অশ্রুজলে বোনা বিয়ে ২ পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
71

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_30
#ইয়াসমিন_খন্দকার

নিঝুম দৌড়ে গিয়ে সালমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,”আমার মেয়ে বৃষ্টি..”

সালমা হতবাক চোখে এই অচেনা মহিলার দিকে তাকালো। কে এই মহিলা? এনাকে তো সে চেনেও না। তাহলে ইনি কেন তাকে নিজের মেয়ে বলে দাবি করছেন? সালমা ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারে না৷ এদিকে নিঝুম সালমাকে বলতে থাকে,”এতগুলো দিন তুমি আমার থেকে দূরে ছিলে..তোমাকে জন্ম দিলেও আমি তোমাকে পালন করার সৌভাগ্য পাইনি। কিন্তু আজ..তোমাকে নিজের পাশে পেয়ে আমি আপন আপন অনুভব করতে পারছি। তুমি আমার মেয়ে..”

সালমা তার বাবা আব্দুল রহমানের দিকে তাকায়। আব্দুল রহমান বলে ওঠেন,”ইনিই তোর আসল আম্মা।”

সালমার পুরো পৃথিবী যেন ওলোট-পালট হয়ে যায়। সালমার যখন এরকম অবস্থা ছিল তখন হঠাৎ করে নিঝুম বলে,”বহু বছর আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল৷ সন্তানের অদল-বদল ঘটেছিল। আর সেখানেই আমার আর তুমি যাকে আম্মু বলে জানো তার সন্তানের বদল ঘটেছিল।”

সালমার পালিত মা খোদেজা খাতুন কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলেন,”সালমা, তুই আমার পুরি না..এইডা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।”

সালমাও অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে,”আমি তোমারই পুরি আম্মা। এনারা কে আর কিসব বলছেন..আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”

এমন সময় ব্লু হসপিটালের লোকটা সামনে আসেন। অতঃপর তিনি সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। এসব শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। সালমা বলে ওঠে,”এসব কিভাবে হতে পারে? আমার পুরা জীবনটাই তাইলে একটা মিথ্যা?”

বলেই সে কাঁদতে থাকে। আবরাজ এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সে এসে সালমার পাশে দাঁড়ায়। সালমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তোমার পুরো জীবনটা মিথ্যা নয়। তোমার বাকি জীবনটা এখনো পড়ে আছে। তুমি এতদিন ভুল পরিচয়ে ভুল যায়গায় ছিলে তবে এবার তোমার আসল পরিবারে ফিরে যাবার সময় এসেছে।”

সালমা বলে,”আসল পরিবার?”

ছবি বেগম এগিয়ে এসে বলেন,”হ্যাঁ, তোমার আসল পরিবার। যেখানে তুমি বড় হয়েছ, সেটা তোমার মিথ্যা পরিচয় ছিল৷ কিন্তু তোমার আসল পরিবার অন্য কোথাও। তুমি আমার নাতনী। বাকি জীবনটা তুমি সেই পরিচয়েই বাঁচবে।”

আব্দুল রহমান এবার ব্যকুল কন্ঠে বলেন,”আর আমার আসল পুরি? হে কোনখানে?”

ছবি তুলতে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থেকে বলেন,”ঐ যে আদৃতা..ওকে এতদিন আমরা আমাদের নাতনী ভেবেছিলাম। কিন্তু ঐ আপনাদের আসল মেয়ে।”

কথাটা শুনেই আব্দুল রহমান আর খোদেজা বেগম ছুটে যান আদৃতার কাছে। খোদেজা বেগম আদৃতাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমার পুরি!”

আদৃতা খোদেজা বেগমকে ধাক্কা দিয়ে বলে,”দূর হন আমার কাছ থেকে। একদম স্পর্শ করবেন না আমায়। আপনারা আমার কেউ নন৷ এসব কিছু মানি না। এসব নিশ্চয়ই আমার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমি কিছুতেই এই গরিব পরিবারের মেয়ে হতে পারি না।”

ছবি বেগম বলেন,”এসব বলে কোন লাভ নেই৷ সত্যটাকে অস্বীকার করা যাবে।”

“কিসের সত্য? কোন সত্যই আমি মানি না।”

নিঝুম বলে ওঠেন,”আদৃতা, তুমি ভীষণ বাড়াবাড়ি করছ। ওনারা তোমার আসল মা-বাবা ওনাদের সাথে তুমি এমন খারাপ ব্যবহার করতে পারো না। তোমাকে অনেক আগে থেকেই আমি বলে আসছি, সকল মানুষকে যোগ্য সম্মান দিতে কিন্তু তুমি নিজের অহংকার আর দম্ভতে এতটাই অন্ধ ছিলে যে..”

আদৃতা গলা উচু করে বলে,”চুপ করো তুমি। বলছি না, এনারা আমার মা-বাবা নয়।”

নির্ঝর বলে ওঠে,”রিয়্যালিটি মেনে নে আদৃতা। আমরা তো বলেছি, তুই সবসময় আমাদের কাছে আপনজন হয়েই থাকবি। তা কেন এমন বিহেভ করছিস তুই?”

ছবি বেগম বলেন,”আমাদের কাছে থাকবে মানে কি? ও ওর আসল মা-বাবার কাছে থাকবে না?”

খোদেজা বেগমও বলেন,”আমিও নিজের আসল পুরিকে নিজের কাছে রাখতে চাই।”

আবরাজ খান বলেন,”আদৃতাকে আমি ছোট থেকে নিজের মেয়ের মতোই বড় করেছি। হয়তোবা ও আমার আসল মেয়ে নয়। কিন্তু তাই বলে, আমি তো ওকে এভাবে ছেড়ে দিতে পারি না। মিস্টার আব্দুল রহমান, যা অন্যায় হয়েছিল তার ফল আমাদের দুজনকেই ভোগ করতে হয়েছে। আমি বুঝি, আমার এখন যেমন অনুভূতি হচ্ছে আপনার অনুভূতিও তেমন। আমি আপনার মেয়েকে আপনার থেকে আলাদা করতে পারি না, আবার আদৃতাকেও এখানে থাকতে বলতে পারি না৷ কারণ, ও যেই পরিবেশে বড় হয়েছে তাতে করে ও এই পরিবেশে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারবে না। তাই আপনাদের কে আমি একটা প্রস্তাব দিতে চাই। আপনারা আমাদের সাথে সিলেটে চলুন। আমাদের বাসার পাশে, আপনাদের থাকার একটা ব্যবস্থা করে দেব।”

আব্দুল রহমান বলেন,”এটা কিবাবে অয়? এইভাবে আপনাদের দয়া..”

“দয়া না। মনে করুন, এটা অতীতের সেই ভুলের পরিণাম।”

এদিকে আদৃতা হঠাৎ করে বলে ওঠে,”তোমরা আমার কথা শোনো, এভাবে শুধু একজন মানুষের কথায় তোমরা সব বিশ্বাস করতে পারো না। আগে প্রমাণ তো করো, যে এই সালমা আক্তার বৃষ্টিই তোমাদের মেয়ে।”

নিঝুম বলে ওঠে,”কি বলতে চাও তুমি?”

আদৃতা বলে,”ডিএনএ টেস্ট..এটা করলেই সব স্পষ্ট হয়ে যাবে।”

আবরাজ বলে ওঠে,”বেশ। তাই হবে। চলো, আমরা দ্রুত সিলেটে ফিরে যাই। তারপর সব সত্যতা যাচাই করা হবে।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সিলেটের একটি হাসপাতালের মধ্যে অবস্থান করছে খান পরিবারের সবাই। সকলের সাথে সালমা ও তার পালিত পরিবারও আছে। কিছু সময় পর আবরাজ ও সালমার ডিএনর স্যাম্পল নেয়া হয় পরীক্ষা করার জন্য।

আদৃতা বলে ওঠে,”আমি নিশ্চিত এবার সব সত্য সামনে আসবে। ঐ মেয়েটা কিছুতেই আসল নয়, আমিই তোমাদের আসল মেয়ে সেটা এবার প্রমাণিত হবে।”

সালমা নিশ্চুপ ছিল৷ তবে ছবি বেগম বলেন,”দেখা যাক, আসল সত্য কি।”

একটু পর আদৃতা বাইরে যাওয়ার নাম করে চুপিচুপি পরীক্ষাগারের বিশেষ ল্যাবে ঢুকে পড়ে। আদৃতাকে সেখানে আসতে দেখেই একজন ডাক্তার বলে ওঠেন,”আরে আপনি এখানে কি করছেন?”

আদৃতা বলে ওঠে,”চুপ করুন, আমার কথা মন দিয়ে শুনুন। এখানে যেই স্যাম্পল আপনাদের কাছে পাঠানো হয়েছে তার রিপোর্ট যাই আসুক না কেন..আপনাদের নেগেটিভ রিপোর্ট দেখাতে হবে।”

“মানে? এসব কি বলছেন আপনি? আমরা অনেক বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করি। এসব ভুল রিপোর্ট আমরা দিতে পারব না।”

আদৃতা তখনই নিজের কাছে থাকা ২০ লাখ টাকা বের করে। মূলত এখানে আসার আগেই তার নামে থাকা ব্যাংক একাউন্ট থেকে সে এই টাকা বের করেছিল। আদৃতা টাকাটা তাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”এখনও কি আপনারা না-ই বলবেন?”

ডাক্তারদের চোখ লোভে চকচক করে ওঠে। তারা হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে বলে,”কোন ব্যাপার না, আপনাদের কাজটা হয়ে যাবে।”

এমন সময় হঠাৎ করে একটা কন্ঠ ভেসে আসে,”তাই বুঝি। এখন টাকার লোভে আপনারা ভুল রিপোর্ট দিবেন?”

কথাটা শোনামাত্রই সবাই ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। ছবি বেগম এসে দাড়িয়েছেন। তাকে দেখামাত্রই আদৃতা বলে ওঠে,”গ্রানি, তুমি!”

ছবি বেগমের সাথে সাথে খান বাড়ির বাকি সবাইও সেখানে চলে আসে। ছবি বেগম এগিয়ে এসে বলেন,”আমার আগে থেকেই সন্দেহ ছিল এই মেয়ে এমন কিছুই করবেম”

বলেই তিনি ডাক্তারদের হাত থেকে টাকা কেড়ে নেন। আদৃতা বলে ওঠে,”গ্রানি, আমার কথাটা শোনো।”

কিন্তু ছবি বেগম তার কোন কথা না শুনে তার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলে,”চুপ, একদম চুপ। তুমি কি ভেবেছিলে এভাবে আমাদের ঠকাবে? আমার আসল নাতনী কে সেটা এবার সামনে আসবেই। তারপর তোমায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করছি দাড়াও।”

to be continue…….

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_31
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আরিশা চুপচাপ বসে আছে ঈশিতাদের বাড়ির ভেতরে এসে। ঈশিতা আরিশার পাশে বসে বলে,”কি হয়েছে আরিশা? তোমায় এমন লাগছে কেন?”

আরিশা হতাশ স্বরে বলে,”ঐ লোকটা কেন আমার সামনে এলো আপু? আমার ঐ লোকটাকে একদম সহ্য হয়না।”

“ঐ লোকটা বলতে তুমি কাকে বোঝাচ্ছ? তখন রাস্তায় যেই ছেলেটাকে দেখলাম? কে ঐ ছেলেটা?”

আরিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”ঐ ছেলেটাই সেই ব্যক্তি যার জন্য আজ আমার এই অবস্থা। যার জন্য আমার জীবনটা এলোমেলো হয়েছে, যার জন্য আজ আমাদের পরিবারটা ভেঙে গেছে।”

ঈশিতা বলে,”তার মানে ঐ ছেলেটাই তোমায় জোরপূর্বক বিয়ে করেছিল?”

আরিশা দুদিকে মাথা নাড়ায়। ঈশিতা রাগান্বিত স্বরে বলে,”কথাটা তুমি আমায় আগে বললে না কেন? তারপর আমি ঐ ছেলেকে দেখে নিতাম। খচ্চর ছেলে কোথাকার!”

“বাদ দিন, আপু। আমি তো ওনার বিচার পুরোপুরি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছি।”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি এখন তাহলে একটু বিশ্রাম নাও। আমি আসছি।”

বলেই ঈশিতা চলে যায়। ঈশিতা যাওয়ার পর আরিশা জাঈদের বলা কথাগুলোই ভাবতে থাকে। তার ক্ষমা চাওয়া, ফিরে আসার অনুরোধ আরিশাকে ভাবায়। কিছু সময় এসব নিয়ে ভাবার পর আরিশা বলে,”নাহ, আমি এসব নিয়ে ভাবব না। সবই ঐ লোকটার নাটক। ওনাকে বিশ্বাস করলে আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে যাবে। ওনার মতো মানুষকে কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না। আমি ঘৃণা করি ওনাকে শুধুই ঘৃণা।”

~~~~~~~~~~~~~~~~~
আবরাজ তার হাতে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে বিন্দু বিন্দু জল। নিঝুম, ছবি বেগম, নির্ঝর সবাই প্রশ্নাত্মক চোখে আবরাজের দিকেই তাকিয়ে। নিঝুম বলে ওঠে,”কি এসেছে রিপোর্টে? ”

ছবি বেগমও বলেন,”হ্যাঁ, চুপ করে আছিস কেন? রিপোর্টে কি এসেছে বল! আমাদের সবার যে ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।”

আবরাজ চোখের জল মুছে বলে,”সালমাই আমাদের সন্তান, নিঝুম। এই রিপোর্টে সেটা প্রমাণিত।”

এবার নিঝুমও কাঁদতে শুরু করে। কিছুটা দূরে বসা সালমার চোখেও জল। নিঝুম সালমার কাছে গিয়ে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমি জানতাম..যখন ওকে প্রথম স্পর্শ করি তখনই অনুভব করতে পেরেচ ছিলাম যে ও আমার আপন।”

নির্ঝর এগিয়ে এসে বলে,”আমার বোন..”

ছবি বেগমও খুশিতে গদোগদো হয়ে বলেন,”এত দিন পর আমার আসল নাতনীর খোঁজ পেলাম। তোমাদের দাদা যদি এই দিনটা দেখে যেতে পারতেন! লোকটার সারাটা জীবন মিথ্যা ভেবেই কেটে গেলো!”

দূর থেকে এসব দৃশ্য দেখে আদৃতা জ্বলছিল৷ সে বলে ওঠে,”এসব সত্য হতে পারে না? এতদিন আমি তোমাদের মেয়ে ছিলাম..আর আজ এই কোন সত্য সব কিছু এলোমেলো করে দিল? এটা কিছুতেই হতে পারে না। আমার যায়গা কিছুতেই এই মেয়েটা দখল করতে পারে না। আমি সেটা কিছুতেই হতে দেব না।”

সালমার পালিত বাবা বলেন,”আপনেরা তো নিজেদের পুরিরে ফেরত পাইলেন, এবার আমাদের পুরিরেও আমাদের কাছে ফেরত দেন।””

ছবি বেগম সাথে সাথেই বলেন,”হ্যাঁ, ঐ তো আপনাদের মেয়ে আদৃতা। ওকে নিয়ে যান আপনাদের সাথে।”

আদৃতা ক্রোধান্বিত স্বরে বলে,”আমি কোথাও যাব না,ওনাদের সাথে। আমি ওনাদের মা-বাবা বলে মানি না।”

“সে তুমি মানো বা না মানো ওনারাই তোমার আসল বাবা মা। তুমি এতদিন নিঝুম আর আবরাজের মেয়ে হিসেবে বড় হলেও তোমার এই পরিচয় তো সত্য না। তাই, জেদ না দেখিয়ে রিয়্যালিটি মেনে নেয়ার চেষ্টা করো।”

আদৃতা তখনও রাগে ফোসফাস করছিল। আবরাজ ও নিঝুম তাদের মেয়ে সালমাকে আগলে নিয়ে বলে,”চলো, আজ তুমি তোমার আসল বাড়িতে যাবে।”

সালমা অবাক স্বরে বলে,”আসল বাড়ি?”

“হুম।”

আদৃতার যেন এসব দৃশ্য একদম সহ্য হচ্ছিল না। সে কিছু বলতে যাবে এমন সময় আফিফা সেখানে চলে আসে। আফিফা এই হাসপাতালেই পড়াশোনা করে। সে এখানে এসেছিল কিছু কাজে। বাড়ির সবাইকে এখানে দেখে সে থমকে যায়। কিন্তু তাদের সবার উপর রেগে থাকায় কাউকে কিছু না বলেই এড়িয়ে যেতে চায়। এমন সময় ছবি বেগম তার পথ আটকে বলে,”এখনও রেগে আছিস আমাদের উপর?”

উত্তরে আফিফা কিছু বলে না। ছবি বেগম বলেন,”যাই হোক, একটা আনন্দের কথা শোন। আমাদের পরিবারের অনেক বড় একটা রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। আবরাজ আর নিঝুমের আসল মেয়ে আদৃতা নয় জানিস। জন্মের পর ওদের বাচ্চা অদল-বদল হয়ে গেছিল৷ এই যে ওদের আসল মেয়ে সালমা।”

কথাটা শুনে আফিফা অবাক হয়ে যায়। ছবি বেগম তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। অতঃপর বলে,”এতদিন পর আমাদের পরিবারটা এক হয়েছে। তুই একটা কাজ কর, তোর মা-বাবাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আয়।”

আফিফা বলে,”না, দাদি। এটা সম্ভব নয়। তুমি জানো, কেন আমরা বাড়ি ছেড়ে এসেছি৷ আরিশার সাথে তোমরা.।।”

ছবি বেগম বলেন,”আরিশাকেও নিয়ে আয় তোরা। আরিশার উপরে আমরা যে কারণে রেগে ছিলাম সেটা তো রইল না।।এই আদৃতা তো আমাদের বাড়ির মেয়েই নয়।”

আফিফা বিদ্রুপের স্বরে বলে,”আজ আদৃতা তোমাদের বাড়ির মেয়ে নয় জন্য তুমি এসব বলছ? যদি হতো তাহলে বলতা? বলতা না। তাই আমি এখন ফিরবো না। আর তোমাদের অনেক অভিনন্দন নিজেদের বাড়ির আসল মেয়েকে খুঁজে পাওয়ার জন্য।”

এমন সময় নির্ঝর আফিফার সামনে এসে বলে,”তুমি প্লিজ ফিরে এসো আফিফা। আমি তোমাকে অনেক মিস করছি। আমি সবকিছুর জন্য ক্ষমা..”

“তোমার ক্ষমা তোমার কাছেই রাখো। তুমিই তো বলেছিলে তোমার আর আরিশার মধ্যে একজনকে বেছে নিতে। আমি আরিশাকে বেছে নিয়েছি৷ এখন তাই তোমার এসব বলার কোন অধিকার নেই।”

“অভিমান করেছ?”

“না, অভিমান না। এটাই আমি ভেবে চিন্তে বলছি। যাইহোক, তোমার আসল বোনকে বাড়িতে নিয়ে যাও।”

বলেই আফিফা চলে যায়৷ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নির্ঝর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ছবি বেগম বলেন,”চিন্তা করিস না, ও ঠিকই ফিরবে দেখিস। অভিমান কাটুক।”

এদিকে আদৃতা বলে,”আমাকে কষ্ট দিয়ে তোমরা সবাই এক হবে, তাই না? তোমাদের পরিবারকে আমি কিছুতেই এক হতে দেব না। তোমাদের মধ্যে আমি ভাঙন সৃষ্টি করবোই।”

~~~~~~~~~
সালমাকে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে এসেছে খান পরিবারের সবাই। সালমাকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করেই নিঝুম বলে,”দেখো, এইটাই তোমার আসল বাড়ি। তুমি এই বাড়িরই মেয়ে।”

সালমা অবাক হয়ে চারিদিকে দেখতে থাকে। ছবি বেগম বলেন,”দেখো দিদিভাই, মন ভড়ে দেখো। এই সবকিছুই তো তোমার। এই বাড়ির উত্তরাধিকার তো তোমরাই।”

সালমা সব কিছু দেখছিল এমন সময় আদৃতা চলে আসে বাড়ির মধ্যে। সে এসেই বলে,”এই মেয়েটাকে এখন তোমতরা এতোটা তোল্লাই দিচ্ছ? আমাকে এত তাড়াতাড়ি পর করে দিলে?”

আদৃতাকে দেখে আবরাজ বলে,”তোমাকে আমরা পর করে দেই নি৷ তুমি তো এখনও আমার কাছে মেয়ের মতোই।”

“মেয়ের মতো..কিন্তু মেয়ে তো নই..”

আবরাজ কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছবি বেগম এগিয়ে গিয়ে বলেন,”তোমাকে যতটুকু অধিকার দেওয়া হয়েছে ততটুকু অধিকার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো। ভুলে যেও না, এটাও তোমার প্রতি দয়া দেখিয়ে করা হচ্ছে।”

আদৃতা রেগে বলে,”কাউকে আমায় দয়া দেখাতে হবে না। আমার অধিকার আমি নিজেই বুঝে নেব।”

বলেই সে হনহন করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে থাকে। এমন সময় তার আসল মা-বাবা তার সামনে আসলে সে বলে,”আপনাদের আমি কখনোই মেনে নেবো না, কখনোই না।”
to be continue…….

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_32(Bonus)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আরিশা মন খারাপ করে নিজের ঘরে বসেছিল। এমন সময় আফিফা আরিশার রুমে আসে। সে এসেই আরিশার পাশে বসে বলে,”আরিশা..তুই এমন মন খারাপ করে বসে আছিস কেন? ঈশিতার কাছে শুনলাম যে ঐ জাঈদ শয়তানটা নাকি আজ আবার তোকে বিরক্ত করছিল। কথাটা কি সত্যি? এবার তাহলে এর একটা বিহিত করতেই হবে। কি পেয়েছে টা কি ও?”

আরিশা বলে,”তুমি এসব কথা বাদ দাও আপ্পি। ওকে আমি যেভাবে অপমান করেছি আমার মনে হয় না..ও আবার আমার কাছে আসবে।”

“কি জানি, ওরকম ছেলেদের একদম বিশ্বাস নেই। যেভাবে আমার পেছনে পড়ে ছিল..আচ্ছা বাদ দেই সেসব কথা। তুই এখন ঠিক আছিস তো?”

“হুম।”

“জানিস, তোকে একটা কথা জানানোর আছে।”

“কি কথা?”

আফিফা এর হাসপাতালের সমস্ত ঘটনা আরিশাকে খুলে বলে। সব শুনে আরিশা অবাক হয়ে যায়। হতবাক স্বরে বলে,”কি বলছ কি তুমি? আদৃতা আপু তোমার চাচাতো বোন নয়? মানে অন্য কেউ তোমার চাচাতো বোন?”

“হ্যাঁ, সেটাই তো শুনলাম। মেয়েটার নাম নাকি সালমা আক্তার বৃষ্টি। এতদিন ও গ্রামে বড় হয়েছে৷ তবে এখন থেকে বোধহয় শহরেই থাকবে। জানিস, দাদি আমায় বলেছিল ওবাড়িতে ফিরে যেতে, নির্ঝরও আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। কিন্তু আমি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলাম যে আমি ও বাড়িতে ফিরব না।”

আরিশা বলে,”তুমি কেন ওদের না করতে গেলে আপ্পি?”

“ওরা তোকে যেভাবে অপমান করেছে তারপর আমি আর ওবাড়িতে ফিরব না।”

“আমার জন্য তোমরা শুধুশুধুই এত ভাবছ। কে হই আমি তোমাদের? তোমাদের সাথে আমার না কোন রক্তের সম্পর্ক আছে আর না তো অন্য কোন কিছু৷ তাহলে আমার জন্য কেন তোমরা এভাবে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে থাকে? তোমার আর নির্ঝর ভাইয়ের সম্পর্কই বা কেন শুধুমুধু আমার জন্য খারাপ হবে?”

“একটা থাপ্পড় দেব তোকে। খুব পাকা পাকা কথা শুনেছিস তাই না? আমার যা ভালো মনে হয়েছে আমি তাই করেছি। তুই বলার কে? আর কি বললি তুই আমার কেউ না? তুই আমার বোন। এ কথা আর কতবার বলতে হবে তোকে? নাকি তুইও আমায় আপন ভাবিস না?”

“না, না আপ্পি। তোমার থেকে আপন আর আমার এই দুনিয়ায় কে হয়েছে? আমি ভুল করে বলে ফেলেছি। আমায় ক্ষমা করে দাও।”

“ক্ষমা করতে পারি তবে একটা শর্ত আছে?”

“কি শর্ত?”

“আর কোনদিন যেন তোর মুখে এমন কথা না শুনি।”

“ঠিক আছে।”

“তবে যাইহোক, আমার একটা জিনিস ভেবে ভালো লাগছে যে অন্তত এতদিন পর সালমা তার আসল পরিবারটাকে ফেরত পেল। আদৃতার যা খারাপ ব্যবহার ও যে আমার চাচাতো বোন নয় এটা জেনে আমার ভীষণ ভালো লাগছে।”

হঠাৎ করে আরিশার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আফিফা সেটা খেয়াল করে বলে,”তোর মুখটা হঠাৎ এভাবে শুকিয়ে গেল কেন?”

আরিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আমার আসল পরিবারকেও কি আমি কখনো এভাবে খুঁজে পাব? হ্যাঁ, আমি জানি তারা নিজেরাই একদিন আমায় ত্যাগ করেছিল। কিন্তু তবুও তাদের প্রতি আমার ভীষণ মায়া জাগে। একবার হলেও আমি তাদের মুখোমুখি হতে চাই। তাদের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করতে চাই, কেন তারা আমায় ত্যাগ করেছিল। কেন আমায় পর করে দিয়েছিল।”

আফিফা আরিশাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”একদম কষ্ট পাবি না। ওরা তোকে পর করেছে তো কি হয়েছে? আমরা আছি না? আমরাই তো তোর আপনজন।”

আরিশা মাথা নাড়ায়।

~~~~~~~~~~~~~~~
ছোট বাচ্চাদের কিছু পুরাতন পোশাক হাত দিয়ে স্পর্শ করছেন মিসেস রাহেলা খন্দকার। তার দুচোখ ভড়া জল যেন তার দীর্ঘ ২০ বছরের কষ্টের সাক্ষ্য দিচ্ছে। তার সামনেই বসে আছেন তার শ্বাশুড়ী সিতারা বেগম। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন,”এসব দেখে আর কি হবে বৌমা? আল্লাহ তো তোমার ভাগ্যে সন্তান সুখ রাখেন নি। বিয়ে সুদীর্ঘ ১২ বছর পর তুমি একটা সন্তানের মা হলে। সেই সন্তানকেও আল্লাহ তোমার থেকে কেড়ে নিল। আর তুমি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে তোমার সন্তানের জন্য বানানো জামা-কাপড় সব আগলে রেখেছ।”

রাহেলা খন্দকার এবার জামাগুলো নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠেন,”আপনার মনে আছে আম্মা? আমার সন্তান যখন আমার পেটে ছিল তখন আমি৷ নিজের হাতে সেলাই করে এইসব জামা বানিয়েছিলাম। কত আশা নিয়ে ছিলাম যে একদিন আমার সন্তান জন্ম নেবে আর এই জামাগুলো পড়বে। অথচ আমার সন্তান জন্মের পরপরই কিনা আমায় শুনতে হলো যে আমি একটা মৃত বাচ্চার জন্ম দিয়েছি। আজো আমি ঐ দিনটা ভুলতে পারি না।”

সিতারা বেগম চশমা খুলে নিজের চোখের জল মুছে বলেন,”এসব ভেবে কোন লাভ নেই, বৌমা। তার থেকে ভালো, তুমি আল্লাহর কাছে দোয়া করো। দোয়ার থেকে বেশি কার্যকর আর কিছু হয় না।”

এমন সময় হঠাৎ করে তাদের বাড়ির ড্রাইভার এসে বলে,”ম্যাডাম, আমি গাড়ি বের করেছি।”

সিতারা বেগম বলে ওঠেন,”এই ভর দুপুরবেলায় আবার গাড়ি কেন বের করেছ?”

“ম্যাডাম নাকি কোথাও একটা যাবেন।”

রাহেলা খন্দকার বলেন,”আমি এখন একটু অনাথ আশ্রমে যাব আম্মা। জানেনই তো, ঐ অনাথ বাচ্চাগুলোর সান্নিধ্য পেলে আমার মনে হয় যেন আমার বাচ্চা আমার পাশেই আছে।”

“আচ্ছা, বেশ সাবধানে যেও।”

রাহেলা খন্দকার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান। তিনি যেতেই সিতারা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”ভাগ্য করে একটা বৌমা পেয়েছিলাম। কত ভালো মন ওর, কি সুন্দর ব্যবহার। কারো কষ্টই সহ্য করতে পারে না মেয়েটা। অথচ ওর কপালেই কষ্টের সুখ নেই। আল্লাহ, তুমি একটু ওর দিকে মুখ তুলে তাকাও। অন্তত ওর জীবনে একটা সুখের কারণ নিয়ে এসো।”

~~~~~~~~`~~
আফিফা আরিশাকে নিয়ে একটু শপিং করতে বের হয়েছে কারণ আরিশার মন ভালো ছিল না। শপিং করা শেষে আফিফার মনে পড়ে সে কিছু জরুর জিনিসপত্র একটা দোকানের সামনে রেখে এসেছে। তাই আফিফা আরিশাকে বলে,”বোনু, তুই একটু এখানে দাঁড়া। আমি ভেতর থেকে আসছি জিনিশগুলো নিয়ে।”

“আচ্ছা, আপু। তাড়াতাড়ি এসো।”

আফিফা ভেতরে চলে যায়। এদিকে আরিশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ করে সে খেয়াল করে রাস্তার মধ্যে দিয়ে একটা মহিলা হেটে যেতে যেতে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। আরিশা তৎক্ষণাৎ গিয়ে সেই মহিলাটিকে ধরে বলে,”আপনি ঠিক আছেন তো?”

মহিলাটা মাথা নাড়িয়ে হু হা করে। আরিশার কাছে পাতির বোতল ছিল সে সেখান থেকে মহিলাটিকে পানি খাওয়ায়। আরিশা দেখতে পায় মহিলাটির হাতে অনেক গুলো চকলেটের বক্স।

এদিকে একজন ড্রাউভার ছুটে এসে বলে,”আপনি ঠিক আছেন তো ম্যাডাম?”

রাহেলা খন্দকার ততক্ষণে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছেন। তাই তিনি বলেন,”হুম। ঠিক আছি।”

অতঃপর তিনি আরিশার দিকে তাকান তাকে ধন্যবাদ দিতে। কিন্তু আরিশার দিতে তাকাতেই তার কেন জানি ভীষণ কান্না পায়৷ আরিশাকে দেখে তার মনে হতে থাকে এ যেন তার ভীষণ কাছের কেউ। আরিশা রাহেলা খন্দকারের দিকে খেয়াল করে বলেন,”আন্টি, এই পানিটুকু সম্পূর্ণ খেয়ে নিন, তাহলে আরো সুস্থ বোধ করবেন।”

রাহেলা খন্দকার পানিটুকু খেয়ে নেন। আরিশা মিষ্টি স্বরে বলে,”যদি বেশি সমস্যা হয় তাহলে ডাক্তারের কাছে যান।”

রাহেলা খন্দকার হালকা হেসে বলেন,”না, মা তার প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক আছি।”

“আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না।”

রাহেলা খন্দকার আরিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”কেন জানি আমার মনে হচ্ছে, তোমার সেবাই আমাকে সাড়িয়ে তুলেছে। তোমাকে নিজের ভীষণ কাছের কেউ মনে হচ্ছে।”

আরিশাও বিনয়ী হাসে তার কথা শুনে। রাহেলা খন্দকার জিজ্ঞেস করে,”কি নাম মা তোমার?”

“আমার নাম আরিশা।”

“আরিশা..খুব সুন্দর নাম।”

to be continue…….