অর্ধাঙ্গ পর্ব-৩৭ এবং শেষ পর্ব

0
14

#অর্ধাঙ্গ
#মীরাতুল_নিহা
#পর্ব – ৩৭

বিকেলের আলো গড়িয়ে পড়েছে উঠোনে। সূর্য পশ্চিমে হেলে আছে, তালগাছের ছায়া লম্বা হয়ে মাটি ছুঁয়ে গেছে। উঠোনে আজ একটা নীরব উত্তেজনা, যেন খুব শিগগির কিছু ঘটবে। সবাই তন্ময় হয়ে তার অপেক্ষায়। টিনের চালের ছায়াঘেরা উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে টুম্পা, শরীফ, পারুল, আর পাশেই কিছুটা দূরে জমেলা বেগম—চোখে অস্বস্তিকর চাহনি, যেন না চাইতেও দেখতে হচ্ছে। ঘরের পাশ থেকে কামাল হোসেন আসছেন ধীরে ধীরে, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। আসরের নামাজ শেষ করে ফিরলেন। সবাই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু চোখ একটাই জায়গায় স্থির—সজীবের দিকে।

সজীব দাঁড়িয়ে আছে উঠোনের মাঝ বরাবর, সবার সামনে। পরনে ধুলো-মলিন শার্ট, হাতের ভাঁজে গুঁজে রাখা একটা মোটা কাগজ। তার মুখে কোনো হাসি নেই, বরং চোখ দুটো গম্ভীর, ঠোঁট নীচের দিকে চেপে রাখা।

“কি’রে বাপ? খাড়াইয়া আছোস ক্যান? কইতে পারোস না? তোর বউয়ের ওই রির্পোটে কি লিখা আছে? কতক্ষণ ধইরা খাড়াইয়া রইছি তোর কথা হুনতাম!”

একপ্রকার অর্ধৈর্য হয়েই কথাগুলো বললো জমেলা বেগম। সজীবের তাতে কোনো হেলদোল নেই। সে আগের ন্যায়ই নিশ্চুপ। যেনো কথা বলতে ভুলে গেছে। পারুল এবার কেঁদে দিবে দিবে এরকম ভাব। শেষমেশ সজীবের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখের কোনে পানি না চাইতেও টলমল করছে! যেনো টুপ করেই গড়িয়ে পড়বে।

“আমনে উত্তর দেন, না ক্যান?”

সজীব বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে আরম্ভ করে,

“আমারই দোষ। ডাক্তার কইছে, একটা বাচ্চা হইতে যেটুকু থাকা দরকার, আমার নাকি সেটুকুও নাই।এক পার্সেন্টও নাই! আমি বিয়া করছি ঠিকই, কিন্তু আমি জীবনেও সন্তানের বাবা হইতে পারুম না। আমি সন্তান জন্মদানে অক্ষম!”

সজীব আর আর মুখ তুলতে পারে না। মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে। দুই চোখে পানি জমে ওঠে। ফাইলটা বুকে চেপে সে বসে পড়ে উঠোনে। কথাগুলো কাঁপতে কাঁপতে বলে সে। বুক ফেটে যাচ্ছে তার! একটা সন্তানের জন্য কতই না আশা ছিলো বুকের ভেতর। অথচ এই জীবনে সে একটা সন্তান জন্মে ভূমিকা রাখতে পারবে না! জমেলা বেগম যেন হঠাৎ বিদ্যুতে ছ্যাঁকা খায়। মুখ হাঁ হয়ে যায়। চোখ কটমট করে তাকিয়ে থাকে সজীবের দিকে, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না!

“তুই কি কইলি বাপ? ডাক্তার নিশ্চয়ই মিছা কথা কইছে!”
“আমি যা কইছি তাইই সত্যি। আমি সন্তান জন্মদানে অক্ষম, আম্মা।

“এই ডাক্তার ভন্ড!”
“আমি আরো একটা ডাক্তাররে দেখাইছি, আম্মা। সমস্যা পারুলের না আমারই। দুইডা ডাক্তার নিশ্চয়ই ভুয়া না?”

তার যে এতদিনকার সন্দেহ, অশান্তি, পারুলকে গালি, টিপ্পনী—সব যেন ফিরে আসছে আজ নিজের দিকে। তিনি চুপ। মুখ কাঁচুমাচু করে, অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল।

পারুল দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়গাতেই, মাথা নিচু, চোখে জল নেই। সজীব দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে থাকে। দুনিয়ার সব অপমান যেন এখন কেবল তার কাঁধে এসে চেপে বসেছে। সে এগিয়ে গিয়ে পারুলের কাছে দাঁড়ালো। জোর হাত করে বলে,

”আমারে মাফ কইরা দিস, বউ।”

পারুল কোনো কথা বলে না। নীরবতা অবলম্বন করে। জমেলা বেগমের সহ্য হলো না, ছেলের করুন দশা। তিনি ফের গর্জে উঠলো,

“এইডি কুনো কথা? তুই বিশ্বাস করিস না, দোষ তোর বউয়েরই। কবিরাজে কইছে না? তুই আরেকটা বিয়া করলে সব ঠিক হইয়া যাইব।”

সজীব কোনো উত্তর দেয় না। এবার টুম্পা মুখ খুলে,

“আম্মা? আমনে কি বোঝান এইডি?”
“তুই চুপ কর! আমার পোলারে আমি যা খুশি তা বুঝাই, তাতে তোর কি? এহ্! আইছে! দুইদিনে সংসার কইরা আমার থেইকা বেশি বুঝতে। কথা কম ক ছেমড়ি!”

এভাবে বলাটা পছন্দ হলো না টুম্পার। সবার সামনে ধমক দেওয়া! নাক মুখ কুঁচকে আসলো। পাল্টা জবাব সেও দিলো,

“আমি ক্যান চুপ করতাম? এতদিন চুপ কইরাই আছিলাম! আমনের ভন্ড কবিরাজের কথা কিছু কই নাই। ভাল্লাগে নাই শ্বাশুড়ি আম্মা?”

কথাটা জমেলা বেগম শুনতে না শুনতেই চোখ দু’টি বড়বড় করে ফেলেন। ফের তর্জন গর্জন করার আগেই শরীফ তার স্ত্রী’কে বলে,

“কি কও? কি জানো!”

টুম্পা এবার জমেলা বেগমের দিকে তাকায়। সেই তাকানোর অর্থ, এবার পাল্টা কথা শোনার জন্য প্রস্তত হওয়া।

“আমি যহন তোমার বউ হই নাই? এই তোমার আম্মাই কইছিলো পারুল ভাবীরে হের পছন্দ না। ভাইজান ভাবীরে তালাক দেয় না, তাই কবিরাজ আইন্যা মিছা কথা কইয়া খেদাইব, বাচ্চার দোহাই দিয়া। আর দেহো? আমার বিয়া হওনের পর হেয় ঠিক কবিরাজই আনছে।”

কথাটা শেষ করার পরপরই জমেলা বেগম তেড়ে এসে টুম্পার চুলের মুঠি ধরলেন! সাথে সাথে টুম্পার আলতো করে বাঁধা চুলের খোঁপা খুলে গেলো। ব্যাথায় আহ্ করে উঠলো। যেনো আগুনে ঘি ঢাললো। শরীফ দ্রুত তার মা’কে ছাড়ায়। বাকিরা নীরব দর্শকের মতন সবটা দেখছে!

“আম্মা আমনে কি শুরু করলেন!”
“তোর বউরে সামলা! যা নয় তাইই কইতাছে!”

টুম্পা এবার আরো বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো।

“যা নয় তাই কি? এহন সব কইয়া দেই শাশুড়ী আম্মা? আমনে কেমনে আমারে ছুডো বউ করছেন?”

জমেলা বেগম থতমত খেয়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টায় ভয় পেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলে,

“চুপ কর বেয়াদপ মাইয়া!”
“চুপ করমু না, শুনেন সবাই। হেইদিন আমি ইচ্ছে কইরা আমার জামাইর রুমে যাই নাই। আমারে আমার শ্বাশুড়ি আম্মা কইছিলো যাতে ওই রুমে থাহি, আর সজীব ভাইজানরে হেয় পাঠাইব। তারপর রাইতের আন্ধারে লোকজন ডাইকা বদনাম কইরা আমারে ভাবীর সতীন বানাইয়া আইন্যা, ভাবীরে তালাক দেওয়াইব। আমি বংশের মুখ দেখাইতাম! আমিও রাজি হইয়া গেছিলাম আবেগের বশে পইড়া। লোভ দেখাই ছিলো রাজি হইয়া গেছিলাম পাপ কাজে!”

কথাটা শেষ হতে না হতেই সজোরে একটা চড় বসলো টুম্পার গালে। সবার সামনে চড় খেয়ে টুম্পা অপমানের বেশি লজ্জা পেলো। জমেলা বেগম তখন হাসি মুখে এগিয়ে এসে ছেলেকে বলে,

“একদম সঠিক কাম করছিস বাজান! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!”

“আম্মা, নেহাৎ আমনে আমারে জন্ম দিছেন তার লাইগা চড়টা আমনের মুখে মারতে পারি নাই! মারছি আমার বউয়ের মুখে!”

অবাক নয়নে প্রশ্ন করে,

“তুই তোর আম্মারে মারতি?”
“পারি না দেইখাই, বউরে মারছি! ওর লজ্জা হওয়া উচিত। এত বড় একটা কামে কেমনে আমনেরে সাহায্য করলো!”

টুম্পা তৎক্ষনাৎ শরীফের পায়ে পড়ে গেছে। চোখ বেয়ে টলমল করে পানি ঝড়ছে। কান্নারত কন্ঠে বলে,

“আমারে আমার আম্মা আর খালা বুঝাইছিলো ভাইজানরে বিয়া করলে রানীর মতন রাখবো। অন্য ঘরে বিয়া হইলে কাম করাইব, জামাই মারবো আরো কত্ত কিই! কিন্তু খালায় আমারে দেইখা রাখবো, ভালোবাসবো। আর ভাইজানও নাকি অনেক ভালা। আমি গাঁধার মতন বিশ্বাস করছি সব। কিন্তু এহন সব ভুল বুঝতে পারছি৷ বিয়ার পর খালার ব্যবহার দেইখা বুঝছি, উনার আসল রূপ দেখছি। আমারে মাফ কইরা দেও। আমি তোমার লগেই থাকমু আজীবন। নিজের ভুল বুঝতে পারছি, মাফ কইরা দেও আমারে।”

“মাফ? তারও যোগ্য না তুই!”

দু’জনের কথার ভেতর আচমকা জমেলা বেগম বলে উঠেন,

“বাজান? তোর বউ চায় বাড়ির মাইয়াগো মতন শুইয়া বইয়া থাকতো, আমি ডাক দিছি দেইখা আমি তার শত্রু। এই কারনেই তোরে এসব কইতাছে! তুই এইডি বিশ্বাস করিস না!”

এবার সপাটে ঠাসঠাস করে দু’টো চড় পড়লো জমেলার গালে। জমেলা গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকাতেই দেখে কামাল হোসেন দাঁড়িয়ে আছে।

“নেহাৎ তোর বয়স হইছে, তাই ছাইড়া দিলাম! নইলে তিন তালাক দিতে আমার সময় লাগতো না।”

জমেলা বেগম খালি ফ্যালফ্যাল করে স্বামীর দিকে তাকিয়েই রইলো। সবাই যেন আজ তার বিরুদ্ধে নেমেছে। সজীব বসা থেকে আস্তে করে উঠে গিয়ে মা’য়ের সামনে দাঁড়ালো।

“আমনে আমার আম্মা তো? আমি পারমু আমনেরে আর আম্মা কইয়া ডাকতে? মনে তো হয় না! কেমনে পারলেন আম্মা? বুকে বিঁধলো না আমনের? আমারে না বাজান কইয়া ডাকেন, আম্মা? কেমনে পারলেন? কথা কন না, আম্মা?”

সজীবের করুন কন্ঠের কথা জমেলার কানে যেতেই দু হাত দিয়ে কান চেপে ধরলেন। ছেলের অসহায়ত্ব, তার প্রতি ঘৃনিত দৃষ্টি যেনো নিতে পারছে না! শুনতে পারছে না কথাগুলো!

“চুপ কর বাজান! আমি তোর ক্ষতি চাই নাই কুনোদিন।”
“ভালাও তো করলেন না! ছুডো থেইক্যা আমনের আঁচলের তলায় আছিলাম। আম্মা আম্মা কইরা, সারাদিন ঘুরছি। আর আমনে? আমার বউরে অপবাদ দিয়া পুরা গেরাম রটাইলেন, আমারে ছলনা কইরা বিয়া দিতে চাইছেন! উপরে আল্লাহ আছে, পাপ বাপরেও ছাড়ে না জানেন তো? আমনের পাপের শাস্তিই মনে হয় আল্লাহ দিলো আমারে!”

জমেলা বেগম মনোযোগ দিয়ে পুরো কথাগুলো শুনলেন! না চাইতেই ছেলের কথা শুনে চোখ দিয়ে টলমল করে পানি ঝড়তে লাগলো অঝোর ধারায়। সজীব তাকে আর আম্মা ডাকবে না? ছেলেটা যে তাকে শাস্তি না দিয়েও সবচেয়ে বড় শাস্তিটাই দিলো। বাড়ির প্রত্যেক সদস্যের সামনে তর্জন গর্জন করে কথা বলা জমেলা বেগম আজকে নিঃশেষ হলেন! তার মাথা আজকে নিচু হলো, যেটা আর কখনোই উঁচু হবে না! কামাল হোসেন এগিয়ে এসে বলে,

“ভুলেও তুই আমার লগে আমার ঘরে আসবি না! তোর মতন মহিলার লগে আমি একসাথে থাকতে রাজি না! তালাক দেই নাই দয়া কইরা, হেই দয়াও বেশিক্ষণ থাকব না, দেখিস কইলাম

বলেই গটগট পায়ে তিনি চলে গেলেন। একে একে সবাইই চলে যায়। জমেলা বেগম ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। সন্ধ্যা নেমে আসছে প্রায়! অগত্যা মেয়ের রুমটাতে গিয়ে উঠলেন।

°°°°°°°°°°°

“বউ? ও বউ! তুই আর কুনোদিনও আমার লগে কথা কইবি না?”

ব্যাকুল কন্ঠে পারুলের হাত ধরে কথাটা বললো সজীব। দুদিন হয়ে গেছে! সেদিন থেকো আজকে বিকেল অব্দি পারুল একটাও কথা বলেনি। সে তার মতন কাজ করেছে। সজীব ভেবেছে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে৷ সেজন্য সে নিজেও চুপচাপ ছিলো। আশ্চর্যজনক ভাবে টুম্পা কেমন বদলে গেছে। সেটা কি শরীফের ভালোবাসায় নাকি জমেলার আসল রূপ প্রকাশে সে নিজেও বোঝে না মাঝেমধ্যে। তবে এই সংসারটাকে তার বড্ড আপন লাগছে। হয়ত চোখে লাগানো পট্টিটা খুলেছে সেজন্য। এইতো পারুলের মানসিক অবস্থা বুঝে সে নিজেই আজকে চলে গেছে রান্নাঘরে। কোনো রকম বাক বিতন্ডা না করে। কিন্তু পারুল তার দায়িত্ব পালনে অনল হয়ে টুম্পার সাথে সাথে সবই করলো। সজীব শুধু দুপুরে সকালের খাবার টুকু খেয়েছে। আর সারাবেলাই না খেয়ে ছিলো। বিকেল হতেই পারুলকে ঘরে দেখতে পেয়ে সজীব ভেতরের চাপা কষ্টটাকে আর আঁটকে রাখতে পারলো না। বলেই ফেলে, পারুল তখন মৃদু হেঁসে বলে,

“আমি এডাই চাইছিলাম, আমনে আমার লগে কথা কন।”
“তুই কথা কইবি না?”
“কি করতাছি?”

সজীব ভরসা পেয়ে পারুলের দু’টো হাত ধরে বসে।

“আমি তোর উপরে অন্যায় করতাছি বউ। তুই চাইলে যাইতে পারছ।”

পারুল বড় করে দম নিয়ে বলে,
“যাওনের হলো যাইতাম। যাই নাই যহন, তহন নিশ্চিন্ত থাহেন মরনের আগে যাইতাম না!”

পারুলের কথায় সজীব শুকনো একটা হাসি দেয়।

“আগের জনমে নিশ্চয়ই পূন্য করছি। না হইলে তোরে পাইতাম না।”

পারুল কিছু বলতে যাবে তখনি রুমে চলে আসে টুম্পা। সজীব আর পারুলকে একসাথে বসে থাকতে দেখে লজ্জা পায়। চলে যেতে নিচ্ছিলো তখনি বাঁধ সাধে পারুল। সে এগিয়ে যায় দরকার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। টুম্পার মুখে তখন মিটিমিটি হাসি।

“কি টুম্পা? এত খুশি ক্যান?”

টুম্পার চোখমুখে উপচে পড়া খুশি! সে মুঁচকি হেঁসে হেঁসে বলে,
“আগে সংসার সামলাইতা এহন কিন্তু দায়িত্ব আরো বাড়ছে তোমার, বুঝছো ভাবী?”
“কি?”

টুম্পা আঁচলে মুখ গুঁজে বলে,

“এহন সংসারের পাশাপাশি আরেক জন মানুষরেও তোমার দেখা লাগব, বুঝছো?”

পারুল অবাক নয়নে শুধোয়,

“সত্যি!”
“হ, ভাবী। আল্লাহর রহমতে তাড়াতাড়িই হইয়া গেলো।”

পারুলও হাঁসলো। এত দুঃখের মাঝে যেন এক টুকরো সুখ খুঁজে পেলো!

“শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর দরবারে লাখো লাখো শুকুর।”

টুম্পার মুখে এখনো সেই হাসি, সরছেই না যেনো। একটা বাচ্চা! যার জন্য এতগুলো বছর পারুল হাহাকার করছিলো সেই বাচ্চা মাস দু’য়েক না পেরোতেই টুম্পার গর্ভে। পারুলের ভাবতেই আনন্দ লাগছে আর কিছুদিন পরেই সে ছোট্ট ছোট্ট দু’টি হাত পা নিয়ে খেলবে। একটা নিষ্পাপ বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসবে। তাকে মানুষ করবে! টুম্পা চলে যায়। উঠোনের এক কোনে থেকে সব কথাগুলোই শুনলেন জমেলা বেগম। এর ভেতর কেউ তার সাথে কথা বলেনি। এমনকি খেতে অব্দিও ডাকেনি! যেন একঘরে করে দিয়েছে সবাই। সে যে আছে, নাকি নেই তাতে কারো কিছু যায় আসে না। যত যাই হউক যে পারুল তার মুখের সামনে খাবার এনে ধরেছে সেই পারুলও চোখের দেখা দেখলো না একবার! এখন সব হম্বিতম্বি শেষ হয়েছে তার। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দু’দিনে তার দুই ছেলে, তার নারী ছেঁড়া ধন যাকে বলে। সেই ছেলেরা তার সাথে কথা বলবে তো দূর মা অব্দিও ডাকেনি! জমেলা বেগমের মনে একটু একটু করে অনুতাপ হচ্ছে এবার। সে যদি এসব না করতো তাহলে কি টুম্পা আর পারুলের আনন্দে সেও সামিল হতে পারতো না? একটা বাচ্চা! যার জন্য ছেলেকে আবার বিয়ে করাতে চেয়েছিলো। আচ্ছা বাচ্চাটা জন্মালে শরিফ তাকে ছুঁতে দিবে তো? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কতকত ভাবনা সে ভেবে ফেলছে তার হিসেব নেই। এখনো ভেবে কূল পাচ্ছে না, সে পারুলকে এত অপছন্দ কেনো করেছিলো? মেয়েটা তো তার সব করতো! তাও! কিছু কিছু মানুষ আছে কলজে কেটে খাওয়ালেও তাদের লবনে কম হয়। জমেলা বেগমের এক মুহুর্তের জন্য সেই মানুষের কাতারেই নিজেকে দাঁড় করালো। নিজের হাতে সব করেছেন, সংসারে থেকেও আজকে নেই তিনি। যেনো দু বেলা দু মুঠো খাবারের জন্য পড়ে আছেন। তিনি যে কারো স্ত্রী, কারো কারো মা, এ পরিচয় বিলীন করে দিচ্ছে সবাই। সবকিছুই তার কৃতকর্মের ফল!

“এত আফসোস কইরেন না, আমনে বাপ না হউন, জেডা হইতে পারবেন! আমার আর কুনো দুঃখ নাই!”

পারুলের কথা শুনে সজীব স্তব্ধ নয়নে তার স্ত্রীর মুখপানে তাকায়। মনে মনে ভাবছে মেয়েটা এত ধৈর্য্য নিয়ে কীভাবে আছে?

“তুই এত শক্ত কেমনে হইলি বউ? আমি যে ভাইঙা চুইরা শেষ হইয়া যাইতাছি!”
“আমার জীবনে আমনে ছাড়া আর কেউ নাই। আমি কই যামু আমার জামাইরে ছাইড়া? তারে ছাইড়া যাইতে হইলে তো আমার দুনিয়া ছাড়া লাগবো।”

সজীব আর কিছু বলতে পারে না, শব্দ খুঁজে পায় না। পারুল একটু এগিয়ে গিয়ে সজীবের কাছে বসলো। কাঁধে মাথা ঠেকালো। সজীব যত্ন করে পারুলের মাথায় হাত রাখলো। কপালে একটা চুমু একে দিতেই পারুল মুঁচকি হেঁসে বলে,

“এই যে এতো যত্ন? এত আদর, সোহাগ ছাইড়া কই।যামু আমি? যাওনের জায়গা আছে? একদমই না! রইলো বাচ্চা? হেইডা টুম্পার বাচ্চা কাচ্চা মানুষ কইরাও যাইবো গা।”

“তোর আফসোস হইতো না? তোর যদি একটা বাচ্চা থাকতো! আমার দোষে তুই দোষী হইবি ক্যান?”

“আমনে আছেন আর কি লাগে? এতকিছুর পর আফসোস থাকতে নাই, আল্লাহ নারাজ হইবো।”

সজীব যেন প্রতি উত্তর করতে ভুলে গেছে। কেবল মনে মনে আল্লাহর প্রতি লাখ লাখ শুকুর আদায় করলো।

অর্ধাঙ্গ মানেই তো জীবনের অপর ভাগ—
সে না থাকলে মানুষ নিজেকেই অসম্পূর্ণ ভাবে।
সন্তান না থাকলেও সংসার চলে যায়, কিন্তু যার হাত ধরে জীবনের পথচলা শুরু—সে না থাকলে সবই ফাঁকা লাগে। সজীবকে ছাড়া পারুল বাঁচতেও ভুলে যাবে! মানুষজন দুর্বলতা জেনে গেলে আর সুযোগ দেয়না। আঘাত করে বসে। তারউপর পুরুষ মানুষ, সব দিয়ে কি বিশ্বাস করা যায়? আচ্ছা করলো না হয় বিশ্বাস! কিন্তু সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরতে কতক্ষণ? মন ঘুরতে কতক্ষণ? কিছু সময়? তারপরের গ্যারান্টি আছে? নেই! আবার জমেলার মতন শ্বাশুড়ি তো আছেই! সত্যি প্রকাশ হলে সজীব শান্তি দিলেও বাঁচতে দিতো না তার শ্বাশুড়ি নামের মহিলা! সেজন্যই বলা চলে স্বামীর জন্যই কিংবা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে, একপ্রকার সাপও মরলো লাঠিও ভাঙলো না, টাইপ সিদ্ধান্ত নিলো পারুল। সব কিছুই সে করলো। ছলনার আশ্রয় নিলো। চুরি, কিংবা মিথ্যে বলা! বাদ দিলো না, কিছুই। হুট করেই মনে পড়ে যায়, রিয়া বলেছিলো, ভালোবাসলে একটু আকটু পাপ করাই যায়! একটুখানি পাপ না-হয় পারুলও করলো। নিজেকে ভালো রাখতে, ক্ষতি কি? বরং এবার থেকে সবাইকে নিয়ে ভালোভাবেই ভালো থাকবে সে।

সজীব তো তার অর্ধাঙ্গ!
অর্ধাঙ্গ শুধু সঙ্গী নয়, সে হৃদয়েরই আরেক প্রতিধ্বনি। মানুষ স্বভাবগতভাবেই অসম্পূর্ণ।
প্রকৃতি তার প্রতিটি প্রাণে রেখে দেয় অপূর্ণতার একটি অংশ, যা অপেক্ষা করে কারও কাছে পূর্ণ হয়ে ওঠার। সেই শূন্যতা পূরণের জন্যই নিয়তি মানুষকে উপহার দেয় একজন সঙ্গী। একজন অর্ধাঙ্গ, যে কেবল জীবনসঙ্গী নয়, হয় হৃদয়ের ছায়া, সুখ-দুঃখের সাথি, প্রতিটি নিঃশ্বাসে ভাগীদার। সজীবকে ছাড়া পারুল নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে না। অর্ধাঙ্গ মানেই এমন এক অস্তিত্ব, যার ভালোবাসা বুকে না পেলে ঘর-সংসার, হাজার সুখ সবকিছুই বৃথা মনে হয়। সংসারের হাজার সুখ, বাহ্যিক প্রাচুর্য, সবই তার কাছে অর্থহীন যদি না পাশে থাকে সেই মানুষ! তার জন্য একটু ভুলচুক হলে মন্দ কি?

(#সমাপ্তি)