#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-৯
#সারা মেহেক
আদ্রিশ ভাই আমাদের দিকে শীতল ও শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। আমাদের কথা বলার জন্য উনি যেরূপ ধমকের সুরে শাস্তিটুকু বলে দিলেন তাতে উনার চাহনির বেশ পরিবর্তন আসা উচিত। অথচ এমনটা হলো না। উনি ভালো করেই জানেন কি করছেন উনি। প্রথম ক্লাসেই আদ্রিশ ভাইয়ের এ শাস্তি শুনে আমি ও সামিহা একে অপরের দিকে বিস্মিত চাহনিতে তাকালাম৷ আমরা মোটেও আশা করিনি উনি প্রথমদিন এসেই এমন ছক্কা পিটিয়ে আমাদের ক্লাসরুম থেকে বের করে দিবেন।
আমি নিশ্চিত, সমস্ত ক্লাস আমাদের দিকে অবাক চাহনিতে চেয়ে আছে। সামনে বসেছি বলে কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
আদ্রিশ ভাই দু হাত মুঠো বদ্ধ করে থুঁতনিতে ঠেকালেন। পরনে আজ উনার নেভি ব্লু জিন্সের শার্ট। এই গরমে জিন্সের শার্ট কীভাবে পরেছেন কে জানে! চুলগুলো বরাবরের মতোই সুন্দরভাবে সেট করা। আর চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। উনি সচারাচর চশমা পরেন না। বুড়ো দাদুদের মতো কিছু পড়তে গেলেই উনার চশমার দরকার হয়।
আদ্রিশ ভাই সে চশমার ফাঁক গলিয়েই আমাদের দিকে তীক্ষ্ণ চাহনিতে চাইলেন এবার৷ শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” কি হলো? কানে কম শুনো নাকি স্যারকে সম্মান করতে জানো না?”
প্রথম ক্লাসেই আদ্রিশ ভাইয়ের এহেন ঢং দেখে আমি চুপ করে রইলাম৷ দিক উনি শাস্তি। কত ধরণের, কত বার শাস্তি দিতে পারে আমিও দেখবো।
মনে মনে এ সিদ্ধান্ত এঁটে ফেলার কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই সামিহার জন্য সকল পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো। ও অনুনয়ের সুরে বললো,
” স-সরি স্যার। আর এমনটা হবে না। এবারের মতো মাফ করে দিন স্যার। ”
আদ্রিশ ভাই বিজয়ের হাসি হাসলেন। আমি একদিকে সামিহার কাজে বিস্মিত হলাম, অপরদিকে আদ্রিশ ভাইয়ের হাসিতে ক্রোধিত হলাম। আদ্রিশ ভাই আমার দিকে, শুধুমাত্র আমার দিকে চেয়ে বললেন,
” আচ্ছা বসো। এবারের মতো মাফ করে দিলাম। নেক্সট টাইম থেকে আমার ক্লাসে কথা বলবে না।”
” জি স্যার, জি স্যার। আর কখনও এমনটা হবে না। ”
বলে ও বসে পড়লো। আমিও ওর সাথে সাথে বসে পড়লাম। উনার ক্লাসে যে এখন থেকে প্রচণ্ড সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে তাই মাথায় এঁটে নিয়েই ক্লাসে মনোযোগ দিলাম।
আদ্রিশ ভাই আজকে প্রথম ক্লাস নিলেন। শত শত্রুতা বা অপছন্দ থাকলেও আমি এটা মানতে বাধ্য হলাম যে উনি পড়াতে পারেন বেশ! যা পড়ান এতো সুন্দর করে বুঝে পড়ান যে পরবর্তীতে আইটেমের জন্য একবার রিভিশন দিলেই হবে।
ফিজিওলজি টিউটোরিয়াল ক্লাসের পর আবারও একটা লেকচার ক্লাস হলো। অতঃপর ছুটি। ছুটি শেষে লাইব্রেরীতে গিয়েছিলাম বই ফেরত দিতে। লাইব্রেরী থেকে লিফটে উঠে দেখা হলো আদ্রিশ ভাইয়ের সাথে। উনি বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে জিন্সের পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে লিফটে উঠতে দেখেই এক গাল হেসে বললেন,
” হোয়াট আ প্লেযেন্ট সারপ্রাইজ মিশমিশ! তুমি এখনও কলেজে।”
লিফটে আর কেউ ছিলো না বিধায় আমি আমার আসল রূপ ফিরে এলাম৷ উনার এহেন বিস্ময়সূচক মন্তব্যের বিপরীতে আমি সরাসরি ভেঙচি কেটে বললাম,
” প্লেযেন্ট সারপ্রাইজ তো আমার জন্য। আপনার কলেজে আগমনের জন্য। তো বলুন জনাব আদ্রিশ, কোন দুঃখে, কোন কুলক্ষণে সময়ে আমাদের মেডিকেলের লেকচারার হিসেবে জয়েন করার ভূত মাথায় চেপেছিলো? বলুন।”
আদ্রিশ ভাই মৃদুহাস্যে মাথা নিচু করলেন। ফের মাথা তুলে ফের হাসলেন। যেনো আমি কোনো মজার কৌতুক বলে ফেলেছি। উনার এ হাসি দেখে আমার গায়ে জ্বালা ধরে গেলো। আমি তেতিয়ে উঠে বললাম,
” কি হলো! হাসছেন কেনো? আমি কোনো জোকস বলিনি। আপনার না পোস্টগ্রাজুয়েশনের প্রিপারেশন নেয়ার কথা ছিলো? সেই সিদ্ধান্তের কি হলো তাহলে? এই শুক্রবারেই তো শুনলাম! এত দ্রুত সিদ্ধান্ত বদলে ফেললেন!”
আদ্রিশ ভাই পুনরায় হাসলেন। আমি বোধহয় নিশ্চিত কোনো জোকস বলেছি বা আমার চোখেমুখে কোথাও কৌতুকের কোনো চিহ্ন লেগে আছে। তা না হলে একটা মানুষ এত হাসবে কেনো! আশ্চর্য!
আদ্রিশ ভাইয়ের হাসাহাসির পর্ব শেষ হলে উনি বড় নিঃশ্বাস ফেললেন। বললেন,
” সিদ্ধান্ত হয় বদলে ফেলার জন্য। তাই আমিও বদলে ফেলেছি! একচুয়েলি আমি ভালো একটা অফার পেয়েছিলাম। তাই তো ডিগ্রির নেশা ছেড়েছুড়ে এ নেশায় জড়িয়ে গেলাম। ”
লিফট এসে গ্রাউন্ড ফ্লোরে থামলো। আমি ও আদ্রিশ ভাই দুজনেই নেমে পড়লাম। নেমে নিচে দাঁড়িয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
” কিসের এত নেশা শুনি? টাকার নেশা?”
আদ্রিশ ভাই বিস্তৃত হাসলেন। বললেন,
” উঁহু। এ নেশার থেকেও মারাত্মক এক নেশার টানে এসেছি। ”
আমার বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। অতঃপর কথাটা বুঝতেই আমি রাখ ঢাকবিহীন চট করে বলে ফেললাম,
” বুঝেছি। মেয়ের নেশা তাই তো?”
আদ্রিশ ভাই সন্তুষ্ট চাহনিতে চেয়ে হাসলেন। একদম স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” তুমি কি করে বুঝলে!”
আদ্রিশ ভাইয়ের এহেন প্রশ্নে আমি বিস্মিত হলাম। ভেবেছিলাম এ উত্তর বোধহয় একটু হলেও মিথ্যে হবে। কিন্তু এ দেখি অপরাধী নিজ জবানে নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে! নাহ, লোকটাকে যতটা খারাপ ভাবতাম, সে এর চেয়েও দ্বিগুণ খারাপ। আমি নাক সিঁটকে বললাম,
” ছিহ! আপনি আমার ধারণার চেয়েও খারাপ আদ্রিশ ভাই! ”
বলেই আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে চলে এলাম। পিছে আদ্রিশ ভাই প্রায় গলা উঁচিয়ে বলতে লাগলেন,
” জিজ্ঞেস করবে না কোন মেয়ের নেশায় এসেছি? আরে! শুনে তো যাও!”
আমি উনাকে পাত্তা দিলাম না। দপাদপ পায়ে বাইরে এসে রিকশায় উঠলাম।
—————–
আজ আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। তারই জ্যোৎস্নায় ভিজে উঠেছে সমস্ত ঢাকা শহর। কোলাহলপূর্ণ ব্যস্ততম এ শহরটাও রাত এলে একদম ঝিমিয়ে পড়ে। দূরের সেই রিকশার টুংটাং শব্দ, গাড়ির হর্ণের শব্দও শোনা যায় কালেভদ্রে। হয়তো একটু গলির ভেতরটায় থাকি বলে গভীর রাত হলে ওসব যান্ত্রিক আওয়াজ কানে এসে যন্ত্রণার সূচনা ঘটায় না।
আমি বসে আছি আমার রুমের ব্যালকনিতে। আমার ব্যালকনিটা বিভিন্ন রকমের গাছগাছালিতে পূর্ণ। এখন বর্ষার সময়। এই ঘনঘোর বর্ষায় আমার ব্যালকনিতে আপাতত দু ধরণের ফুলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রথমত অলকানন্দা, দ্বিতীয়ত বাগানবিলাস। এ সময়ে বাগানবিলাস সংখ্যায় কম হলেও অলকানন্দা নিজেকে উজার করে সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যালকনির মেঝেতে ঝরে পড়ে আছে দু চারটে হলদে রাণী অলকানন্দা।
এই অলকানন্দা গাছটা বেশ কয়েক বছর আগে লাগিয়েছিলাম একটা বিশেষ কারণে।
তখন আদ্রিশ ভাইকে নতুন নতুন পছন্দ করতে শুরু করি। স্বভাবতই কিশোরী মনটা সবসময় উড়ুউড়ু করতো। অবাধ্য এ মনটা তখন পছন্দের মানুষটির নানান পছন্দ-অপছন্দের খেয়াল রাখতো। এমনই এক দিনে হঠাৎ জানতে পারি, আদ্রিশ ভাইয়ের পছন্দের রঙ হলো ডিপ নেভি ব্লু, ডিপ মেরুন ও হলুদ। প্রথম দুটো রঙের কথা শুনে পছন্দ হলেও তৃতীয় রঙটার কথা শুনে নাক সিঁটকিয়েছিলাম। হলুদও কারোর পছন্দের রঙ হতে পারে! সেটাও আবার একজন ছেলের! অদ্ভুত! এ কথাগুলো বলার পরও আমি মনে মনে উনার পছন্দের রঙের জিনিসপত্র খুঁজতাম। অতিরিক্ত পাগল হলে যা হয় আরকি! এরই প্রেক্ষিতে একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে ভ্যানে নজরকাঁড়া হলুদ রঙের এ অলকানন্দা গাছটা দেখেছিলাম। ব্যস, টাকা পয়সার কথা চিন্তা না করে, শুধুমাত্র ক্রাশের পছন্দের রঙের কথা ভেবে গাছটা কিনে বাসায় ফিরলাম। এ গাছ নিয়ে বাসায় ফেরার পর আম্মুর সে কি বকুনি! সে তো গাছ ফেলে দিবে দিবে ভাব। আমি কান্না করে প্রায় পায়ে ধরার মতো অবস্থায় মিনতি করে গাছটা রেখে দেই। সেদিনের পর থেকে গাছটার অনেক যত্ন করি। কিন্তু এর মাঝে আপুর বিয়ের সময় যখন আদ্রিশ ভাইয়ের আসল আচরণ দেখলাম, তখন উনার উপর হতে আমার মন একদম উঠে গেলো। সে ঘটনার পর একবারের জন্য মন বলেছিলো গাছটা ফেলে দেই। যে গাছটা উনার কথা মাথায় রেখে কিনেছি, সে গাছটা এখন রাখার কোনো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আমি গাছটা ফেলতে পারিনি। এই হলদে সুন্দরীর সৌন্দর্যের টানে, মায়ার টানে আমি ওকে রাখতে বাধ্য হই। এরপর হতে আদ্রিশ ভাইয়ের উপর যত মায়া, ভালোবাসা কমেছে, এই অলকানন্দার প্রতি আমার ততই মায়া ও ভালোবাসা বেড়েছে। আজও এ ঘ্রাণহীন ফুলের সৌন্দর্যে আমার চক্ষুজোড়া মাতোয়ারা হয়।
এক হাতে অলকানন্দা ও অপর হাতে আমার পুরোনো ডায়েরি নিয়ে বসে আছি ব্যালকনির মেঝেতে। আজ জ্যোৎস্না এত বেশি যে আমি ব্যালকনিতে বসে দিব্যি আমার ডায়েরির লেখাগুলো পড়তে পারছি।
এ ডায়েরিতে লেখা আছে আমার অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা নানান কথা। এ ডায়েরিটা পেয়েছিলাম আমার স্কুল জীবনের বান্ধবী জেবার কাছ থেকে, জন্মদিনের গিফট হিসেবে। সেই জেবা আমার ডাকনাম দিয়েছিলো তিতলি। প্রজাপতির অপর নাম যে তিতলি, তা ওর দেয়া নামের মাধ্যমে সেদিন প্রথম জানতে পেলাম। ও আমার নাম তিতলি দিয়েছিলো, কারণ আমি বলে তিতলির মতো ওর জীবনে রঙ ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। ওকে মানসিক চাপ থেকে মুক্ত করেছিলাম। ওকে নানানভাবে খুশি করেছিলাম। সেই জেবার সাথে এত বছর পরও এখন টুকটাক ফোনে আর ফেসবুকে কথা হয়। ও থাকে চট্টগ্রামে। এজন্যই আর দেখাসাক্ষাৎ কিছু হয় না। তবুও আমাদের দুজনের ইচ্ছে, কোনো এক সুসময়ে আমাদের দেখা হবে।
জেবার দেয়া এ নাম ও ডায়েরিতে লিখেছিলাম, ‘তিতলির ডায়েরি’। হঠাৎ এ ডায়েরিটা দেখলে কেউ বুঝে উঠতে পারবে না যে এটা আমার ডায়েরি। এজন্যই বাসায় মোটামুটি সেইফ আছে এটা।
আমি আজও মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলি এই ভেবে যে, মিম নামক এই তিতলিটার জীবনে কেউ রঙ ছড়িয়ে দিলো না। সে নিজ হাতে নিজের জীবনটা রঙিন করতে চেয়েছিলো। ভালোবাসায় রঙিন। অথচ তার ভাগ্যে নিজের জীবন রঙিন করার কোনো অপশনই ছিলো না! ইশ, জেবা যদি জানতো, তার এই তিতলিটার জীবন আজ বড়ই বর্ণহীন!
এসব পুরোনো কথা মনে পড়তেই আমার চোখের কোনে অশ্রুবন্দি হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি আনমনে ডায়েরিটা খুললাম। ডায়েরির পাতাটাও গিয়ে খুললো আদ্রিশ ভাইকে নিয়ে লেখা অনুভূতি ও মুহূর্তের মধ্যে। মন বললো, এক্ষুণি এই ডায়েরির পাতা থেকে উনাকে উপ্রে ফেলে দিতে। এই উনার ছায়া তিতলির ডায়েরিতে আছে বলেই তিতলির জীবন আজ বর্ণহীন। তবে কি আমি উনার স্মৃতিকে চিরতরে আমার জীবন থেকে মুছে ফেলবো?
®সারা মেহেক
#চলবে