অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব-৪৩

0
676

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Part_43
#ইয়াসমিন_খন্দকার

নিঝুমকে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়তে দেখে আবরাজ আর্তনাদ করে ওঠে। ছোট্ট নির্ঝরও নিজের মায়ের এই পরিণতি দেখে আতকে ওঠে। সে ভয়ে একদম স্থির হয়ে যায়৷ আবরাজ নির্ঝরকে কোলে নিয়েই দ্রুত পায়ে নিচের দিকে নামতে থাকে নিঝুমকে বাঁচানোর জন্য কিন্তু সেও পা ফসকে পড়ে যেতে নেয়। ভাগ্যক্রমে কোনরকমে একটা পাথরে পা আটকে বেঁচে যায়। নাহলে আজ বাবা-ছেলের দশাও একই হতো। ছোট্ট নির্ঝর এবার কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আম্মুর কিছু হবে না তো, বাবা? আম্মু এত উপর থেকে পড়ে গেল। আমার খুব ভয় হচ্ছে।”

আবরাজ নিজেও নিঝুমের পরিণতি নিয়ে শঙ্কিত। তবুও সে নির্ঝরকে আশ্বাস দেয়ার জন্য বলে,”চিন্তা করো না, নির্ঝর। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তোমার আম্মুর কিছু হবে না। আমি নিঝুমের কিছু হতে দেব না।”

আবরাজ নির্ঝরকে সাথে নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে পড়ে। এরপর নিচে নেমেই উন্মাদের মতো চারিদিকে নিঝুমকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পায় না। উপায় না পেয়ে আবরাজ ভাবে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নেবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সে কনওয়ার্লের স্থানীয় রেসকিউ টিমের সাথে যোগাযোগ করে। তারা আবরাজকে অভয় দেয় যে যেকোনভাবে নিঝুমকে উদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। তবে আবরাজ নিশ্চিত হতে পারে না। তার মনে ভয় তীব্র থেকে তীব্রতর হয়৷ নিঝুমকে কি আদৌ খুঁজে পাবে এই ভয়ে তার বুক কাপতে থাকে। তার থেকে বড় ভয় যে, নিঝুমকে অক্ষত ফিরে পাবে তো?

আবরাজ দুহাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে বলে,”হে আল্লাহ, আপনি আমার সহায় হন। অনেক অপেক্ষার পর, আমার আর নিঝুমের সম্পর্ক একটু স্বাভাবিক হচ্ছিল। আমি আর ওকে হারাতে পারব না। ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন আল্লাহ। আমার ছেলে যে ওর মাকে ছাড়া ভালো থাকবে না। কিছু একটা করুন আল্লাহ। আমার স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখুন।”

বলেই সে কাঁদতে থাকে। ছোট্ট নির্ঝরও নিজের বাবাকে এভাবে কাঁদতে দেখে আতংকিত হয়ে পড়ে। আবরাজ সেটা বুঝতে পেরে নির্ঝরকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। নিজের চোখের জল মুছে নেয় আবরাজ। কেননা, সে বুঝে নেয়। নিজের সন্তানের ভালোর জন্য হলেও তাকে এখন নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
“এমিলি…আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখ। দেখবি তাহলে তুই আর পড়বি না।”

নিজের বন্ধু এডওয়ার্ডের মুখে এমন কথা শুনে এমিলি ভ্রু কুঁচকে ফেলে। এমনিতেই তার এমন উঁচু স্থানের প্রতি ফোবিয়া আছে। তার উপর তার এই ভ্রমণপিপাসু বন্ধু যেন তাকে মারার জন্য এখানে হাইকিং করতে নিয়ে এসেছে। এমিলি হতাশ স্বরে বলে,”আমাকে ভয় দেখানো বন্ধ কর। তোর জন্যই বাধ্য হয়ে আমার আজ এখানে আসা। শয়তান ছেলে কোথাকার!”

“আরে চিল! এত ভয় পাবার কিছু হয় নি। আগেরবার ট্রিপে তো আমি একাই আল্পস পর্বতমালায় উঠেছিলাম। আর এটা তো সামান্য কনওয়ার্লের পর্বত। এখানে এত ভয় পাবার কি আছে।”

বলেই সে এগোতে লাগল। এমিলিও এডওয়ার্ডের পিছন পিছন এগোতে লাগল। কিছুদূর যাবার পর এমিলি একটু ক্লান্ত হয়ে পড়ল এবং দাঁড়িয়ে হাটুতে হাত ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। এডওয়ার্ড ততক্ষণে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। সে পিছন ফিরে এমিলিকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,”কি হলো? এভাবে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?”

এমিলি বলল,”দাঁড়া যাচ্ছি।”

বলেই সে যেইমাত্র এগোতে যাবে ঠিক সেই মুহুর্তে কোন একটা দৃশ্য দেখে আতকে ওঠে। চিৎকার করে বলে ওঠে,”আহ! এটা কি!”

এমিলির চিৎকার শুনে এডওয়ার্ড দ্রুত তার দিকে এগিয়ে এসে বলে,”কি হলো?”

এমিলি একটা পাথরের দিকে ইশারা করে। সেই ইশারা অনুসরণ করে পাথরের দিকে তাকাতেই এডওয়ার্ডও আতকে ওঠে। কারণ সেই পাথরের সাথে কোন নারী এক দেহ আটকে ছিল। অদম্য সাহসী এডওয়ার্ড বলে ওঠে,”ওয়েট, আমি দেখছি ব্যাপারটা।”

এমিলি বলে,”এডওয়ার্ড, থাম। বিপদ হতে পারে।”

এডওয়ার্ড এমিলির বাঁধা উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়। পাথরের কাছাকাছি নিথর দেহটার কাছাকাছি গিয়ে তার নাকে হাত রেখে বলে,”ইনি তো এখনো জীবিত!”

এমিলি এগিয়ে এসে বলে,”এডওয়ার্ড, চল আমরা এখান থেকে চলে যাই। এখানে থাকলে আমরা সমস্যায় পড়তে পারি।”

এডওয়ার্ড বলে,”তুই পাগল নাকি? এভাবে আমরা একটা মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে যেতে পারি না। আমাদের ওনাকে সাহায্য করা উচিৎ! ভাগ্য ভালো উনি এই পাথরের সাথে আটকা পড়েছিলেন। নাহলে নিচে যা গভীর খাদ এখান থেকে পড়ে গেলে তো বাঁচার কোন সম্ভাবনাই থাকত না।”

এমিলি নারীটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলে,”এনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে, কোন বাইরের দেশের মানুষ, বিট্রিশ না। জানি না, আসল ঘটনা কি। আমাদের কি কোন ঝুঁকি নেয়া উচিৎ?”

এডওয়ার্ড বলিষ্ঠ কন্ঠে বলে,”এখন এত কিছু ভাবার সময় নেই, এমিলি। তুই আমাকে সাহায্য কর। ওনাকে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ কোন হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”

“না, এতে আমরা ফেঁসে যেতে পারি। মনে নেই, কিছু বছর আগে এভাবেই তুই নরওয়েতে একটা ঝামেলায় ফেঁসে গেছিলি। তাই এবার কোন রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না।”

“তাহলে কি চাইছিস তুই? এনাকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ফেলে আমরা চলে যাই?”

“না, তা নয়। তবে একটা উপায় আছে, কেননা আমরা এনাকে নিয়ে কার্ডিফে ফিরে যাই। ওখানে আমার বাবার ক্লিনিকে ওনাকে ভর্তি করাবো।”

“তুই কি পাগল? ওনার চিকিৎসার প্রয়োজন। এখান থেকে কার্ডিফে যেতে প্রায় চার ঘন্টা সমত লাগবে। এত সময় কি আমাদের হাতে আছে?”

“তুই ভুলে যাচ্ছিস, এডওয়ার্ড আমি একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট। আমি বিষয়টা সামলে নেব। আমার উপর একটু ভরসা রাখ। এমনিতেই তোর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই মাদক মামলা চলছে এখন আবার এখানে নতুন করে কোন বিপদে ফাসলে সেটা ভালো হবে না।”

এডওয়ার্ড একটু চিন্তা ভাবনা করে দেখে এমিলি ভুল কিছু বলছে না৷ তাই সে সহমত জানিয়ে বলে,”বেশ, চল তাহলে।”

এরপর এডওয়ার্ড ও এমিলি মিলে নারীটিকে নিয়ে নিজেদের সাথে যেতে থাকে। পাহাড়ের খুব কাছেই তাদের গাড়ি পার্ক করা ছিল। সেটাতে করে তারা রওনা দেয় ওয়েলসের প্রধান শহর কার্ডিফের দিকে৷ এমিলির কাছে কিছু প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সারঞ্জম ছিল৷ সে সেসব দিয়েই আহত নারীটির প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করে এবং মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে ডাকতে বলে,”গড, সবকিছু ঠিক করে দাও।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আবরাজ হতাশ হয়ে বসে আছে কনওয়ার্লের পুলিশ স্টেশনের কাছে। এলা খবর পেয়ে ইতিমধ্যেই ছুটে এসেছে। সে বর্তমানে নির্ঝরকে সামলাচ্ছে। এরইমধ্যে একজন পুলিশ অফিসার হন্তদন্ত হয়ে থানায় প্রবেশ করেন। তাকে দেখামাত্রই আবরাজ ছুটে গিয়ে বলে,”কি হলো অফিসার? আমার স্ত্রীর কোন খবর পেলেন?”

অফিসার হতাশ স্বরে বলে ওঠেন,”রেসকিউ টিম এখনো তাদের কাজ করে যাচ্ছে। আমরা নিকটবর্তী সমস্ত হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছি। কোথাও আপনার স্ত্রীর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। চিন্তার কারণ নেই, আমরা আশাবাদী যে খুব শীঘ্রই ওনাকে খুঁজে পাব। তবে একটা কথা…”

“কি?”

“খাদটা কিন্তু অনেক উঁচু ছিল৷ এত উঁচু থেকে পড়ার পর বাঁচার আশা একেবারেই কম যদি না মাঝখানে কোন পাথরে উনি আটকা পড়েন!”

আবরাজ বিস্ফোরিত কন্ঠে বলে ওঠে,”কি বলছেন কি?!”

“আমরা আমাদের চেষ্টা চালাচ্ছি। দেখা যাক কি করতে পারি।”

আবরাজ হতবিহ্বল হয়ে বসে পড়ে। নিঝুমের চেহারাটা ভেসে ওঠে তার সামনে৷ সে ডুকরে কেঁদে ওঠে। বিড়বিড় করে বলে,”এটা হতে পারে না! তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না নিঝুম। তোমাকে আমার কাছে ফিরতেই হবে।”

to be continue…..