#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-২
#সারা মেহেক
আংকেলকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে কিছুটা ভালো। তবে পুরোপুরি সুস্থ নন। সেসময় অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় মাইনর স্ট্রোক করেছিলেন তিনি৷ আদ্রিশ ভাই তৎক্ষনাৎ আংকেলকে হসপিটালে ভর্তি করান। এ মুহূর্তে হসপিটালে আদ্রিশ ভাই ও তার চাচা,মামা এবং চাচাতো ভাই উপস্থিত আছেন৷ আমরাও গিয়েছিলাম৷ তবে বেশিক্ষণ থাকতে দেয়নি আমাদের৷ হসপিটালের মতো জায়গায় এত গ্যাঞ্জাম বাঁধানোর দরকার নেই বলেই আমরা চলে এসেছি। আন্টির অবস্থা এখন আরোও বেগতিক। কয়েক ঘণ্টাও পূর্বেও যিনি ছেলের সংসার নিয়ে হা-হুতাশ করছিলেন, সেই তিনি-ই এখন নিজের স্বামী, সংসার নিয়ে দুশ্চিন্তায় মগ্ন৷ আম্মু বারবার তাঁকে বুঝাচ্ছে যেনো তিনি আংকেলের মতো অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা না করে। কিন্তু কে শুনে কার কথা! প্রেশার বাড়িয়ে-টাড়িয়ে আন্টির অবস্থাও প্রায় সংকটপূর্ণ। আমি প্রেশার মেপে দেখলাম। তারপর আন্টির প্রেশারের ওষুধ খাইয়ে ঘুমাতে বললাম। আপু আর ইমাদ ভাই গিয়েছে আংকেলকে দেখতে। এতক্ষণ দুজনে এখানেই ছিলো।
আদ্রিশ ভাইদের বাসা এখন ধীরেধীরে খালি হচ্ছে। তাদের ঢাকার আত্মীয়স্বজনরা যে যার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। এজন্য বাসা প্রায় খালি হয়ে গিয়েছে। আমরাও কিছুক্ষণের মধ্যে বের হবো। আব্বু হসপিটাল থেকে ফিরলে তবেই আমরা বাসায় যেতে পারবো।
আম্মুসহ আদ্রিশ ভাইয়ের নানী,খালা,চাচী,মামী আন্টির কাছে বসে আছে। নানী তো আংকেল হসপিটালে যাওয়া মাত্রই জায়নামাজে বসে পড়েছেন। উনি সেই যে বসেছেন এখন অব্দি উঠেননি। দোয়া-দরুদ সব এখনও চলমান।
আভাও ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি আন্টির রুমেরই বিছানার উপর বসে আছি। আর আভা আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েছে।
বড়দের মধ্যে টুকটাক গল্প-গুঞ্জন চলতে চলতে এক পর্যায়ে আদ্রিশ ভাইয়ের নানী জায়নামাজ ভাঁজ করে উঠতে উঠতে বললেন,
” আমি তো আগেই সন্দেহ করছিলাম মাইডারে। চেহারা সুরুত ভালা না। চায়া থাহে কেমন কইরা। ওরে দেইখাই তো আমার নাতীনের জন্য কষ্টে বুকটা ফাইট্টা যাইতাছিলো। ওমন রাজপুত্তের মতোন নাতীনডার জন্য ওমন মাইয়া যে কেমনে খুঁইজা আনছিলো তনিমা কেডা জানে। আমার তো একটুও পছন্দ হয় নাই। তারপরও আদ্রিশের লাইগা আমি রাজি হইছিলাম। এহন দ্যাখ, মাইডার চরিত্রেই সমস্যা। কোন নাগরের হাত ধইরা পালাইছে দেখগা।”
আদ্রিশ ভাইয়ের নানীর এহেন বেসামাল জবান শুনে খালামনি একটু ধমকের সুরেই বলে উঠলেন,
” চুপ করো তো আম্মা। আপা আর দুলাভাই এখানে অসুস্থ। আর তুমি এখন ঐ মেয়ের বদনাম নিয়ে পড়ে আছো। জায়নামাজ থেকে উঠেই যে বদনামগুলো করলা, আল্লাহ কি তোমার দোয়া কবুল করবে?”
নানী কেমন সরু চোখে চাইলেন। কিছু বললেন না। তসবিহ নিয়ে বসে পড়লেন সোফার উপর। আদ্রিশ ভাইয়ের নানী এমনিতে বেশ ভালো মানুষ। আমাদের সবাইকে খুব আদর করেন৷ কিন্তু যখন উনার একমাত্র আদরের নাতী আদ্রিশের উপর কোনো কথা উঠে, তিনি আর চুপ থাকেন না। এক আদ্রিশ ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে উনি পুরো দুনিয়ার বিরুদ্ধে চলে যান৷
মেয়ে খোঁজার কথায় যখন আন্টির নাম উঠলো তখন আম্মু চুপ করেছিলো। কেননা মেয়ে তো আন্টি খুঁজেনি। বরং আপু খুঁজেছে। কিন্তু এ মুহূর্তে আপুর নাম নিলে নানী নির্ঘাত আপুর বংশ উদ্ধার করে ছাড়তো। তাই আম্মু চুপ থাকার পাশাপাশি আমাকেও চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলে।
রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি আব্বু হসপিটাল থেকে আদ্রিশ ভাইদের বাসায় ফিরে। আর সেখান থেকেই আমরা রওনা হই। আপু আর ইমাদ ভাই হসপিটাল থেকেই তাদের বাসায় চলে যায়। সারাদিন এ বাসা, ও বাসা দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হওয়ায় বাসায় ঢুকে কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
———————-
প্রচণ্ড ক্লান্তির জন্য সকালের ক্লাসটা মিস করি। এগারোটায় গিয়ে কলেজে পৌঁছে লেকচার ক্লাস করে যাই আংকেলকে দেখতে। আমি ঢাকার একটি বেসরকারি মেডিকেলের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। কয়েকদিন পর জুনিয়ররা চলে আসবে। অতঃপর আমি সেকেন্ড ইয়ারে উঠে যাবো। আপুর সাথে আমার বয়সের পার্থক্য পাঁচ বছরের। আর আভার সাথে তিন বছরের। আমাদের তিন বোনের স্বভাব চরিত্র প্রায় তিন রকমের। প্রায় তিন রকমের কেনো বলছি বলি৷ আমাদের আপু স্বভাবে ভীষণ মিশুক, এক কথায় পুরোপুরি এক্সট্রোভার্ট সে। আর আমি পরিস্থিতি ও মানুষ বুঝে আচরণ করি। এক কথায় বলতে গেলে আমি এম্বিভার্ট কিসিমের। আর আমাদের ছোটবোন আভা, সে পুরোপুরি ইন্ট্রোভার্ট। কম কথার মানুষ৷ যদিও আমাদের দু বোন ও আব্বু আম্মুর সাথে অনেক ফ্রি সে। কিন্তু এখন অব্দিও ইমাদ ভাইয়ের সাথে অতটা ফ্রি হতে পারেনি যতটা আমি হয়েছি।
এখনও ফার্স্ট ফেজে থাকার দরুণ আমাদের মেডিকেলের হসপিটাল সাইডটা অপরিচিত আমার কাছে। তাই একাডেমিক ভবন থেকে হসপিটালের নিউরো ডিপার্টমেন্ট খুঁজে আসতে আসতেই আমার যত সময় লাগলো। বহু কষ্টে যখন নিউরো ডিপার্টমেন্ট খুঁজে পেলাম তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আংকেলের জন্য বরাদ্দকৃত কেবিনে ঢুকলাম। দেখলাম,আংকেল ঘুমিয়ে আছেন। আশেপাশে খুঁজেও কেবিনে কাউকে পেলাম না৷ তাই বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে দেখি আদ্রিশ ভাই ওষুধ হাতে হাঁটতে হাঁটতে আসছেন। উনার চেহারায় ক্লান্তিভাব স্পষ্ট। পরনের টিশার্টেও ভাঁজ পড়ে গিয়েছে। রাতে কীভাবে ঘুমিয়েছিলেন কে জানে! উনার সুদর্শন মুখমন্ডলের উপর ক্লান্তিরা এমনভাবে বাসা বেঁধে ফেলেছে যে আমার দেখেই ভীষণ মায়া হলো। অথচ উনাকে দেখে মায়া হওয়ার কথাই না!
বুঝলাম, আংকেলের অসুস্থতাই উনাকে এতোটা ক্লান্ত করে দিয়েছে। একমাত্র ছেলে বলে কথা! চাচারা থাকা সত্ত্বেও এ বয়সে বাবার শরীরের দেখাশোনার গুরুদায়িত্ব উনার উপরই। উপরন্তু উনি ডাক্তার।
আদ্রিশ ভাই আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন,
” কি ব্যাপার?এখানে কি?”
উনার অবান্তর প্রশ্নে আমার ভ্রু কুঁচকে এলো। কি অদ্ভুত প্রশ্ন! একজন অসুস্থ মানুষের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। স্বাভাবিকভাবেই তাকে দেখতে এসেচি। নাচতে আসিনি নিশ্চয়ই! ঠিক এই কথাগুলো উনাকে বলতে মন চাইলো। কিন্তু নিজেকে দমিয়ে রেখে জবাব দিলাম,
” অবশ্যই আংকেলকে দেখতে এসেছি। ”
আদ্রিশ ভাই প্রত্যুত্তর করলেন না। উনি আমাকে এমনভাবে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন যেনো কেবিনের বাইরে কেউই দাঁড়িয়ে নেই। উনার এহেন আচরণে আমি হা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। অবশ্য এ আচরণ নতুন নয়। উনি মাঝেমধ্যে আমার সাথে এমন আচরণ করেন যেনো আমি কোনো অদৃশ্য বস্তু। মাঝে মাঝে তো মাছি তাড়ানোর মতো আমাকে তাড়িয়েও দেন!
আংকেলের সার্বিক অবস্থা জানার জন্য আদ্রিশ ভাইয়ের পিছু পিছু কেবিনে ঢুকলাম আমি৷ গিয়েই জিজ্ঞেস করলাম,
” আংকেলের কি অবস্থা এখন?”
আদ্রিশ ভাই কেবিনের বেডসাইড টেবিলে ওষুধগুলো রাখতে রাখতে বললেন,
” দেখতেই পারছো কেমন।”
এবার আমার হলো রাগ। কি আশ্চর্য! সোজাসাপটা উত্তর দিলে কি হয় উনার! ঘুমন্ত মানুষকে দেখে আমি কীভাবে বুঝবো উনার শারীরিক অবস্থা কেমন! এবার একটু চড়া গলায়ই বললাম,
” আংকেল ঘুমিয়ে আছে। উনাকে দেখে কীভাবে বুঝবো বলুন! আপনার বলতে কোনো সমস্যা? ”
আদ্রিশ ভাই কাঠ কাঠ চাহনিতে চাইলেন আমার দিকে। পুরোপুরি আমার দিকে ঘুরে বুকে দু হাত গুঁজলেন। রাশভারী গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” একজন মাইনর স্ট্রোকের পেশেন্ট কেমন থাকতে পারে বলে তোমার মনে হয়? ”
আমি একটু তব্দা খেলাম। অবশ্যই স্ট্রোক ভালো না। এখন মাইনর স্ট্রোকের পেশেন্ট কেমন থাকে, সিভিয়ার স্ট্রোকের পেশেন্ট কেমন থাকে তা আমি কি করে জানবো! সবে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী, সেকেন্ড ইয়ারে উঠা উঠা ভাব।
আমি আমতাআমতা করে বললাম,
” আমি জানি না। ”
আদ্রিশ ভাই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। হাত দুটো আলগোছে ছেড়ে দিয়ে বললেন,
” একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট হয়ে এইটুকু জানো না!”
আমিও খানিক চড়াও হয়ে বললাম,
” সবে ফার্স্ট কাম সেকেন্ড ইয়ারে আমি। এখনই এত কিছু জানলে তো কলেজ থেকে আমাকে এমবিবিএস ডিগ্রিটাই দিয়ে দিত। ”
” উফ। বাদ দাও। ভীষণ ক্লান্ত আমি। খাওয়ার জন্য কিছু এনেছো?”
আমি পড়লাম এক বিব্রতকর অবস্থায়। ব্যাগে ছোট্ট একটা পানির বোতল বাদে কিছুই নেই। বললাম,
” পানি আছে। খাবেন?”
আদ্রিশ ভাই হতাশ হলেন। চরম হতাশ। আঙুল দিয়ে আমাকে পাশে তাকাতে বললেন। অতঃপর বললেন,
” ঐ দেখো, পাঁচ লিটারের একটা পানির জার পড়ে আছে৷ আমি কি পাঁচ লিটার পানি রেখে তোমার হাফ লিটারের পানি খেতে চাইবো?”
আমি প্রত্যুত্তর করলাম না৷ আদ্রিশ ভাই এবার ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ভারী অবাক কণ্ঠে বললেন,
” সত্যিই কিছু আনোনি! রোগী দেখতে আসলে তো মানুষ কিছু না কিছু হাতে আনে। একটা আপেল এটলিস্ট!”
উনার এহেন কথায় এখনই লজ্জায় ম’ রে যেতে ইচ্ছে করলো আমার। আমি মানুষটা ছোট। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দৌড়ে এসেছি শুধুমাত্র আংকেলকে দেখবো বলে। উপরন্তু ফল কেনার মতো টাকাও হাতে নেই। ঢাকায় একেকটা ফলের যে দাম! সেখানে আমার মতো ছোট মানুষকে উনি এভাবে খোঁটা দিতে পারলেন! মানুষটা আসলেই খারাপ।।আপাদমস্তক একটা খারাপ মানুষ উনি। সাধেই কি উনাকে অপছন্দ করি!
আদ্রিশ ভাই আরোও যোগ করলেন,
” এটা একটা ব্যাসিক ম্যানার মিশমিশ। রোগী দেখার সময় খালি হাতে কেউ আসে না। হোক সে যতই পরিচিত!”
আমার এবার লজ্জায়,দুঃখে, অপমানে কাঁদতে মন চাইলো। যেখানে আমি সকালে কিছু খেয়ে আসিনি। সেখানে উনি খাবার না আনার খোঁটা দিচ্ছে আমাকে! আচ্ছা এই লোকটাকে এখনই গরুর ইনজেকশন পুশ করা যায় না! এই লোকটাকে এক্ষুণি হসপিটালের ছাদ থেকে ফেলা যায় না? পরে নিউজ হলো- ❝একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর হাতে খু’ ন’ হলেন মস্ত বড় জ্ঞানী এক ডাক্তার।❞
আচ্ছা? এই লোকটার মাথার সবগুলো চুল ছিঁড়ে টাকলা করে দেয়া যায় না! আমার এই মুহূর্তে সবগুলো করতে মন চাইলো। আমি শুধু কল্পনা করছি, রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে আদ্রিশ ভাইয়ের মাথার চুলগুলো টেনে টেনে ছিঁড়ছি। আর উনি আমার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছেন। কি স্বস্তির মুহূর্ত!
®সারা মেহেক
#চলব