অলকানন্দা ও তিতলি পর্ব-১৮

0
12

#অলকানন্দা_ও_তিতলি
#পর্ব-১৮
#সারা মেহেক

চুড়িগুলো প্যাকেট থেকে খুলে একে একে পরতে লাগলাম। এর মাঝেই হঠাৎ করে কলিং বেল বাজলো। চমকে উঠলাম আমি। বুকের ধড়ফড়ানি ক্রমশ বৃদ্ধি পেলো। অস্থিরতা ঘিরে ধরলো আমাকে। ফলস্বরূপ হাত থেকে চুড়িগুলো মেঝেতে পড়ে গেলো। আমি দ্রুত ঝুঁকে চুড়িগুলো মেঝে থেকে উঠাতেই বাইরে থেকে কিছু কথা কানে এলো,
” কাজি সাহেব এসেছে। কাজি সাহেব এসেছে।”
এটুকু শুনতেই আমি থমকে গেলাম৷ আমার হাত দুটো একদম স্থির হয়ে রইলো। নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম ক্ষণিকের জন্য। কাজী সাহেব এসেছে মানে! আমি কি কানে শুনতে ভুল করলাম নাকি? কাজী সাহেব আসবে কেনো আজকে?
দ্রুত চুড়িগুলো উঠিয়ে হাতে পরে নিলাম৷ ওদিকে আমার হৃৎস্পন্দন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভয় ও শঙ্কায় গলা শুকিয়ে আসছে। আমি দ্রুত দরজা খুললাম। খুলেই দেখি আমার রুমের দরজার চারপাশে মানুষজনের ভীড়। ড্রইংরুমের সামনের পর্দাটা টেনে দেয়া হয়েছে৷ আমার অস্থির দৃষ্টিজোড়া আব্বুকে খুঁজছে, আদ্রিশ ভাইকে খুঁজছে৷ মনে কু ডাক দিচ্ছে। শুধু মনে হচ্ছে, আমার অনিচ্ছায় কিছু একটা হতে চলেছে। এবং অবশ্যই সেটা বিয়ে। তবুও আমি নিশ্চিত হতে চাই। এজন্য ভীড়ের মধ্যেই আভাকে ডাকলাম। ওকে কাছে টেনে উদ্বিগ্ন গলায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম,
” এ্যাই! কি হচ্ছে রে বাইরে? কাজী ডেকেছে কেনো?”

আভাও উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
” তুমি যা ভাবছো তাই আপু। বিয়ের জন্যই ডেকেছে। ”

আমার বিস্মিত হলাম। রুদ্ধশ্বাস এক পরিস্থিতিতে পড়লাম। হতভম্ব গলায় বললাম,
” কি বলছিস এসব! বিয়ে! কিন্তু আজ তো বিয়ের কথাই ছিলো না। আজ না শুধু এঙ্গেজমেন্টের প্রিপারেশন নিয়েছে?”

” আমিও তা জানতাম আপু। এমনকি আমরা সবাই তা-ই জানতাম। কিন্তু আব্বু আম্মু এ ডিসিশন নিয়েছে। কিন্তু কখন নিয়েছে তার কিছুই জানি না। ”

মুহূর্তেই আমার মেজাজ চটে গেলো। হঠাৎ গতকাল রাতে আদ্রিশ ভাইয়ের সাথে আমার কথোপকথনের বিষয়টি মাথায় এলো৷ গতকাল রাতে উনি বিয়ে করার ব্যাপারে কথা বলছিলেন। নিশ্চিত উনিই আব্বু আর আংকেলের ব্রেনওয়াশ করেছেন। নাহলে কাল পর্যন্ত এঙ্গেজমেন্টের কথা হয়ে আসার পর হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো মানুষ না আব্বু। নির্ঘাত ঐ লোকটার হাত আছে।
আভাকে ক্রোধান্বিত গলায় এক কথায় জানিয়ে দিলাম,
” মগের মুল্লুক নাকি! কাজী সাহেব নিয়ে এসে জানিয়ে দিলো আজই বিয়ে। মেয়ের পারমিশন নেয়ারও প্রয়োজন বোধ করলো না! আমি বিয়ে করবো না। দেখি আজ কার বিয়ে হয়!”
বলেই ঠাস করে দরজা আটকিয়ে দিলাম৷ আমি জোরেই কথাগুলো বলেছিলাম বিধায় সবাই শুনেছিলো। আমার দরজা আটকিয়ে দেয়া প্রথম কয়েক সেকেন্ড পিনপতন নীরবতা বিরাজ করলো। অতঃপর চাপা গুঞ্জন শোনা গেলো বাইরে।
এভাবে হঠাৎ বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ায় আমার প্রচণ্ড রাগ হলো। বিয়ে নিয়ে প্রতিটি মোয়েরই কমবেশি স্বপ্ন থাকে। আমারও আছে। আমি কখনো এভাবে হুটহাট বিয়ে চাইনি। আমি সবসময় চেয়েছি আমার বিয়েটা ধীরেসুস্থে হবে। আমরা একে অপরকে জানবো, বুঝবো, স্বাভাবিক হবো। যেনো বিয়ের দিন কবুল বলার সময় এমনটা না মনে হয় যে আমি নিজের উপর জোর করছি। যেনো সবটাই স্মুদলি চলে তাই তো সময় নিতে চেয়েছি। অথচ এখানে তারা আমাকে না জানিয়ে আজই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে! যেখানে আমি মানসিকভাবে একেবারেই প্রস্তুত নই!

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার রুমের দরজায় ধুমধাম ধাক্কাতে লাগলো আব্বু। বাইরে থেকে অস্থির কণ্ঠে বলতে লাগলো,
” মিম! দরজা খোল মা। আমার কথা শোন। এভাবে হুটহাট সিদ্ধান্ত জানাস না। ”

আব্বু শান্ত গলায় বললেও আমি দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বললাম,
” আমার জীবনের সিদ্ধান্ত তোমরা হুটহাট করে নিলে দোষ নেই। আর আমি হুটহাট সিদ্ধান্ত নিলেই দোষ!”

” আচ্ছা দরজাটা খোল। সরাসরি কথা বলি আমরা। আমার কথাটা শোন মা। প্লিজ।”

আব্বুর করুণ কণ্ঠ শুনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দরজাটা খুললাম৷ খুলতেই দেখলাম বাইরে আমার সব আত্মীয়স্বজন ভীড় জমিয়ে আছে। তন্মধ্যে আন্টি ও নদীও ছিলো।
আমি দরজা খুলতেই আব্বু, আম্মু রুমে ঢুকে দরজা আটকিয়ে দিলো।
আম্মু ঢুকেই কিছুটা ক্রোধান্বিত গলায় বললো,
” কি শুরু করেছিস এসব! কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে এসেছে চল। ”

আমি আম্মুর কথার কোনো প্রত্যুত্তর না করে আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম,
” এগুলো কি শুরু করলে আব্বু! আজ তো বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো না। তাহলে কাজী ডাকলে কেনো?”

” আসলে হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে রে। তোকে জানানোর সময় পাইনি।”

” জানানোর সময় পাওনি! যাকে ঘিরে এতো আয়োজন তাকেই জানাওনি! এত ব্যস্ত ছিলে? তাহলে এতগুলো মানুষ যে বাসায় আছে, তাদেরকে জানিয়ে দিতে। বলতে আজ আমার বিয়ে পড়িয়ে রাখবে। এটুকু কাজের সময় পাওনি?!”

আব্বু কিছু বলতে নিলো। কিন্তু পরক্ষণেই আমি বলে উঠলাম,
” আর এসব আদ্রিশ ভাইয়ের কাজ তাই না? উনি নিশ্চয়ই তোমাকে জোর করেছে? ”

” না না। এখানে আদ্রিশের কোনো হাত নেই। আমাকে তো ইদ্রিস ভাই ফোন করে জানিয়েছে বিয়ের কথা। আংটি পরানোর চেয়ে বিয়ে পড়িয়ে দেয়া আমার কাছে উত্তম মনে হয়েছে। তাই তো আমি ইদ্রিস ভাইয়ের প্রস্তাবে রাজি হই। ”

জানতাম,আদ্রিশ ভাই-ই এসবের মূল হোতা। উনিই আংকেলকে রাজি করিয়ে আব্বুর সাথে কথা বলেছে। মেজাজটা আমার চটে গেলো। শক্ত গলায় বললাম,
” আদ্রিশ ভাই কোথায়? উনার সাথে জরুরী কথা আছে। আমার সাথে ডিসকাস না করে উনি আমাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত কিভাবে নিলেন! ”

” এখানে আদ্রিশ এলো কোথ থেকে? ও তো কিছু করেনি। ”

” তুমি জানো না আব্বু। আমি শতভাগ নিশ্চিত, উনিই আংকেলকে জোর করেছেন। প্লিজ আব্বু। উনাকে রুমে পাঠিয়ে দাও। সবকিছু ক্লিয়ার না হওয়া অব্দি আমি কিছুতেই কবুল বলবো না। ”

আমার কথায় আব্বু আম্মু একে অপরের দিকে এক পল চাইলো। অতঃপর দুজনই নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো। তার কয়েক সেকেন্ডের মাঝে আদ্রিশ ভাই হুড়োহুড়ি করে রুমে ঢুকলেন। দুজনেই কয়েক সেকেন্ড নিঃশব্দে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আজ এ মুহূর্তটুকু অন্য রকম হওয়ার কথা ছিলো। দু’জনেই দুজনার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার কথা ছিলো। দুজনেই দুজনার দিকে অনুভূতি নিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকার কথা ছিলো। অথচ এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আমি প্রচণ্ড রাগে ফুলেফেঁপে আছি। আর আদ্রিশ ভাই অবুঝের মতো তাকিয়ে আছেন। উনি হয়তো জানেন না উনাকে কি কারণে এতো জরুরী তলবে আমার রুমে পাঠানো হয়েছে।
আমি কারোর পরোয়া করলাম না। রাগের চোটে ঠাস করে দরজা আটকিয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম। আদ্রিশ ভাই বিস্মিত চাহনিতে চাইলেন আমার দিকে। উনি কিছু বলতে চাইলেন হয়তো। কিন্তু উনাকে সে সুযোগ না দিয়েই আমি আচমকা এগিয়ে গিয়ে দু হাতে উনার পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরলাম। দাঁতে দাঁত চেপে উনার দিকে সরাসরি গলা উঁচিয়ে তাকিয়ে বললাম,
” কালকে নিষেধ করা সত্ত্বেও আজ কাজী ডেকে এনেছেন কোন সাহসে? আমার কথা শুনেননি? বুঝেননি? ডাক্তার হয়েও কানের অপারেশন করাননি কেনো?”

আমি কলার চেপে এগিয়ে যেতে যেতে প্রশ্ন করছি। কেননা আদ্রিশ ভাই এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে নেই। উনি একটু একটু পিছিয়ে যাচ্ছেন বলেই আমি এগিয়ে যাচ্ছি।
আদ্রিশ ভাই এমতাবস্থায়ও শান্ত হয়ে আমার কথার প্রত্যুত্তর দেয়ার চেষ্টা করে চলছেন। আমার দু হাত ধরে রেখে বললেন,
” আমি কাজী ডাকিনি মিশমিশ। বিশ্বাস করো। ”

” আহ, আবারও মিথ্যে! আপনি কাজী ডাকেননি এটা আমি কিছুতেই মানি না। কেনো না আপনি কালকে বিয়ে করার জন্য একটু জোর করছিলেন। আর আজ কাজী সাহেবও এসে উপস্থিত হয়েছে। তো কাজী সাহেব কি আপনার মনের কথা পড়ে একাই উপস্থিত হয়েছেন? আপনি না ডাকলে উনি কোথ থেকে আসবেন.।”

” বিশ্বাস করো মিশমিশ। আমি ডাকিনি। আব্বুর প্ল্যানিং ছিলো এসব। আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। ”

আমি আরো শক্ত করে উনার পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরলাম। বললাম,
” নিশ্চয়ই আপনি বলেছেন। নাহলে এমন বিতিকিচ্ছিরি আইডিয়া কখনও আংকেলের মাথায় আসবে না। ”

” আমি কি করলে আমার কথা বিশ্বাস করবে মিশমিশ?”

” কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করবো না। আপনি দিনকে দিন চরম মিথ্যুক হয়ে যাচ্ছেন। আপনাকে বিশ্বাস করা আর……..”

সম্পূর্ণ কথাটি শেষও করতে পারলাম না। এর পূর্বেই কিসের সাথে যেনো বেধে আদ্রিশ ভাই পড়ে যেতে নিলেন। উনার কলার ধরে থাকায় আমিও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যেতে নিলাম। কিন্তু এ অঘটন ঘটার পূর্বেই আদ্রিশ ভাই আমার দুটো হাত ছেড়ে তৎক্ষনাৎ এক হাতে দেয়ালে ভর দিলেন এবং অপর হাতে আমার কোমড় পেঁচিয়ে চেপে ধরলেন। ফলস্বরূপ এ যাত্রায় দুজনই বেঁচে গেলাম।

ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা দুজনই বেখাপ্পা পরিস্থিতিতে স্থির হয়ে আছি। আমি ওভাবেই কলার ধরে আছি। আর আদ্রিশ ভাই আমার কোমড় ধরে আছেন। দুজনেই চুপ। এতক্ষণ ভারী তেজ নিয়ে কথা বললেও এখন রীতিমতো মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে আছি। এতক্ষণ রাগের চোটে হুঁশ না থাকলেও এখন হুঁশ ফিরলো আমার। আমি যে আদ্রিশ ভাইয়ের এতোটা কাছে, গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে তা টের পাইনি এতক্ষণ। এখন বোধ হতেই ভীষণ অস্বস্তিতে পড়লাম। দৃষ্টি নত করলাম ক্ষণেই। ওদিকে আদ্রিশ ভাই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দেখছেন আমাকে। তীব্র অস্বস্তিতে গা গুলিয়ে এলো। আমি দ্রুত উনার কলার ছেড়ে সরে যেতে নিলাম। কিন্তু উনি তাতে বাধা দিলেন। আমাকে সহ’ই দেয়াল হতে ভর ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। এবং আরোও জোর দিয়ে আমার কোমড় চেপে ধরলেন। অপর হাত দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় আমার হাত দুটো উনার হাতের মুঠোয় বেধে আমারই কোমড়ের পিছনে পেঁচিয়ে ধরলেন।
অদ্ভুত ও তীরের মতো তীক্ষ্ণ চাহনিতে আমার দিকে চাইলেন। বাম চোখের ভ্রু উঁচিয়ে আমাকে নিজের আরোও কাছে টেনে নিয়ে গলার স্বর খাদে নামিয়ে ভারী গলায় শুধালেন,
” কি? এত দ্রুত সব তেজ শেষ? আমার কাছে এলেই সিংহী থেকে ভেজা বেড়াল হয়ে যাও কেনো? ”
®সারা মেহেক

#চলবে,,