অশ্রুজলে বোনা বিয়ে ২ পর্ব-৫০ এবং শেষ পর্ব

0
81

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_50(Last)
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আরিশা জাঈদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে৷ তার চোখে বিন্দু বিন্দু জল৷ জাঈদ আরিশার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে,”কাঁদছ কেন আরিশা? তুমি জানো না, তোমার চোখের জল আমার সহ্য হয়না।”

আরিশা অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে,”আমার যে আজকাল নিজেকে ভীষণ ব্যর্থ মনে হয় জাঈদ। আমি না নিজে মা হতে পেরেছি আর না তোমায় বাবা হওয়ার সৌভাগ্য দিতে পেরেছি। আমার সাথে থেকে তুমি শুধু শুধু নিজের জীবন নষ্ট করছ। আমি তো তোমায় বলেছি যে..”

জাঈদ আরিশাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”ব্যস,এসব কথা আর মাথায় আনবে না। আমার কাছে শুধু তুমি একাই যথেষ্ট। আর কিচ্ছু চাইনা আমার।”

আরিশা এত দুঃখের মাঝেও জাঈদের এই কথায় যেন মনে অনেক শক্তি খুঁজে পায়। এরইমধ্যে জাঈদের ফোনে হঠাৎ করে একটা কল আসে। জাঈদ উঠে দাঁড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করে। অতঃপর কিছু সময় ফোনে কথা বলে আরিশার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি থাকো, আমায় একটা জরুরি কাজে বেরোতে হবে।”

বলেই জাঈদ বেরিয়ে যায়। আরিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ইদানীং জাঈদের ব্যস্ততা অনেক বেড়েছে। বাড়বে না-ই বা কেন?

সময়ের পরিক্রমায় যে ৩ বছর পেরিয়ে গেছে। এই ৩ বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। আরিশার দাদি সিতারা বেগম ইন্তেকাল করেছেন, ছবি বেগমও অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। আলমগীর খন্দকার ভাবছেন তিনিও এবার রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে বাকি জীবনটা পরিবারের সাথে কাটাবেন। তাই তো নিজের জামাই জাঈদকে জোরেশোরে নামিয়ে দিয়েছেন রাজনীতির ময়দানে।আগামী বছর তার দল থেকে জাঈদের নির্বাচনে লড়ার কথা।

এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে আরিশার ফোন বেজে ওঠে। আরিশা ফোনটা রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে আফিফা বলে ওঠে,”কি খবর বোনু? তুই কেমন আছিস?”

“ভালো,আপ্পি। তুমি কেমন আছ?”

“আমিও ভালো আছি। যাইহোক, যেটা বলার জন্য তোকে ফোন করা৷ তুই চটজলদি আমাদের বাসায় চলে আয় তো।”

“কেন আপ্পি? কোন বিশেষ কিছু আছে?”

“এখানে আয়। তারপর সবকিছু জানতে পারবি।”

“আচ্ছা।”

বলেই আরিশা ফোনটা রেখে দেয়৷ তারপর সুন্দর একটা শাড়ি পড়ে তৈরি হয়ে নেয়৷ রাহেলা খন্দকার আরিশার রুমে এসে বলেন,”তুমি কি কোথাও যাচ্ছ মা?”

আরিশা বলে,”হ্যাঁ, মা। আপ্পি একটু ওদের বাসায় যেতে বলল৷ কি যেন দরকার আছে।”

“ওহ। ঠিক আছে, সাবধানে যেও।”

আরিশা মাথা নাড়িয়ে নিজের মাকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে আসে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আরিশা ধীর পায়ে খন্দকার বাড়িতে প্রবেশ করে। আরিশাকে আসতে দেখেই আফিফা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমার বোনুটা এসে গেছে! কতদিন পর তোকে দেখলাম।”

আরিশাও আফিফাকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়৷ দীর্ঘ ১ মাস পর তারা সামনাসামনি দেখা করল। আফিফা এবার একটু অভিমানী সুরে বলল,”তুই তো নিজের পরিবার পেয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিস যে আমাদের কথা মনেই পড়ে না।”

“না, আপ্পি। তেমন না আসলে..”

“থাক, হয়েছে। আর অজুহাত দিতে হবে না। যাইহোক, যে জন্য আজ তোকে ডাকা। আজ আমার শ্বশুর, শাশুড়ী,ননদ, তার স্বামী ও মেয়ে লন্ডন থেকে ফিরে এসেছে। শেষবার তো সেই আরহামের জন্মের সময় এসেছিল। তারপর এই আজ এলো। তাই আমি চাইছিলাম সবাই মিলে একসাথে মিলে আনন্দ করি।”

এমন সময় একটা ছেলে গুটি গুটি পায়ে ছুটে আসে। আরিশাকে দেখামাত্রই খালুমনি বলে তার কাছে আসে। আরিশা ছোট্ট আরহামকে কোলে তুলে নেয়। আফিফার ছেলে আরহাম, আমাদের সেই ছোট্ট অতিথি আজ ৩ বছরের শিশু। ভীষণ দুষ্টুমিষ্টি একটা বাচ্চা। সে আরিশা অন্ত প্রাণ। আরিশাকে ভীষণ ভালোবাসে। তার কোলে একবার উঠলে আর নামতেই চায় না। এতদিন পর নিজের খালামনিকে পেয়ে সে ভীষণ খুশি।

আরহাম আদুরে স্বরে বলে,”আমার খালামনি আমার দন্য(জন্য) কি এনেচে?”

আরিশা একটা চকলেট বের করে আরহামের হাতে দিয়ে বলে,”খালামনি চকলেট এনেছে। আরহাম বাবু চকলেট খাবে তো নাকি?”

আরহাম মাথা নাড়ায়। চকলেটটা হাতে নিয়ে খুব খুশি হয়। এমন সময় বৃষ্টি এগিয়ে আসে। তার পাশে তার স্বামী সায়নও দাঁড়িয়ে আছে। আড়াই বছর আগে তাদের বিয়ে হয়েছে। মূলত পারিবারিক ভাবেই তাদের বিয়েটা দেয়া হয়েছিল। বৃষ্টির কোলে তাদের এক বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে সায়রাও আছে। বৃষ্টির কোলে ঘুমন্ত সায়রাকে দেখে কেন জানি আরিশার বুকটা আবার হাহাকার করে ওঠে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। যখনই আরিশা কোন বাচ্চাকে তার মায়ের কোলে দেখে তখনই তার এমন অনুভূতি হয়। নিজেকে ভীষণ একা একা লাগে। কারণ সে যে মাতৃত্বের এই সুখ থেকে বঞ্চিত। আরিশার এই মনোভাব বুঝতে পারে আফিফা৷ তাই তো আরিশাকে খুশি করার জন্য বলে,”জানিস বোনু, আরহাম না একদম তোর মতোই দুষ্টু হয়েছে। ছোটবেলায় যেভাবে তুই দুষ্টুমি করে আমায় বিরক্তি করতি আরহামও ঠিক সেইরকমই।”

আরিশা হালকা হেসে বলে,”দেখতে হবে না ও কার বোনঝি।”

বৃষ্টি ও সায়ন এগিয়ে আসে আরিশার দিকে। সায়নকে দেখে আরিশা একটু অস্বস্তি বোধ করে তাদের অতীতের ব্যাপারগুলো নিয়ে। সায়নের দিক থেকেও ব্যাপারটা একইরকম। কিন্তু দুজনেই যেহেতু এখন নিজেদের আলাদা সংসার গড়ে তুলেছে তাই হালকা হেসে একে অপরকে স্বাগত জানাল। বৃষ্টি আরিশার কাছে এসে বলল,”কেমন আছ আরিশা আপু? আজ কতদিন পর তোমায় দেখলাম!”

“ভালো আছি, তুমি কেমন আছ?”

“আমিও ভালো।”

“এটা বুঝি তোমার মেয়ে?”

“হ্যাঁ, আমার মেয়ে সায়রা। জানো, ও আমায় ভীষণ বিরক্ত করে। সবসময় শুধু কাদে। আমি তো একা ওকে সামলাতেই পারি না। শুনেছি, তুমি অনেক ভালো বাচ্চা সামলাতে পারো। ও ঘুম থেকে উঠলে একটু আমায় সাহায্য করিও তো।”

আরিশা বলে,”ঠিক আছে।”

আফিফা বলে ওঠে,”হুম, সামনে কিন্তু তোর দায়িত্ব আরো বাড়তে চলেছে বোনু?”

“কেন?”

“কারণ তোর আরো একটা বোনঝি বা বোনপো পৃথিবীতে আসতে চলেছে।”

আরিশা খুশি হয়ে বলে,”আপ্পি তারমানে..”

“হুম,আমি আবারো প্রেগন্যান্ট।”

আরিশা আফিফাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমি ভীষণ খুশি।”

তবে তার গলায় একটা বেদনার সুরও ছিল। আফিফা তা টের পেয়ে বলে,”একদম মন খারাপ করবি না। আমার দুই সন্তানের উপরই তোর সবসময় সমান অধিকার থাকবে। আমি ওদের জন্মদাত্রী মা হলে তুইও ওদের দ্বিতীয় মা হয়ে থাকবি। বুঝলি?”

আরিশা মাথা নাড়ায়। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক করতে সায়ন বলে,”চলুন, অনেকদিন পর সবাই একত্রিত হয়েছি একটু আনন্দ করি।”

এমন সময় হঠাৎ জাঈদ সেখানে এসে বলে,”আনন্দ তো করতেই হবে। আজ যে আমাদের একজন নতুন সদস্যকে স্বাগত জানাতে হবে।”

জাঈদের কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা। যা দেখে আরিশা অবাক হয়ে বলে,”মানে?”

জাঈদ এগিয়ে এসে বাচ্চাটিকে আরিশাকে দেখিয়ে বলে,”ওর নাম আরুশি, বয়স ১ বছর। জন্মের পর থেকেই অনাথ আশ্রমে মানুষ। আমাদের যেমন সন্তানের দরকার তেমনি ওরও একটা অভিভাবকের দরকার। তাই আমি ওকে দত্তক নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

আরিশার চোখে অশ্রু চলে আসে। জাঈদ বলে,”আর তোমায় মাতৃত্বের অভাব বোধ করতে হবে না। এখন থেকে ঐ আমাদের মেয়ে।”

আফিফা আরিশার কোল থেকে আব্রাহামকে নেয়। আরিশা ছোট্ট আরুশিকে কোলে নিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে বলে,”আমার মেয়ে!”

এদিকে আমাদের ছোট্ট আব্রাহাম একটু জেলাস হয়ে যা। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেন বলছে,”ধুর! আমার খালামনির ভালোবাসায় ভাগ বসাতে চলে এসেছে!”

এরমধ্যে নিঝুম খান, আবরাজ খান, আবির খান, আনিকা খান ও নির্ঝর সবাই সেখানে চলে আসেন। নিঝুম খান সবাইকে এভাবে আনন্দিত দেখে আবরাজ খানকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেন,”মনে আছে, আমাদের জীবন একদিন এভাবেই শুরু হয়েছিল। কত কষ্টের পর আমরা এক হয়েছিলাম। তারপর আমাদের ছেলে-মেয়ে হলো। ওদের জীবনেও নানা চড়াই-উতরাই এলো। আমাদের মেয়েকে কতদিন পর আমরা কাছে পেলাম। এখন আবার আমাদের নাতি-নাতনিও চলে এসেছে।”

আবরাজ খান বলেন,”ঠিক বলেছ তুমি। আমি শুধু এটাই চাই,আমাদের নাতি-নাতনীদের জীবন অনেক বেশি সুন্দর হোক। আনন্দে ভড়ে যাক।”

আরিশা ও জাঈদ তাদের দত্তক নেয়া মেয়ে আরুশিকে কোলে নিয়ে আনন্দে ব্যস্ত। আরিশা বলে,”আমি কখনো ওকে মায়ের অভাব বুঝতে দেব না। আমি ওর মা হয়ে উঠব। শুধু আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া, ওর ভাগ্যটা আমার মতো না হোক। আমি নিজের আসল মা-বাবা ছাড়া বড় হয়ে যত কষ্ট পেয়েছি তা যেন ও না পায়। ওর জীবন যেন সুখে ভড়ে ওঠে।”

The End
[আজ আরেকটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। শেষদিনে পুরো গল্পটি সম্পর্কে আপনার মতামত চাই। খুব শীঘ্রই দেখা হচ্ছে নতুন কোন অধ্যায় নিয়ে। আশা করি সামনের অধ্যায়ের আপনাদের পাশে পাবো।]