অশ্রুজলে বোনা বিয়ে ২ পর্ব-১৫+১৬+১৭

0
73

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_15
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আরিশা এগিয়ে চলেছে অজানা গন্তব্যের দিকে। তার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু পড়ছে৷ নিজেকে নিয়ে বড্ড বিতৃষ্ণায় ভুগছে অসহায় মেয়েটি। মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে যে তার জীবন এতটা বদলে যাবে সেটা আরিশা কল্পনাও করতে পারে নি। আরিশা ভাবছিল সে আর নিজের এই জীবন রেখে কি লাভ পাবে? যাদেরকে সে এতদিন ধরে নিজের পরিবার ভেবে এসেছে তারা কেউ তার আপন নয়! তার পুরো জীবনটাই মিথ্যা। বিয়েও হলো এমন একজনের সাথে যে শুধু তার সাথে প্রতিশোধ নিতে চায়৷ আরিশা একটা রাস্তার পাশে একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়ল। অতঃপর নিজের ব্যর্থ জীবনের হিসাব মিলাতে লাগল।

এদিকে জাঈদ বাড়িতে ফিরে এসেই নিজের রুমে আরিশাকে না দেখে অস্থির হয়ে ওঠে। আরিশার নাম ধরে ডেকে সে সারা বাড়ি খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও আরিশার কোন খোঁজ পায় না৷ জামিলা শেখ এসব দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন,”এত চেচাচ্ছিস কেন? আমি একটু ঘুমিয়েছিলাম তোর জন্য আমার কাচা ঘুম ভেঙে গেল।”

জাঈদ হাফাতে হাফাতে বলে,”আরিশা কোথায় আম্মু? ”

জামিলা শেখ নাটক করে বলেন,”ওই মেয়েটা কোথায় সেটা আমি কি ভাবে বলব? আমি কি সারাদিন ওর খোঁজ করতে বসে থাকি নাকি? কেন, ও ঘরে নেই?”

“না, আমি একটু বাইরে গেছিলাম বাড়িতে ফিরে দেখি ও রুমে নেই। তারপর পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। কিন্তু ওকে কোথাও খুঁজে পায়নি।”

“দেখ, নিজের বাপের বাড়িতে ফিরে গেছে হয়তো।”

“না, ও ওখানে যাবে না।”

“তাহলে আর কোথায় যাবে?”

জাঈদ কোন কথা না বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায়৷ এদিকে জামিলা শেখ জাঈদকে ডাক দিলেও সে সাড়া দেয় না। জামিলা শেখ বিরক্তির স্বরে বলে,”অনেক কষ্ট করে মেয়েটাকে তাড়াতে পেরেছি। আল্লাহ, তুমি দেখো, ঐ আপদটা যেন আর ফিরে না আসে!”

বলেই তিনি হতাশার শ্বাস ফেলেন।

———
জাঈদ নিজের বাইক বের করে রাস্তার মধ্যে উন্মাদের মতো বাইকটা চালাতে থাকে। তার কেন জানি হঠাৎ অনেক বেশিই চিন্তা হচ্ছে আরিশার জন্য? কালকের রাতের ঘটনার পর মেয়েটা কি ভুল কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল নাকি? জাঈদ আর ভাবতে পারে না। বাইকের স্পিড আরো বাড়াতে থাকে। সে নিশ্চিত আরিশা নিজের বাড়িতে ফিরে যায় নি? তাহলে কোথায় গেছে? মাথায় কিছু একটা খেলে যেতেই জাঈদ বাইকটা ঘুরিয়ে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যেতে থাকে

আরিশা ঠিক বাস স্ট্যান্ডেই বসে ছিল। অনেক রাত হয়ে গেছে। চারিপাশটা বেশ নিস্তব্ধ। সর্বশেষ বাস একটু পরেই ছাড়বে। আরিশা সেই বাসের টিকিট হাতে নিয়ে বসে আছে৷ কিন্তু বাসে ওঠার সাহস পাচ্ছে না। কারণ সে একটু আগেই দেখে এলো, বাসে শুধু ৪/৫ জন পুরুষ আছে। এই বাসটা সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেবে। এত রাতে এমন একটা বাসে এত জন পুরুষের সাথে উঠে যাওয়ার ভরসা সে পাচ্ছিল না। এদিকে বাসটা ছাড়ার সময় হয়ে এলো। বাসের হেলপার আরিশার উদ্দ্যেশ্যে বলল”কি ব্যাপার? আপনে উঠবেন না? না উঠলে কইয়া দেন, বাস ছাইড়া দিব এখন।”

আরিশা মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ বলে ওঠে,”দাঁড়ান আমি উঠব।”

বলেই সে বাসে উঠে বসে। কোনরকমে গুটিশুটি মেরে এককোনায় একটা সিটে বসে পড়ে। একটু পরই বাসটা স্টার্ট দেয়। আরিশা বুঝতে পারে কিছু শয়তানের লোলুপ দৃষ্টি ছিল তার দিকে। তাই সে ভয় পেয়ে হেলপারের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”ভাইয়া..বাসটা থামান প্লিজ..আমি নামব..”

হেলপার একটা বিশ্রী হাসি দিয়ে বলে,”তা বললে তো হবে না মামনী..বাসে উঠে যখন পড়েছ আজকের রাতের জন্য আমাদের মনোরঞ্জনটা করে দিয়ে যাও!”

হেলপারের কথা শুনে আরিশার অন্তরাত্মা কেপে ওঠে। সে আকুতি মিনতি করতে শুরু করে দেয়।

এদিকে জাঈদ বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছেই দেখতে পায় একটা পাস কিছু সময় আগেই ছাড়ল৷ তার মনে সন্দেহ জাগায় সে সবার শেষ বাসটিকে ফলো করতে লাগল।

বাসের মধ্যে আরিশার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল ভেতরে বসে থাকা চার-পাঁচজন নরপিশাচ৷ তাদের মধ্যে একজন তো আরিশার ওড়না ধরে টান দিল। আরিশা হাত দিয়ে নিজের লজ্জা ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। ততক্ষণে কিছু নোংরা হাতের স্পর্শে তার পুরো শরীর বিষিয়ে উঠছিল। আরিশা আর্তনাদ করতে থাকে। এরইমধ্যে একজন পুরষ তার ওড়না দিয়ে তার মুখটা বেধে বলে,”যত খুশি চিৎকার করার করে নাও কিন্তু কোন লাভ হবে না।”

বলেই তারা আরিশার উপর ঝাপিয়ে পড়তে লাগল। এমন সময় হঠাৎ করে বাসটা থেমে গেল। বাসটা থেমে যেতেই একজন বলে উঠল,”থামল কেন?
এরমধ্যেই জাঈদ বাইক থেকে নেমে দৌড়ে বাসের মধ্যে ওঠে। উঠেই সে একটু খুঁজতেই আরিশাকে করুণ অবস্থায় দেখতে পায়। সাথে সাথেই তার মাথা গরম হয়ে যায়। জাঈদ এগিয়ে এসে সকলের সাথে মারামারি করতে করতে বলে,”তোদের সাহস কি করে হয় ওকে স্পর্শ করার?”

কিন্তু এতজনের সাথে সে একা পেরে ওঠে না। অনেক মার খেতে থাকে। এমন সময় জাঈদের বন্ধুরাও সবাই বাইক নিয়ে উপস্থিত হয়। জাঈদ নিজে তাদের ফোন করে ডেকেছে। জাঈদের বন্ধুরা মিলে জাঈদকে সাহায্য করে। খুব দ্রুতই ঐ শয়তান গুলোকে পর্যুদস্ত করে তোলে। জাঈদ তো যেই লোকটা আরিশার মুখ বেঁধেছিল তার মুখে ঘুষি মারতে মারতে তাকে আধমরা করে ফেলে। তার বন্ধুরা মিলে অনেক কষ্টে তাকে সরিয়ে আনে।

সবকিছুর পর জাঈদের নজর যায় ভীত আরিশার দিকে। সে এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চায়,”ঠিক আছ তো তুমি?”

আরিশার গায়ে আঁচড়ের দাগ, সালোয়ারের কিছু অংশ ছিড়ে ফেলেছে হায়না গুলো। তাই তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল৷ আরিশার এই অস্বস্তি বুঝ পেরে জাঈদ নিজের জ্যাকেট খুলে আরিশাকে আবৃত করে আলতো করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”চিন্তা করো না৷ তুমি একদম ঠিক আছ।”

আরিশার হঠাৎ কি হয় সে বুঝতে পারে না। সে জাঈদকে জোরে একটা ধাক্কা দিতে নিজের থেকে সরিয়ে বলে,”দূরে সরে যান আপনি৷ কেন এসেছেন এখানে? আজ আপনার জন্য আমাকে এই দিন দেখতে হলো। আপনি আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলেন।”

“কিচ্ছু হয়নি তোমার! ওরা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারে নি।”

“ওরা পারে নি তো কি? আপনি তো কাল রাতে আমার যা ক্ষতি করার করেই দিয়েছেন। এখন আর আমার বাকি আছে কি? শুধু তো এই জীবনটাই বাকি আছে এটা নিয়ে নিন। তাহলেই তো আপনি শান্তি পাবেন, তাইনা? আপনার প্রতিশোধ তো তাহলেই পূর্ণতা পাবে। তো নিন,মারুন আমায়। এভাবে তিলে তিলে মারার থেকে একবারে শেষ করে দিন। শেষ করে দিন আমায়…”

বলেই আরিশা কাঁদতে থাকে। জাঈদের কি হয় সে বুঝতে পারে না। এই প্রথম বার তার নিজের কাজের জন্য খারাপ অনুভূতি হচ্ছিল৷ ইচ্ছা করছিল নিজেকে কঠিন শাস্তি দিতে। জাঈদ কাপা কাপা হাতে আরিশার কাধে হাত রেখে বলে,”ফিরে চলো আমার সাথে।”

“কোথথাও যাব না আমি আপনার সাথে। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিন। আমার জীবনটাকে যথেষ্ট নরক বানিয়েছেন আর না..আমি আর পারবো না। প্লিজ আমায় যেতে দিন..”

জাঈদ আরিশাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”তুমি যাই বলো আর তাই বলো, আমার হাত থেকে তোমার কোন মুক্তি নেই। তোমার ভাগ্য যেভাবেই হোক আমার সাথে জড়িয়ে গেছে। আর এই ভাগ্য এভাবে জড়িয়েই থাকে। তোমাকে আমি নিজের থেকে দূরে যেতে দেব না।”

আরিশা রাগে বলে ওঠে,”মগের মুল্লুক নাকি?”

“ধরে নাও তাই।”

“তাহলে আপনিও একটা কথা শুনে রাখুন। আপনি আমাকে এভাবে বেশিদিন আটকে রাখতে পারবে না। একদিন আমি আপনার থেকে এতোটা দূরে চলে যাব যে, আপনি চাইলেও আর আমাকে ফেরাতে পারবেন না!”

“আরিশা!”

to be continue…….

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_16
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আরিশাকে নিজের সাথে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসলো জাঈদ। আরিশা যদিও আসতে চায়নি কিন্তু জাঈদ একপ্রকার জোর করেই তাকে নিয়ে এসেছে৷ আরিশাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসতেই তাকে দেখতে পান জামিলা শেখ। তিনি এগিয়ে এসে জাঈদকে প্রশ্ন করেন,”তুই ওকে কোথায় পেলি?”

জাঈদ উত্তর দিলো,”যেখানেই পাই না কেন, ওকে আমি ফিরিয়ে এনেছি এটাই সবথেকে বড় কথা। ভাবছি এখন থেকে একটা লোককে ঠিক করে রাখতে হবে দিন রাত ২৪ ঘন্টা ওর উপর নজর রাখার জন্য।”

জামিলা শেখ ভীষণ বিরক্ত হয়ে যান জাঈদের কথা শুনে। কোথায় তিনি ভেবেছিলেন আপদ বিদায় হবে তা না, আপদ আরো ঘাড়ে চড়ে বসছে। জাঈদ আরিশার সামনে এসে বলে,”শোন, এরপর থেকে আর এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করবে না৷ দেখলে তো, আজ কি বিপদে পড়তে যাচ্ছিলে? যদি আমি সঠিক সময় না পৌঁছাতাম তো কি হতো? আর এমনিতেও তোমার যাওয়ার তো আর কোন যায়গাই নেই। এই বাড়িতেই নাহয় আশ্রিতা হয়ে থাকলে তুমি!”

জাঈদের বলা শেষ কথাটা শুনে আরিশা বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। জাঈদ সেটা দেখে বলে,”এভাবে তাকানোর কি আছে? তোমার মতো অনাথ মেয়েকে আশ্রিতা করে রাখছি সেটা কি ভালো লাগছে না? তোমাকে তো আফিফাদের বাড়িতেও আর কেউ আশ্রয় দিবে না। রাস্তায় গেলে কু-*কুর শিয়ালেরা ছিড়ে খাবে। তার থেকে তো এখানে থাকাই তোমার জন্য নিরাপদ।”

আরিশার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করল৷ কিন্তু সে কাঁদল না। এদিকে জামিলা শেখ জাঈদের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,”ওকে যদি তোমার আশ্রিতা করে রাখার ইচ্ছা হয় তো রাখতেই পারো, এমনিতেই আমাদের বাড়িতে অনেক কাজের লোক আছে। তাদের মতো নাহয় ও থাকল। কিন্তু একটা কথা আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, আমি বা তোমার বাবা কেউই ওকে এই বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিব না। আর তুমি তো জানোই, আমি নিজের বোনের মেয়ে সন্ধ্যার সাথে অনেক আগে থেকেই তোমার বিয়ে ঠিক করে রেখেছি। সন্ধ্যা আগামীকাল লন্ডন থেকে ফিরছে। আমি চাই না, সন্ধ্যা তোমার বিয়ের কথা জানুক। এই মেয়েকে আর এই বাড়িতে তোমার বউয়ের মর্যাদা দিয়ে রাখা যাবে না। আজ থেকে তোমাকে ওকে এই বাড়ির আশ্রিতা বলে পরিচয় দিতে হবে!”

জাঈদ আরিশার দিকে তাকায়। আরিশাকে দেখে ভাবলেশহীন লাগছিল। জাঈদের কেন জানি মাথায় জেদ চেপে বসে। এমনিতেই মেয়েটা পালিয়ে গিয়ে তার মেজাজটা গরম করে দিচ্ছিল অথচ এখন এত খুশি শোনার পর এমন ভাব করছে যে সে কিছু পরোয়াই করে না। জাঈদ ভীতি রেগে যাচ্ছিল আরিশাকে এমন শান্ত দেখে। তাই সে মনে মনে বলে,”নাহ, আমি তোমায় কোন দয়া দেখাবো না। এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে তুমি অনেক বড় ভুল করেছিলে৷ এবার তার শাস্তি পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।”

এমন ভাবনা থেকেই জাঈদ বলে ওঠে,”বেশ, আমি মেনে নিলাম তোমার কথা। আজ থেকে আরিশা এই বাড়ির আশ্রিতা হয়েই থাকবে। আমার স্ত্রী হয়ে নয়।”

আরিশা জাঈদের কথাটা শুনল। তার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু বাইরে থেকে যেন সে ঠিক ততোটাই শক্ত ছিল। কোনরকম কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সে যেমন নিশ্চুপ ছিল তেমনই থাকে। এদিকে জামিলা শেখ বলেন,”তাহলে ওকে তোমার ঘর থেকে বের করার ব্যবস্থা করো। আমি চাই না, সন্ধ্যা এসে এমন কোন দৃশ্য দেখুক যা ওর খারাপ লাগে। ওকে তুমি সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দাও। এমনিতেই এই বিয়ের ব্যাপারে বাইরের কেউ কিছু জানে না। তাই ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে তেমন কোন সমস্যা হবে না।”

জাঈদ আরিশার দিকে আবারো তাকালো। আরিশা এখনো ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়ে। রাগের মাথায় সে বলে দিলো,”বেশ!”

অতঃপর জাঈদ আরিশার দিকে ঝুঁকে বলে,”নিজের অন্যায়ের শাস্তি ভোগ করতে প্রস্তুত হও। আর দ্বিতীয় বার আমাদেরও বাড়ির বাইরে পা রাখার দুঃসাহসও দেখিও না। নাহলে তোমার আপ্পির জীবনে বিপদের কালো ছায়া নেমে আসবে।”

এতক্ষণে আফিফার বিপদের কথা শুনে আরিশার হুশ ফেরে। সে বলে ওঠে,”নাহ, আপনি আমার আপ্পির কোন ক্ষতি করবেন না। আমার সাথে যা খুশি করুন, আমার কোন অসুবিধা নেই৷ কিন্তু আমার আপ্পির কোন ক্ষতি করবেন না প্লিজ।”

“নিজের আপ্পির ভালো চাইলে আমার কথা মতো চলো।”

“বেশ, আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। আপনার সব কথা মেনে নেবো আমি।”

“গুড গার্ল। এখন যাও নিজের সব জিনিসপত্র নিয়ে সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে শিফট হও। আমার ঘরে আর থাকবে না তুমি।”

আরিশা চোখের জল মুছে এগিয়ে যায়।

★—★
আফিফা সবেমাত্র মেডিকেল থেকে বাড়িতে ফিরল। অনেক প্রেশার গেছে আজ তার উপর দিয়ে। এখন একটু আরাম বোধ করছে সে। আফিফা ধীরে ধীরে হাপ ছাড়ছিল। এমন সময় নির্ঝর এসে আরিশাকে বলে,”এসে গেছ তুমি?”

“হুম, এই মাত্র এলাম।”

“ওহ, তোমাকে একটা কথা জানানোর ছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সামনের আসে আমরা হানিমুনে ইউরোপে ঘুরতে যাব। তোমার পাসপোর্ট, ভিসার ব্যবস্থা করতে হবে সেজন্য৷ এখন থেকেই তৈরি হয়ে নাও।”

আফিফা বলে,”সামনের মানে যাওয়া সম্ভব না। আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে।”

নির্ঝর খানিক রেগে বলে,”ক্লাস ক্লাস ক্লাস! তোমায় দেখে কি মনে হয় জানো? এই দুনিয়ায় তুমি একাই মেডিকেল স্টুডেন্ট। সবকিছুতেই এত অজুহাত দাও কেন তুমি?”

“আমি সত্যি বলছি।”

“থাক, তোমায় আর কিছু বলতে হবে না। বেশ তুমি ক্লাসই করো। তোমায় কোথাও যেতে হবে না। আমি একাই যাব ইউরোপে ট্যুর দিতে।”

বলেই নির্ঝর রেগেমেগে রুম থেকে বের হয়। এদিকে আফিফা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নিজের বিছানায় বসে পড়ে সে। বিছানার ধারেই তার পড়ার টেবিল। সেই টেবিলেই তার আর আরিশার একত্রে একটা ছবি জ্বলজ্বল করছে। আরিশা সেই ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে বলে,”জানি না,আমার বোনটা এখন কেমন আছে। এই অবস্থায় কিনা আমি ঘুরতে যাব? কখনোই না। আমি ঠিক জানি আরিশার সাথে নিশ্চয়ই ঐ কুলাঙ্গারটা অনেক অন্যায় করছে। আমায় আরিশাকে ওর হাত থেকে উদ্ধার কর‍তেই হবে৷ সেদিন আমি আরিশার মুখ দেখেই অনেক কিছু আন্দাজ করেছি। এবার আমায় কোন পদক্ষেপ নিতে হবে। সরাসরি কিছু করা যাচ্ছে। যা করার করতে হবে লুকিয়ে। নিজের বোনকে ঐ নরক থেকে উদ্ধার না করে আমি কিছুতেই আনন্দ করতে পারব না।”

এদিকে নির্ঝর রুম থেকে বের হতেই আদৃতার মুখোমুখি হয়। নির্ঝরকে দেখেই আদৃতা বলে ওঠে,”কি হলো ব্রো? তোমায় দেখে এমন লাগছে কেন?”

“এমন মানে?”

“কেমন জানি আপসেট লাগছে। আমি খেয়াল করছি, বিয়ের পর থেকে তুমি কেমন যেন হয়ে গেছ! আগে তুমি কতোটা হাসিখুশি ছিলে। এখন আর তেমন নেই।”

“তেমন কিছু না। তুই ভুল ভাবছিস আদৃতা।”

“সে তুমি যাই বলো আমি বুঝতে পারছি ব্রো। এজন্যই তো আমি বলছিলাম তোমায় এই বিয়েটা না করতে। আমি তো আগেই বুঝেছিলাম এই বিয়েটা করে তুমি সুখী হবে না। যাইহোক, জানো আমার ফ্রেন্ড সন্ধ্যা কাল লন্ডন থেকে সিলেটে আসছে।”

“সন্ধ্যা? মানে তোর ঐ কোকড়ানো চুলের বান্ধবীটা?”

“হ্যাঁ, ওই। মনে আছে, ও তোমাকে পছন্দ করত? অনেক বার আকারে ইঙ্গিতে বোঝানোরও চেষ্টা করেছে। কিন্তু তুমি ওকে সেরকম পাত্তা দাও নি৷ এখন তো তুমি বিয়ে করে নিয়েছ। এখন শুনলাম, ও ওর কোন খালাত ভাইকে বিয়ে করবে। ওর ফ্যামিলি থেকে নাকি বিয়ের কথাবার্তা চলছে। ওর খালু নাকি সিলেটের বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি। আমার তো মনে হয়, ও সুখীই হবে। মাঝখান থেকে তুমি ঝামেলায় পড়লে!”

নির্ঝর রেগে বলে,”ফারদার আর আমার সামনে এমন কথা বলবি না একদম।”

বলেই সে রেগেমেগে চলে যায়। আদৃতা নির্ঝরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,”যতোই তুমি আমার উপর রাগ দেখাও, এটা আমি খুব ভালো করেই জানি যে ঐ টিপিক্যাল মেয়েটাকে বিয়ে করে তুমি কখনো খুশি হবে না, কখনোই না।”

to be continue…….

#অশ্রুজলে_বোনা_বিয়ে(সিজন ২)
#Part_17
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আরিশা জাঈদের বাড়ির সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে নিজের সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে আসে। ঘরটা ধুলায় পরিপূর্ণ। ঘরে প্রবেশ করতেই তার নাকে মুখে ধুলা এসে লাগে। আর সেজন্য সে হালকা কাশতে থাকে। আরিশা উপায়ন্তর না দেখে একটা ঝাড়ু এনে কোনরকমে ঘরটা ঝাড়ু দিয়ে থাকার উপযুক্ত করে তোলে। অতঃপর বিছানায় বসে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এই ঘরটা ভীষণই ছোট। তবে এখানেই এখন তাকে মানিয়ে নিতে হবে। নিজের জীবনের এই পরিবর্তন দেখে আরিশার নিজের অদৃষ্টের প্রতি ভীষণ করুণা হয়। কিছুদিন আগেও অব্দি চঞ্চল, হাসিখুশি মেয়েটার জীবন মাত্র ক’টা দিনের মধ্যেই কতোটা মলিন হয়ে গেল। যেই আরিশা একসময় সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখত আজ সে নিজেই হাসতে ভুলে গেছ। আরিশার চোখের কোণে অশ্রু জ্বলজ্বল করছিল। সে কোনরকমে অশ্রুটুকু মুছে নিয়ে স্বগতোক্তি করে বলে,”এই জীবন থেকে কি আমার মুক্তি নেই আল্লাহ? মৃত্যুও তো এর থেকে ভালো!”

এমন সময় হঠাৎ করে জামিলা শেখ আরিশার রুমে চলে আসে। তিনি এসেই দরজা লাগিয়ে দেন। আরিশা তাকে দেখামাত্রই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। অতঃপর কিছু বলতে যাবে তার আগেই জামিলা শেখ আরিশার সামনে এসে ঠাস করে তার গালে থা*প্পড় বসিয়ে দেন। আরিশা পুরো তাজ্জব বনে যায়। গালে হাত দিয়ে হতবাক স্বরে বলে,”আন্টি…”

“চুপ..একদম চুপ। আপদ একটা, তোকে না আমি এখান থেকে চলে যেতে বলেছিলাম তাহলে কেন আবার ফিরে এলি?”

আরিশা জামিলা শেখকে হঠাৎ এমন তুইতুকারি করতে দেখে বুঝতে পারে তার মধ্যে আরিশাকে নিয়ে কতোটা বিদ্বেষ লুকিয়ে আছে। কিন্তু আরিশাও তো আর চুপ থাকার মেয়ে নয়। তাই সেও প্রতিবাদের সুরে বলে,”আপনার ছেলেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমি নিজের ইচ্ছায় এখানে আসিনি। আর আমার গায়ে হাত তোলার কোন অধিকার আপনার নেই। নেহাতই আপনি আমার থেকে বয়সে বড় তাই আমি কিছু বললাম। অন্যথায় বুঝিয়ে দিতাম।”

“কি তোর এত বড় সাহস তুই আমাকে হুমকি দিচ্ছিস? এত সাহস কোথায় পাচ্ছিস তুই? কে দিচ্ছে তোকে এত সাহস?”

“সাহস কেউ কাউকে দেয় না। সাহস আদায় করে নিতে হয়৷ আপনারা যদি আমার চুপ থাকাকে আমার দূর্বলতা ভাবেন তো ভুল করবেন। নেহাতই আমি এখন একটু বেকায়দায় পড়েছি তাই চুপ আছি। নাহলে আপনাদের সবাইকে দেখিয়ে দিতাম আরিশা কি জিনিস। বিশেষ করে আপনার ঐ লম্পট ছেলেকে।”

“খবরদার! আমার ছেলেকে নিয়ে কিনা বলবি না। নিজেকে আয়নায় দেখিস ভালো করে। কোথায় তুই আর কোথায় আমার সোনার টুকরো ছেলে জাঈদ। তুই তো ওর পাশে দাঁড়ানোরও যোগ্য না।”

“ঠিকই বলেছেন আপনি। আমি আপনার ছেলের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্য না। কিন্তু দেখুন, আপনার ছেলে আমায় বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। আপনার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি।”

জামিলা শেখ এবার রেগে যান। আরিশাকে চোখ রাঙিয়ে হাতের আঙুল তুলে হুমকি দিয়ে বলেন,”এই শোন! আজ আমার বোনের মেয়ে সন্ধ্যা আসছে এই বাড়িতে৷ ও যেন কিছুতেই জানতে না পারে তোর আর জাঈদের বিয়ের ব্যাপারে। তোকে তো আমি এখান থেকে চিরতরে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু জানি না জাঈদ কেন তোকে ফিরিয়ে আনল..যাইহোক, যদি সন্ধ্যা ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে পারে তাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না। কথাটা মাথায় রাখিস।”

আরিশা বলে,”আপনার হুমকিকে আমি ভয় পাই না। কিন্তু আপনার ছেলেকে নিজের স্বামী হিসেবে পরিচয় দেয়ারও কোন অভিরুচি আমার নেই। তাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন কেউ এই ব্যাপারে কিছু জানবে না।”

“কথাটা মাথায় থাকে যেন।”

বলেই জামিলা শেখ বেরিয়ে যান। তিনি চলে যাওয়ার পরই আরিশা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নিজের গালে আলতো করে হাত বুলোয় সে। এখনো তার গালটা বেশ ব্যাথা করছে। নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিয়ে সে বলল,”এসবে অভ্যেস করে নে আরিশা! মানসিকভাবে তো ক্ষতবিক্ষত হয়েইছিস এখন নাহয় শারীরিক ভাবেও হ!”

~~~~~~~~~~~~~~
জামিলা শেখ অধীর আগ্রহে ড্রয়িংরুমে বসে ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ করে কলিং বেল বেজে উঠতেই তিনি অধীর আগ্রহ নিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেন। দরজাটা খুলতেই নিজের বোনঝি সন্ধ্যাকে দেখতে পান। বেশ সুন্দরী, লম্বা, ফর্সা একটা মেয়ে। পরণে মিনি স্কাট ও টপস। তাকে দেখেই জামিলা শেখ আলিঙ্গন করে বলেন,”আমার সন্ধ্যা! কতদিন পর তোমাকে দেখলাম! বেশ ভালোই বড় হয়েছ।”

“ও মাই সুইট খালা, তোমায় দেখে অনেক ভালো লাগল।”

“এখানে আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো?”

“না খালা। সেরকম কোন অসুবিধা হয়নি। তবে আমি আশা করেছিলাম জাঈদ ভাইয়া আমায় পিক করতে যাবে।”

জামিলা শেখ ব্যাপারটা সামাল দেয়ার জন্য বলেন,”আরে! জাঈদের কথা আর কি বলবো। ও তো সারাদিন এত ব্যস্ত থাকে যে ঠিকমতো খাওয়ারই সময় পায় না। জানোই তো সামনে তোমার খালুর ইলেকশনের ডেইট আসছে। তোমার খালু এবার এমপি পদে লড়বে। সেই জন্যই অনেক ব্যস্ততা যাচ্ছে জাঈদের উপর দিয়ে।”

“ওহ আচ্ছা।”

হালকা স্বরে বলে সন্ধ্যা। এমন সময় ধুপধাপ পা ফেলে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো জাঈদ। জাঈদকে দেখামাত্রই জামিলা শেখ বললেন,”জাঈদ এসো দেখে যাও কে এসেছে!”

জাঈদ এগিয়ে এসে বলে,”কে এসেছে লন্ডনের রাণী ভিক্টোরিয়া?”

সন্ধ্যা বলে,”দেখেছ খালা? জাঈদ ভাইয়া এখনো আমায় এই নামে ডেকে ক্ষেপাচ্ছে!”

“আহা! তোমাদের এই খুনশুটি দেখে খুব ভালো লাগছে।”

সন্ধ্যা তার লাগেজগুলো দেখিয়ে বলে,”এগুলো কোথায় রাখব? এতে অনেক দামী জিনিস আছে। তোমাদের জন্য লন্ডন থেকে অনেক গিফটও এনেছি।”

“ওগুলো..আচ্ছা দাঁড়াও।”

বলেই জামিলা শেখ একজন কাজের লোককে ডেকে বলেন,”যাও তো গিয়ে আরিশাকে ডেকে নিয়ে আসো।”

অতঃপর কাজের লোকটি জামিলা শেখের কথামতো আরিশাকে ডেকে নিয়ে আসে। আরিশা আসতেই সন্ধ্যা তাকে দেখে বলে,”ইনি কে খালা? এনাকে তো ঠিক চিনলাম না।”

জামিলা শেখ বলে ওঠেন,”ও আমাদের বাড়ির আশ্রিতা..কাজের লোকও বলতে পারো। মেয়েটার ভাগ্য খুব খারাপ জানো বিয়ের পর ওর স্বামী ওকে স্বীকৃতি না দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারপর ওর দুঃখের কথা জেনে আমরা ওকে এখানে আশ্রয় দিয়েছি।”

“ওহ আচ্ছা।”

আরিশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। জামিলা বলে ওঠে,”এই মেয়ে! চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ কেন? দেখছ না সন্ধ্যা হাতে লাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যাও গিয়ে লাগেজ গুলো ভেতরে রেখে আসো।”

আরিশা অবাক হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে,”আমি?”

“হ্যাঁ, তুমি। যাও যাও রেখে আসো।”

আরিশা একবার জাঈদের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ গিয়ে লাগেজগুলো নিতে চায়। তখন সন্ধ্যা তাকে বলে,”থাক, থাক তোমায় এগুলো নিতে হবে না। এত টুকুনু পুচকে একটা মেয়েকে এত ভারী লাগেজ বহন করতে দেয়া ঠিক হবে না। আমার তো তোমার জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। তোমার স্বামী তো ভীষণই খারাপ মানুষ। তোমার মতো এত মিষ্টি একটা মেয়েকে কিভাবে এত কষ্ট দিতে পারল? আল্লাহর লানত পড়ুক এমন মানুষের উপর।”

সন্ধ্যার কথা শুনে জাঈদ ভ্রু কুঁচকে নেয় এদিকে জামিলা শেখ হালকা কেশে বলেন,”আরে ওকে নিতে দাও। ও পারবে।”

“না, থাক খালা। আমি নিয়ে যাচ্ছি ভেতরে। আর তোমার নাম যেনো কি?”

আরিশা উত্তর দেয়,”আমার নাম আরিশা।”

“ওহ, হ্যাঁ, আরিশা। তুমি শোনো, তোমার সাথে যা হয়েছে তা হয়েছে। এখন তুমি এসব নিয়ে আর ভেবো না। এখন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো। দেখবে একদিন যারা তোমাকে অপমান করেছিল, কষ্ট দিয়েছিল তারা একদিন ঠিকই তাদের অন্যায়ের শাস্তি পাবে।”

বলেই হালকা হাসে সন্ধ্যা। এসব শুনে আরিশা একবার জাঈদ ও জামিলা শেখ এর দিকে তাকিয়ে বলে,”তাই যেন হয়!”
to be continue…….