#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-৬
#সারা মেহেক
ড্রইং রুমে হরর মুভির আসর বসেছে। আমি, আপু, আভা ও নদী বসেছি সোফায় আর আদ্রিশ ভাই ও ইমাদ ভাই বসেছে মেঝেতে। ড্রইংরুমের টিভিতে মুভি দেখা হবে। আজকে সিলেক্ট করা হয়েছে ‘ডাব্বে সিজন ৪’ মুভি। আমি নিশ্চিত আদ্রিশ ভাই ইচ্ছে করে এই মুভি সিলেক্ট করেছেন। কেননা তিনি আমার ভয় সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত আছেন৷ ভূতের নাম শুনলে আমি ভয় পাই। হ্যাঁ, খুব বেশি ভয় পাই না৷ কিন্তু ভূতের মুভি দেখলে, গল্প শুনলে আমার অন্ধকারে একা একা চলাফেরা করা, বাথরুমে যাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। বাসায় আমরা তিন বোন হরর মুভি দেখার পর আমি সবসময় আপু বা আভাকে বাইরে দাঁড়িয়ে তারপর ওয়াশরুমে যাই। আর এক ঘুমে রাত পার করার চেষ্টা করি। রাতে যেনো ঘুম না ভেঙে যায় সে নিয়তেই ঘুমাই। আজ হরর মুভি দেখার কোনো পরিকল্পনা ছিলো না। ভেবেছিলাম কোনো থ্রিলার বা ফানি মুভি দেখবে। কিন্তু পরে শুনলাম হরর দেখা হবে। এখন আদ্রিশ ভাই ও ইমাদ ভাইয়ের সামনে নিজের মান সম্মান বাঁচাতে হলে হরর মুভিই দেখতে হবে। তাই আর না-টা করিনি। কারণ আগে মান-সম্মান, পরে ভয়-ভীতি।
মুভি দেখার জন্য পপকর্ণ আর চিপস নিয়ে বসেছি। আপু আর ইমাদ ভাই এক বাটি নিয়ে বসেছে। আমি,আভা আর নদী এক বাটি, আদ্রিশ ভাই এক বাটি নিয়ে বসেছে। যেনো মুভি দেখার সময় খাওয়ায় কোনো বাঁধা না আসে৷
অন্ধকার রুম। মুভি শুরু হলো। এমনিতেই ভূতের ভয় যা-তা। কিন্তু টার্কিশ মুভিগুলোয় যে জ্বিন দেখানো হয় এটায় আমার আরোও ভয়। কেননা জ্বিন পরী যে বাস্তবে আছে, এটা চিন্তা করলেই আমার ভয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়। কিন্তু শুধুমাত্র আমার নাক বাঁচাতে আজ এ মুভি দেখতে বসেছি। না জানি মুভি দেখার সময় কীভাবে রিয়েক্ট করে বসি!
মুভি তার গতিতে চলছে৷ আপুর সামনে ইমাদ ভাই বসে আছে। আর আমার সামনে আদ্রিশ ভাই। সামনে বলতে ঠিক সামনে নয়। সামান্য পাশে৷ মুভি চলাকালীন হঠাৎ আমার মনে নিজ থেকেই ভয় উদয় হলো। মনে হলো, এই বুঝি সোফার নিচ থেকে আচমকা কেউ আমার পা টেনে ধরবে। এই ভয় মনে আসার সাথে সাথেই আমি ঝেড়ে ফেললাম। কিন্তু সে ঝড়লো না। বরং ভয় বাবাজি তীব্র থেকে তীব্রতর ভাবে আমাকে বশে করে নিলো। সে এমন ভয়ানক বশে করলো যে আমি আদ্রিশ ভাইয়ের সামনে ইজ্জতের পরোয়া না করেই তড়িৎ গতিতে পা জোড়া সোফায় তুলে ফেললাম। পাশে নদী আর আভা খেয়াল করেনি। ওরা মুভি দেখতে ব্যস্ত। কিন্তু ঠিকই আদ্রিশ ভাই খেয়াল করেছে। আর খেয়াল করা মাত্রই উনি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে চেয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। তাচ্ছিল্যের হাসি। বক্র কঙ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” কি? এত তাড়াতাড়ি ভয়ে পেয়ে গেলে!”
আদ্রিশ ভাইয়ের কথায় সবার মনোযোগ ভাঙলো। সকলেই আমাদের দুজনের দিকে চাইলেন। আমি এ কথায় নিজ পক্ষের সাফাই দেয়ার পূর্বেই ইমাদ ভাই জিজ্ঞেস করলেন,
” কি হয়েছে আদ্রিশ?”
আদ্রিশ ভাই মৃদু দম ফেলে হাসলেন। আমার দিকে তাকানোর পর ইমাদ ভাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন,
” তোর শালিকা ভয়ে মেঝে থেকে পা দুটো সোফায় তুলে বসেছে৷ ”
আরোপ সত্য হলেও আমি নিজেকে বাঁচাতে মিনমিনে গলাতেই মুহূর্তেই তেজীয়ান কণ্ঠে বললাম,
” কে- কে বলেছে! আপনি বেশি বুঝেন কেনো সবসময়! আপনার কেনো মনে হলো আমি ভয়ে পা তুলে বসেছি! আমি মোটেও ভয়ে পা তুলিনি।”
বলেই কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিলাম, শক্তপোক্ত একটা কারণ খোঁজার জন্য। অতঃপর বললাম,
” আ-আমার পা তুলে বসতে আরাম লাগে। তাই পা তুলে বসেছি। সবসময় এক ডিগ বেশি বুঝে!”
আমি শত চেষ্টা করলাম মিথ্যে বলার। কি উপস্থিত সকলেই আমার মিথ্যে ধরে ফেললো। মিটমিট করে হাসলো। অতঃপর ফের মুভি দেখায় মনোযোগ দিলো। কিন্তু এক নম্বরের বজ্জাত আদ্রিশ ভাই তখনও হাসছেন। যেনো এখন হেসে যাওয়াই উনার মূল কাজ। মেঝেতে বসে হাঁটু দুটো ভাঁজ করে বাটি থেকে পপকর্ণ নিলেন৷ অতঃপর আমার উদ্দেশ্যে বিরবির করে বললেন,
” ভীতুর ডিম। মিম হলো ভীতুর ডিম। ”
এ কথা শোনা মাত্রই আমার মেজাজের পারদ তড়াক করে উর্ধ্বমুখী হলো। মনে হলো উনার অনাবৃত বাহুতে ইচ্ছেমতো খামচি বসিয়ে দেই। তখন আপুর বলার পরও উনি স্যান্ডু গেঞ্জি ছাড়েননি। ফলে এখনও উনার অনাবৃত বাহু বেরিয়ে আছে, ঠিক আমার সামনে। রাগের চোটে উনার এ নগ্ন হাত দুটো দেখে আমার চিমটি দেয়ার ইচ্ছে প্রবল হচ্ছে। তবে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখলাম। কিন্তু নাহ, আমার রাগ দমিয়ে রাখতে পারলাম না। অতঃপর এযাবৎকালের সবচেয়ে সাহসী কাজটা করে বসলাম আমি৷ রাগের মাথায় উনার বাম পাশের বাহুতে নিঃশব্দে চিমটি দিলাম। জোরেশোরেই দিলাম৷ নিজের ভেতরকার রাগ মেটালাম। এবং এরপর যে বড় রকমের একটা কাহিনী হবে তারও প্রস্তুতি নিয়ে রাখলাম মনে মনে৷ কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আদ্রিশ ভাই টু শব্দটুকুও করলেন না। ব্যতিত, ব্যাথায় মৃদু গোঙানি দিয়ে সামান্য নড়েচড়ে বসলেন। ঠিক কয়েক সেকেন্ড পর শুধু এক নজর আমার দিকে চেয়ে ফের মুভি দেখায় মনোযোগ দিলেন। উনার এরূপ ব্যবহারে আমি অবাক হলাম। ভীষণ অবাক। যেনো টুপ করে আকাশ থেকে পড়লাম। কি আশ্চর্য! উনাকে এতো জোরে চিমটি কাটলাম, আর উনি তেমন কোনো রিয়েকশন দেখালেন না! উপরন্তু কাউকে কিছু বললেনও না! বিস্ময়ের উপরে বিস্ময় হলাম৷ উনার এ কাজের ফলে মুভির বেশ খানিকটা সিন দেখতে পারলাম না।
সবাই মুভি দেখায় ব্যস্ত। অন্ধকার রুমের ফলে আমার ভয় খানিকটা বাড়ছে। মুভি দেখার মাঝে আদ্রিশ ভাই যে কোন ফাঁকে সোফার সাথে লেগে বসেছেন কে জানে! আমি ভয়ে ভয়ে মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করতে ব্যস্ত ছিলাম। হয়তো সেই ফাঁকেই সোফার সাথে লেগে বসে আছেন। আমার প্রায় কাছাকাছিই বসে আছেন৷ মুভি দেখার ফাঁকে আদ্রিশ ভাই আমাকে পপকর্ণ সাধলেন। আমিও মুভির ঘোরে উনার বাটি থেকে পপকর্ণ খেতে লাগলাম।
আড়াই ঘণ্টা পর মুভি দেখা শেষে সবাই আবার ভূতের গল্প করলো। বিশেষত আদ্রিশ ভাই! উনার সমস্যা কি জানি না। উনি বোধহয় আজ আমাকে ভয় পাইয়ে মে’ রে’ ফেলার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। হয়তো তখনকার সেই চিমটির প্রতিদান দিলেন আমাকে। আমি পারি না কান বন্ধ করে পালিয়ে যেতে। আজ যে আমার রাতের ঘুম হারাম হবে তা নিশ্চিত।
আপু, ইমাদ ভাই, আদ্রিশ ভাই, তিনজন একযোগে তাবৎ দুনিয়ার সকল জ্বিন ভূতের গল্প করলেন। তিন অতি সাহসী বান্দার ভূতের মুভি দেখেও আত্মায় শান্তি আসেনি। তাই তো মহলটাকে আরোও ভয়ংকর করতে অন্ধকার রুমে জ্বিনের গল্প করছে!
চরম বিরক্ত আর ভয় পেয়ে আমি আপুকে বলেই ফেললাম,
” আর কত গল্প করবে আপু! মুভি দেখে শান্তি পাওনি?”
আপু মৃদু ধমকে বললো,
” তোর সমস্যা কি! ভয় পাচ্ছিস? ভয় পেলে রুমে চলে যা। আমার তো বেশ মজা লাগছে।”
এ কথায় বুকে পাথর চেপে বললাম,
” ভয় পাচ্ছি কে বললো! আমার ঘুম পাচ্ছে তাই বললাম গল্প তাড়াতাড়ি শেষ করতে।”
ইমাদ ভাইও আপুকে এবার তাড়া দিয়ে বললেন,
” হ্যাঁ, নাফিসা। তাড়াতাড়ি শেষ করো। আমারও খুব ঘুম পাচ্ছে।”
আদ্রিশ ভাই কেমন আড়চোখে তাকালেন আমার দিকে। আমি সরু চোখে চেয়ে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
” কি?”
আদ্রিশ ভাই চোখের ইশারায় বললেন,
” উঁহু, কিছু না। ”
————-
শেষ রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেলো। আমি, আপু, আভা ও নদী এক রুমে ঘুমিয়েছি, নদীর রুমে। আর আদ্রিশ ভাইয়ের রুমে উনি ও ইমাদ ভাই ঘুমিয়েছে।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে চোখ খুলতেই মাথার উপর ফ্যানের পাখা দেখলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। বুঝলাম পানির তৃষ্ণায় ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু চোখ খুলতেই এত অন্ধকার দেখে আমার মনে নতুন করে ভয় চাড়া দিলো। ক্ষণিকের জন্য সিদ্ধান্ত নিলাম আবারও ঘুমিয়ে পড়বো। কিন্তু গলা এত শুকিয়ে গিয়েছে যে এখন পানি না খেলে আমি বুঝি ঢোকও গিলতে পারবো না। তাই সাহস করে ফোন নিয়ে উঠলাম। ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দেখি আরোও অন্ধকার। ভেবেছিলাম ডাইনিং এ বোধহয় ড্রিম লাইট জ্বালানো আছে। কিন্তু এ কি! একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার! এমন অন্ধকার শুধু একদিক দিয়ে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালালে ভয় আরোও বেড়ে যায়৷ মনে হয় পিছন থেকে এখনই বুঝি কাঁধে কারোর হাত পড়বে।
ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে ডাইনিং এর সুইচবোর্ড খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পেলাম না৷ এদিকে অন্ধকারে আশেপাশের জিনিসের সাথে বাড়ি খাচ্ছি। শেষমেশ চেষ্টার পরও সুইচবোর্ড না পেয়ে ফ্ল্যাশেই পানি খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আসলে মনের মধ্যে এত ভয় রেখে এভাবে বাইরে থাকা যায় না। তাই টেবিলে গিয়ে জগ থেকে মগে পানি ঢাললাম। এক মগ পানি খেলাম। কিন্তু গলা ভিজলো না বোধহয়। ফের এক গ্লাস পানি খাবার জন্য উদ্যত হলাম। কিন্তু ইতোমধ্যে বোধ হলো আমার ঠিক পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে বুকটা ধক্ করে উঠলো। শ্বাস নিতেও ভুলে গেলাম৷ পিছনে ঘুরে তাকানোর সাহসটুকুও হলো না। তাই তো মস্তিষ্ক বিপদ থেকে বাঁচতে চিৎকার করার ইঙ্গিত দিলো। আমিও মস্তিষ্কের কথামতো চিৎকার করতে উদ্যত হলাম। কিন্তু মুখ দিয়ে সামান্য আওয়াজ বের হওয়া মাত্রই আচমকা কেউ আমার মুখ চেপে ধরলো। এবার মাত্রাতিরিক্ত ভয়ে আমি বোধহয় মা’ রা’ ই যাবো। (তখন আপনাদের গল্প বলবে কে!)
®সারা মেহেক
#চলবে