অশ্রুজলে বোনা বিয়ে ২ পর্ব-০২

0
56

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#2nd_Part
#ইয়াসমিন_খন্দকার

নির্ঝর আফিফার রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ থেকেই আফিফাকে দেখছিল। আফিফার পুরো মনযোগ তার পড়ার টেবিলে। এই অবস্থায় তাকে দেখে ভীষণ স্নিগ্ধ ও মায়াবী লাগছিল। সাদা রঙের সালোয়ার-কামিজটা যেন তার স্নিগ্ধতা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল৷ নির্ঝর কিছু সময় চুপ থেকে অতঃপর বলে ওঠে,”আসব?”

আফিফা থমকে যায়। এক ভারী পুরুষালি কন্ঠ কর্ণগোচর হতেই আচমকা তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। চোখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে এক বলিষ্ঠ যুবককে দেখে স্মিত হাসে সে। ৫ বছর আগে দেখা চেহারাটা এখনো মনে আছে তার। যদিও মাঝে মাঝে ভিডিও কলেও কথা হয়েছিল। আফিফা বসা অবস্থাতেই বলে,”ভাইয়া, আপনি৷ জ্বি, আসুন।”

নির্ঝর আফিফার কক্ষে প্রবেশ করে। আফিফা বইপত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলে,”কেমন আছেন আপনি? আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো?”

“জ্বি, ভালো আছি। না,তেমন কোন অসুবিধাও হয়নি। তোমার কি খবর বলো? পড়াশোনা কেমন চলছে?”

“এই তো আলহামদুলিল্লাহ।”

কিছুক্ষণ পীনপীতন নীরবতা বিরাজ করে তাদের মাঝে। নির্ঝর সেই নীরবতা ভেঙে আফিফার দিকে একটি গিফট বক্স বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”এটা তোমার জন্যে।”

আফিফা অবাক হয় সাথে এক অদ্ভুত ভালো লাগাও কাজ করছিল তার মাঝে। গিফট বক্সটা হাতে নিয়ে সে বলে,”এসবের কোন দরকার ছিল না, তবে ধন্যবাদ আপনাকে।”

নির্ঝর হালকা হেসে বলে,”বাড়ির সবার জন্যই কিছু না কিছু এনেছি তাই ভাবলাম তোমার জন্যেও কিছু আনি। গিফটটা খুলে দেখো পছন্দ হয়েছে কিনা।”

নির্ঝরের কথায় আফিফা গিফটটা খুলে দেখে তার ভেতরে একটা লিমিটেড এডিশন বই। এটা দেখে তো আফিফার খুশির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। নির্ঝর বলে ওঠে,”পছন্দ হয়েছে তো?”

“ভীষণ। এই বইটা তো জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির লেটেস্ট রিসার্চ পেপার। অনেক কস্টলি মনে হয়?”

“খুব একটা না৷ সবার জন্য বিভিন্ন গিফট কেনার সময় মনে হলো বাড়ির পড়ুয়া মেয়েটার জন্য এমন গিফটই বেস্ট হবে৷ তাই নিয়ে এলাম।”

“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সত্যি গিফটা অনেক সুন্দর।”

নির্ঝর আফিফার খুশি দেখে নিজেও ভীষণ আনন্দিত হয়। অতঃপর বলে,”বেশ, তাহলে আমি আসি। তুমি পড়ছিলে নিশ্চয়ই, আর বেশি ডিস্টার্ব না করি।”

“না,না তেমন কিছু নয়। আসলে কাল একটা আইটেম জমা দেয়ার লাস্ট ডেইট তো তাই একটু প্যারায় আছি।”

“বুঝেছি। থাকো তাহলে।”

বলেই নির্ঝর একটা ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায়। আফিফা নির্ঝরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে তার দেয়া বইটা যত্ন করে নিজের বুকশেলফের মধ্যে সাজিয়ে রেখে আবারো পড়ার টেবিলে বসে পড়ে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
সকাল সকাল খান ভিলায় অদ্ভুত ব্যস্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। খান বাড়ির সবাই মূলত সকালেই তাদের কর্মক্ষেত্রে বেড়িয়ে যায়। আনিকা খান তাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে সবাইকে খাবার পরিবেশন করছেন। দুই মেয়েকে কলেজে পাঠিয়ে আবার তাকে তার চেম্বারে যেতে হবে।

আরিশা ডাইনিং টেবিলে এসে ঠিক নির্ঝরের পাশের সিটটায় বসে পড়ে। আফিফা বসে পড়ে আবরাজের মুখোমুখি হয়ে। খেতে খেতে নির্ঝর বেশ কয়েকবার আফিফার দিকে তাকাচ্ছিল। আফিফা ব্যাপারটা খেয়াল করে মুচকি মুচকি হাসছিল। অন্যদিকে আরিশার নজরে এটা আসে না। সে তো খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আরচোখে কেবল নির্ঝরকেই দেখে যাচ্ছিল। তবে নির্ঝরের প্রতি আরিশার এই আগ্রহটা ঠিকই খেয়াল করেন ছবি বেগম। ব্যাপারটা তার কাছে খুব একটা ভালো লাগে না। কারণ তিনি ভেবে রেখেছেন তার বড় নাতনী আফিফার সাথেই নির্ঝরের বিয়ে দেবেন। এজন্য তিনি আরিশার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”এতো চারিদিকে নজর না দিয়ে খাওয়ায় মনযোগ দে। কলেজের সময় তো হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল আছে?”

আরিশা মুখ বাকিয়ে খাওয়ায় মনযোগ দিল। আনিকা খানও সবাইকে খাবার পরিবেশন করে নিজেও খেতে বসে পড়লেন। আবির খান কিছুটা অসুস্থ বোধ করায় তিনি ঘরেই নাস্তা করে নিয়েছেন। আনিকা খান খেতে বসে নির্ঝরের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”তোমার মা-বাবা, বোন ওদের কি অবস্থা? তারা কি দেশে ফিরবে না এখন?”

নির্ঝর খেতে খেতেই উত্তর দেয়,”আসলে মম-ড্যাড দুজনেই তাদের পেশাজীবন নিয়ে অনেক ব্যস্ত। আর আদৃতারও এখন ফাইনাল এক্সাম চলছে তাই ওরা একটু ব্যস্ত।”

ছবি বেগম আফসোস করে বলেন,”আদৃতা দিদিভাই তো এদেশে বেশি একটা আসতেও চায়না। যে কয়বার ওকে দেখেছি শুধু ভিডিও কলে। তুমি তো তবু মাঝে মাঝে আমাদের সাথে দেখা করে দাও কিন্তু আদৃতা দিদিভাইকে সামনাসামনি সেই কোন ছোটবেলায় দেখেছি।”

নির্ঝর হেসে বলে,”তুমি চিন্তা করো না গ্রানি এরপর মম, ড্যাড যখন দেশে আসবে তখন আদৃতাকে নিয়েই আসবে বলেছে। তখন দুচোখ ভড়ে দেখো।”

এদিকে আরিশা ছোটবেলার কিছু ঘটনা মনে করে মনে মনে বলে,”উফ! আদৃতা আপ্পি যা নাক উঁচু মেয়ে! আমার তো এখনো মনে আছে আমাদেরও ছোটবেলার একটা ঘটনা কিভাবে সে সিলেটে ঘুরতে গিয়ে গায়ে মাটি লাগায় কান্না করে ভাসিয়ে দিচ্ছিল। এছাড়া আমাদের দেশের ব্যাপারে কত বাজে কথা বলেছিল! সেই মেয়ে আবার সিলেটে এলে যে কি কাণ্ড করবে আল্লাহ মালুম!”

সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই আফিফা আরিশার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”চল বোনু আমরা গাড়িতে করে যাই। আমার মেডিকেলে যাওয়ার পথেই তো তোর কলেজ। আমি নাহয় তোকে ড্রপ করে দেব।”

আরিশা সম্মতি জানিয়ে বলে,”আচ্ছা, আপ্পি। চলো যাই।”

আরিশা ও আফিফা একসাথে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। নির্ঝর খাওয়া শেষ করলে আনিকা খান তাকে বলেন,”তাহলে তুমি নিজের রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও। আমায় এখন আবার বেরোতে হবে তো!”

“কাল থেকে তো বিশ্রামই নিচ্ছি। আজ নাহয় একটু চারপাশটা ঘুরে আছি।”

“কিন্তু তুমি তো সিলেট শহরে তেমন কিছু চেনো না।”

“কোন ব্যাপার না কাকি।। আমি এরকম কত অজানা দেশ-বিদেশে ঘুরে বেরিয়েছি। তুমি এই নিয়ে চিন্তা করো না।”

“ঠিক আছে, তবে সাবধানে যেও।”

~~~~~~~~~~~~~
আরিশা ও আফিফা গাড়িতে করে একসাথে গল্প করতে করতে যাচ্ছিল। বলতে গেলে আরিশাই বকবক করছিল আর আফিফা ভালো শ্রোতার মতো তার কথা শুনছিল। হঠাৎ করেই গাড়ি জোরে ব্রেক কশলে তারা দুজনেই হচকচিয়ে যায়। আফিফা বলে,”কি হলো ড্রাইভার চাচা?”

“কি জানি, বুঝতে পারছি না। মনে হয় কোন সমস্যা হয়েছে। একটু নেমে দেখতে হবে।”

বলেই তিনি গাড়ি থেকে নেমে চেক করতে থাকেন। আরিশা ও আফিফাও কিছু সময় পর গাড়ি থেকে নামে। এরইমধ্যে হঠাৎ করে বাইকে করে মাথায় হেলমেট পড়ে কেউ একজন তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার লুকটা ছিল ভীষণ অদ্ভুত, পেশিবহুল ট্যাটু করা হাতটা দৃশ্যমান হচ্ছিল। তবে একটা গাড়ি না, ধীরে ধীরে ৪-৫ টা এমন গাড়ি এসে থামে। আফিফা কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। অতঃপর সবার সামনের বাইকের যুবকটি নিজের হেলমেট খুলে ফেলে। তাকে দেখেই আফিফা কিছুটা ক্রোধিত স্বরে বলে,”আপনি!”

আরিশা ভ্রু কুঁচকে বলে,”এটা জাঈদ শেখ না? এখানকার কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর শেখের ছেলে! কিন্তু এ এখানে কি করছে?”

জাঈদ আফিফার দিকে তাকিয়ে একটা ডেভিল স্মাইল দিয়ে বলে,”কি ব্যাপার সুন্দরী? সকাল সকাল এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে বুঝি?”

আফিফা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”আমি এখানে কোন সিনক্রিয়েট চাই না। সরে যাও আমাদের সামনে থেকে।”

“উফ! এত রেগে যাচ্ছ কেন জান্স। রেগে গেলে না তোমায় আরো সুন্দর লাগে জানো..”

বলে যেই না আফিফার দিকে হাত বাড়াতে যাবে এমন সময় আরিশা তার হাতটা ধরে বলে,”কাউন্সিলের ছেলে হয়ে রাস্তায় এমন মস্তানি করতে লজ্জা করছে না?”

জাঈদ আরিশার দিকে তাকিয়ে একটা বিদঘুটে হাসি দিয়ে বলে,”আরে! আমার হবু শালিকা যে! তোমারও দেখছি তেজ কম না। অবশ্য কার বোন দেখতে হবে তো।”

আরিশা রেগে বলে,”আমার আপ্পিকে ডিস্টার্ব করবে না। নাহলে কিন্তু আমি ছেড়ে কথা বলবো না।”

জাঈদ এবার বাইক থেকে নেমে আরিশার মুখোমুখি হয়ে বলে,”তাই বুঝি? তা কি করবে?”

জাঈদের পেছন পেছন আসা তার বন্ধুরাও একে একে বাইক থেকে নামে। তাদের একজন বলে,”তোর এই শালিকাকে আমার খুব পছন্দ হয়ে। একে আমার হাতে তুলে দে।”

জাঈদ আরিশার হাত শক্ত করে ধরে কিছু বলবে তার আগেই নির্ঝর ছুটে এসে জোরে একটা লাথি মারে জাঈদের পেটে। যার ফলে সে কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ে।

to be continue…….