অশান্ত বসন্ত পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
381

(৩০ আর ৩১ পর্ব দুটো একসাথে)
**************************************

#অশান্ত বসন্ত।
(৩০ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী।
********************
সকাল থেকে একেই প্রচন্ড বৃষ্টি তার ওপর সৃঞ্জয় কোনো মেসেজই করেনি পিউকে। অথচ আজকেই দেখা করবার কথা ছিলো। সৃঞ্জয়কে ফোন করবে কি! কিন্তু সৃঞ্জয়ের তো নিজেরই ফোন করা উচিত ছিলো।

প্রায় পাঁচটা বাজতে চললো। কিছু না জানালে কি করে চলবে! আসতে না পারলে জানিয়ে দিতে পারতো। বরুন দাকেও আটকে রেখেছি বের হবো বলে! কি যে করে না ছেলেটা!’ এসব নানান ভাবনায় অস্থির হয়ে ঘরের মধ্যেই পায়চারি করছিলো পিউ।

ঠিক তখনই বেজে উঠলো ফোনটা। পিউ ছুটে গিয়ে ফোনটা ধরে ‘হেলো’ বলতেই সৃঞ্জয় বললো,’চলে এসো, আমি তোমাদের ফ্ল্যাটের বাইরেই আছি’।

পিউ বললো,’মানে কি? সকাল থেকে মেসেজ করোনি,আমার মেসেজের রিপ্লাই ও দাওনি, ফোনটা পর্যন্ত সুইচ অফ করে রেখেছো। এভাবে হয় নাকি!’

সৃঞ্জয় বললো,’যাহ বাবা!কাল রাতেই তো কথা হলো, বিকেল পাঁচটায় তোমাদের ফ্ল্যাটের বাইরে থেকে তোমায় পিক আপ করবো।আমি কি করে বুঝবো তুমি ভুলে যাবে?’,পিউ বললো,’ভুলবো কেন?কিন্তু তা বলে সকালে একবার কনফার্ম করবেনা?যেভাবে বৃষ্টি পরছিলো আজ।আচ্ছা তুমি ওপরে চলে এসো।আমি রেডি হয়ে নিয়ে বের হচ্ছি’।

সৃঞ্জয় বললো, তুমি রেডি হয়ে নীচে এসো।গাড়ির ভিতর বসে অপেক্ষা করতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।আমি গেলে তো আবার চা কফির অফার করবে।এসব করতে গিয়ে দেরি হয়ে যাবে’।

পিউ বললো,’বেশ ওয়েট করো, আসছি’।আলনা থেকে নীল রঙের সালোয়ারকামিজটা নিয়ে চটপট পরে নিলো পিউ,চুলটা আঁচড়ে নিয়ে ক্যাচার দিয়ে আটকে, হালকা লিপস্টিক দিয়ে রেডি হয়ে নিলো।

বাইরের ঘরে দেখলো বরুন সাহা সোফায় হেলান দিয়ে বই পড়ছে।শিখাদি জানালার সামনে চেয়ারে বসে একমনে আঁকছে।

পিউ বললো,’বরুনদা আমি বের হচ্ছি, সৃঞ্জয় নীচে অপেক্ষা করছে।দাদা সাতটা নাগাদ চলে আসবে।পারলে থেকে যেও প্লিজ’।বরুণ সাহা হেসে বললো, ‘সাবধানে যেও’।

ঠিক এই মুহুর্তটারই অপেক্ষা করছিলো বরুণ সাহা। ভালো লাগারা জমাট বেঁধে কখন যেন ভালোবাসায় পরিনত হয়েছে।সারা দুপুর বই নিয়ে বসে থাকলেও বইয়ের আড়াল থেকে শুধু শিখাকেই দেখে গেছে।

বরুণ সাহার আজ মনে হচ্ছে,

‘বাকি আছে আরো অনেক কিছুর,
অনেক না পাওয়া শিহরনের স্বাদ,
বাকি আছে নতুন করে কাউকে
ভালোবাসা দেওয়ার এবং
পাওয়ার অধিকার’।

কথা বলার জন্যই শিখার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো বরুণ সাহা। “কিছু বলবো বলে এসেছিলেম, রইনু চেয়ে না বলে” ঠিক এই অনুভূতিটি আচ্ছন্ন করে দিলো বরুন সাহাকে।অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন শিখার আঁকার দিকে।

দীপক বলছিলো বটে,দারুণ আঁকার হাত মেয়েটার।কিন্তু এতোটা সুন্দর সেটা বুঝতে পারেনি।
একটা সময় ছিলো বরুন সাহা নিজেও আঁকা আঁকি করতো মনের তাগিদে।

আসলে শিল্প হলো অপ্রয়োজনের প্রয়োজন। শুধু শিক্ষার্থীর জন্যই শিল্পের নিয়ম কানুনের বাঁধাধরা নিয়ম থাকে।কিন্তু শিল্পীর সৃজনশীল মন কোনো বাঁধা মানেনা।কোনো নিয়ম কানুন মানেনা।তাই সৃষ্টি সেখানে নিজের তালেই নেচে বেড়ায়।আসলে এই প্রয়োজনটুকুর মধ্যেই আছে শিল্প সৃষ্টির আসল রহস্য।

এই প্রয়োজনের তাগিদেই শিল্পী তার তুলির আঁকড়ে বিশ্বপ্রকৃতির অধরা রূপকে অবয়ব দিতে একটার পর একটা সৃষ্টি চালিয়ে যায়।

মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো, ‘অসাধারণ ‘,শিখা চমকে দাঁড়িয়ে পরলো।বরুন সাহা বললেন,তোমার চোখ দুটো যতটা সুন্দর, ঠিক ততোটাই সুন্দর তোমার আঁকার হাত’।

শিখা কি বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নীচু করলো।বরুণ সাহা বললো,’কিছু প্রশ্নের কোনো উওর হয় না জানো।এই যে এতো বছর ধরে এতো পেশেন্ট নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছি,তাদের মুখের ভাষা এনেছি,ভাষার জড়তা কাটিয়ে তাদের আত্মনির্ভর করেছি,অথচ সেই আমি হঠাৎই কেন তোমার চোখে নিজের ভাষা হারিয়ে ফেললাম? ‘

শিখা ধীরে ধীরে চোখ দুটো মেলে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকালো বরুন সাহার দিকে।

‘দুমাস বাদে আমাকে আর তোমার প্রয়োজন পরবে না।তোমার স্পিচ থেরাপিস্ট হিসেবে এটা আমার জয়ের উপহার।অথচ তোমার সাথে দেখা হবেনা এই ভাবনাতে কেন এতো উতলা হয়ে উঠি?’

একটু থেমে নিয়ে আবার বললেন,’আমি বিপত্নীক হলেও কখনো মনে হয়নি আবার নতুন করে জীবনটাকে সাজাবো,অথচ আমার জীবনের সেই বিশেষ জায়গাটায় তোমাকেই কেন দেখতে চায় মন?’,বরুন সাহার কথায় শিখার চোখ দুটো জলে ভরে যায়।

বরুন সাহা বলে,’প্লিজ কেঁদোনা।আমি বুঝিনি তোমায় কষ্ট দিয়ে ফেলবো।বুঝলে আমি হয়তো এসব জানাতাম না তোমায়,কিন্তু না জানিয়ে ও যে পারছিনা’,শিখা কোনো কথা না বলে বরুন সাহার বুকে মুখ গুজে দেয়।ভালো লাগার প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে যেতে থাকে দুটো মন,শব্দের আর কোনো প্রয়োজন হয়না।

(চলবে)

#অশান্ত বসন্ত।
(৩১ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
*******************
“এমনি করে যায় যদি দিন যাক না/মন উড়েছে উড়ুক নারে/ মেলে দিয়ে গানের পাখনা” গানটা গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে চলছে, স্টিয়ারিং হাতে সৃঞ্জয়, পাশে হাওয়াতে এলোমেলো চুলে বসে পিউ।

সৃঞ্জয়ের চোখ বারবার খেলা করছে পিউয়ের চোখে, মুখে,চুলে।পিউ বুঝতে পারছে সৃঞ্জয় ওকেই দেখছে।
তাই একটা আড়ষ্ট ভাব কাজ করছে ওর মধ্যে। সৃঞ্জয় হঠাৎ বলে উঠলো,’লজ্জা পাচ্ছো না ভয় পাচ্ছো?’
পিউ হেসে বললো,’না না লজ্জা,ভয় কোনোটাই পাচ্ছিনা’।

এদিকে পিউয়ের গলা শুকিয়ে কাঠ।কোনোরকমে বললো,’জলের বোতল আনা উচিত ছিলো’।সৃঞ্জয় হেসে নিজের জলের বোতলটা এগিয়ে দিলো।
পিউ ঢকঢক করে কিছুটা জল গলায় ঢেলে নিলো।

সৃঞ্জয় বললো,’কোথায় যাবে বলো?কোনো কফিশপে যাই আমরা?’পিউ একটু চুপ থেকে নিজেকে গুছিয়ে নিলো।আসলে ওর ইচ্ছে ছিলো প্রিয় মানুষটির সাথে ট্রেনে করে যেতে যেতে হঠাৎই দুরের কোনো অচেনা স্টেশনে নেমে পরবে,তারপর একসাথে হারিয়ে যাবে দুজন’।

সৃঞ্জয়কে হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটিং এর সময় একদিন বলেছিলো ওর এই ইচ্ছের কথা।তাতে সৃঞ্জয় জানিয়েছিলো,ও ট্রেনে কমফোর্টেবল নয়,তাই
পিউকে গাড়িতেই একটু এডজাস্ট করে নিতে হবে।

পিউকে চুপ করে থাকতে দেখে সৃঞ্জয় আবার জিজ্ঞেস করলো,’জানালে না কোথায় যেতে চাও?’

পিউ বললো,’চাই গাড়িটা কোনো খালি জায়গায় দাঁড় করিয়ে নিজেরা পায়ে হেঁটে যাবো মানে ওই উদ্দেশ্য বিহীন যাত্রা আর কি! তারপর ক্লান্ত হলে পথের পাশের কোনো চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ভাঁড়ে করে চা আর প্রজাপতি বিস্কুট’।

সৃঞ্জয় হাসলো।বললো,’ বেশ তাই হবে।দুজনে হেঁটে হেঁটে অনেকটা দূর যাবো।আচ্ছা পিউ হাত ধরা যাবে তো?’, পিউ সৃঞ্জয়ের কথা বলার ভঙ্গিমায় হেসে ফেললো।

সেদিন পিউয়ের কথা মতোই নির্জন রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়েছিলো সৃঞ্জয় ,তারপর দুজনে গাড়ি থেকে নেমে নিজেদের হাত মুঠোয় ভরে , হারিয়ে গিয়েছিল শুধু হারাবার জন্যই।

ওদের দুজনের চোখ মুখ দেখলে যে কেউ বুঝে যেতো যে ওই মুহূর্তে ওরা সব পেয়ে গেছির দেশে পৌঁছে গেছে।

রাতে আর সেদিন ঘুম আসেনি কারো চোখে।সারা রাত নিজেদের মিউট রেখে ভিডিও কলে নির্নিমেষ চেয়ে ছিলো দুজন।

প্রত্যেকের জীবনে এমন একজন আসে যাকে বাদ দিলে বা বাদ দেওয়ায় কথা ভাবলেও শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়,যাকে বাদ দিতে গেলে বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হয়,মনে হয় তাকে না পেলে বুঝিবা শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে।

সে পাশে থাকলে শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায়,চোখ বুজে যায় আবেশে,দূরে যাওয়ার ভাবনাটাও শূন্যতার সৃষ্টি করে মনে অথচ দুরেই তো যেতে হবে পিউকে ছেড়ে।মেয়েটাকে ওর স্বপ্ন গড়বার সুযোগ আর সময়টা তো দিতেই হবে।

পিউয়ের সাথে পরিচয়ের মেয়াদ খুব বেশি নয়।দেখাও হয়েছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকদিন।কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কতো জন্ম ধরে পরিচয় দুজনের। ভীষণ রকম অস্থিরতা ঘিরে ধরেছে সৃঞ্জয়কে যখন থেকে ট্রান্সফার লেটারটা হাতে পেয়েছে।

ওকে ওদের আমেরিকার ব্রাঞ্চের হেড করে পাঠানো হচ্ছে।আগে হলে খুশি হতো কারণ নিজেও তো সৃঞ্জয় এটাই চাইতো।কতো পরিশ্রম করেছে এই দিনটা দেখবার জন্য।দিন রাত এক করে কাজ করে গেছে। অথচ ফল পাওয়ার পর মনে হচ্ছে এটা ওর জিৎ নয় হার।

ঘরে ফিরে ফ্রেস হয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরলো সৃঞ্জয়। আজ অফিস ছুটি হওয়ার পর সোজা বাড়ি চলে এসেছে। ‘কিরে অসময়ে শুয়ে আছিস যে?’,মায়ের কথার উত্তর দেয়না সৃঞ্জয়।

‘পিউ ফোন করেছিলো আমায়।ফোন ধরছিস না কেন ওর?’,এবার সৃঞ্জয় বললো, ‘আমার মাথাটা একটু টিপে দেবে মা?’,অঞ্জনা তাড়াতাড়ি এসে ছেলের কপালে গলায় হাত ছোঁয়ায়,তারপর জ্বর আসেনি দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে কপাল টিপে দিতে বসে।

সৃঞ্জয় জানায় ওর ট্রান্সফারের কথাটা।অঞ্জনা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বললো,’এটা তো দারুণ খবর।মুখ ভার করে শুয়ে আছিস কেন?সেই কবে থেকে তো পরিশ্রম করছিলিস।পিউকে জানিয়েছিস?দাঁড়া ফোন করছি আমি,তোর বাবাকেও জানাই গিয়ে’।

পিউকে ফোন করতেই অপর প্রান্তে থেকে উদবিগ্ন গলাতে হেলো বলে উঠলো পিউ।অঞ্জনা সৃঞ্জয়ের হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
সৃঞ্জয় হেলো বলতেই পিউ রীতিমতো অভিযোগের বন্যা বইয়ে দেয় ফোন না করার জন্য,ফোন না ধরার জন্য।

সৃঞ্জয় চুপচাপ সব কথা শোনে।তারপর জানায় নিজের ট্রান্সফারের কথাটা।এবার পিউ ও নির্বাক হয়ে যায়। ফোনটা কেটে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকে বেশ কিছুটা সময়।

তারপর সোজা চলে যায় দাদাভাইয়ের ঘরে।পল্লব একমনে কাজ করছিলো ল্যাপটপে। পিউ এসে বললো,’আচ্ছা দাদাভাই আমি তো বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে ও মাস্টার্স এর জন্য এপ্লাই করতে পারি’।পল্লব বললো,’ তা পারিস।কিন্তু হঠাৎ দেশের প্রতি বিদ্বেষ জন্মানোর কারনটা কি শুনি?’

‘সৃঞ্জয় ট্রান্সফার হয়ে গেছে ওদের আমেরিকার ব্রাঞ্চে।ভাবছি ও যাওয়ার আগেই আমাদের রেজেষ্ট্রিটা সেরে নেবো।তারপর আমিও ওখানের ইউনিভার্সিটিগুলোতে মাস্টার্সের জন্য এপ্লাই করবো,মনে হচ্ছে হয়ে যাবে’।

পল্লব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পিউয়ের দিকে।ওর সেই ছোট্ট বোনু সত্যিই কতো বড়ো হয়ে গেছে। নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে।ভালোবাসা ওকে কতোটা পরিনত করে দিয়েছে।তবে ভালো লাগলো একটা বিষয় ভেবে,পিউ বিয়ের পাশাপাশি নিজের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্নটাও বজায় রেখেছে। পল্লব হেসে বললো,’ ঠিক আছে আমি কথা বলবো কাল সকালেই।

(চলবে)

#অশান্ত বসন্ত।
(৩২ পর্ব)
জয়া চক্রবর্তী
*********************
আজ ছুটি নিয়েছে পল্লব। গতকাল রাত থেকে উত্তেজনায় দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি।

আসলে ছয় মাস কথাটা শুনতে কম লাগলেও সময়টা একেবারেই কম নয়। ছয় মাস অর্থাৎ চার হাজার তিনশো আশি ঘন্টা।

এতো গুলো ঘন্টা বহ্নিকে ছেড়ে কাটানোটা তো আর মুখের কথা নয়! তাই যতো সময় এগিয়ে আসছে ততোই মনটা আর নিজের আয়ত্তে থাকছে না।

তাছাড়া বহ্নি তো শুধু ওর নামের প্রেমিকা নয়, সত্যিই ভালোবাসে বহ্নিকে। প্রেম হয়তো পরিবর্তনশীল, কিন্তু ভালোবাসা চিরন্তন, সেখানে বিদায় নেই, বিচ্ছেদ নেই। আসলে ভালোবাসা অসংজ্ঞেয় -আত্মঅনুভব।

ভাগ্যিস পিউ আর শিখার দায়িত্বের সাথে অফিসের কাজের চাপটাও ছিলো ওর ওপর। নাহলে এর মধ্যে হয়তো দু-তিন বার নিজেই চলে যেতো বহ্নির ট্রেনিংয়ের জায়গায়।

বহ্নিকে আনতে যাওয়ার জন্য রেডি হতেই পিউ আর শিখা বায়না ধরলো এয়ারপোর্টে যাওয়ার। পল্লবের যদিও একেবারেই মন চাইছিলোনা ওদের সাথে নিতে।কিন্তু উপায় কি!মুখের উপর ‘না ‘তো করে দিতে পারেনা।

গাড়িটা অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু তাড়াতাড়িই চালাচ্ছে, তবে গাড়ির গতিবেগের চাইতেও দ্রুত বেগে মনটা ছুটে চলেছে বহ্নিকে এক ঝলক দেখবার আশায়।

বিমান ল্যান্ড করতেই নির্দেশ অনুযায়ী সীট বেল্ট খুলে নিলো বহ্নি। মাথার উপরের লাগেজ চেম্বার থেকে হ্যান্ড ব্যাগটা নামিয়ে নিয়ে ফোনটা বের করে সুইচ অন করে পল্লবকে জানালো।

তারপর প্লেন থেকে বেরিয়েই দাঁড়ানো বাসে উঠে পরলো বহ্নি।বাস এয়ারপোর্ট এর গেটে নামিয়ে দিল, তারপর কনভেয়র বেল্ট এর সামনে আরো একটু সময় দাঁড়িয়ে থেকে নিজের লাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্ট এর বাইরে বেরিয়ে আসলো।

আর বেরিয়েই প্রিয় মানুষদের মুখোমুখি। মনে হচ্ছে যেন বহু যুগ পর দেখা হচ্ছে। দিদিয়া নিজে থেকেই এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো বহ্নিকে। পিউ বললো, ‘আমরাও কিন্তু লাইনে আছি, তবে আমার আগে দাদাভাই ‘। বহ্নি হেসে ফেলে বলে, ‘তোরা তিনজনই এখন আমার দুনিয়া’।

সেদিনই রাতে বহ্নির প্রমোশনের খুশিতে পল্লব একটা ছোট্ট পার্টির এরেঞ্জ করে রেখেছিলো। বহ্নিকে সেটা জানাতেই পিউ বলে উঠলো, ‘বরুণ দাকেও ডেকে নিয়েছি আমি, আর সাথে দীপকদাকেও’।বহ্নি বললো,’দীপকদাটা কে?’,পিউ বললো,’আরে দীপকদাকে চেনোনা!শিখাদির আঁকার স্যার’।

বহ্নি বললো,’ভালো করেছিস।এরা না থাকলে দিদিয়াকে তো এইভাবে দেখতেই পারতাম না’।

বরুণ সাহা সাধারণত পার্টি এটেন্ড করেননা। কিন্তু শিখার ব্যাপারে বহ্নির সাথে কিছু কথা আছে। তাই পিউয়ের এক কথাতেই রাজি হয়ে যায়।

অনলাইনে ফুলের গুচ্ছ আর চকোলেট আনিয়ে রেডি হয়ে নেয়।কিছুদিন আগে মাকেও জানিয়েছে শিখার কথা। মা দারুণ খুশি তার একমাত্র আদরের ছেলে আবার সংসারী হবে সেই আনন্দে। এবার বহ্নিকে জানাতে হবে।

বরুণ সাহা পার্টিতে ঢোকার পর থেকেই, ওর চোখ দুটো খুঁজতে থাকে শিখাকে। ওই তো শিখা সোফায় বসে আছে কমলারঙের শাড়িতে। বরুণ সাহা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শিখার দিকে।

হঠাৎ শিখার চোখ বরুণ সাহার দিকে পরতেই শিখা হাসি মুখে এগিয়ে আসে। বরুণ সাহা এই প্রথম শিখাকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখলো। অসাধারণ সুন্দর লাগছে শিখাকে।

বহ্নিও দিদিয়া আর বরুণ সাহাকে একসাথে দেখতে পেয়ে ওদের দিকে এগিয়ে যায়। বহ্নি কাছে আসতেই ফুল আর চকোলেট দিয়ে বহ্নিকে শুভেচ্ছা জানায়
বরুণ সাহা।

তারপর ভনিতা না করে সরাসরি জানায়, ‘বিশেষ কিছু কথা বলবার জন্যেই আজ আসা।আসলে আমি পার্টি এটেন্ড করিনা সেভাবে’।

বহ্নি বললো, ‘বলুন কি বলবেন? তবে তার আগে আমার তরফ থেকে অনেক ধন্যবাদ, যদিও জানি ধন্যবাদ জানিয়ে এই ঋণ শোধ করবার নয়। কি যে বলি আপনাকে! আসলে আমি ভীষণ রকম কৃতজ্ঞ আপনার কাছে। আপনি যেভাবে দিদিয়ার মুখে ভাষা ফুটিয়েছেন!’

বরুন সাহা হেসে বললো, ‘এটাই যে আমার কাজ। তবে আমি কৃতজ্ঞ হতে চাই আপনার কাছে , যদি আপনার দিদিয়ার হাতটা আমার হাতে দেন’।
বহ্নি অবাক হয়ে গিয়ে বলে,’ঠিক বুঝলাম না,কি বলতে চাইছেন!’

বরুণ সাহা বলেন,’আমি বিপত্নীক। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় বাচ্চা হতে গিয়ে বৌ মারা যায়। তারপর থেকে নতুন করে জীবন সাজাবার কথা কখনোই মনে হয়নি’।

একটু থেমে বললেন, ‘কিন্তু শিখাকে দেখে মনে হয়েছে আমরা একসাথে ভালো থাকবো। আপনার কোনো আপত্তি না থাকলে আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। কথা দিচ্ছি আপনার দিদিয়াকে আমি সারাজীবন ভালো রাখবো’।

ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে একটু হকচকিয়ে যায় বহ্নি।তবে একটু ধাতস্থ হতেই নিজের অজান্তে ভ্রুটা কুঁচকে মুখটা কঠিন হয়ে যায় বহ্নির।
গম্ভীর মুখে বলে,’ বিষয়টা নিয়ে পরে কথা বলবো আমরা,তাছাড়া বিয়ে করতে চাই বললেই তো আর বিয়ে দিয়ে দেওয়া যায়না।এর আগে পরের অনেক ব্যাপার থাকে’।

বহ্নি কথাটা বলে আর দাঁড়ায় না ওখানে।অহেতুক ব্যস্ততা দেখিয়ে সরে যায়। তবে যাওয়ার আগে খেয়াল করে বরুন সাহার মুখটা থমথমে হয়ে গেছে,যেন এখনি কেঁদে ফেলবে।

খানিকক্ষণ বাদে দেখলো ওর আদরের দিদিয়া চুপচাপ বিষন্ন মুখে সোফায় বসে আছে।চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে বরুণ সাহাকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলোনা।
‘উনি কি আমার ব্যবহারে অপমানিত বোধ করে চলে গেলেন! কিন্তু দিদিয়ার মুখটা অন্ধকার কেন? তবে কি দিদিয়া বরুণ সাহা কে ভালোবাসে!

বহ্নি এতো ভিড়ের মধ্যেও ভেবে চলেছে ওদের কথা। ‘আচ্ছা এটা বরুণ সাহার আবেগ বা ক্ষনিকের অনুভূতি নয়তো! অর্নব চৌধুরী ও তো আমার নিখুঁত সুন্দরী মাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো। তারপর কোথায় গেলো সেই ভালোবাসা!

তার ওপর দিদিয়া তো নিখুঁত নয়, এখনো টেনে টেনে কথা বলে, পড়াশোনাটাও তো করবার সুযোগ পায়নি দিদিয়া। সাময়িক আবেগের বশে বিয়ে করে যদি এই লোকটাও অন্য কারো মোহে পরে দিদিয়াকে ছেড়ে চলে যায়, তখন কিভাবে সামলাবো দিদিয়াকে!

না আর ভাবতে পারছেনা বহ্নি।এইসব নানান ভাবনার ভিড়ে অস্থির মনটা নির্জনতা চাইছে।অথচ এই মুহূর্তে তার কোনো উপায় নেই।

পার্টি শেষ হতেই বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ সাওয়ার নেয় বহ্নি।ঠিক করে বিষয়টা নিয়ে আজ রাতেই বসবে পল্লবের সাথে। তারপর না হয় বরুণ সাহার সাথে কথা বলবে।

পুনেতে যাওয়ার আগের দিন রাতেও পল্লব- বহ্নি একসাথে অনেকটা সময় কফি হাতে ব্যলকনিতে কাটিয়েছিলো। স্নান সেরে বেরিয়ে পল্লবকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে রাখলো,’দিদিয়া আর পিউ ঘুমিয়ে পরলে ব্যলকনিতে বসে তোমার হাতের কফি খাবো’।

ফোনটা হাতে নিয়ে বহ্নির মেসেজটার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিলো পল্লব।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবার ফ্রেস হতে বাথরুমে ঢুকলো। বহ্নি আসার পর থেকে আলাদা ভাবে একটুও কাছে পায়নি ওকে।

রাত দেড়টা নাগাদ , সবাই ঘুমোচ্ছে দেখে নিয়ে বহ্নি ব্যলকনিতে আসলো। দেখলো পল্লব আগে থেকেই চেয়ারে বসে আছে।

বহ্নি আসতেই পল্লব উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত প্রসারিত করলো।বহ্নি ও যেন এই মুহুর্তটারই অপেক্ষা করছিলো। ঝাপিয়ে পরলো পল্লবের বুকে। পল্লব ও আঁকড়ে ধরলো বহ্নিকে। আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে থাকলো তার প্রিয় কাঙ্ক্ষিত নারীকে।

‘মনে হচ্ছে এক কোটি বছর তোমায় দেখিনি’,পল্লবের কথায় বহ্নি হেসে বললো,’সেকি ভিডিও কলে তো প্রায় রোজই দেখা হতো আমাদের’,পল্লব বললো,’দুর ছাই!ওই ভাবে দেখে কি শান্তি পাওয়া যায় নাকি!

তারপর ফ্লাক্স থেকে কফি ঢেলে এগিয়ে দিলো বহ্নির দিকে। বহ্নি কফিতে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির আওয়াজ তুলে মজা করে বললো,’আমি তো তোমার থেকেও বেশি মিস করেছি তোমার হাতের কফিটাকে!’

পল্লব হো হো করে হেসে বহ্নির কফি লাগানো ঠোঁটটায় চুমু খেয়ে বললো,’তাতেই হবে।মিস তো করেছো কোনোভাবে’।

‘জানো বরুণ সাহা দিদিয়াকে বিয়ে করবার প্রস্তাব দিয়েছে আজ সন্ধ্যায় ‘,বহ্নির কথায় খুব খুশি হয়ে পল্লব বললো,’আরে এর চাইতে আনন্দের খবর তো আর হোতেই পারেনা। আমার নিজেরো কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়েছিলো ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে’।

বহ্নি বললো,’আমি মানি বরুণ সাহা সত্যিই ভালো মানুষ,কিন্তু তাবলে দিদিয়ার হাত ওনার হাতে দিয়ে দেওয়া যায় নাকি!আমি কিছুতেই এই ভুলটা করতে পারিনা।দিদিয়াকে আমি সারাজীবন নিজের কাছেই আগলে রাখবো ‘।

পল্লব বললো,’ শিখার হাত কারো হাতে দেওয়া যায়না কেন শুনি! শিখার কি নিজস্ব চাওয়া পাওয়া বলে কিছু থাকতে পারেনা?আর তাছাড়া বরুন সাহা তো শিখাকে ভালোবেসেই বিয়ে করতে চাইছে’।

বহ্নি বললো,’তোমায় তো আগেও বলেছি আমার মা নিঁখুত সুন্দরী ছিলেন, সাথে সংসারিক খুঁটিনাটিতে পটীয়সী। তারপরেও অর্নব চৌধুরী মাকে ছেড়ে দিদিয়ার বয়েসী একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছিলো’।

পল্লব বললো,’তুমি তোমার বাবাকে দিয়েই সব ছেলেকে বিচার করবে কেন?আমি ভেবেছিলাম অন্তত আমার সংস্পর্শে থেকে একটা সময় তোমার ভুলটা ভাঙবে। কিন্তু আমি জানিনা সেটা কবে, বা আদৌ সেই দিনটা আসবে কিনা! কিন্তু এটা মানতে পারছিনা তুমি বরুন সাহার প্রস্তাব কে নাকচ করে দিতে চাইছো’।

একটু থেমে বললো, ‘আমার মনে হয় তোমার বাবা একটা ভুল করে ফেলেছেন, আর সেই ভুলের মাশুল তিনি এখনো গুনে যাচ্ছেন। তাছাড়া যার জন্য উনি তোমার মায়ের হাত ছেড়েছিলেন, তিনি নিজেও ওনাকে একা করে অন্যের হাত ধরে চলে গেছেন’।

বহ্নি বললো,’তাতে কি ওনার সাত খুন মাপ হয়ে গেলো নাকি!ওনার ভুলকে আমি কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না’, পল্লব বললো,’না পারলে কোরোনা ক্ষমা, কিন্তু ওনার সেই ভুলের জন্য, তুমি নিজে এই ভুলটা করতে পারো না’।

পল্লব আবার বললো, ‘ কাউকে বিয়ে করবার পর আর কারো প্রতি কখনো ভালোবাসা আসবে না এটা কোথায় লেখা আছে? ভালোবাসাকেও যত্ন করতে হয়, অনুভূতি গুলিকে আলতো আদরে উসকে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তোমার মা হয়তো সব কিছুর মাঝে সেটা ভুলে গিয়েছিলেন। এক সাথে থাকাটা শুধুই তাই অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছিল’।

‘তুমি তারমানে ওনার কোনো অন্যায় দেখছোনা তাইতো?’, বহ্নির কথায় পল্লব বলে, ‘মানছি সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়াটা ওনার অন্যায় হয়েছিলো। তার ওপর ভুল মানুষের হাত ধরে। কিন্তু তুমি বলোতো জীবন যেখানে একটাই, সেখানে নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়াটা কি খুব অন্যায়?’।

বহ্নি বললো,’আমার মা তো ওনার জন্যই নিজের আপনজনদের ছেড়ে এসেছিলো চিরদিনের জন্য।আমার মা কি দোষ করেছিলো বলো?সারাটা জীবন মাকে শুধু আমাদের দায়িত্ব নিয়ে চলতে হলো।ভালোবাসার পরিনাম যদি এটা হয় তাহলে তো মানুষ ভালোবাসতেই ভয় পাবে’।

,’তুমি তোমার দিক থেকে ভুল কিছু বলছোনা। তবে বহ্নি আমি একটা কথা বলতে পারি,বরুণ সাহাকে বিশ্বাস করলে তোমার দিদিয়া ঠকবে না আর আমার এই মতামতকে মান্যতা দিলে তুমি ঠকবে না। তবে আমি আমার মতামত দিলাম মাত্র,বাকিটা তোমার সিদ্ধান্ত’।

বহ্নি এক পৃথিবী চিন্তার মধ্যে ডুবে যেতে যেতে পল্লবের হাতের উষ্ণ চাপ অনুভব করলো নিজের হাতে,যেন পল্লবের আঙ্গুল গুলো বলতে চাইছে,’তোমার সব সিদ্ধান্তের সাথে সবসময় তোমার পাশেই আছি আমি’।

(চলবে)