#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-১০
#সারা মেহেক
❝তিতলির ডায়েরি❞ অর্থাৎ আমার বাক্সবন্দী অনুভূতির লেখাগুলো চোখে পড়লে বুকটা হু হু করে কেঁদে উঠে। এখন আর আগের মতো ডায়েরি লেখা হয় না। সময় পাই না। মেডিকেলে ক্লাস শুরুর পর থেকেই মূলত ওর সাথে আমার দূরত্বটা বেড়েছে। এমন না যে আমি ওকে খুলে বসিনি। ওর পাতায় নিজের মনের প্লাবনের কথা লিখতে বসিনি। চেষ্টা করেছি। তবে দিন শেষে প্রচণ্ড ক্লান্তি এসে ধরা দেয় আমার শরীরে। তখন একটুও মন চায় না যে আমি ডায়েরি নিয়ে বসি। অথচ এই আমিই মেডিকেলে আসার আগ পর্যন্ত কারণে অকারণে মন খারাপ হলে ওকে নিয়ে বসতাম। খুব আনন্দের কিছু হলে ওকে নিয়ে বসতাম। অথচ এখন……
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার নিজের অতীতের লেখাগুলোই পড়তে আরম্ভ করলাম…….
❝৩রা মার্চ,
আজ ছিলো শুক্রবার। আজকের দিনটা আমার জন্য অনেক স্পেশাল। কেননা আজকে আমি আদ্রিশ ভাইয়ের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম। জীবনে প্রথমবারের মতো ক্রাশের সাথে কোথাও ঘুরতে গিয়েছি। বুঝতে পারছো ঠিক কতটা এক্সাইটেড ছিলাম আমি! অবশ্য ঘুরতে আমি একা যাইনি। আপু, ইমাদ ভাই, আদ্রিশ ভাই ও আমি।
আমার ঘুরতে যাওয়ার কোনো প্ল্যানই ছিলো না। ইমাদ ভাইই আপুকে জোর করে আমাকে সাথে নেয়ার জন্য। আপু প্রথমে একটু বিরক্ত হয়। কারণ সে যাবে তার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে। এর মধ্যে তার ছোট বোনের কাজ কি!
পরে ইমাদ ভাইয়ের কথায় আব্বুও বললো আপুর সাথে যেতে। সাধারণত এমন ছেলেদের সাথে আম্মু বা আব্বু একা বাইরে যেতে দিতো না। কিন্তু আব্বু আম্মুর আমাদের দু বোনের প্রতি এবং আদ্রিশ ভাই ও ইমাদ ভাইয়ের উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে।
আদ্রিশ ভাইয়ের সাথে ঘুরতে যাওয়া নিয়ে আমি ভীষণ এক্সাইটেড ছিলাম। সেই এক্সাইটমেন্টের ঠ্যালায় আপুর কাছ থেকে লুকিয়ে আপুর একটা ফেস প্যাক মুখে নিয়েছিলাম, ঠিক গোসলের আগে। যেনো আমার এ কাজটা সে ধরতে না পারে। আপুর ফেসপ্যাক নেয়ার পর চেহারায় আলাদাই একটা গ্লো এসেছিলো। এরপর গোসল থেকে বেরিয়ে আদ্রিশ ভাইয়ের পছন্দের ডিপ মেরুন রঙের সিম্পল একটা গাউন ও একটা হিজাব পরলাম। চোখে কাজল, আইলাইনার, ঠোঁটে লিপস্টিক আর মুখে হালকা ফেস পাউডার দিলাম। আপু আমার সাজ দেখে জিজ্ঞেস করেছিলো, ‘ কি রে! বিয়ে খেতে যাচ্ছিস নাকি!”
আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও সাহস নিয়ে বললাম,
‘ তুমি বিয়ে করলে তোমার বিয়েতে যেতে পারি আপু। ‘
আপুও তখন সরু চোখে চেয়ে একটু রাগ দেখিয়ে বললো,
‘ তাহলে এত সাজ দিচ্ছিস যে?’
‘ এত সাজ আর কই? একদম সিম্পল লুক আপু! বাইরে গেলে মানুষ এটুকু সাজেই। ‘
আপু আর কথা বাড়ায়নি তখন। আমিও মনের সুখে রেডি হয়ে আদ্রিশ ভাইয়ের অপেক্ষায় ছিলাম।
আপুর এই বন্ধুকে আমার কারণে অকারণে ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে ভালো লাগার কোনো কারণ খুঁজে পাই না। কিন্তু উনার উপর ক্রাশ খাওয়া থেকেই আমার ভালো লাগার শুরু। মানুষটা হয়তো জানেও না এক কিশোরী মেয়ে তাকে এতোটা পছন্দ করে। আচ্ছা, উনি যদি আমার পছন্দের কথা জানতেন তাহলে কি রিয়্যাকশন দিতেন? আমার উপর হাসতেন? নাকি উল্টো আমাকেও পছন্দ করতে শুরু করতেন?
দ্বিতীয়টা হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও প্রথমটা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। হয়তো ছোট বলে আমার মাথায় একটা টোকা দিয়ে বলবে, ‘পড়াশোনায় মনোযোগ দাও মেয়ে। এখন এসবের সময় না৷’
এসব আজগুবি সব চিন্তাভাবনা করতে করতে আমি আর আপু নিচে নেমে এলাম। নিচে নেমেই আদ্রিশ ভাইয়ের দর্শন হলো। আর উনার এ দর্শনেই আমার অজ্ঞান হবার দশা হলো। আজ উনাকে মাত্রাতিরিক্ত হ্যান্ডসাম লাগছে। এ হ্যান্ডসামনেসের কোনো সীমানা নেই। উনার পরনে আজ ডিপ নেভিব্লু রঙের শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট। শার্টের হাতা ফোল্ড করা। ডান হাতে ঘড়ি। চোখে কালো সানগ্লাস। গালে ছাট ছাট দাঁড়ি ও চুলগুলো বরাবরের মতোই সেট করা। মোট কথা আজ উনার রূপের প্রশংসা ব্যতিত আমার দিন যাবে না। ক্রাশ খাওয়া এই মানুষটার উপর আজ আবারও ক্রাশ খেলাম৷
আমি আর আপু যখন নিচে নামলাম তখন দেখলাম আদ্রিশ ভাই তাদের গাড়িতে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে ফোন চালাচ্ছেন। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি রোদের মধ্যে চোখমুখ কুঁচকে আমাদের দিকে তাকালেন। প্রথমত আপুর দিকে চেয়ে বিরক্তিভরা চাহনিতে বললেন,
” বয়ফ্রেন্ডের জন্য রূপবতী হতে গিয়ে যে ফ্রেন্ডের জন্য লেটবতী হয়ে যাচ্ছিস সেটা কি একবারও মাথায় আসে না?”
আপু জিব কেটে ‘সরি সরি’ বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে। আর আমি আপুর পিছে লুকানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করে চলছি। কেননা আপুকে এ কথা বলার পর আদ্রিশ ভাই আমার দিকেই তাকালেন। আচমকা ঐ রোদের মধ্যেই দাঁড়িয়েই ধীরেসুস্থে সানগ্লাসটা খুলে হাতে নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। এ চাহনি আমার দিকে তাক করে ছিলো মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। কিন্তু ঐ কয়েকটা সেকেন্ডেই আমার দূর্বল মনকে আরোও দূর্বল করে ভেতরে অস্থিরতা বাড়িয়ে তুললো। মনের ভেতর কি ঝড় শুরু হলো কে জানে? নতুন তান্ডব নাকি নতুন ঘূর্ণিঝড় নাকি কালবৈশাখী ঝড়!
আদ্রিশ ভাইয়ের ঐ কয়েক সেকেন্ডের তাকানোর মাঝেই ভুলবশত উনার আর আমার চোখাচোখি হয়ে যায়। এজন্যই আমি লজ্জায় আপুর পিছে লুকিয়ে লুকিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি।
আদ্রিশ ভাই আমাকে দেখে আপুকে জিজ্ঞেস করলেন,
” ব্যাপার কি? ফ্রেন্ড সার্কেলের মাঝে এই পুচকে মেয়েটার কাজ কি?”
উনার ‘পুচকে মেয়ে’ সম্বোধনে তখন আমার ভীষণ রাগ উঠে গেলো। উনাকে উদ্দেশ্য করেই সরাসরি ভেঙচি কাটলাম। তবে নীরবে।
আপু এবার আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে বললো,
” ইমাদের স্পেশাল গেস্ট ও।”
এতক্ষণে ইমাদ ভাই ও ওপাশ থেকে এপাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমাকে দেখা মাত্রই হাসিমুখে কুশল বিনিময় করলেন৷ এক গাল হেসে আপু ও আদ্রিশ ভাইয়ের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন,
” আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে মনে হয়?”
আদ্রিশ ভাই চোখের ইশারায় আমাকে আপাদমস্তক দেখিয়ে বললেন,
” ও বলে তোর স্পেশাল গেস্ট? ”
ইমাদ ভাই তখন বিস্তৃত হেসে বললেন,
” ইয়াপ। মিম আমার স্পেশাল গেস্ট। আমার হবু শালিকা বলে কথা। ভাবলাম আজ ওকেও আমাদের সাথে এড করি। আইডিয়াটা ভালো না?”
আদ্রিশ ভাই বেশ পার্ট নিয়ে সানগ্লাসটা ফের চোখে দিয়ে বিড়বিড় করে বললেন,
” ওর্স্ট আইডিয়া এভার। ”
বলেই তিনি শিষ বাজাতে বাজাতে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসলেন৷ উনার এ কথায় আমি তখন খুব কষ্ট পেলাম৷ বাসা থেকে আসার পথে যতটা হাসিখুশী ছিলাম, উনার এ কথায় আমার সব আনন্দ উল্লাস মুহূর্তেই বাতাসে উবে গেলো। ঘুরতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি আপুর সাথে গাড়িতে বসলাম।
গাড়িটা আদ্রিশ ভাইয়ের বাবার। আদ্রিশ ভাই ও ইমাদ ভাই সামনে বসেছেন। আর আমি ও আপু পিছনে বসেছি। আমাদের যাত্রাপথ ধানমন্ডি লেকের উদ্দেশ্যে। প্রথমে জিন্দা পার্ক সিলেক্ট করা হলেও আমাদের বের হতে দেরি হয়ে গিয়েছে বিধায় ধানমন্ডি লেকই আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল হলো।
ধানমন্ডি লেকে গিয়ে আমরা কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। চারজন একসাথে বসে কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা বাতাস উপভোগ করলাম। এরপর ইমাদ ভাই ও আপু আমাকে আদ্রিশ ভাইয়ের দায়িত্বে রেখে নিজেদের মতো ঘুরতে চলে যায়। আমি তখন পড়ি বিপদে। একে তো ক্রাশের সাথে একা একা, উপরন্তু আজ ক্রাশের চেহারা-সুরুত গরমের সাথে আমাকে দেখেও মেজাজটাও গরম।
আপু ও ইমাদ ভাই যেতেই আদ্রিশ ভাই সরাসরিই আমাকে খোঁচা দিয়ে বললেন,
” এই হলো তোমার হবু ব্রাদার ইন ল’র স্পেশাল গেস্ট হওয়ার ট্রিটমেন্ট। হাহ।”
বলেই তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এর বিপরীতে কি জবাব দেয়া যায় তা ভাবতে ভাবতেই উনি পরবর্তী কথাটা বললেন। বেশ আফসোসের সুরেই বললেন,
” এ জায়গাটা হলো পিওর প্রেম করার জায়গা। কাপল প্লেস এটা। ব্যাটা ইমাদ ইচ্ছে করেই এ জায়গাটা চুজ করেছে। যেনো ও আর নাফিসা এখানে ছোটখাটো একটা কাপল ট্যুর দিতে পারে। এ জায়গাটা আসলে আমাদের মতো সিঙ্গেলদের জায়গা না। ”
বলেই তিনি হাসলেন। মুহূর্তের মধ্যেই আমার দিকে চেয়ে সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” ওয়েট ওয়েট। এখানে আমি সিঙ্গেল হলেও তুমি তো সিঙ্গেল না-ও হতে পারো। কি? প্রেম-টেম করো নাকি?”
আমি তৎক্ষনাৎ আঁতকে উঠে উনার এ প্রশ্ন কম আরোপের বিরুদ্ধে গিয়ে বলি,
” না না। আমি ওসবের মধ্যে নেই। এখন আমার বয়সই বা কত। এই বয়সে প্রেম করলে আব্বু আম্মুর আগে আপুই আমাকে বাসা থেকে বের করে দিবে। ”
এই শুনে আদ্রিশ ভাই হাসলেন। বললেন,
” প্রেম করার অপরাধে তোমাকে বের করার আগেই নাফিসারই তো বের হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ ও তো এ বয়সে প্রেম করেছে। ”
বলেই তিনি মৃদু শব্দে হাসলেন। এ পরিস্থিতিতে চুপ থাকলে দৃষ্টিকটু দেখায় বলে আমিও উনার সাথে মেকি হাসি দিলাম।
আমাদের এ কথার মাঝেই আদ্রিশ ভাই জিজ্ঞেস করলেন,
” বাদাম খাবে?”
আমি সামান্য মাথা নাড়িয়ে বললাম,
” খাওয়া যায়!”
অতঃপর আদ্রিশ ভাই কাছে থাকা এক বাদামওয়ালাকে ডাক দিলেন। বললেন,
” মামা, একশ বাদাম দেন। ”
বলেই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
” এক প্যাকেটেই নিবো নাকি আলাদা প্যাকেটে। ”
ক্রাশের সাথে একই প্যাকেট হতে বাদাম খাবো, এই ভেবে অতি এক্সাইটমেন্টের জ্বালায় প্রায় বলেই বসেছিলাম যে, এক প্যাকেটই থাক। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে চক্ষুলজ্জায় মিনমিন করে বললাম,
” আপনার যেমনটা সুবিধা হয়। ”
আদ্রিশ ভাই মৃদু হাসলেন। বাদামওয়ালা মামাকে এবার বললেন,
” এক প্যাকেটেই দেন মামা। শুধু শুধু কাগজ অপচয় করার দরকার নেই। ”
আদ্রিশ ভাইয়ের এহেন কথায় মনের ভেতরে চরম এক্সাইটমেন্টের লাড্ডু ফুটলেও বাইরে দিয়ে আমি নিজেকে শান্ত নদীর মতো সুশীল ও সুস্থির দেখালাম।
দুজনে একই প্যাকেট থেকে বাদাম খাচ্ছি। সাবধানে একবার উনি, একবার আমি বাদাম নিচ্ছি। বাদাম খাওয়ার এক পর্যায়ে আদ্রিশ ভাই বললেন,
” তুমি বসো। আমি দুটো সফট ড্রিংকস নিয়ে আসি। গলা শুকিয়ে আসছে। তুমি কি আর কিছু খাবে?”
” না না। সফট ড্রিংকসই থাকুক। ”
” আচ্ছা। এখানেই বসো তাহলে। ”
অতঃপর আদ্রিশ ভাই চলে গেলে আমি একা একাই বসে টুকটুক করে বাদাম খেতে লাগলাম। খেতে খেতে হঠাৎ আমার দৃষ্টি আটকে গেলো অদূরে থাকা একটা গাছের উপরে বসে থাকা পাখির উপর। হলদে সবুজাভ রঙের পাখিটাকে দূর থেকে দেখতে দারুণ লাগছে। পাখিটাকে দেখে আমার ফটোগ্রাফি মন কয়েকটা ছবি তুলতে উদ্যত হলো। কিছু না ভেবেই আমি ফোনসহ উঠে ঐ গাছটার কাছে গেলাম। ফোনটা আপুর দেয়া। আপুর সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন আরকি। এই বয়সে আব্বু আমাকে ফোন কিনে দিবে না। তাই আপুর এ ফোনের স্পিকার নষ্ট হওয়ায় অনেক রিকুয়েষ্ট করে এটা আমার কাছে রেখে দেই। এ ফোনে আমি শুধু ছবি তুলি আর টুকটাক গান শুনি। সিম নেই, সুতরাং কথা বলারও কোনো ব্যবস্থা নেই।
পাখি ও গাছের বেশ কয়েকটা ছবি তোলার পর আমি হঠাৎ করেই যেনো হারিয়ে গেলাম। ধানমন্ডি লেকে কখনও আসা হয়নি। উপরন্তু একা তো কখনোই না। মানুষের ভিড়ে কোন পথে এদিকে এসেছিলাম সেটাই হারিয়ে বসি। এদিকে আমার ফোনে নেই কোনো সিম। ফোন দেয়ারও ব্যবস্থা নেই। এই ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার ভয় আমাকে চরম আতঙ্কিত করে তোলে। অস্থির হয়ে পড়ি আমি। বুকটা চেপে আসে। মুহূর্তের মধ্যে নিঃশ্বাস নেয়াও কষ্ট হয়ে যায় আমার জন্য। আমি কি তবে হারিয়ে গেলাম? কেউ কি আমাকে খুঁজে পাবে এই ভিড়ের মধ্যে?
®সারা মেহেক
#চলবে