#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_34
#ইয়াসমিন_খন্দকার
আবরাজ অবাক চোখে নিঝুমের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিঝুমের অবস্থাও অনেকটা একই রকম। দুজনেই এত বছর এভাবে একে অপরকে দেখবে সেটা বোধহয় আশা করে নি৷ আবরাজ নিঝুমকে দেখেই ধীর পায়ে তার দিকে আগাতে লাগল। এদিকে নিঝুম আবরাজকে দেখে প্রথমে ভাবছিল সে ঠিক দেখছে নাকি ভুল। যখন নিশ্চিত হলো যে সে ঠিক দেখছে তখন আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না। পিছন ফিরে চলে যেতে চাইল৷ এমন সময় আবরাজ দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,”অনেক পালিয়ে বেড়িয়েছ তুমি! এবার আর নয়। এবার আমার মুখোমুখি তোমায় হতেই হবে। তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।”
নিঝুম আবরাজের চোখে চোখ রেখে তাকায়। গম্ভীর স্বরে বলেন,”আমার মতো দুশ্চরিত্রা মেয়ের সাথে আপনার কি কথা থাকতে পারে?”
“নিঝুম! ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, আমাদের কথা বলাটা জরুরি।”
“কিন্তু আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই। আপনি আমার মায়ের খু**নি। আপনার জন্যই আমার মা মা*রা গেছে। আমি আপনাকে ঘৃণা করি জাস্ট ঘৃণা করি।”
আবরাজ কাতর স্বরে বলে,”তোমার সব অভিযোগ আমি মেনে নিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি জ্ঞানত তোমার কাকে কিছুই বলি নি। সেই সময় আমি ড্রাংক ছিলাম আর তাই না বুঝেই জানি না কি বলতে কি বলে ফেলেছি। আমি এর জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। জানি, তোমার যেই ক্ষতি আমি করেছি তা অপূরণীয়। তবে এত কিছুর পরেও তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।”
“বেশ করলাম আপনাকে ক্ষমা। এখন চলে যান আমার সামনে থেকে।”
আবরাজ আকুল চোখে তাকাল নিঝুমের দিকে। এত গুলো বছরেও নিঝুমের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসে নি। আবরাজ যদিও নিজের ইগো, অহংকার সব কাটিয়ে উঠতে পেরেছে কিন্তু নিঝুম সেই আগের মতোই জেদি রয়ে গেছে। এসব ভেবেই আবরাজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,”আমার উদ্দ্যেশ্য তোমায় বিরক্ত করার নয়, নিঝুম। আমি মোটেই তোমায় বিরক্ত করার জন্য এই দেশে আসি নি। আমার দেশে আসার মূল কারণ ছিল তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা বলা। আমি তো ভেবেছিলাম এখানে এসে তোমায় খুঁজতে হবে কিন্তু তোমাকে এখানে পেয়ে গিয়ে ভালোই হলো।”
“যা বলার বলুন, আমি শুনছি।”
“আমি তোমাকে মুক্তি দিতে এসেছি নিঝুম।”
“মুক্তি?”
“হ্যাঁ, মুক্তি। আমি চাই তুমি নিজের জীবনে এগিয়ে যাও। আর এজন্য আমি তোমার পথে কোন বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে চাই না। এমনিতেই তুমি আমার জন্য অনেক সাফার করেছ। যাইহোক, আমি এখানে একজন ভালো উকিলের সাথে যোগাযোগ করব ভাবছি। আমাদের ডিভোর্স নিয়ে কথা বলার জন্য।”
নিঝুম অবাক চোখে আবরাজের দিকে তাকায়। অতঃপর বলে,”বেশ। আপনি কোন ভালো উকিলের সাথে কথা বলে আমাকে জানান। আমি ডিভোর্সের যাবতীয় কার্যক্রম পূরণ করব।”
“ঠিক আছে।”
আবির হুইল চেয়ারে করে এগিয়ে আসে। সে দূর থেকেই নিঝুম আর আবরাজের সব কথা শোনে। এসব শুনে সে আর থাকতে পারে না। তাই তো এগিয়ে এসে বলে,”এভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক না। আপি, তুমি একটাবার ভেবে দেখো এই সম্পর্কটা এভাবে ভেঙে না দিয়ে তো সম্পর্কটাকে নতুন একটা সুযোগ দিতে পারো। এটা তো এখন শুধু তোমাদের দুজনের ব্যাপার নয় এখন এখানে আরো একজনের ভাগ্য জড়িয়ে আছে।”
আবরাজ অবার স্বরে জানতে চায়,”আরো একজনের ভাগ্য মানে?”
আবির নির্ঝরের কথা আবরাজকে বলতে যাবে এমন সময় দেখতে পায় নিঝুম তার দিকে হাতজোড় করে অনুরোধ করছে। ইশারা করে বোঝাচ্ছে নির্ঝরের কথা আবরাজকে না জানাতে। তাই আবির একটা দীর্ঘশ্বাস শ্বাস ফেলে বলে,”আমাদের এই পুরো পরিবারটাও খুশিও তো তোমাদের সাথে জড়িয়ে। তোমরা সুখী হলে আমরাও ভালো থাকব।”
আবরাজ নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই সম্পর্কটা ভাঙলেই বোধহয় নিঝুম সুখী হবে। আমি আর ওর সুখের পথে বাঁধা হতে চাই না।”
আবির প্রশ্ন করে,”আর আপনি? এই সম্পর্কটা ভাঙলে আপনি সুখী হবেন তো?”
আবরাজ স্লান হেসে বলে,”হয়তো!”
নিঝুম তখনো কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না৷ আবরাজকে বলে,”তাহলে আপনি উকিলের সাথে যোগাযোগ করুন। আমি ডিভোর্স পেপারে সই করে দেব।”
বলেই নিঝুম সামনের দিকে পা বাড়ায়। আবরাজ নিঝুমের যাওয়ার পানেই তাকিয়ে থাকে। আবির এসব দেখে মনে মনে বলে,”তুমি কেন এতটা নিষ্ঠুর হচ্ছ নিঝুম আপি? আবরাজ ভাইয়াকে দেখে কি তুমি বুঝতে পারছ না, সে আর আগের মতো নেই। সে বদলে গেছে। কেন তাকে একটা সুযোগ দিচ্ছ না?”
~~~~~~~~~~~~~~
নিঝুম নিজের ঘরে চুপ করে বসে আছে। এমন সময় ঘরে কারো প্রবেশের শব্দ পেয়ে সে পিছন ফিরে তাকায়। দেখতে পায় ছবি বেগমকে। নিঝুমের চোখে বিন্দু বিন্দু অশ্রু ছিল। ছবি বেগমকে দেখেই সে সেই চোখের জল মুছে নেয়। ছবি বেগম এগিয়ে এসে নিঝুমের কাঁধে হাত রেখে বলেন,”চোখের জল লুকিয়ে কি লাভ? মনের কষ্ট তো লুকাতে পারবে না!”
নিঝুম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”তাহলে আমি কি করব চাচি? জীবন আমাকে আজ এমন পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে যে, এছাড়া আমার আর কিছু করার নেই।”
“তুমি নিজে থেকেই বিষয় গুলোকে জটিল করছ নিঝুম। চাইলেই কিন্তু তুমি বিষয় গুলো ঠিক করে নিতে পারো। তবে তুমি সেটা করছ না। আচ্ছা, আবরাজ কি একটা সুযোগ ডিজার্ভ করে না?”
“কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বাসটাই মূল। উনি তো আমায় বিশ্বাস না করে ইমরানের বলা মিথ্যা অভিযোগ গুলা বিশ্বাস করেছেন। আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলেছেন। সেখানে এই সম্পর্কটাকে আমি কিভাবে আরেকটা সুযোগ দেই?”
“মানছি, দোষটা আবরাজেরই বেশি। কিন্তু তুমিই বলো তুমি কি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলে?”
“কিভাবে করব আমি চাচি? উনি তো আমায় কোন সুযোগই দেন নি নিজেকে প্রমাণ করার। একপাক্ষিক ভাবে ইমরানের কথা শুনে আমায় দোষারোপ করে গেছেন।”
“আমি তো বললাম, আবরাজের দোষ এক্ষেত্রে বেশি ছিল কিন্তু তোমারও কিছু ভুল ছিল। তুমি ইমরানের সাথে যেভাবে মেলামেশা করেছ এটা তোমার ঠিক হয়নি৷ মানছি ও তোমার ভালো বন্ধু কিন্তু বিয়ের পর একটা মেয়ে তার স্বামী বাদে অন্য কোন ছেলেকে এতটা গুরুত্ব দিলে যে কেউ মাইন্ড করবে। হ্যাঁ, তুমি বলতে পারো তোমাদের সম্পর্ক আর চার-পাঁচটা দম্পত্তির মতো ছিল না। কিন্তু তবুও তোমরা তো বিবাহিত ছিলে। এই বিষয়টা অন্তত তোমার মাথায় রাখা উচিৎ ছিল। আর সবথেকে বড় কথা বিষয়টা এখন শুধু আর তোমার কিংবা আবরাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এখন নির্ঝরও আছে তোমাদের মাঝে। ওর কথাটা একটু ভাবো। বাচ্চাটা ছোটবেলা থেকেই বাবা থাকার পরেও বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। মানছি তুমি ওকে যথেষ্ট ভালোবাসা দিচ্ছ আমরাও আছি। কিন্তু বাবার অভাবটা তো পূরণ করার মতো হয়। আজ নাহয় ও ছোট আছে জন্য এতটা বোঝে না। কিন্তু সামনের মাসেই তো তুমি ওকে স্কুলে ভর্তি করাবে ভাবছ। স্কুলে যাওয়ার পর যখন ও দেখবে ওর সব বন্ধুদের বাবা আছে কিন্তু ওর নেই তখন ওর কেমন লাগবে ভেবেছ একবারও?”
নিঝুম আর কিছু বলতে পারে না। ছবি বেগম বলেন,”তাই বলছি,ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নাও।”
নিঝুম হঠাত করেই বলে ওঠে,”যতো যাই হোক, আমি কখনো এটা ভুলব না যে ওনার জন্য আমার মা মারা গেছে। এটার পর আমি কখনোই ওনার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারব না। কোন ভাবেই না। আর আমার ছেলের জন্যও আমি একা যথেষ্ট।”
ছবি বেগম বুঝতে পারেন নিঝুমকে বুঝিয়ে কোন লাভ নেই৷ এবার যা করার তাকেই করতে হবে। কোনভাবেই তিনি নিঝুম আর আবরাজের ডিভোর্স হতে দিবেন না।
এদিকে, নির্ঝর খেলছিল। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ পড়ে যেতে নিতেই আবরাজ তাকে ধরে নেয়। নির্ঝর এটা দেখে হেসে বলে,”আপনি কি সুপারহিরো? আমাকে সুপারহিরোর মতো বাচিয়ে নিলেন?”
আবরাজ হাল্কা হেসে বলে,”না, আমি তো সাধারণ মানুষ।”
“কিন্তু আমি তো মুভিতে দেখেছি সুপারহিরোরাই এভাবে বাঁচায় বাচ্চাদের। আমার আম্মুও তো তাই বলে।”
“তাই বুঝি?”
“হুম।”
এমন সময় নির্ঝর দেখতে পায় নিঝুম একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাই সে বলে,”ঐ তো আমার আম্মু। আমার আম্মুকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন।”
নির্ঝরের কথামতো পিছন ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় আবরাজ। বলে ওঠে,….
to be continue…..
#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_35
#ইয়াসমিন_খন্দকার
নির্ঝরের কথামতো পিছন ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় আবরাজ। বলে ওঠে,”কই এখানে তো কেউ নেই?”
নির্ঝর মাথা চুলকে বলে,”কিন্তু আমি তো একটু আগে আম্মুকে এখানেই দেখলাম।”
এমন সময় ছবি বেগম সেখানে এসে নির্ঝরকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন,”কি হয়েছে নির্ঝর? তুমি এখানে কি করছ?”
“আমি তো এই সুপারহিরোর সাথে কথা বলছিলাম।”
“ওহ, আচ্ছা। তা বুঝি? বেশ, তাহলে তো ভালোই। তবে শুধু গল্প করলেই তো হবে না, খেতেও হবে৷ তুমি ওদিকে যাও তোমার আম্মু তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। সকাল থেকে তো তেমন কিছু খাও নি। কিছু খেয়ে এসো।”
“আচ্ছা। সুপারহিরো তুমি থাকো, তোমার সাথে আবার পরে কথা হবে।”
বলেই নির্ঝর ছুটে চলে যায়৷ নির্ঝরকে ছুটে যেতে দেখে আবরাজ বলে,”বাচ্চাটা ভীষণ মিষ্টি! কেন জানি ওকে আমার ভীষণ আপন লাগছে।”
ছবি বেগম হেসে বলেন,”ও তো তোমার আপনই!”
আবরাজ অবাক হয়ে জানতে চায়,”মানে? ও আমার আপন বলতে?”
ছবি বেগম বলেন,”না মানে, বাচ্চারা তো সবাইকেই আপন করে নেয় সেটাই বলছিলাম আরকি।”
“ও আচ্ছা৷ বুঝলাম। আপনি আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন?”
“হুম, বলো৷ আমি উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব।”
“নিঝুম এতদিন কোথায় ছিল আর আজ এখানে এলোই বা কখন?”
“তোমাকে বলেছিলাম না ও এতদিন ঢাকায় ছিল। সেখানেই তো একটা মেডিকেলে ও এখন ডাক্তার হিসেবে আছে। আমি ওকে আবিরের বিয়ে উপলক্ষে দাওয়াত দিয়েছিলেন সেজন্যই ও এই বাড়িতে ফিরে এসেছে।”
“সত্যিই কি তাই?”
“হ্যাঁ, তা নয়তো কি?! যাইহোক, তুমি আনন্দ করো। আমি আসছি। অনেক কাজ পড়ে আছে তো।”
বলতে বলতেই তিনি সামনের দিকে এগিয়ে চলেন এবং মনে মনে বলেন,”আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও আবরাজ। তোমাকে অনেক মিথ্যা বলতে হচ্ছে। কি করবো বলো? আমার যে হাত-পা বাঁধা৷ তবে আর বেশিদিন এই মিথ্যা চলবে না। আমি খুব শীঘ্রই তোমার সামনে সব সত্য নিয়ে আসব। আমার উপর একটু ভরসা রাখো। আশা করি, নিরাশ হবে না।”
এদিকে আবরাজ ছবি বেগম এর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ভাবতে থাকে,”ওনার ব্যবহার কেমন জানি সন্দেহ জনক লাগছে। উনি কি আমার থেকে কিছু লুকানোর চেষ্টা করছেন? আমার কেন জানি তেমন টাই মনে হচ্ছে।”
~~~~~~
নির্ঝরকে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে নিঝুম৷ আজ বিয়ে উপলক্ষে বেশ ভালো ভালো পদ রান্না হয়েছে। পোলাও, কোরমা, চিকেন, গরুর কালো ভুনা আরো কত কি। এসব তো নির্ঝর এর ভীষণ পছন্দের খাবার। তাই সে এক প্রকার চেটেপুটে খাচ্ছে। খেতে খেতেই সে নিঝুমকে বলে,”আম্মু, জানো আজ না আমি একজন সুপারহিরোর দেখা পেয়েছি। ঐ সুপারহিরো আমার পড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে যেমন মুভিতে করে।”
নিঝুম নিজের ছেলের এই বাচ্চামো দেখে বলে,”ওহ আচ্ছা, তাই বুঝি। ভালো তো।”
“এরপর আমার সাথে ঐ সুপারহিরোর দেখা হলে এখন আমি ওনার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব।”
‘আচ্ছা, দিও। এখন ভালো ছেলের মতো সবটুকু ভাত খেয়ে নাও।’
এভাবে নির্ঝর সব খাবার খেয়ে নেয়।
এদিকে গায়ে হলুদের আয়োজন শুরু হয়৷ আবিরের গায়ে হলুদ মাখানো হচ্ছিল এবং নিঝুমও একটি হলুদ শাড়ি পড়ে আজ সেখানে উপস্থিত হয়। আবরাজও একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে। তার নজর যায় নিঝুমের দিকে। নিঝুমের দিকে চোখ পড়তেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। এই পাঁচ বছরে যেন নিঝুমের সৌন্দর্য আরো কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ভেবেই হালকা হাসে আবরাজ। নিঝুমেরও চোখ যায় আবরাজ এর দিকে কিন্তু সে নিজের চোখ ফিরিয়ে নেয়। এরইমধ্যে নিঝুম আবিরের গায়ে হলুদ মাখিয়ে দূরে সরে আসে। আবির হুইলচেয়ারে বসে ভাবছিল কিভাবে তার ভাই ও নিঝুমকে আবার কাছাকাছি আনা যায়। আর এই নিয়ে ভাবতেই তার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো। আবরাজ সকলকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,”আমার গায়ে হলুদ মাখানো শেষ হলে এবার আপনারাও একটু একে অপরকে হলুদ মাখিয়ে মজা করুন।”
আবিরের কথা শুনে সবাই একে অপরকে হলুদ লাগাতে শুরু করে। এসব দেখে আবরাজেরও ভীষণ ইচ্ছা করছিল নিঝুমের গায়ে হলুদ মাখিয়ে দিতে কিন্তু কোথাও একটা গিয়ে সে বাঁধা পাচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ করেই কিছু ছেলে দৌড়ে এসে তার গায়ে ধাক্কা খায় যার ফলে সে কিছুটা দূরে গিয়ে কারো একটা গায়ে পড়ে যায় এবং সেই ছেলেদের হাতে থাকা হলুদের বাটি থেকে সমস্ত হলুদ পড়ে যায় আবরাজের গায়ে। আবরাজের মুখে হলুদ লেপ্টে থাকায় সে চোখ খুলতে না পারায় কিছু দেখতে পারছিল না। সে নিজের চোখ মুছতেই দেখতে পায় সে আরো অন্য কারো উপর নয়, নিঝুমের উপর পড়ে আছে। দুজনের মধ্যে বিন্দুমাত্র দূরত্ব নেই। আবরাজ আবেগের বশে নিজের হাতে লেপ্টে থাকা হলুদ মাখিয়ে দেয় নিঝুমের গালে। নিঝুম হতবাক হয়ে যায়। তার হৃদস্পন্দন যেন একেবারে থেমে গেছে।
হঠাৎ করে নিজের হুশ ফিরে পেয়ে সে আবরাজকে রেগে বলে,”কি করছেন টা কি? সরে যান আমার উপর থেকে।”
আবরাজ দ্রুত সরে গিয়ে অনুতপ্ত গলায় বলে, “আমি… আমি আসলে ইচ্ছা করে করিনি। পা ফসকে পড়ে গিয়েছিলাম।”
নিঝুম বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তা বলে আপনি আমাকে এভাবে বিব্রত করবেন? এই হলুদ মাখার খেলায় অংশ না নিলেই পারতেন। দেখছেন কিভাবে আমার গায়ে হলুদ মাখিয়ে দিলেন।”
আবরাজ কিছু বলার আগেই তাদের কথোপকথন থামিয়ে ছবি বেগম এগিয়ে এসে বলে উঠলেন, “কিরে, এখানে এত হৈ চৈ হচ্ছে কেন? সবাই কি ঠিক আছে?”
নিঝুম কিছু বলার আগেই আবরাজ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বলল, “না, কিছু হয়নি। আমি আসলে পা ফসকে পড়ে গিয়েছিলাম, তাই এমনটা হলো।”
ছবি বেগম সন্দেহের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আবরাজের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,“ঠিক আছে। একটু দেখে শুনে চলাফেরা করো। এমন দূর্ঘটনা ঘটেই যায় মাঝে মাঝে।”
তবে ভেতরে ভেতরে তিনি সবকিছু বুঝে নিলেন। আবরাজের নিঝুমের প্রতি আকর্ষণ যে এখনো গভীর আছে, সেটা তিনি অনুভব করলেন।
—
গায়ে হলুদের পর আয়োজন মিটে গেলে সবাই একে একে যার যার রুমে চলে যায়। আবরাজ তখনও তার রুমে যায়নি। বাড়ির বাগানে এক কোণে বসে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মনে হাজারটা প্রশ্ন। নিঝুম, ছবি বেগম সবার ব্যবহার যেন হাজার প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে।
এসব ভেবেই সে মনে মনে বলে উঠল, “আমি কিছুতেই আর অন্ধকারে থাকতে চাই না। এবার আমাকে সমস্ত সত্যিটা খুযে বের করতেই হবে।”
~~~~~~~
আনিকা কবুল বলার মধ্য দিয়েই তাদের বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেল। সবাই খুশি হল৷ অবশেষে ও আবির ও আনিকার ভালোবাসা পূর্ণতা পেল। নিঝুম নির্ঝরকে নিয়ে খুব সাবধানে দূরে সরে আছে যাতে তাকে আর আবরাজের মুখোমুখি না হতে হয়। বর্তমানে তারা আনিকাদের বাড়িতেই অবস্থান করছে। নিঝুমের এখানে আসার একদম কোন ইচ্ছা ছিল না কিন্তু ছবি বেগম এর জোরাজুরিতে তাকে এখানে আসতে হলো। তবে এখন আবরাজের নজর বাঁচিয়ে চলতে হচ্ছে কারণ সে তাকে আর নির্ঝরকে দেখলেই হাজারটা প্রশ্ন করবে। কিন্তু এরইমধ্যে হঠাৎ করে নির্ঝর ছুটে কোথাও একটা হারিয়ে গেল। আসলে একটু দূরেই সে আবরাজকে দেখতে পেল। তাই ছুটে গিয়ে আবরাজ এর হাত ধরে বলল,”সুপারহিরো, এসো। আমি তোমাকে আমার আম্মু সাথে দেখা করাবো।”
বলেই তাকে টানতে টানতে নিঝুমের সামনে নিয়ে এলো। নিঝুম তখন অন্যমনস্ক ছিল তাই খেয়াল করে নি কিছুই। নির্ঝর আবরাজকে নিয়ে নিঝুমের সামনে এসে বলল,”সুপারহিরো, এই হলো আমার আম্মু। আর আম্মু এই হলো আমার সুপারহিরো।”
আবরাজ ও নিঝুম একে অপরের সাথে চোখাচোখি করেই স্তব্ধ হয়ে যায়। আবরাজ বিস্ফোরিত চোখে তাকায় নিঝুমের দিকে!
to be continue…..