম কইরা আনতাছি ঘষার লাইগা।”
এইটুকু কথা শুনে টুম্পার চোখে কী যেন ঝিলিক দিলো। সাথে সাথেই একটু চঞ্চল স্বরে বলে উঠলো,
“আরে, আচ্ছা ঠিক আছে। দাও ভাবী, আমি দেই আম্মারে। তুমি তো হাপায়া গেছো। এই কাজটা আমি করলেই হয়। আর সজীব ভাইজান তোমারে খুঁজতাছিলো, তুমি ঘরে যাও।”
পারুল কিছু না বলে একঝলক তাকিয়ে রইলো টুম্পার মুখের দিকে। না বলে চুপচাপ তেলটা এগিয়ে দিলো। টুম্পা নিজের মেজাজে ঘরে ঢুকে গেলো। জমেলা বেগম তখনো কাত হয়ে শুয়ে আছেন। ঘরের বাতাসে রসুনের ঝাঁঝালো গন্ধ।
“আম্মা, ঘুমাইছেন?”
জমেলা কষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। টুম্পা কড়াই থেকে তেলটা ছোট পাত্রে ঢেলে কোমরের কাছে বসে গেছে ইতিমধ্যে।
“এই যে, আমি রসুন তেল দিয়া ঘষতাছি। আমি তো শুনেই আনছি তেলটা। কইলাম না আমনে কষ্ট হইতাছে, আর মন মানে নাই।”
জমেলা একটু চমকে তাকালেন। কণ্ঠে একটু আশ্চর্যের রেখা।
“তুই আনছিস?”
“হ, আম্মা। এই তো চুলা নিভবার আগেই গরম কইরা আনছি। সময়মতো মালিশ কইরা দিলে ব্যথা থাকে না। মা করতো আগে, মনে আছে? আমি শিখে গেছি।”
টুম্পা নিজের মতো করে ধীরে ধীরে জমেলার কোমরে তেলটা ঘষতে লাগলো। আঙুলের ছোঁয়ায় খুব বেশি পারদর্শিতা নেই, কিন্তু আন্তরিকতা আছে যেন। আর জমেলা বেগমের বুকের ভেতরে যে অভিমান জমে ছিলো টুম্পার উপর, তা যেন একটু একটু করে গলে যাচ্ছে রসুনের তেলের মতো। চোখ বুজে জমেলা একটু হেসে বললেন,
“রাগ কইরা আমি তো মরেই যাইতাছিলাম। কিন্তু দেখতাছি, তুই তো খেয়াল রাখিস।”
টুম্পা মাথা নিচু করে হেসে বললো,
“রাগ কইরেন না আম্মা, আমি তো আমনের পাশে, খেয়াল রাখার লাইগ্যা।”
জমেলার মুখে তৃপ্তির হাসি। তবে টুম্পার মালিশে তিন আরকম পাচ্ছেন না কেনো জানি! মনে পড়ে যাচ্ছে পারুলের কথা, মেয়েটা যে কত যত্ন নিয়ে তাকে মালিশ করিয়ে দিতো সেটা টুম্পার স্পর্শেই বিস্তর ফারাক বুঝতে পারছেন। অথচ কতবার পারুল তাকে তেল মালিশ করে দিয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। বিনিময়ে সে আরো দু এক কথা শুনিয়ে দিয়েছিলো!
#চলবে…