#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-১১
#সারা মেহেক
এই ভিড়ে কোনো পরিচিত মুখের সন্ধান না পেয়ে আমার চোখ দিয়ে অঝোরে নোনাজল নেমে এলো। জীবনের সবচেয়ে বেশি অসহায় বোধ হলো ঠিক এখানটায় দাঁড়িয়ে।
এদিকে না আপুকে দেখছি, না আদ্রিশ ভাইকে। বুকের মধ্যে অস্থিরতা বেড়েই চলছে। কিছুক্ষণ পরই মনে হলো আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে চলেছি। শরীরে দুর্বলতা বোধ করছি। ঝিম ধরে আসছে সমস্ত শরীরে। আমার এই সমস্যাটা প্রবল। যেকোনো বিপদে যখন আমি দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে পড়ি, তখন শরীরটা আমাকে একা ছেড়ে দেয়। দুর্বল করে দেয়। ফলে তখন না পারি পালাতে, না পারি বিপদের মুখোমুখি হতে।
আমার চোখের সামনে ধীরেধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে। শরীরে ব্যালন্সও রাখতে পারছি না। আমার এ অবস্থা দেখে কয়েকজনকে এগিয়ে আসতে দেখছি। এতজন মানুষকে এভাবে দেখে আমার শরীরটা আরোও ছেড়ে দেয়। ঠিক যেসময়ে শরীরের সমস্ত ভার ফেলে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে যাবো, সে মুহূর্তেই আদ্রিশ ভাইয়ের আগমন ঘটে। অস্পষ্ট দৃষ্টিতে আমি উনাকে এগিয়ে আসতে দেখছি। উনি প্রায় দৌড়ে এসেই মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগে আমাকে ধরে ফেলেন৷ আমিও শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দেই আদ্রিশ ভাইয়ের উপর। উনি আমাকেসহ ধীরেসুস্থে মাটিতে বসে পড়েন৷ পাশ থেকে কার যেনো পানির বোতল থেকে পানি নিয়ে আমার চোখেমুখে পানির ছিটা দেন, পানি খাওয়ান।
আদ্রিশ ভাইকে দেখে আমি শান্ত হই, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি৷ ফলে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আমার বেশি সময় লাগেনি। শুধুমাত্র শরীরটা একটু দুর্বল লাগছে।
আদ্রিশ ভাই আমাকে দেখে উদ্বিগ্ন পূর্ণ চাহনিতে চেয়ে অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” এখন ভালো লাগছে? ”
আমি ধীর গলায় বললাম,
‘ হুম। এখন ভালো লাগছে৷ আপনি প্লিজ ওনাদেরকে চলে যেতে বলবেন? এভাবে খুবই আনকম্ফোর্টেবল ফিল হচ্ছে।”
আমার কথা মতো আদ্রিশ ভাই মানুষ তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
অতঃপর সবাই যে যার মতো চলে গেলে আমি মাটিতেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আদ্রিশ ভাইয়ের সহযোগিতায় উঠে দাঁড়াই। উনি আমার হাত ধরে সেই বেঞ্চের নিয়ে বসান। ওখানে কিছুক্ষণ পুরোপুরি চুপচাপ থেকে স্বাভাবিক হয়ে এলে আদ্রিশ ভাই শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
” ওদিকে গিয়েছিলো কেনো?”
উনার এরূপ শীতল স্বরের সাথে আমি পরিচিত নই। ফলস্বরূপ খানিকটা ভয় নিয়েই বললাম,
” একটু কাজে।”
আদ্রিশ ভাই চট করে গরম দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,
” কাজে! এখানে এসে তোমার কি কাজ?!”
আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে বললাম,
” আসলে ওখানে একটা গাছে পাখি বসেছিলো। দেখতে অনেক সুন্দর লাগছিলো। তাই ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। ”
আমার কথা শুনে আদ্রিশ ভাই রাগে ফুঁসে উঠলেন নাকি কে জানে! আমাকে কিছু বললেন না। কিন্তু হাতের মুঠো শক্ত করে চোখের চাহনি কঠিন করলেন। প্রচণ্ড ক্রোধ দমিয়ে রেখে বললেন,
” ছবি তুলতে গিয়েছিলে! বাহ! তোমার সাহস দেখে পারি না! তোমাকে তো সেরা সাহসীর একটা অ্যাওয়ার্ড দেয়া উচিত। অপরিচিত জায়গায়, অপরিচিত মানুষের মধ্যে ম্যাডাম গিয়েছে ছবি তুলতে বাহ!”
বলেই তিনি সিমেন্টের তৈরী এ শক্তপোক্ত বেঞ্চে আচমকা ঘুষি মা’ র’ লে’ ন। উনার এ আকস্মিক কাজে আমি বিস্ময়ে হা হয়ে এলাম৷ অবাক হয়ে উনার চোখের চাহনি পর্যবেক্ষণ করলাম। উনি যে প্রচণ্ড রাগে নিজেকে এভাবে আঘাতও করতে পারে, এ ব্যাপারটা আমার অজানা ছিলো।
আমি আতঙ্কিত চাহনিতে চেয়ে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
” এ কি করলেন আদ্রিশ ভাই! এভাবে অযথা নিজেকে হার্ট করলেন কেনো?”
” তোমার কারণে। শুধুমাত্র তোমার কারণে। তুমি জানো দোকান থেকে এখানে আসার পর আমার কি হয়েছিলো? তোমাকে এ জায়গায় না পেয়ে কেমন লাগছিলো আমার?”
আমি নির্বাক চাহনিতে চেয়ে রইলাম। আদ্রিশ ভাই ফের বললেন,
” আমি কতোটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানো? এতোটা প্যানিকড বোধহয় এ যাবতকালে কোনোদিনও হইনি, যতটা আজ হয়েছিলাম৷ ”
আমার প্রতি আদ্রিশ ভাইয়ের এ উদ্বিগ্নতা, এ অস্থিরতা আমার উড়ুউড়ু মনে অন্য কিছুর জানান দিলো৷ স্বল্প সময়ের মধ্যেই আকাশ পাতাল নানান ভাবনা ভেবে ফেললাম। কিন্তু পরমুহূর্তেই উনার পরের কথাটি শুনে আকাশে উড়তে থাকা আমি এক টানে পাতালে এসে পড়লাম। উনি বললেন,
” নাফিসা আমার উপর তোমার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছে। তুমি হারিয়ে গেলে আমি ওকে কি জবাব দিতাম বলো! একবারও কি আমার এ জবাবদিহিতার কথা ভাবোনি তুমি?!!”
ক্ষণিকের সুখী মনটা মুহূর্তেই দুঃখী হয়ে পড়লো। তাহলে উনি দায়িত্বের কথা চিন্তা করেই আমাকে ওভাবে খুঁজছিলেন৷ ওভাবে খেয়াল রাখছিলেন। দায়িত্বের খাতিরেই এত উদ্বিগ্নতা, অন্যকিছু নয়।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনার………….❞
সেদিনের ঘটনাটি এখানেই অসমাপ্ত রয়েছে। বাকিটুকু লেখা হয়নি। কেনো হয়নি জানি না। অবশ্য পাতার ডায়েরিতে লেখা না হলেও আমার মস্তিষ্কের ডায়েরিতে ঠিকই সেদিনের সম্পূর্ণ ঘটনা তুলে রাখা আছে। সেদিন আদ্রিশ ভাইকে বারংবার নিষেধ করেছিলাম আমার এ অবস্থার কথা যেনো না বলে। বললে আপু আছে আমাকে আস্ত রাখবে না। ঠিক যেটার ভয়ে ছিলাম তখন, সেটাই হলো। আদ্রিশ ভাই পরে ঠিকই আপুকে বলে দিয়েছিলো। এরপর আপুর কি শাসন!
সেসব দিনের কথা মনে পড়লে আজও অবাক হই। কিশোরী আমি’টা কি ছিলাম, আর এখন কি হয়েছি! যে আমি’টা আদ্রিশ ভাইয়ের সামনে নিজেকে পরিপাটি ও সুন্দর দেখানোর জন্য নানান কিছু করতাম, তার মনোযোগ আকর্ষণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম, সেই আমি’টাই আজ উনাকে গুনায় ধরি না। উনাকে উপেক্ষা করে চলি, ঝগড়া করি, পাত্তা দেই না।
ডায়েরিটা বন্ধ করে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আমি হাসলাম। নিজের অতীতের কর্মকাণ্ডের কথা চিন্তা করে হাসলাম। কি পাগলটাই না ছিলাম আমি! এক ক্রাশের সামনে ভালো দেখানোর জন্য কত কিছু করা! অবশ্য বয়সটাও তখন ওমন ছিলো।
মাঝেমধ্যে আমার মনে কিছু প্রশ্ন আসে। আচ্ছা, আদ্রিশ ভাই কি জানে তাকে আমি এক কালে প্রচণ্ড পছন্দ করতাম? আচ্ছা, উনি কি আদৌ জানেন এখন আমি উনাকে একদম সহ্য করতে পারি না, শুধুমাত্র আপুর বিয়ের পর থেকে তার আচরণ বদলে যাবার জন্য! আচ্ছা, উনি এ ব্যাপারে জানলে কি আমার কাছে ক্ষমা চাইবে? নাকি স্বাভাবিক আচরণ মনে করে পাত্তাই দিবে না আমাকে!
এসব ভাববার পরমুহূর্তেই নিজের গালে আলতো করে দুটো চড় মারলাম। আশ্চর্য! উনার পাত্তা দেয়া না দেয়ায় আমার কাজ কি! উনাকে কে পাত্তা দিচ্ছে! উনি কি আদৌ আমার পাত্তা পাওয়ার মতো মানুষ! হাহ। এসব ক্রাশ নামক বাঁশকে পাত্তা দিলেই তারা বাঁশঝাড়ের মাথায় চড়ে আমাদের উপর বাঁশের বর্ষন করে। সুতরাং এমন সুদর্শন ছেলেদের ক্রাশ বানাতে ও পাত্তা দিতে নেই।
———————
আজ শুক্রবার।
আম্মুর সাথে সকালের নাস্তা বানাচ্ছি। সাধারণ আম্মুই সকালের নাস্তা বানায়। যেদিন ছুটি থাকে সেদিন আমি আম্মুকে রান্নার কাজে সাহায্য করি।
সকালের নাস্তায় আজ পরোটা আর সবজি। সবজি রান্না শেষ। আম্মু এখন পরোটা বানাচ্ছে, আর আমি তেলে ভাজছি।
হঠাৎ কাজের মধ্যে আম্মু প্রশ্ন করলো,
” তোদের ক্লাসে কার কার বিয়ে হয়েছে? ”
হঠাৎ আম্মুর এ প্রশ্ন শুনে কিছুটা অবাক হলেও স্বাভাবিক গলায় বললাম,
” তেমন কারোর না। কয়েকটা মেয়ের ভর্তি হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কয়েকজনের ভর্তি হওয়ার পর বিয়ে হলো। আর কয়েকজনের এই তো ক্লাস চলাকালীন বিয়ে হলো। ”
” তাহলে তো অনেকেরই বিয়ে হয়েছে!”
” অনেকের না আম্মু। কয়েকজন বলতে এই ২/৪জন আরকি। ”
এর প্রত্যুত্তরে আম্মু কিছু বললো না। তবে মিনিট খানেক পর নিজেই প্রশ্ন করলো,
” বিয়ের ব্যাপারে তোর মত কি?”
আম্মুর কথা ঠিক বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,
” আমার মত মানে? এখানে আমার মতে কি কাজ?”
” না মানে বলছি যে, এখন বিয়ের সম্বন্ধ আসলে কি বিয়ে করবি?”
আম্মুর এহেন প্রশ্নে আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম। বিস্ময়ে আমার মুখ হা হয়ে এলো। আম্মু অকস্মাৎ এভাবে বিয়ের কথা তুলবে এটা কল্পনাও করিনি। আমি অবাক কণ্ঠে বললাম,
” বিয়ে! এখন! আম্মু, তুমি কি ঠিক আছো!”
” এতো অবাক হচ্ছিস কেনো! মনে হচ্ছে বিয়ে না, কি না কি বলে ফেলেছি!”
” কি না কি-ই বলে ফেলেছো আম্মু। এখন বিয়ের কথা চিন্তাও করতে পারি না আমি। ”
” কেনো পারবি না? এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। ”
” আমার জন্য মোটেও স্বাভাবিক না। আমি এখনও মেন্টালি প্রিপেয়ার্ড না। ”
” বিয়ের জন্য আবার কিসের এত মেন্টাল প্রিপারেশন লাগে!”
আমি চরম বিরক্ত হয়ে বললাম,
” লাগে আম্মু। তুমি ওসব বুঝবে না। আর এই বয়সে আমি বিয়ে করবো না।”
” কেনো করবি না! আমার তো তোর চেয়েও কম বয়সে বিয়ে হয়েছে। ”
” তোমার কথা উদাহরণ হিসেবে বলো না আম্মু। তোমার বিয়ে হয়েছে সেই নব্বই দশকে। এখন ওসব যুক্তি চলে না।”
” আচ্ছা! আমার কথা বাদ দিলাম। নাফিসা? নাফিসার কি এ বয়সে বিয়ে হয়নি?”
আম্মু ঝগড়ার সময় ঠিক জায়গামতো পয়েন্ট ধরতে পারে বলে সবসময়ই আমি ঝগড়ায় হেরে যাই। এবারও ঠিক তেমনটাই হলো। কারণ আম্মু তার জায়গায় ঠিক। আপুরও এ বয়সে বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু আমিও এ ঝগড়ায় দমে যাওয়ার পাত্র নই। বেশ উঁচু গলা নিয়ে বললাম,
” আপুর বিয়ে দিয়েছো কারণ আপুর পাত্র ঠিক ছিলো৷ ইমাদ ভাই আর আপু একে অপরকে ভালোবাসতো তাই। ”
” তো তোর কোনো ভালোবাসার মানুষ নেই? বল, তার সাথে বিয়ে দিয়ে দেই। ”
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললাম, ‘ ছিলো তো! কিন্তু এখন নেই। আর ঐ খাটাশের সাথে কে বিয়ে করবে!’ তবে মনের কথাটা আম্মুকে আর বললাম না। বললাম,
” নেই। কোনো ভালোবাসার মানুষ নেই। আমি পিওর সিঙ্গেলই ঠিক আছি। ”
” সিঙ্গেল আর কতদিন! ভালো সম্বন্ধ আসলে তো বিয়ে দিবোই। ”
” তো কি এমন ভালো সম্বন্ধ এসেছে?”
” এসেছে তো। অনেক ভালো সম্বন্ধ।”
আমি এবার একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালাম। ভাবছিলাম, আম্মু বোধহয় এমনিই বলছে। কিন্তু এ দেখি সত্যি!
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
” কে-কে সম্বন্ধ এনেছে? আরকোন বুড়ো ব্যাটা আমার মতো কচি মেয়েকে বিয়ে করতে চায় শুনি?”
” বুড়ো না। বয়স বেশি না তো৷ ”
” আচ্ছা! বয়স কত? নাম কি? করে কি?”
” বয়স খুব বেশি না। আর নাম হলো……”
®সারা মেহেক
#চলবে