অশ্রুজলে লেখা পর্ব-০২

0
17

#বড় গল্প
#অশ্রুজলে লেখা
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

রানুর পুরো নাম রায়না সরকার। মুসা ওকে রায়না বলে ডাকে। রানু আজ মুসাকে নতুনভাবে দেখছে। মুসা ওকে বলেছে,ওর জন্য নাকি এক বিশাল সারপ্রাইজ আছে। রানু অবশ্য বলেছে সারপ্রাইজটা দেওয়ার আগে ওর কিছু কথা আছে মুসার সাথে। প্রথমে মুসা শুনতে চায়নি। কিন্তু রানু বলেছে, ওর কথাগুলো না শুনলে মুসার সারপ্রাইজ ও গ্রহন করবে না। অগত্যা মুসাকে রাজী হতে হলো।

রানু আড়চোখে মুসাকে দেখছে। ছেলেটা ভীষণ হ্যান্ডসাম। মেদহীন বলিষ্ট শরীর। মুসা দারুণ ফুটবল খেলে। মাথাভর্তি কোকড়া চুল। মুসা রানুর দিকে তাকিয়ে বললো,
—-কি যেন বলতে চেয়েছিলে?
রানু মুচকি হেসে বললো,
—-সাহেবের মনে হয় আর তর সইছে না।
মুসাও হেসে উত্তর দেয়,
—-তাতো বটেই। চার বছর ধরে তোমার কথা শুনবো বলে অপেক্ষা করেছি। আমাকে আর কত অপেক্ষা করাবে?
রানু দৃষ্টিটা জানালা দিয়ে বাইরে মেলে ধরলো। সাপের মতো এঁকে বেঁকে রাস্তাটা দিয়ে গাড়ি লোচ লোমন্ডের দিকে ছুটে চলছে। রাস্তার দুপাশে কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাঁড়। মাঝে মাঝে সবুজ ঘাসযুক্ত তৃণভূমি। সেখানে ভেড়ার পাল চড়ে বেরাচ্ছে। পাশাপাশি কত পাহাড়। একটা পাহাড়ের রং পিংক। স্কটল্যান্ড আসলেই একটা পার্বত্য এলাকা। বাইরের প্রকৃতি দেখতে রানুর ভালো লাগছে। পাশাপাশি এই মুহুর্তটাও ওর কাছে অনেক মুল্যবান। কিন্তু অনেকটা স্বাপ্নিক মনে হচ্ছে। কেন যেন ওর ভয় করছে। মনে হচ্ছে মুসা ওর জীবনের কাহিনী শুনলে ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। সে কারনে যত দেরী করে বলা যায় ততই ভালো। ও এই সময়টাকে পরিপূর্ণ উপভোগ করতে চায়।
গাড়ীর ক্যাসেট প্লেয়ারে পুরোনো দিনের বাংলা গান বাজছে।যদিও মুসা এর ভাষা বুঝে না তারপরও রানুর পছন্দের কারণে ছেড়েছে।
“নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে
চুপি চুপি বাঁশী বাজে বাতাসে”

ঘন্টা দুয়েক পর ওরা লোচলোমন্ডে পৌঁছে গেল। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে শুরু করেছে। ওরা দু’জন গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলো। সময়টা ফেব্রুয়ারী মাস। ভীষণ ঠান্ডা পড়েছিলো সেদিন। রানু ওর মাফলার আনতে ভুলে গিয়েছিলো। ওভার কোট গায়ে জড়িয়েছে তবুও যেন শীতের হিমেল হাওয়া শরীরের ভিতর ঢুকতে শুরু করেছে। ওখানে পার্কে বেঞ্চ পাতা রয়েছে। তার সাথে আবার হঠাৎ করে মেঘ এসে জড়ো হয়েছে আকাশের বুকে। একটু পরেই মনে হয় বৃষ্টি নামবে। ভাবতে ভাবতে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করলো। অনেকেই এসেছে।সবাই কোনো না গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রানু আর মুসাও একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়লো। রানু ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলো। মুসা ওর মাফলারটা রানুর গলায় পরিয়ে দিলো। এতে রানু কিছুটা আরাম বোধ করতে লাগলো। নাহ্ বৃষ্টি থামার কোনো নাম গন্ধ নেই। ওরা দুজন দৌড়ে গাড়িতে উঠে বসলো। মুসা পাশের একটা কফিশপ থেকে দুকাপ কফি নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। এককাপ রানুর হাতে দিয়ে ও নিজের কাপে চুমুক দিলো। কফির গরমে যদি শরীরটাকে একটু ওমে রাখা যায়।
রানুও কাপে চুমুক দিয়ে মুসার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তোমাকে আমার কথাগুলো বলা শুরু করি। আসলে কিভাবে যে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। সময়টা ২০১৪। আমি তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে কেবল ভর্তি হয়েছি। গান শুনতে খুব পছন্দ করতাম। ক্যাসেট প্লেয়ার শুনতে হতো। কেননা তখনও আমি স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতাম না। আমাদের যে সামর্থ ছিলো না তা নয়।কিন্তু বাবা মা চাইতেন না আমি স্মার্ট ফোন ব্যবহার করি। আমার বন্ধুদের হাতে তখন দামী ফোন। ওরা মোবাইলে গান শুনে, সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দেয়। আমারও খুব ইচ্ছে হতো কিন্তু আব্বু আম্মুকে বলতে সাহস হতো না। আমার বাবা কর্পোরেট সেক্টরে জব করতেন। আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। অভাব আমি কোনোদিন চোখে দেখিনি। সচ্ছলতার মাঝেই বড় হয়েছি। তারপর ও এই একটা জায়গায় বাবা খুব কৃপনতা দেখাতেন। সেটা হচ্ছে আমাকে মোবাইল দেওয়ার বেলায়। আমি স্কুলে পড়াকালীন সময়ে আমার মোবাইলটা খুব একটা বের করতাম না। এটার কারনে খুব হীনমন্যতায় ভুগতাম। ছাত্রী হিসাবে আমি খুব তুখোড় ছিলাম।হবো নাই বা কেন? জগত সংসারে লেখাপড়া করা ছাড়া আমার অন্য কোনো কাজ থাকতো না। এসএসসি গোল্ডেন জিপিএ সাথে ট্যালেন্টপুলে স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। রেজাল্ট পেয়ে আব্বু প্রচন্ড খুশী হয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-আজ তুই আমার কাছে যা চাইবি তোকে আমি তাই দিবো।
আমিও সুযোগ বুঝে একটা দামী স্মার্টফোন চাইলাম। আব্বুও সাথে সাথে দিতে রাজী হলেন। আর আমার সর্বনাশের শুরু হলো। কলেজে বান্ধবীদের আমার মোবাইলটা দেখাতে লাগলাম। ওরা খুব প্রশংসা করলো। দামী মোবাইলের কারনে আমার ভিতরে গর্ব অনুভব হলো।একদিন আমার এক বান্ধবী সাইয়্যেরা আমাকে বললো,
—–তোর মোবাইলটা আমাকে দিবি? আমি তোকে অনেক সুন্দর সুন্দর গান ডাউনলোড করে দিবো।
আমিও সরল বিশ্বাসে দিয়ে দিলাম। পরদিন ও আমাকে মোবাইলটা ফিরিয়ে দিলো। কিন্তু গান ডাউনলোড করেনি। পর্ণগ্রাফির ছোটো ভিডিও আপলোড করে দিয়েছে। প্রথমে দেখতে খারাপ লাগলেও পরবর্তীতে আমি শিহরণ অনুভব করতে লাগলাম। আমার ঐ বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের বিষয়ে আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। আমার বান্ধবীদের প্রায় সবারই ছেলেবন্ধু ছিলো। তারা সবাই রুমডেট করতো। কিন্তু ঐ ভিডিও দেখার আগে বুঝতাম না ওরা রুম ডেট করে কিকি করে। তবে ভিডিও দেখার পর সবই বুঝলাম। এর মাঝে আমার একজন ছেলেবন্ধু যোগাড় হয়ে গেল। বলতে পারো আমি নিজ থেকে যোগাড় করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। আমার বন্ধুদের সবার বয়ফ্রেন্ড থাকার কারনে এটা নিয়েও আমি কুন্ঠিত হয়ে থাকতাম। যাক আমারও বয়ফ্রেন্ড যোগাড় হলো। সেটাও হলো মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। পাপের চোরাবালিতে যাওয়ার জন্য আমি আর এক ধাপ এগিয়ে গেলাম। ওদিকে আব্বু আম্মু আমাকে নিয়ে বড় বড় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। তার মেয়ে ডাক্তার নয়তো ইন্জিনিয়ার অথবা দেশ সেরা বিজ্ঞানী হবে। কিন্তু বাস্তবে আমি পাপের অতলে তলিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। আমার সেই বয়ফ্রেন্ড আমাকে রুমডেট করার জন্য অফার দেয়। প্রথমে রাজী হইনি।আসলে বাসায় আব্বু আম্মুকে কিভাবে ম্যানেজ করবো সেটা ভেবেই রাজী হতে পারছিলাম না। এক্ষেত্রে আবারও আমার সেই গুনধর বান্ধবীরা এগিয়ে এলো। কথায় আছে না সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস আর অসৎসঙ্গে সর্বনাশ। বন্ধু ভাগ্যে আমার চরম সর্বনাশের বীজ রোপন হলো।এদের একজনের বাসায় জন্মদিনের পার্টি হবে একথা বলে বাসা থেকে বের হওয়ার বুদ্ধি দিলো। তবে ওদের বুদ্ধিটা কাজে লাগলো। আম্মু রাজী হতে না চাইলেও আব্বুর কারনে রাজী হলেন। তবে শর্ত হলো সন্ধার আগে বাসায় ফিরতে হবে। আমিও আমার বয়ফ্রেন্ডকে বললাম,”আমাকে সন্ধার আগে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে।” সেও সানন্দে রাজী হলো। সেদিন আমার কোনো কোচিং ছিলো না। দুটোর সময় কলেজ ছুটি হওয়ার সাথে সাথে আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে একটা সিএনজি করে রওয়ানা হলাম। ওর নাম সাব্বির। আমি সাব্বিরকে জিজ্ঞাসা করলাম,
–+ আমরা কোথায় যাচ্ছি?
সে আমার কোমরটা জড়িয়ে ধরে বললো,
—-প্রথম রুম ডেট করবো আমরা। সেটা কি যেন তেন জায়গায় করা যায়। আমরা একটা ফাইভস্টার হোটেলে যাচ্ছি।
আমার ভীষণ ভয় হতে লাগলো। আমি ওর হাত ধরে বললাম,
—-আমার ভীষণ ভয় করছে।
ও আমার কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বললো,
—-আমি আছি তো তোমার পাশে।

চলবে