অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব-৪২

0
714

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_42
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আবরাজ ও নিঝুম তাদের ছেলে নির্ঝরকে নিয়ে অবশেষে এক দীর্ঘ যাত্রা শেষে উপস্থিত হলো কর্নওয়ালে। কর্ণওয়ালের পথে পৌঁছানোর পর চারপাশের সৌন্দর্য যেন নিঝুম, আবরাজ, এবং নির্ঝরের ক্লান্তি দূর করে দেয়। সূর্য তখন ধীরে ধীরে দিগন্তে ঢলে পড়ছে, আর কর্ণওয়ালের মনোরম প্রকৃতি যেন এক শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো। রাস্তার দুই পাশে বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসের গালিচা, দূরে ছোট ছোট পাহাড়, আর মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে পাথরের প্রাচীন কুটির।

গাড়ি থেকে নেমেই নির্ঝর চিৎকার করে বলে উঠল,”ওহ আম্মু! এটা তো ছবির মতো সুন্দর! আমরা কি আজকে এখানেই থাকব?”

নিঝুম হেসে বলল,”হ্যাঁ সোনা, এখানেই। তবে প্রথমে আমাদের কটেজটা খুঁজে বের করতে হবে।”

আবরাজ গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে একটি কাগজ বের করে বলল,”কটেজের নাম ‘সানফ্লাওয়ার রিট্রিট’। এটাই আমাদের ঠিকানা। গুগল ম্যাপে দেখা যাক, এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়।”

গাড়ি আবার স্টার্ট দিল। নির্ঝর জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে গুনগুন করে গান গাইছিল। কিছুক্ষণ পর তারা এক শান্ত পাথুরে রাস্তা ধরে এগোতে শুরু করল। রাস্তার পাশে গাছগুলো যেন হাত বাড়িয়ে তাদের স্বাগত জানাচ্ছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা কটেজে পৌঁছে গেল। ছোট্ট কিন্তু অত্যন্ত সুন্দর এই কটেজটি হলদে রঙের দেয়ালে ঘেরা। তার চারপাশে সূর্যমূখী গাছের সারি যেন এর নামকরণকে আরো মানানসই করে তুলেছে। নির্ঝর দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ভেতরে ঢুকতে গেল। নির্ঝর উত্তেজিত হয়ে খুশিতে লাফাতে লাফাতে বলল,”বাবা, ভেতরে চলো! দেখি, কটেজের ভেতরটা কেমন?”

কটেজের দরজা খুলতেই ভেতরের উষ্ণ পরিবেশ তাদের মন ভরিয়ে দিল। কাঠের মেঝে, উঁচু ছাদের নকশা করা কাঠের কাঠামো, আর এক কোণে বড় একটা ফায়ারপ্লেস দেখে নিঝুম বলল, “এটা তো একেবারে ছবির মতো জায়গা!”

আবরাজ লাগেজগুলো আনতে লাগল, আর নির্ঝর ইতিমধ্যে ঘরের প্রতিটি কোণা ঘুরে দেখছিল। সে ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বলল,”আমাদের রুমটা কোনটা, আম্মু?”

নিঝুম হাসিমুখে বলল,”আমাদের রুম ওই জানালার পাশেরটা। সেখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা যাবে।”

নির্ঝর দৌড়ে রুমে ঢুকে জানালার কাছে দাঁড়াল। জানালা দিয়ে দূরের পাহাড় দেখা যাচ্ছিল, আর তার নিচে ছড়িয়ে ছিল সবুজের চাদর। সে মুগ্ধ হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

নিঝুম আর আবরাজ ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে রাখছিল। হঠাৎ আবরাজ বলল,”নিঝুম, চলো আজ একটু তাড়াতাড়ি ডিনার করে নেই। এত লম্বা জার্নির পর একটু বিশ্রাম দরকার।”

নিঝুম সম্মতি জানিয়ে বলল, “ঠিক আছে। নিচে মনে হয়, একটা ক্যান্টিন আছে। সেখানেই আমরা গিয়ে খেয়ে আসি চলুন।”

রাতে তারা একসাথে ডিনার করল। নির্ঝর তার ট্রিপ নিয়ে এতটাই উত্তেজিত ছিল যে একের পর এক গল্প বলতে লাগল। তার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক দেখে নিঝুম আর আবরাজের মন ভরে গেল।

ডিনারের পর সবাই একসাথে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে চা খেতে খেতে গল্প করল। আবরাজ হঠাৎ বলল,”কাল কিন্তু আমরা খুব ভোরে উঠব। এখানকার বিখ্যাত পাহাড়গুলো দেখতে যেতে হবে।”

নির্ঝর খুশিতে হাততালি দিয়ে বলল,”আমি কাল সব থেকে আগে উঠব। আমার ঘড়িতে অ্যালার্ম সেট করে রাখব!”

রাত গভীর হলে সবাই রুমে চলে আসল। জানালার বাইরে তখন চাঁদের আলোয় চারপাশ স্নান করছে। নির্ঝর তার বিছানায় শুয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে মুগ্ধ চোখে বলল,”এ জায়গাটা যেন স্বপ্নের মতো।”

~~~~~~~~~~

পরদিন ভোরে তারা সবাই উঠে তৈরি হয়ে নিল। সূর্যের প্রথম আলো যখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল, তারা গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের দিকে রওনা দিল। কর্ণওয়ালের পাহাড়গুলো এতটাই বিশাল এবং মনোমুগ্ধকর যে একবার দেখলে যেন চোখ ফেরানো যায় না।

নির্ঝর আনন্দে লাফাতে লাফাতে বলল,”এটা সত্যি অসাধারণ! আমরা কি এখানে আরো একটু বেশি সময় ধরে থাকতে পারি?”

আবরাজ বলল,”অবশ্যই। তবে আমাদের সব জায়গা ঘুরতে হবে।”

তারা সকালের নাস্তা সেরে বিভিন্ন স্পটে ছবি তুলল, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করল। সারাদিন তারা এভাবে ঘুরে বেড়াল। দিনের শেষে যখন তারা কটেজে ফিরে এল, তখন তাদের চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ স্পষ্ট।

নিঝুম বলল,”এই জায়গাটা আমাদের মন আর শরীর দুটোই সতেজ করে দিল।”

আবরাজ হাসিমুখে বলল,”আসলে এই ছুটিটা আমাদের সবাইকে আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। এটাই তো জীবনের আসল সৌন্দর্য।”

সবাই এই যাত্রা নিয়ে অনেক খুশি ছিল৷ তবে নির্ঝর কিছুটা দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে বলল,”কাল তো আবার আমাদের ফিরে যেতে হবে তাইনা?”

আবরাজ হেসে বলল,”নাহ, কালকেও আমরা এখানে ঘুরব!”

নির্ঝর উত্তেজিত হয়ে বলে,”সত্যি বাবা? কালও আমরা এখানে ঘুরব?”

“হ্যাঁ, সত্যি। আমার অফিসে আপাতত কোন জরুরি কাজ নেই৷ তোমার আম্মুও ম্যানেজ করে নেবে। তাই না নিঝুম?”

নিঝুম নির্ঝরের হাসিখুশি চেহারার দিকে তাকায়। এখানে থাকার কথা শুনে ছেলেটা কত খুশি হয়েছে৷ তাই সে আর অমত না করে বলে,”হ্যাঁ, আমিও ছুটি বাড়িয়ে নেব। কালকের দিনটা এখানে কাটিয়েই আবার আমরা ফিরে যাব।”

এরপর তারা সবাই মিলে আবারো ঘুমিয়ে পড়ল৷

পরদিন কর্নওয়ালের আকাশ ছিল সুনীল, ঝকঝকে রোদে উদ্ভাসিত। চারপাশে পাখির কিচিরমিচির যেন এক মনমুগ্ধকর সুরেলা সঙ্গীতের মতো লাগছিল। আবরাজ, নিঝুম এবং নির্ঝর সকালের নাস্তা সেরে তৈরি হয়ে নিল নতুন একটি গন্তব্যের জন্য।

“আমরা আজ কোথায় যাচ্ছি, বাবা?” নির্ঝর জিজ্ঞেস করল, তার চোখে ছিল উত্তেজনার ঝিলিক।

আবরাজ মুচকি হেসে বলল,”আজ আমরা যাব ‘ল্যান্ডস এন্ড’-এ। এটা কর্নওয়ালের সবচেয়ে বিখ্যাত পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে একটি। সাগরের কোলঘেঁষে এই জায়গাটি এক কথায় অপূর্ব।”

নিঝুম উত্তেজিত হয়ে বলল,”সত্যি! তাহলে তো অনেক ছবি তুলতে হবে।”

নির্ঝর লাফাতে লাফাতে গাড়ির দিকে দৌড় দিল,”চলো বাবা, আম্মু, দেরি করো না।”

তারা গাড়ি নিয়ে ‘ল্যান্ডস এন্ড’-এর দিকে রওনা দিল। যাত্রাপথ ছিল অসাধারণ, সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ আর পাথুরে রাস্তা যেন চোখে প্রশান্তি এনে দিচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর তারা পৌঁছে গেল তাদের গন্তব্যে। বিশাল সাগরের ঢেউ, নীল আকাশ আর পাথুরে পাহাড়ের অপূর্ব সমন্বয় দেখে সবাই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল।

নির্ঝর একদৌড়ে পাহাড়ের কিনারে পৌঁছে চিৎকার করে বলল,”আম্মু, এটা দেখো! এই জায়গাটা একেবারে ছবির মতো সুন্দর!”

নিঝুম হেসে বলল,”সত্যিই তো! এত সুন্দর জায়গা আগে কখনো দেখিনি।”

আবরাজ বলল,”সাবধানে থেকো নির্ঝর। খাদ কিন্তু অনেক গভীর।”

তারা পাহাড়ের ওপরে ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এসে বসে পড়ল। দূরে ঢেউয়ের শব্দ আর চারপাশে পাখির ডাক যেন প্রকৃতির এক চমৎকার সঙ্গীত সৃষ্টি করেছিল।

“আমরা কি পিকনিক করতে পারি এখানে?” নির্ঝর উত্তেজিত হয়ে বলল।

আবরাজ বলল, “অবশ্যই। আমি তো কিছু স্ন্যাকস আর পানীয় এনেছি। চলো, এখানে বসে খাই।”

তারা বসে নাস্তা খেতে লাগল। চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আবরাজ বলল, “জানো, নিঝুম, এই ধরনের জায়গাগুলোতে এসে মনে হয় জীবন কত সুন্দর। সব ব্যস্ততা আর ক্লান্তি যেন দূর হয়ে যায়।”

নিঝুম হেসে বলল, “ঠিক বলেছ। প্রকৃতির কাছে আসলে আমাদের মন অনেক শান্ত হয়।”

নির্ঝর তখন ছোট একটা পাথরের উপরে বসে সাগরের ঢেউ দেখছিল। তার নিষ্পাপ মুখে আনন্দের ঝিলিক দেখে আবরাজ আর নিঝুমের মুখেও হাসি ফুটে উঠল।

এরপর তারা উঠে দাঁড়াল। সাবধানে পাহাড় বেয়ে নামতে লাগল। নিঝুম নির্ঝরকে নিয়ে সাবধানে পাহাড় বেয়ে নামছিল। হঠাৎ করেই হাত ফস্কে যায়। নিঝুম “আহ” বলে চিৎকার করে ওঠে। আবরাজ সঠিক সময় এগিয়ে এসে নির্ঝরকে ধরে নেয়৷ কিন্তু নিঝুমকে ধরার আগেই সে পা পিছলে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়তে থাকে৷ আবরাজ চিৎকার করে বলে ওঠে,”নিঝুম!”

to be continue…..