#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_42
#ইয়াসমিন_খন্দকার
আরিশা সায়নের সাথে কথা বলা শেষ করে আফিফার কাছে এসে বসলো। আরিশাকে বসতে দেখেই আফিফা বলে উঠলো,”কি হলো বোনু? সায়নের সাথে কি কথা বললি তুই?”
আরিশা বললো,”উনি আমাকে এমটা প্রশ্ন করেছিলেন আর আমি ওনাকে আমার উত্তরটা দিয়ে এসেছি।”
“আর তোর উত্তর নিশ্চয়ই না ছিল?”
আরিশা মাথা নাড়ায়। আফিফা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিস, ভেবেচিন্তে নিয়েছিস তো?”
“আমি না ভেবে কোন সিদ্ধান্ত নেই না, আপ্পি। একটা মেয়ের জীবন কি শুধু বিয়েশাদি এসব নিয়েই গঠিত? ছোটবেলা থেকেই তো আমাদের এটাই শেখানো হয় যে, মেয়ে হয়ে জন্মেছ মানে তোমায় একসময় বিয়ে করতে হবে, নিজের স্বামীর সেবা করতে হবে, স্বামী যেমনই হোক, শ্বশুর বাড়ি যেমনই হোক না কেন সবার সাথে মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু আমি মোটেই তেমন ধারণায় বিশ্বাস করি না। জীবনে একবার বিয়ে করেছি আমি, যদিওবা নিজের ইচ্ছায় করিনি। কিন্তু সেই বিয়েতে যা যা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তাতে আর আমার সংসারের প্রতি কোন রুচিই নেই। আমি এখন শুধু নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই, নিজের একটা ভালো ক্যারিয়ার গড়তে চাই। আজকাল কার যুগে একটা মেয়ের নিজের পায়ে দাঁড়ানো যে অনেক দরকার। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, আমার বাবা অনেক ক্ষমতাবান, তার অনেক প্রভাব প্রতিপত্তি আছে কিন্তু তার বাইরে গিয়েও আমি নিজের একটা পরিচয় গড়তে চাই। তাই এসব ব্যাপারে আমি আর মাথা ঘামাতে চাই না৷ আপাতত আমার চেষ্টা সামনের এইচএসসি পরীক্ষায় একটা ভালো রেজাল্ট করা তারপর ভালো কোথাও এডমিশন নেয়া। এসব বিয়ে, সংসার এসব নিয়ে আমি ভাবতে চাই না।”
আফিফা আরিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”তুই একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস বোনু। আমার গর্ব হচ্ছে তোর কথাগুলো শুনে।”
দুজন মিলে গল্পই করছিল এমন সময় হঠাৎ করে আফিফার মাথা ঘুরে ওঠে এবং সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে নেয়। আরিশা আফিফাকে সামলে নিয়ে বলে,”কি হয়েছে আপ্পি? তুমি ঠিক আছ তো?”
“জানি না রে,মাথাটা কেন জানি ঘুরছে খুব।”
“আচ্ছা, চলো। তোমার রুমে চলো। তোমার এখন বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন।”
“হ্যাঁ, চল।”
আরিশা আফিফাকে ধরে তার রুমে নিয়ে যায়। কিন্তু রুমে যেতেই হঠাৎ করে আফিফা বমি করতে শুরু করে। আরিশা আফিফাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ঘর ও আফিফার শরীর পরিস্কার করিয়ে দিয়ে বলে,”তুমি হঠাৎ করে এমন অসুস্থ হয়ে গেলে কেন আপ্পি? আমার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে।”
আফিফা বলে,”দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই৷ তুমি একটু আমার ওয়ারড্রব থেকে প্রেগ্যান্সির কিটটা নিয়ে আয় তো।”
আরিশা খুশি হয়ে বলে,”আপ্পি! কি বলছ তুমি? তারমানে আমি খালামনি হতে চলেছি?”
আফিফা কিছুটা লাজুক স্বরে বলে,”আগে দে..একটু পরীক্ষা করে দেখি।”
আরিশা আফিফাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”যদি সত্যি এমনটা হয় তাহলে আমি খুব খুশি হবো। আমি তো ভীষণ আনন্দিত।”
আফিফা প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে নিশ্চিত হয় যে সে প্রেগন্যান্ট। আরিশা আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলে,”ইয়ে..আমি খালামনি হতে চলেছি। যাই, এই সুখবরটা সবাইকে দিয়ে আসি। তুমি বিশ্রাম নাও আপ্পি। ”
বলেই আরিশা রুম থেকে বের হয়। এদিকে আফিফা নিজের পেটে হাত রাখে। তাকে একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লাগছে। আফিফা মনে মনে ভাবে,”আমি কি পারবো নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি বাচ্চার দায়িত্ব সামলাতে? এখনো যে আমার মেডিকেলের পড়াশোনা শেষই হয় নি। একসাথে কি আমি ডাক্তার ও মা এই দুই দায়িত্ব সামলাতে পারবো?”
এদিকে আফিফার খবরটা শুনে সবাই ভীষণ খুশি হয়। নির্ঝর তো এসেই আফিফাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”ধন্যবাদ, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে এত খুশির একটা সংবাদ দেবার জন্য।”
নিঝুম খান বলেন,”বাহ, লন্ডনে যাবার আগে এত খুশির খবর পাবো সেটা ভাবতেই পারি নি। আমি দাদিমা হতে চলেছি।”
নির্ঝর দেখে আফিফা একটু চিন্তিত। সে বলে,”তুমি কি কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করছ আফিফা?”
আফিফা বলে,”আমি কি নিজের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার সামলে একজন ভালো মা হতে পারব নির্ঝর? আমি কি ওকে একজন মায়ের ভালোবাসা দিতে পারব?”
নিঝুম বলেন,”কেন পারবে না? এই আমাকে দেখো না, আমিও তো ডাক্তার হবার পাশাপাশি মায়ের দায়িত্ব সামলেছি।”
ছবি বেগম এসে বলেন,”আর তোমার মাও তো একজন ডাক্তার। সেটা ভুলে গেছ দিদিভাই? সে তো তোমাকে আর আরিশাকে মানুষ করেছে নিজের দায়িত্ব সামলে। তুমিও পারবে। আর আমরা তো সবাই আছিই।”
আফিফা এবার একটু স্বস্তি পায়। আরিশা আফিফাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আর আমি তো আছিই..তোমার সন্তানকে মানুষ করতে আমিও তোমায় সাহায্য করবো আপ্পি।”
সবাই মিলে খুশিতে মেতে ওঠে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
দুই দিন পর,
বৃষ্টি নিজের ঘরে বসেছিল। আগামীকাল তাদেরকে লন্ডনে যেতে হবে। যদিওবা আফিফার সন্তানের আগমনের কথা শোনার পর তারা আরো কিছুদিন থাকতে চেয়েছিল কিন্তু আবরাজ খানের ব্যবসায় একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে, নিঝুম খানও হাসপাতাল থেকে এক্সট্রা ছুটি আর পান নি৷ তাই কালই তাদের ফিরতে হবে।
সেজন্যই বৃষ্টি এখন নিজের সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ করে আদৃতা তার রুমে এসে বলে,”ভেতরে আসবো।”
বৃষ্টি বলে,”আরে তুমি। হ্যাঁ, এসো।”
“সবকিছু গোছগাছ করা শেষ?”
“হুম, প্রায় শেষ।”
“তোমার নিশ্চয়ই ভীষণ ভালো লাগছে তাই না? খুব শীঘ্রই তুমি লন্ডনে যেতে পারবে। জানো লন্ডন একদম ছবির মতো সুন্দর শহর।”
“হ্যাঁ, আমাদের গ্রামের কিছু মানুষও লন্ডনে ছিল। তাদের কাছে শুনেছি অনেক।”
“গ্রাম বলতেই মনে পড়লো, লন্ডনে যাবার আগে তুমি যাদের কাছে এতদিন বড় হলে তাদের সাথে একবার দেখা করবে না? তারা তো আমার নিজেরও আসল মা-বাবা। চলো না, তাদের সাথে একবার দেখা করে আসি।”
বৃষ্টির হঠাৎ করে তাদের কথা মনে পড়তেই বুকটা হাহাকার করে ওঠে। সে বলে,”দেখা তো করতে আমারও মন চাচ্ছে কিন্তু বাবা তো বলল, যাওয়ার আগে ওনাদের সাথে দেখা করানোর ব্যবস্থা করাবেন।”
“সেটা তো জানি। কিন্তু তাদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ তো পাবো না। তার থেকে বরং চলো, আমরা এখন তোমাদের গ্রামে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করে আসি।”
“আচ্ছা, আমি তাহলে মা-বাবার থেকে অনুমতি নিয়ে আসি।”
আদৃতা বৃষ্টিকে আটকে বলে,”আরে যেও না..এখন যদি অনুমতি চাইতে যাও তাহলে আমাদের যেতে দেবে না। তার থেকে বরং চলো কাউকে কিছু না বলেই আমরা যাই।”
“কিন্তু না বলে গেলে যদি ওনারা দুশ্চিন্তা করেন।”
“আরে কেউ কিছু জানতে পারবে না। এখন তো রাত ১০ টা বাজে। সবাই নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা এখন বের হই রাত ১২ টার মধ্যে তোমাদের গ্রামে পৌঁছে যাব। তারপর আজকের রাতটা নাহয় ওখানেই কাটিয়ে আসব কাল সকাল সকাল চলে আসব। চিন্তা করো না, আমি গাড়ি নিচ্ছি। আমি কিন্তু ভালোই ড্রাইভ করতে পারি।”
“কিন্তু..”
“ওহ, বুঝেছি৷ তুমি আমায় বিশ্বাস করতে পারছ না, তাইতো? কোন ব্যাপার না। তাহলে যাওয়ার দরকার নেই।”
বলেই বৃষ্টি চলে যেতে নিতেই বৃষ্টি তার হাত ধরে আটকে বলে,”না, না আপু। আপনি ভুল ভাবছেন। মোটেই এমন না। চলুন,আমি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।”
কথাটা শুনেই আদৃতা বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর মনে মনে বলে,”এই যাওয়াই তোমার শেষ যাওয়া বৃষ্টি। এরপর তুমি আর কখনো এই বাড়িতে ফিরতে পারবে না। তোমাকে আমি চিরকালের মতো নিজের পথ থেকে সরিয়ে দেব।”
“হ্যাঁ, চলো। এখনই বের হই আমরা।”
“আচ্ছা, চলুন।”
বলেই দুজনে বের হয় বাড়ি থেকে কাউকে কিছু না বলেই। অতঃপর আদৃতা গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করে। বৃষ্টি তার পাশেই বসে।
to be continue…….
#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_43
#ইয়াসমিন_খন্দকার
আরিশা বর্তমানে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেছে৷ রাহেলা খন্দকার আরিশার পাশে এসে দুধ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আরিশাকে পড়তে দেখে তিনি বলেন,”এই দুধটুকু খেয়ে নাও। তাহলে পড়াশোনায় আরো ভালো করে মন দিতে পারবে।”
আরিশা নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে দুধটুকু নিয়ে খেয়ে নেয়। রাহেলা খন্দকার জিজ্ঞেস করেন,”তোমার পড়াশোনার কি অবস্থা? এইচএসসি পরীক্ষার তো আর বেশিদিন বাকি নেই।”
আরিশা বলে,”আমার সিলেবাস তো প্রায় শেষ। এখন আর নতুন কিছু পড়ছি না। গুরুত্বপূর্ণ টপিকস গুলো রিভাইজ করছি।”
“আচ্ছা, প্রাইভেট টিউটররা ভালো করে পড়াচ্ছে তো? নাকি আরো কয়েকটা টিউটারের ব্যবস্থা করব।”
“না, আর দরকার নেই।”
“ওহ আচ্ছা, ঠিকাছে ভালো ভাবে পড়াশোনা করো।”
অতঃপর কিছু একটা মনে করে তিনি বলেন,”আচ্ছা, তোমার যার সাথে বিয়ে হয়েছিল মানে জাহাঙ্গীর শেখের ছেলে ও নাকি জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে শুনলাম।”
জাঈদের ব্যাপারে কথাটা শোনামাত্রই আরিশা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”হতে পারে। আমি এই ব্যাপারে কিছু জানি না মা।”
“ছেলেটা তো নাকি নির্দোষ ছিল। ও তোমাকে মেরে ফেলার চক্রান্তের মধ্যে ছিলনা। মা হিসেবে তোমায় একটা কথা বলি, তুমি সম্পর্কটা নিয়ে একটু ভাবতে পারো।”
আরিশা বলে,”আমি এসব নিয়ে কিছু ভাবতে চাই না। আপাতত আমি জাস্ট নিজের পড়াশোনায় ফোকাস করব।”
“হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। কিন্তু বিয়ের মতো একটা সম্পর্ককে তো অস্বীকার করা যায়না। তুমি যদি এই সম্পর্কটা রাখতে না চাও বলতে পারো, আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে দেব৷ কিন্তু এভাবে সম্পর্ক ঝুলিয়ে রাখার তো কোন মানে নেই।”
আরিশা বলে,”মা, তোমায় একটা অনুরোধ করছি। দয়া করে এই বিষয় নিয়ে আমায় আর কিছু বলো না। আমি আগে এক্সামটা ভালো ভাবে দেই একটা ভালো ভার্সিটিতে এডমিশন নেই। তারপর এসব নিয়ে ভাবব।”
“বেশ, তাহলে আমি আর এই বিষয় নিয়ে কিছু বলব না আপাতত। তবে তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে একটু ভেবেচিন্তে নিও। কারণ এই সিদ্ধান্তের উপর তোমার ভবিষ্যতের অনেক কিছুই নির্ভর করবে।”
বলেই রাহেলা খন্দকার চলে যান। এদিকে আরিশাকে ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত লাগছিল। হঠাৎ করে আরিশার সামনে জাঈদের চেহারা ভেসে ওঠে৷ আরিশা পড়ার টেবিল থেকে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,”আপনি আমার জীবনের এমন এক ব্যক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছেন যাকে না তো আমি ভুলতে পারছি আর না পারছি আপনাকে মনে রাখতে। আপনাকে ঘৃণাও করতে পারছি না আবার ভালোও বাসতে পারছি না। সত্যিই আমাদের সম্পর্কটা বড্ড এলোমেলো হয়ে ঝুলে আছে। এবার এর একটা দফারফা করা দরকার। জানিনা,আপনি কোথায় আছেন। তবে আমার কেন জানিনা বারবার মনে হচ্ছে,খুব শীঘ্রই আপনার সাথে আমার আবার দেখা হবে৷ তারপর হয়তো আমাকে আমার জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নিতে হবে।”
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আদৃতা ভীষণ দ্রুতবেগে গাড়ি চালাচ্ছিল। যার ফলে বৃষ্টি ভীষণ ভয় পাচ্ছিল। তাই সে আদৃতাকে বলল,”আপু, গাড়িটা একটু আস্তে চালান না৷ আমার ভীষণ ভয় লাগছে।”
আদৃতা আচমকা মাঝরাস্তায় গাড়িটা থামিয়ে দিলো। জোরে ব্রেক কশায় বৃষ্টি নিজেকে সামলাতে হিমশিম খেল। আদৃতা বৃষ্টিকে বললো,”গাড়ি থেকে নামো।”
বৃষ্টি অবাক স্বরে বললো,”এটা কোন যায়গা আপু? এটা তো আমাদের গ্রাম না। আপনি এ কোথায় নিয়ে এলেন আমায়?”
“চুপচাপ গাড়ি থেকে নামো বলছি।”
হুংকার দিয়ে বলে ওঠ আদৃতা। বৃষ্টি ভয়ে ভয়ে গাড়ি থেকে নামে। বৃষ্টি গাড়ি থেকে নামতেই আদৃতা তার হাত থেকে তার মোবাইলটা কেড়ে নেয়। বৃষ্টি ভীত স্বরে বলে,”আমার ফোন..”
আদৃতা বৃষ্টি গাল চেপে ধরে বলে,”চুপ..একদম চুপ..এসব কিচ্ছু তোর নয়। তুই এখানে এসে যা কিছু দখল করেছিস সবকিছু আমার। আমার মম, আমার ড্যাড, আমার ব্রো, আমার ফ্যামিলি এমনকি আমার আইডেন্টিটি, সব কেড়ে নিয়েছিস তুই।”
বৃষ্টি বলে,”আপনি ভুল ভাবছেন আপু। আমি আপনার থেকে কিচ্ছু কেড়ে নেই নি। বরং যা আমার আমি শুধু তাই..”
আদৃতা জোরে একটা ধমক দিয়ে বলে,”খুব আমার আমার করতে শিখে গেছিস তাইনা? আজ তোর বল বুলি আমি বন্ধ করবো। এই আদৃতাকে তুই চিনিস না, আমার পথে বাধা হওয়ার চেষ্টা করলে তার পরিণাম কি হয় এবার তুই সেটা টের পাবি।”
বলেই আদৃতা হঠাৎ করে গাড়িতে উঠে বসে। বৃষ্টি বলে ওঠে,”আপু..আপনি এভাবে গাড়িতে উঠে বসলেন যে।”
আদৃতা কোন কথা না বলেই গাড়িটা চালু করে। এদিকে বৃষ্টি একাই থেকে যায়। কিছুটা দূর সামনে এগিয়ে এসে আদৃতা কাউকে একটা ফোন করে বলে,”মালটাকে খালাস করে দাও। তোমাদের একাউন্টে টাকা পৌঁছে যাবে।”
এদিকে বৃষ্টি একা একা কাঁদছিল ভীষণ। এই অচেনা অজানা যায়গায় সে কি করবে বুঝছিল না। আশেপাশে কোন জন মানুষও নেই। বৃষ্টি কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই সে হাটতে শুরু করে। আচমকা কয়েকজন পুরুষ এসে তার পথ আটকে ধরে। বৃষ্টি ভয়ে কুকিয়ে ওঠে। তাদের মধ্যেই একজন বলে ওঠে,”মালটা তো হেব্বি সুন্দর আছে। মেরে ফেলার আগে একটু এর সাথে এশ করে নেই।”
বৃষ্টি বলে ওঠে,”কে আপনারা? দয়া করে এমন কিছু করবেন না আমার সাথে। আমি তো আপনাদের কোন ক্ষতি করিনি। আমাকে যেতে দিন। আল্লাহর দোহাই লাগে।”
হঠাৎ করে যেই লোকটা একটু আগে কথা বলেছিল সে এগিয়ে এসে বৃষ্টির ওড়না ধরে টান মারে। বৃষ্টি অসহায়ের মতো নিজেকে বাঁচানোর আকুতি করতে থাকে। কিন্তু জানোয়ারগুলোর কানে যেন সেসব আকুতি পৌঁছায় না।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সকাল সকাল খান ভিলায় যেন আমাবস্যা নেমে এসেছে। বৃষ্টিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নিঝুম খান, আবরাজ খান সবাই ভীষণ চিন্তিত। নিঝুম খান অনেকটা অসুস্থই হয়ে পড়েছেন মেয়ের চিন্তায়। তিনি বলতে থাকেন,”এতগুলো বছর পর আমার মেয়েটাকে ফিরে পেলাম। এখন কি তাকে আবার হারিয়ে ফেলব? ও হঠাৎ কোথায় চলে গেল আমাদের কাউকে কিছু না বলে। আজ তো আমাদের লন্ডনে যাওয়ার কথা ছিল। আর আমার মেয়েটাই নেই।”
আবরাজ খান বলেন,”তুমি চিন্তা করো না নিঝুম। আমি পুলিশকে ইনফর্ম করেছি। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
আনিকা খান নিঝুমকে সামলানোর চেষ্টা করেন। ছবি বেগমও বিলাপ করে চলেছেন। ইতিমধ্যে আদৃতা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসা মাত্রই ছবি বেগম বলে ওঠেন,”নিশ্চয়ই এই আদৃতাই আমার বৃষ্টি দিদিভাইয়ের সাথে কিছু করেছে। ও তো ওকে সহ্যই করতে পারে না।”
নির্ঝর প্রতিবাদ করে বলে,”এসব তুমি কি বলছ গ্রানি? আদৃতা কেন এমন করবে। ও এমন মেয়েই নয়।”
আবরাজও বলেন,”হ্যাঁ, আমি আদৃতাকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছি। হতে পারে ও বৃষ্টিকে মেনে নিতে পারছে না কিন্তু বৃষ্টির ক্ষতি করার মতো নিম্ন মানসিকতা ওর নেই।”
আদৃতাও ন্যাকাকান্না করে বলে,”তোমাদের আসল মেয়ে আসার পর থেকে তো তোমরা আমায় পর করে দিয়েছ। তাই সবকিছুতে আমারই দোষ দেখতে পাও। দেখো গিয়ে ঐ মেয়েই আবার না নিজের কোন প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে। এসব গ্রামের মেয়ের কোন ভরসা আছে নাকি। কি পরিবেশে যে বড় হয়েছে।”
এমন সময় হঠাৎ করে সায়ন এসে বলে,”কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা জাজ করার আগে একটু অপেক্ষা তো করো আদৃতা।”
আবরাজ বলে ওঠেন,”তুমি!”
সায়নের পেছন থেকে বৃষ্টি বেরিয়ে এসে বলে,”আপনার ষড়যন্ত্র সফল হয়নি আদৃতা আপু। আমি একদম সুস্থ স্বাভাবিক আছি।।আর এবার সবাই আপনার সব ষড়যন্ত্র জানতে পারবে।”
to be continue…….
#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_44
#ইয়াসমিন_খন্দকার
আদৃতা বৃষ্টিকে আসতে দেখে হতবাক হয়ে যায়। সাথে ভয়ে একপ্রকার তদস্থ হয়ে যায়। এদিকে নিঝুম নিজের মেয়েকে সহি সালামত ফিরে আসতে দেখে ভীষণ খুশি হন। তিনি দৌড়ে গিয়ে বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরে বলেন,”তুমি ঠিক আছ তো? কোথায় চলে গিয়েছিলে আমাদের কাউকে কিছু না বলে।”
বৃষ্টিও নিজের মার বুকে মাথা দিয়ে বলে,”এতদিন পর তোমাদের সবাইকে আমি ফিরে পেয়েছি মা,এখন আর তোমাদের ছেড়ে কোথায় যাব?”
আদৃতা বুঝতে পারে এখানে থাকলে সে বিপদে পড়বে। তাই চুপ করে পালানোর চেষ্টা করে। এমন সময় সায়ন তার পথ আটকে বলে,”পালানোর চেষ্টা করে কোন লাভ নেই আদৃতা৷ পুলিশ পুরো বাড়িটাকে ঘিরে আছে। তোমার আজ আর পালানোর কোন পথ নেই।”
আবরাজ খান অবাক স্বরে বলেন,”এসব কি বলছ তুমি সায়ন? পুলিশ কেন এসেছে?”
বৃষ্টি বলে ওঠে,”আমি তোমাকে সব বলছি বাবা। গতকাল রাতে আদৃতা আপু আমাকে গ্রামে আম্মা-আব্বার সাথে দেখা করানোর কথা বলে একটা নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে মাঝরাস্তায় একা চলে আসে। তারপর কিছু গুণ্ডাকে দিয়ে আমাকে ধ**ণ আর মে*রে ফেলানোর চেষ্টা করে..ভাগ্যিস সায়ন বাবু সঠিক সময় চলে এসেছিল নাহলে..”
বলেই কেঁদে ওঠে বৃষ্টি। সায়ন বলে,”আমি কিছু জরুরি কাজে গতকাল রাতে শর্টকার্ট নিয়ে ঐ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম৷ তাই বৃষ্টিকে ঐ অবস্থায় দেখে ওকে রক্ষা করি। ভাগ্য ভালো যে, আমার সাথে আমার আরো কয়েকজন বন্ধুও ছিল। যদি আমরা সময়মত না পৌঁছাতে পারতাম তাহলে..”
আদৃতার গলা শুকিয়ে আসে। ছবি বেগম বলে ওঠেন,”আমি সবাইকে আগেই বলেছিলাম এই মেয়েটা ডেঞ্জারাস, একে বাড়িতে রেখো না। দেখো, মিলল তো আমার কথা? শেষপর্যন্ত কিনা আমার বৃষ্টি দিদিভাইকে মে*রে ফেলতে চাইল এই মেয়ে! একে এক্ষুনি পুলিশে দেও তোমরা। এর দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে।”
আদৃতা উপায়ন্তর না দেখে নিঝুমের কাছে গিয়ে বলে,”মম, তুমি তো আমায় নিজের মেয়ের মতোই মানুষ করেছ তাইনা? মায়েরা তো নিজেদের মেয়ের সব অন্যায় ক্ষমা করে দেয়। আমি মানছি আমি ভুল করেছি কিন্তু..”
আদৃতা নিজের কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই নিঝুম তার গালে ঠাস করে থা*প্পড় বসিয়ে দেয়৷ আদৃতা হতবাক হয়ে যায়। নিঝুম বলেন,”তুমি যদি আমার নিজের মেয়েও হতে তাহলেও এত বড় অন্যায় করার পর আমি তোমায় ক্ষমা করতাম না। তোমার উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতাম। আর এখনো তাই করব। কেন করলে তুমি এমন আদৃতা? তোমার কেন এত রাগ বৃষ্টির প্রতি? আমরা তো সব সত্যটা জানার পরও তোমাকে নিজেদের মেয়ের মতোই এই বাড়িতে রেখেছিলাম। তুমি তোমার আসল মা-বাবার কাছে ফিরতে চাও নি জন্য আমরাও জোর করিনি। তোমার সব চাহিদা তো আমরা পূরণ করেছি। তাও তুমি এত নিচে নামলে।”
নির্ঝর বলে ওঠে,”তোকে আমি ছোটবেলা থেকে নিজের বোন ভেবেছি আজো তাই ভাবি। কিন্তু তুই যা করেছিস এরপর আর তোকে আপন ভাবা সম্ভব নয়। শেষপর্যন্ত তুই আমার বোনকে মার্ডার করতে চাইলি!”
আদৃতা আবরাজ খানের দিকে তাকায়। আবরাজ কিছু বলছিল না৷ আদৃতা জানে, আবরাজ তাকে অনেক বেশি ভালোবাসে৷ তাই একবার শেষচেষ্টা করতে আবরাজের কাছে গিয়ে বলে,”ড্যাড, তুমি অন্তত কিছু বলো।”
আবরাজ খান বলে ওঠেন,”পুলিশ কোথায় নির্ঝর? ওদের ভেতরে আসতে বলো। এই খু**নি মেয়েটাকে গ্রেফতার করতে বলো। আর নিশ্চিত করতে বলো যেন এর উপযুক্ত শাস্তি হয়।”
“ড্যাড, তুমিও!”
“চুপ করো। আমি তোমার মতো খু*নির মুখে ড্যাড ডাক শুনতে চাই না। আমি শুধু নির্ঝর আর বৃষ্টির বাবা। তুমি কেউ না আমাদের, কেউ না।”
আদৃতা কাঁদতে থাকে। একটু পরই পুলিশ এসে টানতে টানতে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আদৃতা অনেক অনুনয় করেও কোন লাভ পায়না। অবশেষে সে নিজের পাপের জন্য উপযুক্ত শাস্তি পায়। আদৃতাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এদিকে আবরাজ খান ভেঙে পড়েন। তিনি সোফায় বসে পড়েন। নিঝুম তার পাশে এসে বসতেই তিনি বলেন,”দোষটা বোধহয় আমারই তাইনা নিঝুম? আমি অতিরিক্ত ভালোবাসা দিয়ে আদৃতার এই অধঃপতন ডেকে এনেছি। হতে পারে আমরা ওকে জন্ম দেইনি কিন্তু দীর্ঘ ২০ টা বছর তো ও আমাদেরই মেয়ে হিসেবে ছিল। আমরা বোধহয় ব্যর্থ নিঝুম।”
ছবি বেগম বলেন,”থাক, এসব নিয়ে আর কষ্ট পেতে হবে না তোমাদের। আল্লাহর লাখ লাখ শুকরিয়া যে বৃষ্টি দিদিভাই একদম ঠিক আছে। নাহ, আমি আর রিস্ক নিতে চাইনা৷ এবার তোমরা যত দ্রুত সম্ভব লন্ডনে ফিরে যাও। এখানে থাকলে না জানি আবার নতুন কোন বিপদ আসে।”
সায়ন বলে ওঠে,”আমাদের ফ্যামিলির সবাই আগামীকাল লন্ডনে ফিরে যাবে আঙ্কেল। আপনারা চাইলে আপনারাও আমাদের সাথে যেতে পারেন একই ফ্ল্যাটে।”
আবরাজ বলে ওঠেন,”বেশ, তাহলে কালই আমি, নিঝুম আর বৃষ্টি লন্ডনে ফিরে যাবো। নির্ঝর তুমি এদিকে সবাইকে সামলে নিও।”
নিঝুম খানও বলেন,”হ্যাঁ, বিশেষ করে আফিফার দিকে নজর রেখো। ওর এই অবস্থায় তোমাকে আরো বেশি দরকার। আমার নাতি-নাতনি যেই আসুক সুস্থভাবে যেন পৃথিবীতে আসে। আমরা আবার ওর ডেলিভারির সময় ছুটি ম্যানেজ করে সিলেটে ফেরার চেষ্টা করব।”
নির্ঝর বলে ওঠে,”তোমরা কোন চিন্তা করো না। আমি সবটা সামলে নেব।”
এদিকে বৃষ্টি কৃতজ্ঞতা ও মুগ্ধতার সাথে সায়নের দিকে তাকায়। মনে করতেই থাকে কিভাবে গতকাল রাতে এই ছেলেটা বীরত্ব দেখিয়ে তাকে বাঁচিয়েছে। একসময় সায়নও তাকায় বৃষ্টির দিকে। দুজনের চোখাচোখি হতেই লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয় বৃষ্টি। এ যেন নতুন এক শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। যেই লন্ডন শহরে আবরাজ ও নিঝুমের সম্পর্ক নতুন মোড় নিয়েছিল সেই লন্ডন শহরেই হয়তোবা তাদের মেয়ের জীবনেও নতুন মোড় আনতে চলেছে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আরিশা বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘন্টাই পড়ার টেবিলে সময় কাটাচ্ছে। বইয়ে মুখ গুজে পড়ে আছে একদম। তার পরীক্ষার আর একদম বেশি সময় বাকি নেই। তাই বাইরের পৃথিবীর সাথে তার যোগাযোগ একদম বন্ধ। এভাবে পড়তে পড়তেই কখন যে পড়ার টেবিলে আরিশা ঘুমিয়ে পড়ে সেটা নিজেই বুঝে উঠতে পারে না। রাত্রি তখন ২ টা, হঠাৎ করে এক ছায়ামূর্তি বেলকনি টপকে আরিশার রুমে চলে আসে। আরিশার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলে,”মেয়েটা মুখেই যত বড়বড় কথা কিন্তু এখনো ঠিকভাবে নিজের খেয়াল রাখতে শিখলো না।”
বলেই সে এগিয়ে এসে আরিশাকে কোলে তুলে নিলো। অতঃপর আস্তে করে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আরিশা ঘুমের ঘোরে কিছু টের পেলো না। আরিশার গায়ে চাদর জড়িয়ে দিয়ে তার কপালে একটা চুমু খেল। অতঃপর বলল,”কোন ব্যাপার না, তোমাকে সামলানোর জন্য আমি আছি তো। তুমি যতই আমাদের সম্পর্কটাকে অস্বীকার করো সেটা তো মিথ্যা হয়ে যাবে না। আমার আর তোমার দূরত্ব আর বেশিদিনের নয়। খুব শীঘ্রই আবার তোমার আর আমার পথ এক হয়ে যাবে। এবার তুমি নিজের ইচ্ছায় এবার আমায় কাছে টেনে নেবে।”
বলেই জাঈদ উঠে দাঁড়ায়। আরিশার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বলে,”তোমার শেষ গন্তব্য আমিই। তুমি যতই আমার থেকে দূরে থাকো শেষ অব্দি তোমার জীবনে শুধু আমিই থাকবো। আমাকে তুমি দূরে ঠেলতে পারবে না আরিশা। অপেক্ষা করো, তোমার পরীক্ষাটা মিটে যাক। তারপরই তোমাকে আমি নিজের করার ব্যবস্থা করছি৷ ততদিন এই লুকোচুরি খেলা চলুক।”
to be continue…….