অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব-৪০+৪১

0
705

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_40
#ইয়াসমিন_খন্দকার

নিঝুম ও নির্ঝরকে নিয়ে লন্ডনের মাটিতে পা রাখল আবরাজ। নিজের শহরে নিজের পরিবারকে নিয়ে আসার পর তার ভীষণ ভালো লাগছে। প্লেন থেকে নামার পরই তারা গাড়িতে উঠে পড়েছে। লন্ডনের ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে আবরাজের গাড়ি৷ নির্ঝর অবাক চোখে জানালা দিয়ে লন্ডন শহরটাকে দেখছে। এ যেন সম্পূর্ণ এক নতুন অভিজ্ঞতা তার কাছে। সিলেটের গ্রামীন পরিবেশে বড় হবার পর এখন লন্ডনের মতো এক জাকজমকপূর্ণ শহর তার কাছে বড্ড অচেনা। জানালা দিয়ে দেখছে আর নিঝুমকে একের পর এক প্রশ্ন করে চলছে। নিঝুমও বিরক্ত না হয়ে শান্ত থেকেই সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। মা-ছেলের এই সব কাণ্ড আবরাজেরও চোখে পড়ছে। গাড়ি চালাতে চালাতে আড়চোখে সে সমস্তটাই দেখছে এবং এক চিলতে স্মিত হাসি দেখা যাচ্ছে তার ঠোঁটের মাঝে। আবার একটু আফসোসও হচ্ছে। আজ যদি ছোট থেকেই নির্ঝর তার সাথে থাকত তাহলে তার সাথেও হয়তো নির্ঝরের এমনই সুন্দর একটা বন্ধন তৈরি হতো।

অবশেষে কয়েক ঘন্টার যাত্রার পর গাড়ি এসে থামে ইস্ট লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস এ অবস্থিত আবরাজের বিলাবহুল এপার্টমেন্টের সামনে। নিঝুম নির্ঝরকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামে। নির্ঝর গাড়ি থেকে নেমেই অবাক চোখে চারিদিকে তাকায়৷ অতঃপর নিঝুমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”এখন থেকে কি আমরা এখানেই থাকব আম্মু?”

নিঝুম বলে,”হ্যাঁ, সোনা। এখন থেকে আমরা এখানেই থাকব।”

আবরাজ গাড়ির জানালা থেকেই নিঝুমের দিকে এপার্টমেন্টের চাবি বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”তুমি নির্ঝরকে নিয়ে ভেতরে যাও। আমি গাড়িটা গ্যারেজে রেখে আসছি।”

“আচ্ছা।”

নিঝুম এরপর আবরাজের কথা মতো নির্ঝরকে সাথে নিয়ে ভেতরের দিকে যায়। চাবি খুলে এপার্টমেন্টে প্রবেশ কর‍তেই পুরাতন সব কথা মনে পড়ে যায়। সেই প্রথম বার যখন সে লন্ডন শহরে পা রেখেছিল, অতঃপর আবরাজের সাথে কাটানো কিছু স্মৃতি। এসব ভেবেই নিঝুম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
এরইমাঝে আবরাজ ফোনে কারো সাথে কথা বলতে বলতে এপার্টমেন্টে প্রবেশ করে। সে বলছিল,
“হ্যাঁ, মামা। আমরা সবাই সাবধানে লন্ডনে পৌঁছে গেছি৷ তুমি কি এখন নিউ ইয়র্কে?”

বিপরীত দিক থেকে মিজানুর রহমান বলেন,”হ্যাঁ, আমি তো অনেক আগেই পৌঁছে গেছি। আচ্ছা, তোরা তাহলে সাবধানে থাক। আর ঝগড়াঝাটি করিস না বাপু। আমি বারবার তোদের মাঝে মিল করানোর জন্য এই বুড়ো বয়সে ছোটাছুটি করতে পারব না।”

আবরাজ নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি চিন্তা করো না, মামা। আমাদের মাঝে আর কোন ঝামেলা হবে না।”

নিঝুম আবরাজের কথা শুনে তার দিকে তাকাতেই দুজনের আবারো চোখাচোখি হয়। আবরাজ তার মামাকে বিদায় জানিয়ে ফোনটা রেখে দেয়। নিঝুম তার হাতে থাকা ব্যাগগুলোর দিকে ইশারা করে বলে ওঠে,”এগুলো কোথায় রাখব?”

“আমাদের রুমে গিয়ে রাখো।”

“আমাদের রুমে?”

“হুম,আমাদের রুম।”

নিঝুম বুঝতে পারে আবরাজ তার রুমের কথাই বলছে। নিঝুমও আর কথা না বাড়িয়ে সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে আবরাজের রুমেই রেখে দেয়। নির্ঝর এত দীর্ঘ যাত্রার পর অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই সে নির্ঝরকেও ঘুম পাড়িয়ে দেয়। অতঃপর ঘুমন্ত নির্ঝরের মাথায় হাত বোলাতে থাকে।

একটু পর আবরাজ রুমে এসে বলে,”নির্ঝর ঘুমিয়ে পড়েছে?”

“হুম।”

এরপর তাদের মাঝে কিছু সময়ের নীরবতা কাজ করে। আবরাজ টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে যায়। অতঃপর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে। টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে সে নিঝুমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুমিও যাও ফ্রেশ হয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়ো।”

নিঝুম বলে,”আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিল।”

“হুম, বলো।”

“আপনার মামা তো বলল, এখানকার কোন এক হাসপাতালে আমার জবের ব্যবস্থা করেছেন। তার কি হলো?”

“এ ব্যাপারে চিন্তা করো না। মামা আমায় সব বলে দিয়েছেন। কিছু ফর্মালিটিস পূরণ করা বাকি আছে। আশা করি, এক সপ্তাহের মধ্যেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

“আর একটা কথা।”

“বলতে থাক।”

“সিলেটে তো নির্ঝরকে দেখে রাখার জন্য চাচি ছিল। তাই আমি নিশ্চিন্তে ওকে বাসায় রেখে হাসপাতালে চলে যেতাম। কিন্তু এখানে তো আপনিও অফিসে যাবেন আর আমাকেও হসপিটালে যেতে হবে। তাই আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে যে নির্ঝরের খেয়াল কে রাখবে।”

“এটা নিয়েও তোমায় ভাবতে হবে না। আমি ভেবেছি, নির্ঝরকে এখানেই একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। এখানকার স্কুল গুলোয় ডে-কেয়ার সিস্টেম চালু আছে। সারাদিন বাচ্চারা স্যার-ম্যাডামদের তত্ত্বাবধানেই থাকে।”

“কিন্তু নির্ঝর কি এই অচেনা পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারবে?”

“সন্তানের ভালো ভবিষ্যতের জন্য তো আর এর বিকল্প নেই। তবে নির্ঝরের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেই ব্যবস্থা আমি করব। ওর একটা বন্ধুর দরকার। তোমার ম্যাক্স আর এলিনার কথা মনে আছে নিঝুম?”

“হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন? ওরা তো আপনার কত ভালো বন্ধু। ওদের বিয়েতেও তো আমি ছিলাম।”

আবরাজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”ম্যাক্স আজ আর পৃথিবীতে নেই।”

নিঝুম ভীষণ অবাক হয় কথাটা শুনে। আবরাজ বলতে থাকে,”কয়েক বছর আগে একটা এক্সিডেন্টে ম্যাক্সের মৃত্যু হয়েছে। এলিনা এখন ওর ছেলে এলেক্সকে নিয়েই জীবন কাটাচ্ছে। এলেক্সও আমাদের নির্ঝরের বয়সী। ও এখানকার একটা স্কুলে পড়ে। আমরা আমাদের নির্ঝরকেও ঐ স্কুলে ভর্তি করাতে পারি।”

“তাহলে তো ভালোই হয়।”

“হুম৷ তুমি ফ্রেশ হয়ে একটু ঘুমাও। আমি রাতের খাবারের ব্যবস্থা করছি।”

“আমি নাহয় রান্নাটা করে নেই।”

“নাহ, এমনিতেই অনেক জার্নি করেছ এখন আর কষ্ট করে রান্না করতে হবে না। আমি বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করছি।”

আবরাজের এই কেয়ারিং ব্যাপারটা ভীষণ ভালো লেগে যায় নিঝুমের। সেও আর না করে না।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
কিছু দিন পর,
নির্ঝরকে সাথে নিয়ে আজ ইস্ট লন্ডনের স্বনামধন্য একটা স্কুলে এসেছে নিঝুম ও আবরাজ। উদ্দ্যেশ্য তাকে এখানে ভর্তি করানো। এই ক’দিনে নিঝুম ও আবরাজ নির্ঝরের স্বার্থেই একে অপরের সাথে আপোষ করে নিয়েছে। তবে এখনো তাদের সম্পর্ক টা খুব একটা স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর মতো হয় নি। বরং তাদের সম্পর্ক অনেকটা নির্ঝরের মা-বাবা পর্যন্তই সীমিত। যেন তারা বিবাহিত দম্পত্তি হিসেবে না কেবলই সন্তানের পিতা-মাতা হিসেবে জীবনযাপন করছে।

নির্ঝরকে নিয়ে স্কুলে আসলে স্কুলের প্রিন্সিপাল মিসেস টেরেসা তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আবরাজ মিসেস টেরেসাকে বলে,”হ্যালো, মিসেস টেরেসা, আমি আবরাজ চৌধুরী, এলিনা নিশ্চয়ই আপনাকে আমার কথা বলেছে?”

বছর ৫০ এর বিচক্ষণ নারী মিসেস টেরেসা বলেন,”ওহ, হ্যাঁ। আপনি তো আপনার ছেলেকে এই স্কুলে ভর্তি করাতে চান, তাই না?”

“জ্বি।”

“তা কোথায় আপনার ছেলে? ওকে একটু সামনে নিয়ে আসুন। আমি ওর সাথে কথা বলে দেখি।”

নিঝুম নির্ঝরকে বলে,”নির্ঝর, ইনি তোমার ম্যাম। ওনাকে সালাম দাও।”

নির্ঝর বলে,”আসসালামু ওয়ালাইকুম, ম্যাম।”

মিসেস টেরেসাকে কিছুটা বিরক্ত লাগে। তিনি বলেন,”আমাদের লন্ডনে এসব গ্রাটিংস চলে না। ওকে হ্যালো বলতে শেখাবেন।”

নিঝুম বলে,”আমরা লন্ডনে এসেছি সেটা ঠিক আছে। তার মানে এই নয় যে,আমরা আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ধর্মীয় আচারকে ভুলে যাব।”

মিসেস টেরেসা বিরক্ত হন। তিনি ইংলিশে নির্ঝরকে কিছু প্রশ্ন করেন৷ কিন্তু নির্ঝর ইংলিশ তেমন একটা ভালো না বোঝায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মিসেস টেরেসা বলেন,”ও কি ইংরেজি পারে না নাকি?”

আবরাজ বলে ওঠে,”আসলে ও ছোটবেলা থেকে আমাদের দেশেমানুষ হয়েছে তো তাই আরকি..”

মিসেস টেরেসা এবার নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বলেন,”নিজের ছেলেকে ইংরেজিও শেখাতে পারেন নি? ওকে এই স্কুলে ভর্তি করিয়ে কি করব? শুধু এই স্কুল কেন লন্ডনের কোন স্কুলেই তো ওকে নেবে না। ও তো আমাদের পড়া কিছুই বুঝবে না। জানি না, কেমন মা এনারা। নিজেরাও ইংরেজি জানে না, নিজেদের বাচ্চাদেরও শেখায় না। আর দুনিয়ার থার্ড ক্লাস কান্ট্রি থেকে UK তে এসে নিজেদের সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়াতে চায়।”

নিঝুম ভীষণ অপমানিত বোধ করে। সে কিছু বলতে যাবেই তার আগে আবরাজ বলে ওঠে,”মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ, মিসেস টেরেসা। আমার ওয়াইফ একজন ডক্টর। ওর যোগ্যতার ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন না। ওর ব্যাপারে আর একটা খারাপ কথা আমি বরদাস্ত করব না।”
to be continue…..

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_41
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আবরাজ রেগেমেগে নির্ঝরকে নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে। নিঝুমও আসে তার পিছন পিছন। আবরাজ রাগান্বিত স্বরে বলে,”যেই স্কুলের শিক্ষকই এমন যে মানুষকে প্রাপ্য সম্মানটাই দিতে পারে না সেখানে আমাদের ছেলে কে কি শিক্ষা দেবে? আমি নির্ঝরকে এখানে পড়াব না। ওকে অন্য কোথাও ভর্তি করাবো।”

আবরাজের মুখে এহেন কথা শুনে নিঝুম অবাক হয়৷ শুধুমাত্র তাকে অপমান করেছে জন্য আবরাজ নির্ঝরকে এই স্কুলে ভর্তি করালো না৷ নিঝুমের কাছে এই বিষয়টা খুব ভালো লাগল। তার মুখে দেখা গেল হাসির রেখা। এরইমধ্যে আবরাজ গাড়িতে উঠে নিঝুমকে বলল,”চলো আরো কয়েকটা স্কুল ঘুরে দেখি। যেই স্কুলে মানুষকে প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয় সেরকম কোন স্কুলেই আমাদের ছেলেকে আমরা ভর্তি করাবো।”

নিঝুম মাথা নাড়িয়ে সহমত জানায়।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
নিঝুমকে অন্য একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে এপার্টমেন্টে ফিরে আসে নিঝুম ও আবরাজ। এপার্টমেন্টে ফিরে এসেই আবরাজ নিঝুমকে বলে,”আজকের লাঞ্চটাও বাইরে গিয়ে করি, কি বলো?”

নিঝুম বলে,”আজ নাহয় আমিই কিছু একটা রান্না করি?”

আবরাজ কিছু একটা ভেবে বলে,”সেটা ঠিক আছে কিন্তু আগের মতো শুটকির কোন আইটেম করো না প্লিজ।”

বলে আবরাজ হেসে ফেলে। নিঝুমের মুখ কিছুটা গম্ভীর ছিল। আবরাজ হাসি থামিয়ে বলে,”তুমি কি আমার কথা শুনে রাগ করলে নাকি?”

এবার নিঝুমও হেসে ফেলে আর বলে,”না, রাগ করিনি। অসুবিধা নেই,আমি আজ নাহয় চিকেনের কোন রেসিপি করব। নির্ঝর চিকেন খেতে অনেক পছন্দ করে।”

“তাই নাকি? বাহ, আমার ছেলে তো একদম আমার মতোই হয়েছে। আমারও তো চিকেন অনেক পছন্দ।”

“তাহলে তো ভালোই। আপনি যান, নির্ঝরের সাথে একটু সময় কাটান। আমি চিকেন করে নিয়ে আসছি।”

আবরাজ নিঝুমের কথা শুনে নির্ঝরের পাশে তার রুমে গিয়ে বসে। দুই বাবা-ছেলে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করে। নির্ঝর আবরাজের কাছে লন্ডন শহরের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে চায়। আবরাজও ধৈর্য সহকারে নির্ঝরের সাথে অনেক কিছু শেয়ার করে। একই সাথে তাকে ভালো ভাবে ইংরেজি শেখানোর দায়িত্বও আবরাজ নিয়ে নেয়। যদিও নিঝুমও ইংরেজি জানে তবে বাংলাদেশে বড় হওয়ায় নির্ঝরের তেমন একটা ইংরেজি শেখা হয়নি। বাংলাদেশের ৫ বছরের বাচ্চারা কি ওতো ভালো ইংরেজি পারে নাকি? টুকটাক যা একটু বলে। ইংরেজি মিডিয়ামের স্টুডেন্ট হলে সেটা ভিন্ন কথা। তবে যেহেতু এখন নির্ঝরকে লন্ডনেই থাকতে হবে তাই তার ইংরেজি শেখা অত্যন্ত জরুরি।

তাদের আলাপচারিতার মাঝেই নিঝুম এসে বলে,”লাঞ্চ তৈরি হয়ে গেছে।”

অতঃপর বাবা-ছেলে মিলে চলে যায় ডাইনিং টেবিলে। নিঝুম তাদের খাবার পরিবেশন করে। আবরাজ নিঝুমকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”তুমিও আমাদের সাথে বসে পড়ো। আমি তোমাকে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছি।”

আবরাজের মুখে এই কথা শুনে নিঝুম ভীষণ খুশি হয় এবং খাবার খেতে বসে পড়ে। আবরাজ নিজে নিঝুমকে খাবার পরিবেশন করে। অতঃপর পরিবারের সবাই একসাথে লাঞ্চ করতে শুরু করে। খাবার খেতে বসে বারকয়েক আবরাজ ও নিঝুমের মধ্যে চোখাচোখি হয়৷ যেন তারা সত্যিই নির্ঝরের মা-বাবা থেকে এখন ধীরে ধীরে নিজেদের সম্পর্কের দিকেও অগ্রসর হয়ে চলেছে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সময় কেটে যায় চোখের পলকে৷ নদীর স্রোতের মতো বয়ে চলে অবিচল৷ এখানেও তেমনি সময় থেমে থাকে নি৷ ধীরে ধীরে অনেক এগিয়ে গেছে৷ নিঝুমদের লন্ডনে আসার পর মাস তিনেক পার হয়েছে৷ এই ৩ মাসে অনেক পরিবর্তনই লক্ষ করা গেছে।

নিঝুম এখন লন্ডনের একটি প্রাইভেট হসপিটালে ডাক্তার হিসেবে যোগ দিয়েছে। এখানেই সে নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করেছে। আবরাজও নিজের অফিসের কাজে অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে। এদিকে ছোট্ট নির্ঝরও নিজের নতুন স্কুলে পড়াশোনায় অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যদিওবা নিঝুম ও আবরাজের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে। আগের মতো দা-কুমড়া সম্পর্ক তাদের আর নেই। বরং তারা একে অপরকে অনেক ক্ষেত্রেই সাহায্য করে। নিজেদের মধ্যকার মন কষাকষিও তারা অনেকাংশে কাটিয়ে নিয়েছে। তবে বাস্তব সত্য হচ্ছে, বর্তমানের পৃথিবীর কর্মব্যস্ত সময়ে পরিবার গুলো একে অপরকে দেয়ার মতো যথেষ্ট সময় পায় না৷ তারা যেন কৃত্রিম পৃথিবীর এই কৃত্রিমরূপেই জড়িয়ে যাচ্ছে। আর সেরকইমই দেখা যাচ্ছে এই ছোট্ট পরিবারটার ক্ষেত্রেও। তাই তো তারা এখন একে অপরের সাথে সময় কাটানোর তেমন সময়ই পায় না।

তবে এরমধ্যে হঠাৎ করে নির্ঝরের স্কুলে গ্রীষ্মকালীন ভ্যাকেশন দেয়া হলো৷ নির্ঝর তার নতুন বন্ধুদের কাছে শুনেছে তারা সবাই এই সময় নিজেদের পরিবারের সাথে কোথাও না কোথাও ঘুরতে চায়৷ এটা শুনে তার শিশুমনে প্রভাব পড়েছে। তাই তো আজ রাতে ডিনারের সময় খেতে বসে সে আবরাজ ও নিঝুমের উদ্দ্যেশ্যে বলল,”আমার সব বন্ধুরা সামার ভ্যাকেশনে কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে। আমিও যেতে চাই।”

আবরাজ বলে,”এটা তো অনেক ভালো কথা। ঘুরতে গেলে মনও ভালো হয়। আমিও ভাবছি আমাদের কোথাও ঘুরতে যাওয়া উচিত। তুমি কি বলো নিঝুম?”

নিঝুম বলে,”হুম, প্রস্তাবটা মন্দ নয়। আমরা চাইলেই কোথাও একটা ঘুরতে যেতে পারি৷ নির্ঝরের তো এই স্কুল থেকে বাড়ি-বাড়ি থেকে স্কুল এই জীবনটা ভালো লাগছে না। আমিও প্রফেশনাল জীবনে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। এসব থেকে একটু মুক্তির দরকার।”

“তাহলে এবার আমরাও সামার ভ্যাকেশনে সবাই মিলে ঘুরতে যাব।”

আবরাজের এই প্রস্তাব শুনে নির্ঝর বলে ওঠে,”ইয়াহু!”

নিঝুম বলে,”বেশ, আমি হাসপাতালে কথা বলে দেখব ছুটি ম্যানেজ করা যায় কিনা। কিন্তু আমরা যাবো টা কোথায়?”

আবরাজ কিছুটা ভেবে বলে,”কর্নওয়ালে।”

কর্নওয়ালের নাম শুনে নির্ঝর উত্তেজনায় চিৎকার করে ওঠে,”কর্নওয়াল! বাবা, ওখানে কি সমুদ্র আছে? আমার বন্ধুরা বলেছে ওখানে অনেক বড় বড় সমুদ্রতীর আছে!”

আবরাজ হেসে মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, আছে। কর্নওয়াল খুবই সুন্দর জায়গা। সমুদ্রতীর, পাহাড় আর প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য দেখতে গেলে এর চেয়ে ভালো জায়গা আর নেই।”

নিঝুম বলে, “কিন্তু কর্নওয়ালে তো অনেক দূর। আমরা কিভাবে যাব? ফ্লাইট নেব নাকি গাড়ি নিয়ে যাবো?”

আবরাজ একটু ভেবে বলে, “গাড়ি নিয়েই যাই। রোড ট্রিপের মজাই আলাদা। পথে পথে ছোট ছোট শহর আর প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে পারব।”

নিঝুম মাথা নাড়ে, “বেশ। তাহলে আপনার গাড়ির প্ল্যানটাই ঠিক। তবে নির্ঝরের জন্য কিছু খাবার আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে হবে।”

“ঠিক আছে, কাল আমি অফিস থেকে ফিরে গাড়ি সার্ভিস করিয়ে নিয়ে আসব। তুমি আর নির্ঝর বাকিটা সামলাবে,” আবরাজ বলে।

~~~~
কিছুদিন পর,
সকাল থেকেই ঘরজুড়ে এক অন্যরকম ব্যস্ততা। নিঝুম ছোট একটা লিস্ট করে নেয়, যেখানে ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের তালিকা দেওয়া আছে। নির্ঝরও তার খেলার সামগ্রী আর প্রিয় বইগুলো ব্যাগে ভরতে ব্যস্ত। আবরাজ সকালেই গাড়ি সার্ভিসিং করিয়ে বাড়ি ফিরে বলে, “সবাই রেডি তো? আমাদের ঠিক সময়ে বের হতে হবে।”

নিঝুম বলে, “হ্যাঁ, আর মাত্র কয়েকটা জিনিস ব্যাগে ভরলেই আমি রেডি।”

বিকেল নাগাদ তারা গাড়ি নিয়ে রওনা দিল। নির্ঝর পিছনের সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত। নিঝুম আর আবরাজ সামনের সিটে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করতে থাকে। নির্ঝরও এই ট্রিপ নিয়ে অনেক এক্সাইটেড ছিল। তার ভীষণ ভালো লাগছিল নতুন একটা জায়গা ঘুরতে যাবে এটা ভেবে। সে তার মা-বাবাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছিল৷ আর নিঝুম ও আবরাজ ধৈর্য সহকারে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল।

to be continue…..