#অশান্ত_বসন্ত
(৩৭ পর্ব)
#জয়া_চক্রবর্তী
*******************
সূর্য শুধু আমাদের আলো বিকিরণই করে না, সূর্য নতুন আশা, নতুন জীবন আর একটি সুন্দর দিনের সূচনাও করে , যা মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে। তাই সূর্যের কিরন পৃথিবীতে আসা সবচেয়ে দামী সোনা।
জীবনের এইরকম একটা সূর্যোজ্জল দিনের প্রতীক্ষায় মানুষ সমস্ত ঝড়, বিষাদের পাহাড় অতিক্রম করতে পারে হাসি মুখে। বহ্নির ভাবনায় ছেদ পরে সবার ডাকে। আজ সূর্যোদয়ের আগেই সবাই এসে ডেকে তুললো দুজনকে।
বহ্নি ওর দিদয়াকে পাটভাঙা নতুন শাড়ি পরিয়ে দিলো।দিদিয়ার চোখের ঘুম এখনো কাটেনি।
বহ্নি বললো,’খাওয়ার পর আবার ঘুমিয়ে নিস’।
দিদিয়ার পাতে বসে বহ্নিও আজ দইচিঁড়ে খেলো।
মুখে বললো, ‘এই খাওয়ারটা আমার দারুণ ফেভারিট ‘।
বেলা বাড়তেই শিখাকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে চলে আসলো সবাই। যেখানে আগে থেকেই বরুন সাহার পরিবার, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব সাথে পল্লব -বহ্নির কাছের বন্ধুবান্ধবরাও চলে এসেছে।
বহ্নি দেখলো পন্ডিত মশাই হেল্পার সহযোগে বিয়ের দিনের সকালের পুজো করছেন। অর্নব চৌধুরী ও ওনার সামনের আসনে বসে।বহ্নি বাবাকে দেখে সামান্য হাসলো।
এরমধ্যেই বরুন সাহার পিশেমশাই ধানদূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে শিখাকে নেকলেস পরিয়ে দিলেন। সীমাও বহ্নির কেনা হাতঘড়ি আর আংটি দিয়ে বরুন সাহাকে আশীর্বাদ করলেন।
দুই বাড়ির গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ও একই সাথে হলো।আগে বরুন সাহাকে হলুদ মাখিয়ে সেই হলুদের বাটি থেকে হলুদ নিয়ে শিখাকে মাখানো হলো।শিখাকে হলুদ শাড়ি আর ফুলের গয়নায় অসাধারণ লাগছিলো।
ওই সময় বন্ধুরা মজা করে পল্লবের গালে ও হলুদ মাখিয়ে দিলো। পল্লব ইচ্ছে করে সবার সামনে নিজের গাল বহ্নির গালে ঘষে দিয়ে মৃদুস্বরে বললো,’আজ তো তোমারো গায়ে হলুদ’। বহ্নি লজ্জা পেয়ে বেসিনের দিকে ছুটলো মুখ ধুতে।
সন্ধ্যে লগ্নে বিয়ে সেই অনুযায়ী শিখাকে নিয়ে বহ্নি পার্লার চলে যায়। শিখার জিনিসপত্রের সাথে নিজের জন্য পল্লবের আনা শাড়ি গয়নাও নিয়ে নেয়।
বহ্নি শিখাকে নিয়ে পার্লারে যেতেই, পল্লব নিজের মাকে আলাদা করে ঘরে নিয়ে গিয়ে গতকাল তাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাটা জানায়।
সীমা মনে মনে একটু ক্ষুন্ন হলেও মুখে প্রকাশ করেনা।তবে তার একমাত্র ছেলের বিয়ে,আর যেখানে পাত্রী ও তার পছন্দের সেখানে গতকাল বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই কি তাকে জানানো যেতোনা!
এতো বড়ো হয়ে গেছে ছেলে যে মাকে তার আর লাগেই না!কোথাও যেন লাগে সীমার।পল্লব জড়িয়ে ধরে মাকে বলে,’মা তুমি খুশি তো?’।
সীমা বলে,’খুশি কেন হবোনা,তোদের খুশিতেই আমার খুশি।পারলে তোদের বিয়েটা ভিডিও রেকর্ডিং করে পিউকে পাঠিয়ে দিস।ওর একমাত্র দাদার বিয়ে,ওর ও তো কিছু আশা স্বপ্ন জড়িয়ে থাকতে পারে নিজের দাদার জীবনের এই বিশেষ দিনটাকে ঘিরে’।
পল্লব পিউকে তখনই ভিডিও কল করে নিজেদের বিয়ের কথাটা জানালো।পিউ বললো,’ইস তোরা যদি আগেই বিয়ে করবার সিদ্ধান্তটা নিতিস তাহলে আমি অন্তত তোদের বিয়ে মিটিয়ে এখানে আসতাম’।
তারপর সীমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,’মা তুমি কিন্তু আমাদের বাড়ি থেকে দেওয়া নতুন গরদের শাড়িটা পরো আর চুলটা সুন্দর করে খোপা করে নিও’,তারপর বললো, ‘আমি আর সৃঞ্জয় ও তৈরি হয়ে নিচ্ছি।ভিডিও কলে বিয়ে দেখবো।’
পল্লবের খুবই খারাপ লাগছে পিউয়ের জন্য।তার একমাত্র আদরের বোন তার বিয়েতে থাকছে না এটা কি কম আফসোসের কথা!
মুখে বললো,’আমি মৃদুলকে বলবো পুরো সময়টা যেন ভিডিও কলে ধরে রেখে বিয়েটা দেখায়।লক্ষ্মী বোন আমার কষ্ট পাসনা।কি করবো বল,জানিসই তো তোর বহ্নিদি বিয়েতেই রাজি ছিলোনা।কালকে হঠাৎ রাজি হয়েছে।বিয়ে পিছিয়ে দিলে যদি আবার ওর সিদ্ধান্ত বদলে যায়!’
পিউ বললো,’নারে আমি একদম কষ্ট পাচ্ছিনা।তবে যখন যাবো বড়ো রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে হবে কিন্তু ‘,পল্লব আর সীমা দুজনেই হেসে উঠলো।
সীমা পিউয়ের কথা মতোই গরদের শাড়িটা পরে নিলো।চুলে খোপা করে, কপালে বড়ো করে সিঁদুরের টিপ এঁকে নিলো।
পল্লব ও শিখার বিয়েতে পরবে বলে কেনা নতুন শেরওয়ানিতে তৈরি হয়ে নিলো।
সীমাই বরবরন করলো। তারপর পল্লবের বন্ধুরা মিলে শিখাকে পিঁড়িতে বসিয়ে সাত পাঁকে ঘুরিয়ে শুভ দৃষ্টি,মালাবদল সব সারলো।
বিয়ের কাজ নির্বিঘ্নে মিটে যেতে থাকলো।সমস্যা হলো সম্প্রদানের সময়।
হঠাৎই শিখা বলে উঠলো,’আমার বোনু কোথায়? আমাকে আমার বোনুই সম্প্রদান করবে।ছোটো হলেও আমাকে সম্প্রদান করবার অধিকার একমাত্র আমার বোনু বহ্নিরই আছে’।
বরুন সাহা দেখলো কেটে কেটে নয় একদম স্পষ্ট আর এক নাগাড়ে শিখা কথা বলছে।ঠিক এটাই চেয়েছিলো বরুন সাহা।এই কারনেই বলেছিলো,’ওদের বাবা যেন উপস্থিত থাকে বিয়েতে।তাহলে শিখার সব জড়তা কেটে যাবে’।
অর্নব চোখের জল নিয়ে আসন ছেড়ে উঠে গেলো।বহ্নি এসে সেই আসনে বসলো।
সম্প্রদান শেষে বিয়ের বাকি পর্বগুলো মিটিয়ে পন্ডিত মশাই বললেন,’বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে, এবার তোমরা বড়োদের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নাও,আর দ্বিতীয় বিয়ের পাত্র পাত্রীকে পাঠিয়ে দাও’।
পন্ডিত মশাইয়ের কথাতে সবাই অবাক!!
‘বরুন সাহা বললো,’দ্বিতীয় বিয়ের পাত্র-পাত্রীকে পাঠিয়ে দেবো মানে!এ আবার কি কথা!’।
সীমা হেসে বললো,’আজ একই মন্ডপে দিদির পরে বোনের ও বিয়ে হবে।যাকে বলে ডাবল ঢামাকা’।
সীমার কথাতে যেন আনন্দের হিল্লোল পরে গেলো বিয়েবাড়িতে।একটা বিয়ে এটেন্ড করতে এসে দুটো বিয়ের মজা উপভোগ করাটা তো দারুণ ব্যাপার। শিখা গিয়ে বহ্নিকে জড়িয়ে ধরলো,আর বরুন পল্লবকে।
তবে বহ্নিকে ওর বাবাই সম্প্রদান করলো।
পিউ এই জোরা বিয়ে উপলক্ষে নিজের বিয়ের বেনারসিটাই পরেছিলো।তবে সৃঞ্জয় জিন্স আর নীল টী-শার্টে পরে বসেছিলো। মৃদুল ভিডিও কলে বিয়ে দেখাবার সাথে সাথে বিয়ের ধারাবিবরণী ও দিয়ে যাচ্ছিলো।যদিও ফাঁকে ফাঁকে অঞ্জনা,সীমা দুজনেই এসে যোগ দিচ্ছিলো পিউদের সাথে।
রাতের দিকে সীমা অসীমকে ফোন করে পল্লব আর বহ্নির বিয়ের কথাটা জানাবে ঠিক করলো।বুঝতে পারছে অসীম প্রচন্ডই রেগে যাবে কিন্তু জানাতে তো হবেই।শত হলেও তো উনি পল্লব,পিউয়ের বাবা।
সবাই ঘুমিয়ে পরলে দোনোমোনো করে ফোনটা করেই ফেললো সীমা। খবরটা জেনে ফেটে পরলো অসীম।বললো,’কি ভেবেছো,আমি কিছু বুঝিনা?এতো সাহস পায় কোথায় তোমার ছেলে?কে পিছনে কলকাঠি নাড়াচ্ছে কিছু বুঝিনা নাকি আমি?তোমার মতো মেয়েমানুষ কে বিয়ে করাই আমার ভুল হয়েছিলো,এসো এখানে তারপর তোমায় বোঝাচ্ছি আমি কতো ধানে কতো চাল’।
এরপর ও আরো অনেক কথাই বলে যাচ্ছিলো অসীম,কিন্তু কোনো কথাই আর সীমার কানে যাচ্ছিলোনা,সীমা ফোনটা কেটে নাম্বারটা ব্লক করে দিলো।
এদিকে আগামীকাল দুপুরেই কলকাতায় ফেরার ফ্লাইট ধরতে হবে সীমাকে। আগে থেকেই ফ্লাইটের টিকিট কাটিয়ে রেখেছিলো পল্লবকে দিয়ে।
যদিও পল্লব মাকে ফিরতে দিতে চাইছিলোনা।কিন্তু সীমা একপ্রকার জোর করেই শিখার বিয়ের পরের দিনের টিকিট বুক করিয়েছিলো।বলেছিলো,’আমি না ফিরলে তোর বাবার অসুবিধা হবে’।
আসলে সেসব কিছুই নয়।সীমার আগে থেকেই সোনারপুর সংশপ্তক বৃদ্ধাশ্রমে কথা বলা আছে।শেষ জীবনটা নিজের মতো করে ওদের সেবা করেই কাটাতে চায় সীমা।অনেক তো হলো সংসার- সংসার খেলা।
নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলো সীমা।তারপর নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে পরলো ঘুমোবার আশায়।
মনটা বেশ নির্ভার লাগছে সীমার।ছেলে মেয়ে দুজনেই মনের মানুষ খুঁজে পেয়ে গেছে।এবার আর ওর কোনো চিন্তা নেই। এবার নিজের কথা ভাববার সময় এসে গেছে।কতোদিন আর ওই বদমেজাজি লোকটাকে সৈহ্য করবে!
সীমাকে ফ্লাইট ধরাতে বহ্নি পল্লব দুজনেই এয়ারপোর্টে এসেছে। বহ্নি সীমাকে কিছুতেই ফিরতে দিতে চাইছিলোনা। ‘খুব শিগগিরই আবার আসবো’এই কথা দিয়ে তবেই মেয়েটাকে শান্ত করেছে।
পাগলীটা সীমার গোছানো ব্যাগ থেকে সব জামাকাপড় বের করে ফেলে পল্লবকে ফ্লাইট কেন্সেল করতে বলছিলো।
যদিও সীমা মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছিলো,ওর প্রতি বহ্নির আন্তরিকতা দেখে। একবার ভেবেছিলো,থেকেই যায় ওদের সাথে। পরে ভাবলো কাছের থেকে দূরে থাকলে সম্পর্কটা মধুর থাকবে ।
সীমা দমদম এয়ারপোর্ট থেকে উবের বুক করে সোজা চলে যায় সংশপ্তকে।তবে ভুলবশত ফোন সুইচ অন করতে ভুলে যায়।এদিকে পল্লব যখনই ফোন করছে তখনই ফোন সুইচ অফ বলছে।দেখতে দেখতে কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে যায়।
পল্লব বাধ্য হয়েই ওর বাবাকে ফোনটা করে। ফোন ধরেই উনি যা নয় তাই বলা শুরু করলেন ছেলেকে।পল্লব সেসব কথার উওর না দিয়ে বললো,’মাকে ফোনটা দাও,নাহলে বলো নিজের ফোনটা সুইচ অন করতে।সেই কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি’।
অসীম বললো,’তোর মা আসেনি এখানে’।বাবার কথা শুনে পল্লবের মাথা হঠাৎ করেই কাজ করা বন্ধ করে দেয়।একটু ধাতস্থ হয়ে বললো,’বলছো কি!আমি তো নিজেই মাকে ফ্লাইট ধরিয়েছিলাম।আর ফোন করে জেনেছি রাইট টাইমেই প্লেন দমদম পৌঁছেছে।তাহলে মায়ের তো এতোক্ষনে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিলো’।
অসীম বললো,’বললাম তো তোদের মা আসেনি!’,পল্লব বললো,’এটা কি কথা,একটু দেখো। মা কোনো সমস্যায় পরলো না তো!’।
অসীম বললো,’যখন বাড়ি আসার আসবে।আমি ওসব খোঁজ টোজ করতে পারবোনা’।
পল্লব কথা না বাড়িয়ে ফোনটা কেটে দেয়।তারপর প্রচন্ড অস্থিরতার সাথে কলকাতার যাওয়ার জন্য ফ্লাইটের টিকিট সার্চ করতে থাকে। এর মধ্যেই সীমার ফোনটা ঢোকে।পল্লবের শরীরে যেন প্রান আসে।
ফোনটা ধরেই একনাগাড়ে বলে চলে,’মা তুমি কোথায় ? তোমার কিছু হয়নি তো! তুমি সুস্থ আছো তো! বাড়িতে এখনো পৌঁছোওনি কেন?তোমার ফোনটা সুইচ অফ ছিলো কেন?’
সীমা ওকে বুঝিয়ে বলে যে ওই বাড়িতে সে আর ফিরবে না।জানায় যে শেষ জীবনটা নিজের মতো করে কাটাতেই সোনারপুর সংশপ্তক বৃদ্ধাশ্রমে যোগ দিয়েছে।এখানে বয়স্ক মানুষদের অবসরের সঙ্গী হয়ে তাদের ভালো রাখবার চেষ্টা করবেন।
পল্লব অনেক চেষ্টা করেও মায়ের মত বদলাতে পারেনা।তবে সীমা কথা দেয় মাঝেমধ্যেই ওদের কাছে গিয়ে কিছুদিন করে থেকে আসবে।আর ওরাও চাইলেই যখন ইচ্ছে সীমার সাথে এসে দেখা করতে পারবে। তবে জানায় যে অসীমকে ওর খবর না দিতে।
অবশ্য খবর দিলেও কিছু যায় আসবেনা সীমার।কারন সীমা ওর ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অবিচলই থাকবে।ফোনটা রেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সীমা। আজ থেকে ও স্বাধীন ভাবে নিজের জীবন কাটাতে পারবে।
জীবন যেখানে একটাই সেখানে ভালো থাকবার অধিকার সকলেরই আছে।তবে কে কিভাবে ভালো থাকবে সেটা তাকেই ঠিক করতে হবে।
(সমাপ্ত)
*************************