অলকানন্দা ও তিতলি পর্ব-১৩

0
13

#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-১৩
#সারা মেহেক

রাফিদ কিছুটা সময় নিলো। অতঃপর রয়েসয়ে বললো,
” আসলে আপনার সম্পর্কে মোটামুটি খোঁজ খবর পেয়েছি। ইয়ে মানে, পরিবার, পড়াশোনা, চলাফেরা এই তো। তো আমি যেটা নিয়ে জানতে চাচ্ছিলাম আরকি….. আসলে এই যুগে মোটামুটি সবারই রিলেশনশিপ থাকে। ইয়ে মানে, সেক্ষেত্রে আপনার কোনো রিলেশন আছে? বা কাউকে পছন্দ করেন? পছন্দ করলে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। আমি বিয়ে থেকে পিছু হটে যাবো। ”

রাফিদের এহেন কথায় আমি খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। ক্ষণিকের জন্য দোটানায় পড়লাম, আদ্রিশ ভাইয়ের কথা বলবো কি না এই ভেবে। কিন্তু পরক্ষণে মনে বললো, উনি আমার অতীত ছিলেন। অতীতে উনার সাথে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা জড়িত। সে হিসেবে আমার বর্তমানে উনার কোনো ছায়া পড়া উচিত নয়। উপরন্তু আমি যতটা উনাকে নিয়ে ভাবি বা ভাবতাম, উনি ততোটা আমায় গুরুত্ব দেননি। তাই উনার কথা ভেবে নিজ হাতে নিজের ভবিষ্যত নষ্ট করার কোনো মানে নেই৷ আর যেখানে আব্বু আম্মু আমার জন্য এই ছেলেকে ভেবেছে সেখানে আমার মতবিরোধ থাকা উচিত নয়।
তাই তো এবার সৌজন্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বললাম,
” আমার কোনো রিলেশন বা পছন্দ নেই৷ আপনার? ”

রাফিদের চেহারার হাবভাব দেখে মনে হলো তিনি বেশ খুশি হলেন। অতি উৎফুল্লতার সাথে এবার জবাব দিলেন,
” আমারও নেই। এজন্যই আমি এমন মেয়ে খুঁজছিলাম যার রিলেশন নেই বা কোনো ছেলেকে পছন্দ করে না। ”

এ পর্যায়ে আমার মনে একটু অপরাধবোধ জাগলো। বেচারা রাফিদ তো খুশি মনে আমার কথা মেনে নিলেন। কিন্তু আসল সত্য তো এটা নয়। আমি একজনকে পছন্দ করতাম। যদিও তা কোনো এক আমলে!

আমাদের দুজনের কথাবার্তা হলে নিচে নেমে আসলাম। আমাকে রুমে যেতে বলে বাকি সবাই গেলো ড্রইংরুমে। তবে আমার বিয়ের কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তা আমি শুনবো না এটা তো হতে পারে না। এজন্যই আমি লুকিয়ে আড়ালে কান পেতে তাদের কথোপকথন শুনলাম। এক্ষেত্রে আমার পাশে দাঁড়ালো আভা। ও ছোট বলে ওকে সবার সামনে যেতে দেয়া হয়নি।
আমাদের বিয়ের সিদ্ধান্তের সারমর্ম আপাতত এটুকু যে, রাফিদ ও উনার বাবা মা আমাকে পছন্দ করেছে। বাসায় গিয়ে তারা এ ব্যাপারে নিজেদের পরিবারের গুরুজনদের সাথে বিস্তর আলোচনা করবে ও পরবর্তীতে যেদিন আসবে সেদিনই বিয়ের তারিখ পাকা করে ফেলবে।
আব্বু, আম্মু, আপু, ইমাদ ভাই তো মহাখুশি হলেন। আভাও সে কি খুশি! সবার মধ্যেই সে কি এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে! কিন্তু আমার মধ্যে কাজ করছে অদ্ভুত অস্থিরতা। এ বিয়েতে আমার খুশি হওয়ার কথা নয়৷ কেননা বিয়েটা হুট করে হয়ে যাচ্ছে। আবার দুঃখও পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমার মনে এই দুঃখ নামক অনুভূতিটা তীব্রভাবে ধরা দিচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে খারাপ কিছু করতে যাচ্ছি আমি। মনের মধ্যে তীব্র দোটানা ভাব৷ কাউকে ঠকানোর এক অপরাধবোধ, নিজে ঠকে যাওয়ার ভয়। অদ্ভুত সব অনুভূতি ঘিরে ধরেছে আমায়। আমি আর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। নিজের রুমে এসে দরজা আটকে দিলাম।

——————-

ঘড়িতে তখন রাত ৮টা বাজে। রাফিদের পরিবার গিয়েছে আধ ঘণ্টা হলো। আম্মু, আপু আর আভা সবকিছু গোছগাছে ব্যস্ত। এর মধ্যে হঠাৎ বাসায় কলিংবেল বাজলো। আমি একটু অবাকই হলাম এ সময়ে কলিংবেল বেজে উঠার শব্দে। কেননা আব্বু আর ইমাদ ভাই তো বাসায়। তাহলে এখন কে আসবে?
আমি দরজা খোলার জন্য গেলাম। সবাই কাজে ব্যস্ত। শুধু আব্বু ও ইমাদ ভাই বাদে। তারা দুজনে কি নিয়ে যেনো জরুরী আলোচনায় ব্যস্ত। তাই আমি গিয়ে দরজা খুললাম৷ দরজা খুলতেই যেনো আমি টুপ করে আকাশ থেকে পড়লাম। চরম বিস্ময়ে কিছুক্ষণ বড় বড় চোখে দরজার বাইরে তাকিয়ে রইলাম। কেননা দরজার বাইরে আর কেউ নয় বরং আদ্রিশ ভাই ও তার পরিবারের তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। আন্টি,আংকেল ও নদীর মুখশ্রীতে একই সাথে আনন্দের ও অভিমানের ছায়া দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়ের চাহনিতে চাপা ক্রোধ। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
” পড়ালেখা ছেড়ে ছুঁড়ে এখন বিয়ের পিঁড়িতে বসার প্ল্যানিং করছো! তোমার মতো মেয়ের আসলে ডাক্তারি পড়াই উচিত না। ”
বলতে বলতে তিনি আমাকে পাশ কাটিয়ে এমনভাবে বাসায় ঢুকলেন যেনো আমি কোনো অদৃশ্য বস্তু!
আদ্রিশ ভাইয়ের পিছু পিছু আন্টিও ঢুকলেন। পরে আংকেল ও নদী। আন্টি ঢুকতেই আদ্রিশ ভাইয়ের পিঠে আলতো চাপড় মে’ রে বললেন,
” ইশ, তোর কথার কোনো লাইন ঘাট নেই কেনো! মেয়েটাকে এভাবে খোঁচা মা’ রা’ র দরকার কি?”

আন্টির এই বকুনির বিপরীতে আমি কিছু বলতে চাইলাম। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি সমীচীন নয় বিধায় চুপ করে রইলাম৷ কিন্তু উনাদের এই হঠাৎ আগমনের কারণ জানতে চুপিসারে নদীকে পিছনে টেনে ফিসফিস করে সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
” কি ব্যাপার নদী? উইদাউট এনি দাওয়াত, তোমার ভাই এখানে টপকেছে কেনো? আর তোমরাই বা হঠাৎ এখানে কেনো?”

নদী সুন্দরভাবে বিস্তৃত হাসি দিলো। অতঃপর তীব্র অধীরতা নিয়ে বললো,
” আমরা আজ একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছি। ”

” অতি গুরুত্বপূর্ণ? কি কাজ?”

” সেটা তোমার জন্য সারপ্রাইজ আপু। ”

” আমার জন্য সারপ্রাইজ? কি সারপ্রাইজ? ”

” এখন বলে দিলে কি আর সারপ্রাইজ থাকে বলো? একটু ওয়েট করো। দেখো কি হয়। ”

বলে সে আংকেল আন্টির সাথে ড্রইংরুমের সোফায় বসে পড়লো। তাদের এ আগমনের সাড়াশব্দে বাসার সকলে এসে ড্রইংরুমে উপস্থিত হলো। আব্বু তো আংকেলকে দেখেই হাসিমুখে এগিয়ে গেলো। হাতে হাত মিলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আরে ভাইজান আপনি এখন! শরীর সুস্থ তো? ”

আংকেল এক গাল হেসে বললেন,
” আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি এখন সুস্থ ভাইজান। ঐ টুকটাক স্ট্রোক পরবর্তী সমস্যা আছে একটু। তা, আপনারা দেখি আমাদের না জানিয়েই মেয়ে বিয়ে-টিয়ে দিয়ে ফেললেন! এটা কিন্তু ঠিক করলেন না।”

আব্বু মৃদু হাসলো। একটু লজ্জাবোধ নিয়েই বললো,
” আরে কি বলেন ভাইজান! বিয়েশাদি কিছু হয়নি। এই তো মাত্র দেখে গেলো। আজ শুধু ছেলেমেয়ে দেখাদেখিই হলো। বিয়ের তারিখ ঠিক হয়নি।”

আব্বু আর আংকেলের এই কথোপকথনের মাঝে আমার দৃষ্টি হঠাৎ গিয়ে আটকে গেলো আদ্রিশ ভাইয়ের উপর। উনার তীক্ষ্ণ দুজোড়া চোখ যে এতক্ষণ আমার উপর নিবদ্ধ ছিলো তাতে সন্দেহ নেই। কেননা আমি তাকাতেই দেখলাম উনি কটমটে দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছেন। যেনো পারলে এক্ষুণি আমাকে ভর্তা করে খেয়ে ফেলবেন। উফ, কি ভয়ানক দৃষ্টি!

আমরা সবাই ড্রইংরুমেই ছিলাম। তো এই কথোপকথনের মাঝে এবার আংকেল আমাদের বললেন,
” বাসার ছোটরা একটু অন্য রুমে যাও তো! আর ভাই,ভাবী আপনারা এখানে বসুন। জরুরী কিছু কথা আছে।”

আংকেলের এই কথা শুনে আমি, নদী আর আভা একসাথে রুমের দিকে হাঁটা দিলাম। ওদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম তিন বন্ধু অর্থাৎ আপু,ইমাদ ভাই ও আদ্রিশ ভাইয়ের মধ্যে চোখেচোখে, ইশারায় লড়াই হচ্ছে। আদ্রিশ ভাই তো মনে হয় আপুকে চোখের ইশারাতেই হাজার খানেক গালি-টালি দিচ্ছে বোধহয়।

আমি, নদী আর আভা আমার রুমের দিকে রওনা হলাম। নদী ও আভা রুমে ঢুকে গিয়েছে। আমিও রুমে ঢুকতে যাবো, এমন সময়ে হঠাৎ ইমাদ ভাই আমাকে বললেন,
” মিম, ওদের সাথে ঐ রুমে যাওয়ার দরকার নেই। তুমি এদিকে আসো। জরুরী কিছু কথা আছে।”
বলেই তিনজনে একত্রে আপুর রুমে ঢুকে পড়লো।
ইমাদ ভাইয়ের এহেন আদেশে আমি কিছুটা দ্বিধায় পড়লাম। হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেলো আমার এ ছোট্ট মাথায়। ইমাদ ভাইয়ের আদেশ শুনে আভা ও নদীর দিকে এক পলক অসহায় চাহনিতে চেয়ে আপুর রুমের দিকে পা বাড়ালাম। যেতে যেতে এই চিন্তা করলাম যে, সব জায়গায় কিসের এত জরুরী কথা? সবার কিসের এত জরুরী কথা আছে আজ? আশ্চর্য!

এই বেখেয়ালে মাথা নিচু করে আপুর রুমে ঢুকতে গিয়ে আদ্রিশ ভাইয়ের সাথে হোচট খেতে খেতে বাঁচলাম৷ নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা তুলে দেখলাম আদ্রিশ ভাই এখনও সেই চাহনিই নিক্ষেপ করছেন আমার দিকে। উনার এ চাহনি দেখে মনে হচ্ছে আমি উনার কোনো পাকা ধনে মই দিয়েছি। কি অদ্ভুত!
আমার এ বেখেয়ালি পনা দেখে আদ্রিশ ভাই তৎক্ষনাৎ খোঁচা মেরে বললেন,
” সারা জীবন এমন অন্ধের মতোই চলে যায় মানুষ। না সে নিজেকে দেখে, আর না সে সামনের মানুষটাকে দেখে। অন্ধের দলের সর্দারনী একটা!”

উনার এ খোচাখোচা কথায় আমি জবাব দিতে যাবো, এর আগেই আচমকা তিনি রুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন। কি আশ্চর্য! আমাকে, আপুকে আর ইমাদ ভাইকে রুমে রেখে দরজা বন্ধ করলেন কোন উদ্দেশ্যে?!
®সারা মেহেক

#চলবে