অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব-২১+২২

0
848

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_21
#ইয়াসমিন_খন্দকার

নিঝুম আবরাজের থেকে নিজের ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে সেখানেই বসে পড়ল পিঠ ঠেকিয়ে। একটু আগের ঘটনা মনে করে তার দু চোখ অশ্রুজলে ভিজে উঠল৷ নিঝুম বলে উঠল,”এটা কি ছিল! কেন উনি এভাবে আমাকে মায়ার বাঁধছেন? এ যে মরীচিকা ছাড়া কিছুই নয়..”

নিঝুম ধীরে ধীরে নিজের চোখের জল মুছে বলে,”না, আমার এত সহজে গলে গেলে চলবে না৷ এই সম্পর্কের ইতি ঘটবেই আজ নাহয় কাল। উনি তো এখন স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন। আমায় উনি নিজের স্ত্রী ভাবছেন তাই হয়তোবা..কিন্তু যখন উনি নিজের স্মৃতি ফিরে পাবেন তখন নিশ্চয়ই আবার আমাকে আগের মতোই দূরে ঠেলে দেবেন। তাই আমার যেকোন মূল্যেই ওনার থেকে দূরে থাকতে হবে। উনি নাহয় কিছু মনে করতে পারছেন না। কিন্তু আমার তো সব মনে আছে।”

এই বলেই নিঝুম উঠে দাঁড়ায়।

অন্যদিকে, আবরাজের মনে চলছে ভীষণ দ্বন্দ। একটু আগে করা নিজের কান্ডের জন্য সে নিজেই সংশয়ে ভুগছে। আবরাজ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল,”এটা কি আমি ঠিক করলাম? না, এটা ঠিক হয়নি। আমার এত দূর এগোনো ঠিক হয়নি। আমাদের সম্পর্কটা তো এতটা স্বাভাবিক নয়।”

বলেই আবরাজ একটু থেমে বলল,”এবার থেকে আমায় আরো সাবধানী হতে হবে। রাগের বশে এমন কিছু করা যাবে না, যা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
নিঝুম আজ সকাল সকাল চলে এসেছে ইমরানের নতুন কফিশপে। এই কফিশপটা যদিও ইমরানের বাবার। তবে ইমরানই এখানে বেশি সময় কাটায়। ইমরান নিঝুমকে কফিশপে দেখে তার জন্য কফি নিয়ে এসে টেবিলে রেখে বলে,”এই নে, আমার কফিশপের সেরা কফি তোর জন্য।”

নিঝুম মলিন হেসে বলে,”ধন্যবাদ, দোস্ত।”

ইমরান নিঝুমের হাসির মলিনতা খেয়াল করে বলে,”কি হলো নিঝুম? তোকে এমন লাগছে কেন? তোর হাসি দেখে মনে হচ্ছে, এই হাসির আড়ালে রয়েছে ভীষণ চাপা দুঃখ।”

ইমরানের কথায় নিঝুম বলে,”জানি না, দোস্ত। নিজের জীবন নিয়ে আমি অনেক দ্বন্দ্বে আছি। বুঝতে পারছি না আমার কি করা উচিৎ। আজকাল বড্ড সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছি রে।”

ইমরান নিঝুমের কাধে হাত রেখে বলে,”তুই এত চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

নিঝুম একটু স্বস্তি পায়। কফি খাওয়ার একটু পরেই হঠাৎ করে তার শরীরে অন্যরকম অনুভূতি হতে থাকে। তার মাথা কিরকম যেন ঘুরতে থাকে। ইমরান নিঝুমের এই ব্যাপারটা খেয়াল করে বলে,”কিরে! তুই এমন করছিস কেন? কোন সমস্যা?”

“জানি না রে, হঠাৎ করে মাথাটা ভীষণ ঘুরছে।”

“আমার মনে হয় তুই ইদানীং একটুও বিশ্রাম নিস না। তাই অল্পতেই টায়ার্ড হয়ে পড়ছিস।”

এদিকে নিঝুমের জন্য চোখ খোলা রাখাই কঠিন ছিল। ঘুম এসে জেঁকে বসেছিল তার দুচোখে৷ ইমরান আবারো নিঝুমকে ডাক দিয়ে বলে,”এই নিঝুম কি হয়েছে, কিছু তো বল?”

নিঝুম উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই পড়ে যেতে ধরে। এমন সময় ইমরান তাকে ধরে ফেলে। উদ্বিগ্ন স্বরে বলে,”নিঝুম..এই নিঝুম..কি হয়েছে বল না? এমন করছিস কেন তুই?”

নিঝুম ঘুম ঘুম স্বরে বলে,”জানি না রে, দোস্ত। মনে হচ্ছে..মনে হচ্ছে..শরীরে একটুও জোর পাচ্ছি না।”

“আমি আছি এখানে। একদম চিন্তা করিস না।”

আবরাজ নিঝুমকে এপার্টমেন্টে না দেখতে পেয়ে তাকে খুঁজতে খুঁজতে ইমরানের কফিশপ অব্দি পৌঁছে যায়। এসেই সে এই দৃশ্যের সম্মুখীন হয়। যা তার রাগের জন্য যথেষ্ট ছিল৷ আবরাজ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে হুংকার দিয়ে বলে,”এসব হচ্ছে টা কি?”

আবরাজের হুংকারে পুরো কফিশপ যেন থমকে গেল। ইমরান হতচকিত হয়ে বলে উঠল, “আবরাজ ব্রো, আপনি এখানে?”

আবরাজ ইমরানের দিকে আগ্রাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “আমি এখানে না থাকার সুযোগে কি চলছিল এখানে? নিঝুমের এই অবস্থায় তুমি কি করছিলে ওর সাথে?”

ইমরান নিজেকে সামলে শান্ত স্বরে বলে, “ব্রো, আপনি ভুল বুঝছেন। নিঝুমের শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল, তাই ওকে সাহায্য করছিলাম। আর কিছু নয়।”

নিঝুম, যার চোখ ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছিল, কষ্ট করে বলে, “ও শুধুই আমাকে সাহায্য করছিল। আর কিছু নয়।”

আবরাজ এক মুহূর্তের জন্য নিঝুমের অসহায় চেহারার দিকে তাকিয়ে নরম হয়ে যায়। কিন্তু তার রাগ আবার ফিরে আসে। সে বলে, “কিরকম সাহায্য করছিল সেটা তো দেখতেই পারছি। সাহায্যের নামে কি নোংরামি চলছিল?”

ইমরান আবারও বলতে চেষ্টা করল, “ব্রো, আপনি ভুল করছেন। আমি তো শুধু বন্ধুর দায়িত্ব পালন করেছি।”

আবরাজ ঠাণ্ডা গলায় বলে, “তুমি বন্ধুত্বের দায়িত্ব পালন করছো, তা ঠিক আছে। কিন্তু এটা যেন কখনো মাত্রা না ছাড়ায়। নিঝুম আমার স্ত্রী। তার পাশে দাঁড়ানোর অধিকার আমার সবার আগে।”

নিঝুমের মাথা তখন ঠিকমতো কাজ করছিল না৷ সে একদম মদ্যপের ন্যায় আচরণ করছিল। আও হঠাৎ বলে ওঠে, “না! আমি আপনার স্ত্রী নই! ভুলে গেছেন, এই সম্পর্কটা কেবল একটা দায়বদ্ধতা মাত্র। আমার জীবনে আপনি নেই, আর আমিও আপনার জীবনে থাকতে চাই না। প্লিজ, আমাকে ভুলে যান।”

আবরাজের চোখে বেদনার ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু সে নিজেকে শক্ত করে নিয়ে বলে, “তুমি আমার জীবন থেকে চাইলেই বেরিয়ে যেতে পারবে না, নিঝুম। তুমি যতই দূরে থাকতে চাও, আমি ততই তোমার পাশে থাকব। এটা আমার সিদ্ধান্ত।”

নিঝুম কিছু বলতে যাবে, কিন্তু তার মাথা আবার ঘুরতে শুরু করে। এবার আবরাজ তাকে এক মুহূর্তের জন্যও সময় দেয় না। সে দ্রুত নিঝুমকে কোলে তুলে নিয়ে বলে, “তোমার যা খুশি বলো। কিন্তু আগে তোমার চিকিৎসা করাতে হবে। তোমার শরীর যে এমন ভাবে ভেঙে পড়ছে, সেটা আমি সহ্য করতে পারব না।”

ইমরান চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আবরাজের দৃঢ়তা আর কেয়ারিং দিকটা লক্ষ্য করছিল। তার মনে হলো, আবরাজ আর নিঝুমের সম্পর্ক যতই জটিল হোক, সেখানে একটা অদ্ভুত টান আছে।

কফিশপ থেকে বেরিয়ে আসার সময় আবরাজ নিচু গলায় বলে, “ইমরান, তুমিও ওর ভালো বন্ধু। কিন্তু আরেকবার এমন কিছু হলে আমাকে জানিও।”

ইমরান হালকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

আবরাজের গাড়িতে বসে নিঝুম চোখ বন্ধ করে ছিল। সে যেন সম্পূর্ণরূপেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।

~~~~~~~~~~~~~~~~~
নিঝুমের জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে আবরাজের রুমে আবিষ্কার করে। আবরাজ ঠিক তার সামনেই বসে ছিল। নিঝুম চোখ খুলেই বলে,”আপনি এখানে?”

সে চোখ বন্ধ করে কিছু মনে করার চেষ্টা করে। অতঃপর বলে,”আমার তো যতদূর মনে হচ্ছে আমি ইমরানের কফিশপে ছিলাম। তাহলে হঠাৎ এখানে কিভাবে এলাম?”

“আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি।”

নিঝুম হতবাক স্বরে বলে,”আপনি..কিন্তু আমার হঠাৎ করেই মাথা ঘুরিয়ে উঠল আর..”

আবরাজ বলল,”শোনো, তোমাকে একটা কথা বলি। তোমার এই বন্ধু ইমরানকে আমার একদম সুবিধার লাগছে না। আমার তো মনে হয় ও তোমায় এমন কিছু খাইয়েছে যার ফলে তুমি নিজের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে। তোমাকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল যে তোমার উপর কোন মেডিসিন বা এই জাতীয় কোন কিছুর প্রভাব ছিল।”

নিঝুম এর তীব্র বিরোধিতা করে বলে,”আপনি ভুল ভাবছেন। ইমরান আমার ছোটবেলার বন্ধু। ও কেন এরকম করবে? এসব করে ওর কি লাভ?”

“কার কি লাভ সেটা আমি জানি না। আমার যা মনে হয়েছে আমি তাই বলেছি।”

“আপনার কোথাও একটা বুঝতে ভুল হয়েছে। ইমরানকে আমি অনেক ভালো করেই চিনি। ও এমন কিছু করবে না। আমার শরীর হয়তো হঠাৎ দূর্বল হয়ে গেছিল আর তাই..”

আবরাজ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”কাউকে এতোটা অন্ধবিশ্বাস করো না নিঝুম। দিনশেষে এটা তোমারই বিপদ ডেকে আনবে। যাইহোক, তুমি এখন বিশ্রাম নাও। আমি পাশের রুমে আছি।”

আবরাজ এই বলেই চলে যায়। নিঝুম আবরাজের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,”আজকাল ওনাকে দেখে আমার কেন এত মনে হয় ওনার সাথে আগের আবরাজ খানের অনেক তফাৎ! একটা মানুষের এত রূপ কিভাবে হতে পারে!”

অতঃপর কিছু একটা ভেবেই সে বলে,”যাইহোক না কেন, আমায় ওনার এসব কথায় ভুললে চলবে না। এসব তো ওনার স্মৃতি না থাকায় উনি বলছেন। স্মৃতি ফিরে পেলে ঠিকই আমায় আগের মতোই দূরে ঠেলে দেবে।”

এই বলেই সে শুয়ে পড়ে এবং ঘুমানোর চেষ্টা করে।

to be continue…..

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_22
#ইয়াসমিন_খন্দকার

নিঝুমের ঘরে গভীর নীরবতা। মিটমিটে আলোয় বিছানায় শুয়ে থেকেও তার চোখে ঘুম নেই। আবরাজের কথাগুলো তাকে অস্থির করে তুলেছে।

“কাউকে এতোটা বিশ্বাস করো না, নিঝুম। বিশ্বাসই একদিন তোমার সর্বনাশ ডেকে আনবে।”
আবরাজের মুখ থেকে বলা এই কথাগুলো যেন কানে বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে বাজছে।

নিঝুম ভাবছে, ইমরান কি সত্যিই তার ক্ষতি চাইতে পারে? ছোটবেলা থেকে ইমরান তো সবসময় তার পাশে থেকেছে, তার অন্যতম বড় একটা ভরসার জায়গা ছিল ইমরান। জীবনের কঠিনতম সময়ে ইমরানই তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল স্কুলজীবনে। তাহলে আবরাজ কেন এমনটা বলছে?

নিঝুমের মনের গভীরে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকল। ইমরানকে বিশ্বাস করতে গিয়ে সে কি কোনো ভুল করছে? নাকি আবরাজ ইমরানকে ভুল বুঝছে?

“উনি কি আমার ভালো চান? নাকি এটা শুধুই ওনার রাগ বা হিংসা?” নিজের মনের প্রশ্নে বারবার জবাব খুঁজতে গিয়ে নিঝুম আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

~~~~~~~~~~~

অন্যদিকে আবরাজেরও ভেতরে তোলপাড় চলছে। বিছানায় শুয়ে থাকা তার জন্য অসম্ভব হয়ে গেছে। বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে আপন মনে বলে,
“আমি কি নিজের অধিকারের বাইরে চলে যাচ্ছি? নিঝুমের জীবনে আমার হস্তক্ষেপ করার অধিকার আসলেই কি আছে? ওকে বলা আমার কথাগুলো কি ওর জন্য বাড়াবাড়ি হয়ে গেল?”

নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আবরাজ ধীরে ধীরে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। সে ভাবে,
“আমি কি নিঝুমকে শুধু একজন দায়িত্ব হিসেবে দেখি, নাকি সে আমার জীবনের এমন এক অংশ হয়ে গেছে যাকে ছাড়া আমি অচল?”

গভীর রাত। নিঝুম চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলেও তার মনে শান্তি নেই। আবরাজের বলা কথাগুলো তার মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। ইমরান কি সত্যিই এমন কিছু করতে পারে, যা তার ক্ষতির কারণ হবে? নাকি এটা আবরাজের মনগড়া অভিযোগ? নিঝুম বুঝতে পারছে না কাকে বিশ্বাস করবে।

কিন্তু হঠাৎ করেই তার মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিল। গত কিছুদিন ধরেই আবরাজের ব্যবহার তার সুবিধার লাগছে না। তার মনে হঠাৎ প্রশ্ন জাগলো, আবরাজ কি সত্যিই স্মৃতি হারিয়েছে? নাকি এটা নিছকই একটা নাটক? যদি এটা নাটক হয়, তাহলে এর পেছনে উদ্দেশ্য কী?

“আমায় কষ্ট দেওয়ার জন্য কি অবস্থা উনি নতুন ফাঁদ পাতছেন?”
নিজেকে প্রশ্ন করল নিঝুম।

এমন সময় তার মুঠোফোন বেজে উঠল। ইমরান কল করছে। ফোনটা হাতে নিয়ে একটু দ্বিধা করলেও শেষমেশ কলটা রিসিভ করল।

ইমরান বলল,”কিরে, তুই কেমন আছিস এখন? এত রাতে ফোন করার জন্য আমি দুঃখিত কি করবো বল, তোর জন্য বড্ড চিন্তা হচ্ছিল।”

নিঝুম বলল,”ভালোই আছি।”

ইমরান যেন একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই ঠিক ভালো নেই। আমি বুঝতে পারছি। আবরাজ ব্রো যা করল, সেটা আমার একদম ভালো লাগেনি। তুই কি ভেবেছিস ওর এই রাগ আর অধিকারবোধ কি সত্যি নাকি তার অভিনয়?”

নিঝুম চুপ। ইমরানের কথা শুনে তার মনে সন্দেহ আরও দৃঢ় হলো।

“আমি জানি না, ইমরান। সবকিছুই এখন যেন একটা ধাঁধা হয়ে গেছে। ওনার কথাবার্তায় কখনো কখনো মনে হয় সত্যিই উনি কিছুই মনে করতে পারছেন না। আবার কখনো মনে হয় উনি আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এসব করছেন।”

ইমরান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,”তাহলে পরীক্ষা করে দেখ। সত্যিটা বের কর।”

“পরীক্ষা? সেটা কীভাবে করব?”

“ওনার স্মৃতিশক্তি হারানোর বিষয়টা খুব সাধারণভাবে মেনে নিয়েছিস তুই। অথচ এটা যদি সত্যি না হয়, তবে কিছু অস্বাভাবিক আচরণ ধরা পড়বেই। ওনার পুরোনো জীবন, পুরোনো স্মৃতি নিয়ে কিছু প্রশ্ন কর। এমন কিছু যা শুধু একজন আবরাজ খান জানে। যদি নাটক হয়, তবে ধরা পড়ে যাবে।”

“কিন্তু ডাক্তারি রিপোর্ট, সেগুলো তো বলছে উনি সত্যিই স্মৃতি হারিয়েছেন।”

“টাকা দিয়ে এমন হাজারো মিথ্যা রিপোর্ট তৈরি করা যায়৷ তুই সত্যিটা খোঁজার চেষ্টা কর।”

ইমরানের কথা শুনে নিঝুমের মাথায় চিন্তার নতুন একটা দরজা খুলল। সে সেদিনের মতো ফোন রেখে দিয়ে বলল,”এবার আমি সত্যটা খুঁজে বের করবোই।”

~~~~~~~~~~~~~

পরের দিন সকালে আবরাজ ডাইনিং টেবিলে বসে পত্রিকা পড়ছিল। নিঝুম তার জন্য চা নিয়ে এলো। চায়ের কাপ টেবিলে রাখার সময় তার চোখ আবরাজের মুখের দিকে গেল। সেই চিরচেনা গম্ভীর মুখটা যেন আজ কিছুটা নরম।

নিঝুম আবরাজের দিকে খেয়াল করে অনেকক্ষণ ধরে ইমরানের বলা কথাগুলো মনে মনে বিশ্লেষণ করছিল। সন্দেহ যেন তাকে শান্তি দিচ্ছিল না। আবরাজের স্মৃতি হারানোর নাটক কি সত্যিই বাস্তব? নাকি সে সবকিছু পরিকল্পিতভাবে করছে?

এই সমস্ত ভাবনা থেকেই, নিঝুম একটা সিদ্ধান্ত নিল। সে জানত আবরাজের চিংড়ি মাছে এলার্জি। যদি আবরাজ সত্যিই তার স্মৃতি হারিয়ে থাকে, তবে সে হয়তো ভুলে গিয়ে চিংড়ি মাছ খাবে। আর যদি তার স্মৃতি ঠিকঠাক থাকে, তাহলে সে এই খাবার দেখেই সতর্ক হয়ে যাবে।

নিঝুম রান্নাঘরে গিয়ে চিংড়ি মাছের কারি বানাতে শুরু করল।

দুপুরের খাবারের সময়ে ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজানো হলো। নিঝুম স্বাভাবিক থাকার ভান করছিল, কিন্তু তার ভেতরে অস্থিরতা যেন বেড়ে যাচ্ছিল।

নিঝুম রান্না শেষ করে আবরাজকে পরিবেশন করার পর হেসে বলল,”আজ একটা স্পেশাল ডিশ বানালাম,চিংড়ি মাছের কারি। আশা করি, এটা আপনার খুব পছন্দ হবে।”

আবরাজ প্লেটে খাবার তুলল, আর কোনো দ্বিধা না করেই চিংড়ি মাছ খেতে শুরু করল। যদিও আবরাজ জানে এতে তার এলার্জি কিন্তু এখন যেহেতু তার স্মৃতি নেই সেই অনুযায়ী অভিনয় করতে গিয়েই আবরাজ এই ঝুঁকিটা নিল।

নিঝুম থমকে গেল। তার চোখ বড় হয়ে গেল। আবরাজের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হলো, সে সত্যিই চিংড়ি মাছের প্রতি তার এলার্জির ব্যাপারে কিছুই জানে না।

কিন্তু খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আবরাজ অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো, আর কপালে ঘাম জমে গেল।

“আবরাজ! আপনি কি ঠিক আছেন?”

আবরাজ কোনো উত্তর দিল না। তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ল।

নিঝুম ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে গেল। সে তৎক্ষণাৎ কি করবে না করবে ভেবে ম্যাক্সকে ফোন দিল। ম্যাক্স তাদের পাশের এপার্টমেন্টেই ছিল। সে দ্রুত এসে আবরাজকে ধরে গাড়িতে তুলল এবং হাসপাতালে ছুটে গেল।

হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তাররা জানালেন, আবরাজ চিংড়ি মাছ খাওয়ায় প্রচণ্ড এলার্জি আক্রান্ত হয়েছে। তাকে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হলো। তারা ভীষণ রাগও হলো যে কেন আবরাজকে চিংড়ি মাছ খাওয়ানো হলো। নিঝুম অপরাধবোধে মাথা নিচু করে রইল। ম্যাক্স নিঝুমকে জিজ্ঞেস করল,”আপনি কি জানতেন না আবরাজের চিংড়িতে এলার্জি?”

“আমি আসলে..”

নিজের পক্ষে কিছু বলার আগেই নিঝুম কেবিনের মধ্যে শুয়ে থাকা আবরাজের দিকে তাকায়। শক্তপোক্ত মানুষটা কেমন নিথর হয়ে পড়ে আছে৷

আবরাজকে দেখে নিঝুমের ভেতরে এক ধরনের অপরাধবোধ দানা বাঁধতে শুরু করল।

নিজের মনে মনে সে বলল, “আমি কি ঠিক করলাম? এমন পরীক্ষার জন্য ওনার জীবন বিপন্ন হতে পারত। এটা আমার করা উচিত হয়নি। তবে আজ আমি নিশ্চিত হলাম উনি সত্যিই স্মৃতি হারান নি। উনি ঠিক হয়ে গেলে এর জন্য অবশ্যই ক্ষমা চেয়ে নেব।”

to be continue…..