#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-৪
#সারা মেহেক
সামিহা এরূপ বেফাঁস কথায় আমি তব্দা খেলাম। বিস্মিত হলাম। অথচ আদ্রিশ ভাই হাসলেন। আশ্চর্য! সামিহার মুখে লাগাম টানতে আমি মুহূর্তের মধ্যে আদ্রিশ ভাইয়ের আড়ালে ওর হাতে চিমটি দিলাম। বেয়াদব মেয়েটা সজোরে চিৎকার দিয়ে উঠে আমার দিকে রাগত দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
” আহ, চিমটি দিচ্ছিস কেনো! ভুল কি বললাম?”
আদ্রিশ ভাই এবার সজোরে হেসে উঠলেন। আমার দিকে চেয়ে বললেন,
” কি ব্যাপার? ওকে চিমটি দিচ্ছো কেনো?”
আমি পড়লাম চরম লজ্জাজনক এক মুহূর্তে। এদিকে বান্ধবী আমার যেমন আছোলা বাঁশ উপহার দিচ্ছে, তেমনি আদ্রিশ ভাই তাকে সাহায্য করতে নতুন নতুন বাঁশ জোগাড় করে আনছেন। দুজনেই হয়েছে একই নৌকার যাত্রী।
এখন চিমটি দেয়ার কথাটুকু অস্বীকার করলে আরোও লজ্জায় পড়বো বলে আমি সজ্ঞানে স্বীকার করে নিলাম। বললাম,
” চিমটি দিবো না তো কি করবো! শুধু শুধু অপ্রয়োজনীয় কথা বলে আপনার সময় নষ্ট করছে।”
আদ্রিশ ভাই ফের হাসলেন৷ তবে এবার চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে আয়েশ করে বসে বললেন,
” আমার নষ্ট করার মতো অনেক সময় আছে। সো, কন্টিনিউ সামিহা। তোমার বান্ধবীকে নিয়ে আর কি কি চিন্তা আছে বলে ফেলো। শুনি৷ ”
উনার কথায় আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে গেলো। কিন্তু সামিহা ভীষণ খুশি হলো। ও যেনো হাতে গল্পের মোয়া পেয়ে গিয়েছে। এবার আউলফাউল মিশিয়ে নিজেও সে মোয়া খাবে এবং আদ্রিশ ভাইকেও খাওয়াবে। মেয়েটাকে নিয়ে আজ প্রথমবারের মতো চরম বিপদে পড়লাম। আমি যে ওকে উঠতে বললেও উঠবে না তা ঢের জানি। তবুও ওকে অনুরোধের সুরে বললাম,
” প্লিজ সামিহা, চুপ কর। আমার মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিস না প্লিজ। ”
আদ্রিশ ভাই ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললেন,
” আমার সামনে কিসের মান সম্মান? সামিহা! তুমি চুপ করে আছো কেনো? বলো। তোমার বান্ধবীকে নিয়ে ইন্টারেস্টিং কিছু নিউজ দাও। শুনি। ”
আমি ঠোঁট কামড়ে ধরলাম৷ নাহ, এবার আর বেঁচে ফেরার পথ দেখছি না। আমি যা না করেছি তার চেয়েও দ্বিগুণ মসলা মাখিয়ে বলবে এই মেয়েটা।
সামিহা শুরু করলো। বললো,
” জানেন ভাইয়া? ও বাইরের মানুষকে যে রূপ দেখায় তা ওর আসল রূপ না। ও ভেতরে ভেতরে অনেক দুষ্টু।”
আদ্রিশ ভাই বুকে দু হাত গুঁজে আমার দিকে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলেন। ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
” হুম জানি তো! তুমি তো এক বছর হলো ওকে জেনেছো। আমি ওকে ছোট থেকেই চিনি। ভেতরে ভেতরে যে কি তা বেশ ভালো করেই জানি। ”
আমি লজ্জায় মাথা নিচু করলাম৷ কেবল তো শুরু হলো। এখনও কতোটা অপমান হওয়া বাকি আমার!
সামিহা ফের বলতে আরম্ভ করলো,
” জানেন? ও মাঝেমাঝে আমাকে দুষ্টু বুদ্ধিগুলো দেয়। আমিও ওর কথামতো কাজ করি। কিন্তু শেষে দোষ হয় আমার। আর জানেন ভাইয়া? ওকে আমাদের ক্লাসের একটা ছেলে পছন্দ করে! আমার মাধ্যমে ওকে ইনডিরেক্টলি প্রপোজও করেছে!”
আদ্রিশ ভাইয়ের মুখের প্রতিক্রিয়া বদলে গেলো। তিনি ধীরেসুস্থে নিজের আয়েশী ভঙ্গি ছেড়ে সোজা হয়ে বসলেন। এমনভাবে সামিহার দিকে তাকালেন যেনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কেসের খোলাসা হচ্ছে। ভাবসাব এমন যে উনি কোনো ডাক্তার নয় বরং মস্ত বড় এক গোয়েন্দা। সামিহার কথার সুরেই নিজের সুর মেলালেন। বললেন,
” তাই! প্রপোজ করেছে! ইন্টারেস্টিং! এরপর কি হলো?”
আদ্রিশ ভাইয়ের কথায় আমি মনে মনে বললাম,
” ব্যাটা তোর ইন্টারেস্টিং এর গুষ্টি কিলাই। আমার মান সম্মান কাদা পানিতে মাখোমাখো হতে দেখে খুব মজা পাচ্ছো তাই না!”
এদিকে আমি বিরক্ত হলেও সামিহা বেশ মজা পেলো। এতদিনে বোধহয় সে তার উল্টাপাল্টা বকবক শোনানোর জন্য একজন সুযোগ্য মানুষ পেয়েছে। সে পুনরায় আরম্ভ করলো,
” তারপর আর কি। আমি মিমকে বললাম ছেলেটার কথা। মিম বললো, ওকে কয়েকদিন সময় দিতে। ”
আদ্রিশ ভাই ঠোঁট উল্টে বললেন,
” বাহ! সময়ও নিয়েছে! তারপর?”
” এরপর দুদিন পর আমাকে জানালো যে ও রিলেশন করবে না। এসব ঝামেলার মধ্যে ও জড়াতে চায় না৷ যদি ছেলেটার এতোই পছন্দ হয় তাহলে যেনো সোজা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে।”
আদ্রিশ ভাই অবাক হলেন। বললেন,
” বিয়ের প্রস্তাব! বাহ! গল্পটা এত ইন্টারেস্টিং!”
আমিও এবার অবাক হলাম সামিহার কথায়। প্রায় চেঁচিয়ে বললাম,
” আশ্চর্য! বিয়ের প্রস্তাবের কথা কখন বলেছিলাম আমি! আমি তো…
সামিহা আমাকে মাঝপথে থামিয়ে বললো,
” আহহা, বলেছিলি। তোর মনে নেই। কিন্তু আমার মনে আছে। ”
আদ্রিশ ভাইও আবার বললেন,
” হুম হুম, সামিহা। কন্টিনিউ করো। ”
” হুম। তারপর আমি মাহমুদকে মিমের কথা বললাম। কিন্তু মাহমুদ তখনই পিছিয়ে পড়ে। বলে, কেবল মাত্র মেডিকেলে ভর্তি হয়েছি। এখনই বিয়ে করবো না। লাইফটাকে আরোও এঞ্জয় করবো। আমি তো যাস্ট টাইম পাস আর এঞ্জয়মেন্টের জন্য রিলেশন করতে চাই। ”
আদ্রিশ ভাই অনেকক্ষণ পর এবার হাসলেন। বললেন,
” বাহ! তোমাদের ক্লাসে এমন ছ্যাচড়া ছেলেরাও আছে!”
” আছে মানে! কিছু কিছু ছেলেরা তো সরাসরি ছ্যাচড়ামি করে। আর কিছু কিছুরা কলেজের বাইরে করে। ”
আদ্রিশ ভাই আরোও কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু এর পূর্বেই উনার ফোনে কল এলো। বোধহয় চাচু ফোন দিয়েছেন। উনার কল পেয়েই আদ্রিশ ভাই বললেন,
” আচ্ছা চাচু। আমি আসছি। ”
এই বলে ফোনটা কেটে উঠে দাঁড়ালেন। শুধু সামিহাকে ছোট্ট করে ‘বাই’ বলে চলে গেলেন ক্যান্টিন থেকে।
আদ্রিশ ভাই যেতেই আমি সামিহার উপর রাগে দুঃখে, ক্ষোভে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। উনার হাতে জোরেশোরে মে’ রে’ বললাম,
” শ’ য়’ তা’ ন বেটি! আমার মান সম্মান কিছুই রাখলি না তুই। কি দরকার ছিলো ওসব পুরোনো কথা বলার! উনি কি তোর খাজুরেআলাপ শুনতে চেয়েছিলো? তুই আগ বাড়িয়ে বলতে গিয়েছিস কেনো!”
সামিহা ওর কাজে মোটেও লজ্জিত হলো না। বরং উল্টো বললো,
” আমি কবে থেকে এই মজাদার গল্পটা বলার জন্য মানুষ খুঁজছিলাম। তুই তো আমাদের ক্লাসে কাউকে জানাতে মানা করে দিয়েছিস। আজ যেহেতু আমার গল্পের বাক্স খোলার সুযোগ পেলাম তাই আদ্রিশ ভাইয়ার সামনে গল্প নিয়ে বসে পড়লাম। উনিও কত মনোযোগ দিয়ে শুনলেন!”
আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম,
” হাঁদারাম রে… কার সামনে গল্পের বাক্স খুলে বসেছিস জানিস না তো। উনি এবার আমার বারোটা বাজাবে। এসব খবর নিশ্চিত আপু আর ইমাদ ভাইয়ের কানে যাবে। তখন দুজন মিলে আমার খবর নিবে। বুঝতে পারছিস তুই?”
সামিহা এবার বোধহয় সত্যিই উদ্বিগ্ন হলো। অসহায় চাহনিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আমি কি সত্যিই বেশি বলে ফেলেছি দোস্ত?”
আমি পারি না এখন সামিহাকে উদুম কেলানি দিতে। তাই চোখে মুখে রাগ দেখিয়েই বললাম,
” প্রশ্ন করিস কেনো? তুই তো সত্যিই বেশি বলে ফেলেছিস। বেশি মানে অতিরিক্ত। তুই এতো কথা কেনো বলিস বল তো। আর বলিসই যখন ভেবেচিন্তে বলিস না কেনো? আমি কি সাধেই প্রথমে তোকে চিমটি দিয়েছিলাম! ”
সামিহা মুখটা বেজার করে রাখলো। আমি আর কিছু বললাম না। এখন ওর প্রতি আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। বেশিক্ষণ ওর সামনে থাকলে হয়তো রাগে উল্টাপাল্টা কিছু বলে ফেলবো। তখন ও কষ্ট পাবে। তাই কিছু না বলেই আমি ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে এলাম। অতঃপর নিচে নেমে সোজা বাসায় যাবার রিকশা নিলাম।
আদ্রিশ ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় তখন, যখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। সেবার প্রথম আম্মু আপুর দুই বন্ধুকে বাসায় দাওয়াত দিয়েছিলো। এর আগে আদ্রিশ ভাই বা ইমাদ ভাই কারোর সাথেই আমার দেখা হয়নি৷ আদ্রিশ ভাইকে প্রথম যখন দেখি তখন উনি একদম চিকন ছিলেন। ছেলে হিসেবে বলা যায় খানিকটা রোগা-সোগা দেখতে ছিলেন। এরপর আপুদের ভার্সিটি ক্লাস শুরু হওয়ার আগে একবার দেখা হয়েছিলো। আশ্চর্যজনক ভাবে তখন আদ্রিশ ভাই তখন ওয়েট গেইন করেছিলেন। দেখতে ফিট এন্ড ফাইন ছিলেন। স্বভাবতই সে সময় উনাকে দেখে আমার কিশোরী মনে লাড্ডু ফুটেছিলো। ক্রাশের লাড্ডু।
আপুর এডমিশনের পর সেই যে আদ্রিশ ভাইকে দেখে ক্রাশ খেলাম, এরপর উনার সাথে আর যোগাযোগ ছিলো না, দেখা সাক্ষাৎ হতো না। কেননা তখন তিনি অন্য শহরে মেডিকেলে পড়ছেন। ঢাকায় আসতেন কম। ঢাকায় এলেও আমাদের বাসায় একেবারেই কম আসা যাওয়া ছিলো উনার। যে দু তিনবার এসেছিলেন তখন আমি বাসায় ছিলাম না। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেখাসাক্ষাৎ হতো না।
এরপর আমাদের দেখা হলো আপুর বিয়েতে। আপুর বিয়েতে উনাকে দেখে আমি রীতিমতো বড়সড় রকমের ক্রাশ খেলাম, আবারও। সেদিন…….
®সারা মেহেক
#চলবে