অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব-৪৪ এবং শেষ পর্ব

0
1356

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে
#Last_Part
#ইয়াসমিন_খন্দকার

নিঝুমের জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে একটি হাসপাতালের কক্ষে আবিষ্কার করে। কোনরকমে উঠে বসতেই মাথায় তীব্র ব্যাথা অনুভব করে, “আহ” বলে। এমন সময় একজন ডাক্তার ছুটে এসে বলেন,”আপনি বিশ্রাম নিন। আপনার মাথায় ভীষণ আঘাত লেগেছে।”

নিঝুম প্রশ্ন করে,”আমি কোথায় ডাক্তার?”

“আপনি এখন কার্ডিফের একটি হাসপাতালে আছেন।”

নিঝুম কিছু একটা মনে করে বলে,”কিন্তু আমি তো কনওয়ার্লে ছিলাম এবং সেখানে একটা পাহাড় থেকে পড়ে যাই আর তারপর…”

নিঝুম নিজের মাথায় হাত দেয়। ভীষণ ব্যাথা অনুভব করছিল সে। ডাক্তার বলেন,”দুজন পর্যটক আপনাকে উদ্ধার করে এখানে নিয়ে এসেছিল। ভাগ্য ভালো, খুব একটা দেরি হয়নি। তাই আমরা আপনাকে বাঁচাতে পেরেছি।”

নিঝুম বলে,”আমি আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে চাই।”

“হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনার পরিবারের কারো নাম্বার দিন আমরা যোগাযোগ করছি।”

নিঝুম ডাক্তারকে আবরাজের নাম্বার দিয়ে দেয়। ডাক্তার এরপর আবরাজের সাথে যোগাযোগ করেন।

আবরাজ একদম ভেঙে পড়েছিল কিন্তু নিঝুম সুস্থ অবস্থায় কার্ডিফে আছে জানতে পেরেই সে ভীষণ খুশি হয়। ক্রন্দনরত নির্ঝরের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোমার আম্মু কার্ডিফে আছে নির্ঝর তুমি একদম চিন্তা করো না। আমরা গিয়ে তোমার আম্মুকে ফিরিয়ে আনি চলো।”

নির্ঝর ভীষণ খুশি হয়। বিগত একটা দিন নিঝুমের কোন খোঁজ না পেয়ে দুই বাবা-ছেলে একদম ভেঙে পড়েছিল৷ এখন যেন তারা একটু আশা খুঁজে পেল নতুন জীবনের। আবরাজ ও নির্ঝর আর বেশি দেরি না করে রওনা দিল কার্ডিফের হাসপাতালের উদ্দ্যেশ্যে।

আবরাজ ও নির্ঝর হাসপাতালে পৌঁছেই নিঝুমের কেবিনের দিকে ছুটে যায়৷ নির্ঝর তো নিঝুমের একদম কাছে গিয়ে কাদো কাদো স্বরে বলে,”তুমি ঠিক আছ তো আম্মু?”

“হ্যাঁ, সোনা। আমি ঠিক আছি।”

আবরাজ নিঝুমকে বলে,”তোমাকে সুস্থ দেখে ভালো লাগছে। গতকাল থেকে কত চিন্তায় ছিলাম বলে বোঝাতে পারব না। কনওয়ার্লের সব যায়গায় তোমায় খুঁজেছি কিন্তু…”

এমন সময় এডওয়ার্ড এলে আবরাজ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে,”আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মিস্টার এডওয়ার্ড। ভাগ্যিস আপনি আমার স্ত্রীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন নাহলে যে কি হতো।”

“এটা তো আমার দায়িত্ব ছিল।”

এরপর সময় দ্রুত এগিয়ে যায়। নিঝুম কিছুদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায় এবং তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়।

নিঝুম ও আবরাজও অতীত ভুলে নিজেদের সম্পর্ক পুনরায় জোড়া লাগানোর সংকল্প করে। রাত্রে নির্ঝর ঘুমানোর পর নিঝুম বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। এমন সময় কারো স্পর্শ পেয়ে পেছনে ফিরে তাকাতেই আবরাজকে দেখতে পায়। আবরাজ মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে,”কি দেখছ এভাবে?”

“আকাশের ঐ চাঁদকে দেখছিলাম। চাঁদ যেন আজ একটু বেশিই উজ্জ্বল।”

“হুম, ঠিক বলেছ৷”

এরপর কিছু সময় নীরবে কেটে যায়। আবরাজ নীরবতা ভেঙে বলে,”নিঝুম!”

“হুম,”

“আমরা কি আমাদের সম্পর্কটা আবার স্বাভাবিক করতে নিতে পারি?”

নিঝুম আবরাজের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”কেন নয়?”

আবরাজ ভীষণ খুশি হয়। অতঃপর সে নিঝুমকে নিজের কাছে টেনে নেয়। নিঝুমকে অসংখ্য চুমুতে ভড়িয়ে দেয়৷ অতঃপর তারা হারিয়ে যায় ভালোবাসার দুনিয়ায়।

এভাবে সময় এগিয়ে চলে৷ কয়েক মাসের মধ্যেই নিঝুম শারীরিক ভাবে কিছুটা অসুস্থ বোধ করতে থাকে। বমি, মাথা ব্যাথা সহ আরো অনেক সিম্পটম দেখা দেয় তার। অবশেষে পরীক্ষা করে সে জানতে পারে, সে আবারো মা হতে চলেছে। আবরাজকে এই সংবাদটা দিতেই সে তার ভীষণ খুশি হয়৷ আবরাজ খুশিতে আপ্লুত হয়ে বলে,”নির্ঝরের জন্মের সময় আমি তোমার সাথে থাকতে পারিনি, পিতৃত্বের সময়টা উপভোগ করতে পারিনি। তবে এবার আমি পুরো সময়টাই উপভোগ করব।”

আবরাজ সেজন্যই নিঝুমের অনেক বেশি খেয়াল রাখতে শুরু করে। কিভাবে যেন চোখের পলকে নয় মাস পেরিয়ে যায়। নিঝুম একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয়। আবরাজ ও নিঝুম মিলে তাদের কন্যা সন্তানকে স্বাগত জানায়। নির্ঝরও নিজের ছোট্ট বোনকে পেয়ে অনেক খুশি। আবরাজ ও নিঝুম মিলে তাদের ছোট্ট মেয়ের নাম রাখে আদৃতা। লন্ডনে ভীষণ হাসিখুশিতে বড় হতে থাকে এই পরিবারটা।

৫ বছর পর,
আবরাজ ও নিঝুম, তাদের ছেলে-মেয়ে নির্ঝর ও আদৃতাকে নিয়ে শীতকালীন ছুটিতে সিলেটে নিজেদের গ্রামে বেড়াতে আসে। আবরাজ ও নিঝুমের বয়স বেড়েছে, নির্ঝরও এখন একজন ১০ বছর বয়সী বাচ্চা, আদৃতার বয়স ৫ বছর। দুই ভাই-বোন যেন পুরো বাড়িটা মাতিয়ে রাখে।

আলমগীর খান ও ছবি বেগম তাদের আসতে দেখে ভীষণ খুশি হয়েছেন। ছবি বেগম তো হরেক রকমের রান্নাও করেছেন। এদিকে আবির ও আনিকার পরিবারও বড় হয়েছে৷ তাদের ঘর আলো করে এসেছে দুই কন্যা সন্তান। ৫ বছর বয়সী আফিফা, যে আদৃতারই সমবয়সী, ভীষণ শান্তশিষ্ট একটা বাচ্চা। অন্যদিকে ৩ বছর বয়সী আরিশা। ছোট্ট হলেও দারুণ চঞ্চল এই বাচ্চাটি।

নিঝুম তাদের দুজনের সাথে আদৃতা ও নির্ঝরের পরিচয় করিয়ে দেয়। নির্ঝর ছোটবেলায় সিলেটেই বড় হওয়ায় খুব সহজেই এখানকার পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়। কিন্তু ছোটবেলা থেকে লন্ডনে বেড়ে ওঠা আদৃতার কাছে মোটেই সিলেটের পরিবেশ ভালো লাগে না। সে বারবার করে তার মা নিঝুমকে বলছিল,”মাম্মা, আমরা কখন আবার লন্ডনে ফিরে যাব? আমার এখানে একদম ভালো লাগছে না। তুমি পাপাকে বলো না, আমি তাড়াতাড়ি ফিরতে চাই। আমার সব ফ্রেন্ডরা প্যারিস, রোমে ঘুরতে গেছে আর তোমরা আমায় এ কোথায় নিয়ে এলে?”

নিঝুম আদৃতাকে বুঝিয়ে বলে,”এটা তো আমাদের নিজের দেশ। আমাদের নিজের দেশকে ভুলে যাওয়া উচিৎ না।”

আদৃতা আর কিছু বলে না। এদিকে নির্ঝর আফিফার সাথে টুকটাক কথা বলছিল। কিন্তু আফিফা একদম শান্ত একটা বাচ্চা। খুব একটা কথা বলে না। নির্ঝর আফিফার গাল টেনে বলে,”তুমি তো অনেক কিউট একটা বাচ্চা।”

আফিফা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। নির্ঝর নিজের পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে আফিফার হাতে দিয়ে বলে,”এই নাও, এটা খাও।”

এমন সময় কোথা থেকে যেন আরিশা ছুটে এসে বলে,”আমাল তকলেত দাও।”

নির্ঝর বাঁকা হেসে বলে,”কিন্তু আমার কাছে তো শুধু একটা চকলেটই ছিল।”

আরিশা তখন কাঁদতে শুরু করে দেয়। আফিফা নিজের বোনকে কাঁদতে দেখে তার হাতে থাকা চকলেটটা আরিশাকে দিয়ে বলে,”এই নে বোন, তুই আর কাঁদিস না। আমি খাবো না চকলেট।”

চকলেট পেয়েই আরিশার কান্না মিলিয়ে যায়। সে খুশি হয়ে চকলেটটা খেতে শুরু করে। নির্ঝর এটা দেখে বলে,”তুমি তোমার চকলেট ওকে দিলে কেন? তুমি এবার কি খাবে?”

“আমি চকলেট পছন্দ করি না। বোনু পছন্দ করে ঐ খাক।”

“মিথ্যা বলছ কেন আফিফা? আমি তো কাকির কাছে শুনলাম তুমি চকলেট অনেক পছন্দ করো।”

আফিফা আর কিছু বলতে পারে না। নির্ঝর হেসে বলে,”এভাবেই কি নিজের পছন্দের সব জিনিস নিজের বোনের হাতে তুলে দাও নাকি? একসময় না আবার এর জন্য তোমায় পস্তাতে হয়।”

আফিফা কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়

দূর থেকে নিঝুম ও আবরাজ তাদের সন্তানদের ব্যস্ত দেখে খুশি হয়। নিঝুম বলে,”সবকিছু কতটা সুন্দর লাগছে তাই না?”

আবরাজ বলে,’একদম। দীর্ঘ কষ্ট আর বিচ্ছেদের পর এতদিনে আমাদের জীবনটা একটু স্থিতিলাভ হয়েছে।’

“বাকিটা জীবন এভাবেই কাটাতে পারলে আমি খুশি।”

আবরাজ বলে,”ঠিক।”

নিঝুম আদৃতা ও নির্ঝরের দিকে নাকি বলে,”আমার পুরো জীবনটা অনেক কষ্টে গেছে। এতদিনে এসে একটু সুখের দেখা পেয়েছি। তবে আমি চাই, আমার সন্তানদের জীবন যেন এমন না হয়। ওরা যেন সুখী হতে পারে জীবনে। ওদের জীবন যেন অশ্রুজলে বোনা না হয়।”

আবরাজ বলে,”আমিও সেটাই চাই। কিন্তু জানি না, ভাগ্যে কি আছে।”

“আশা করি, ভাগ্যে ভালো কিছুই আছে।”

আবরাজ নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তাই যেন হয়। আমাদের সন্তানরা সুখী হোক। এই প্রত্যাশাই করি।”

~~~~~~~~Then End~~~~~~~~~~
[অবশেষে গল্পটির ইতি টানলাম। এতদিন ধরে ভালোবাসা দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আশা করি, পরবর্তী গল্পেও আপনাদের সমান ভালোবাসা পাবো। খুব শীঘ্রই এই গল্পের দ্বিতীয় সিজন নিয়ে হাজির হবো যা পরবর্তী প্রজন্মকে কেন্দ্র করে হবে। আশা করি, পরবর্তী গল্পেও আপনাদের সমান ভালোবাসা পাবো।]