অশ্রুজলে লেখা পর্ব-০৩

0
18

#বড় গল্প
#অশ্রুজলে লেখা
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী

“হা সাব্বির সারারাত আমার পাশেই ছিলো। আমার অমত সত্বেও আমাকে ভোগ করেছে। আমার সত্যিকার অর্থে নিজের কিছু করার ছিলো না। আমার নিজের করা ভুলের মাশুল এভাবেই আমাকে দিতে হলো। ভোরের দিকে ক্লান্ত শরীরে দুচোখে ঘুম নেমে এসেছিলো। এরপর আমার সেই কথিত প্রেমিক চম্পট। বেলা বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। কিম্তু ও আর ফিরে আসেনি। এদিকে হোটেলের রিসিপশন থেকে বারবার রুম ছাড়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছিলো। যাক সাব্বির বিলটুকু দিয়ে গিয়েছিলো। হয়তো সেটা আমাকে ভোগ করার মুল্য।”
এটুকু বলে রানু মুসার দিকে তাকিয়ে দেখলো। তবে মুসার চেহারায় একটা নিরবভাব লক্ষ করলো। সেখানে একটু আগের উচ্ছলতাটুকু হারিয়ে গেল। রানু অবশ্য জানতো এমনই হবার কথা ছিলো। এরপরের অংশটুকু মুসা আর শুনতে চায়নি। রানু বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু মুসা বলেছিলো,
“এটা তোমার জীবনের একটা বেদনার অধ্যায়। সে অধ্যায়টা বন্ধ থাকাই ভালো। খুলতে গেলে তুমি ব্যথিত হবে।”
রানু মনে মনে তাচ্ছিলের হাসি হেসে বললো,
“কষ্টের বিষমাখা ছুড়িটা বুকে যার বিঁধে রয়েছে
তার কাছে এই সান্তনাগুলো লাগে বড় মিছে”
এরপর সেদিন ওরা ডাক বে তে গিয়ে বিশাল মিঠা পানির হ্রদের সামনে কিছুক্ষন বসেছিলো। রিভারক্রুজ করার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু সময় হয়ে উঠেনি। কিংবা রানুর জীবনের গল্প শুনে মুসা তার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলো। এটুকু শুনেই মুসা আর শুনতে চায়নি। যদিও আসল সত্যটা রানু মুসাকে বলেনি। এরপর আর কখনও মুসা রানুর দিকে প্রেমিকের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। শুধুৃমাত্র বন্ধুত্বের সম্পর্কটুকু মুসা রক্ষা করে চলেছিলো। না,রানু এতে হতাশ হয়নি। এমনটা হবে এটা রানু জানতো। এখনও মাঝে মাঝে ফেসবুকে মুসার সাথে হালকা পাতলা কথা হয়। বিয়ে করেছে কিনা রানুর জানতে ইচ্ছা হয়নি।
বাস্তবতা হলো রানু সেদিন ওর সত্যিগল্পটা মুসার কাছে শেয়ার করতে পারেনি। সেই গল্পটা আরো ভয়ানক। সাব্বির আসলে সেদিন ওকে হোটেলে কিছু ক্লায়েন্টদের কাছে রেখে ওদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলে গিয়েছিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় রানু সেদিন হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলো। সারারাত ধরে তিনজন ক্লায়েন্ট ওকে ভোগ করলো। কি বিভৎস সেই দিন! ওর বয়ঃসন্ধিকালের ভুলের মাশুল ওকে এভাবেই গুনতে হলো। সেদিন ওই খদ্দেররা রানুর মতো আনকোরা নারী পেয়ে ষোলো আনার উপর আঠারো আনাই উসুল করে নিয়েছিলো। প্রথমজন রানুর উপর খুশী হয়ে ওকে পাঁচহাজারটাকা বখশিসও দিয়েছিলো।
হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় রানু ডেক্সের উপরে রাখা টাকাটা নিয়ে বের হয়েছিলো। কারণ ওর প্রচন্ড খিদে পেয়েছিলো। কিন্তু ও যাবে কোথায়? হোটেলে ঢুকার আগে সাব্বির ওকে মোবাইলের সুইসটা বন্ধ রাখতে বলেছিলো। এরপর আর খোলা হয়নি। ও হোটেল থেকে বের হয়ে ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে চালু করলো। দেখলো ওর বাবার মিসকল। না ও গুনতে পারেনি। মনে হলো ওর বাবা শতবার কিংবা হাজারবার ফোন করেছিলো। শুধু অশ্রুজলে ওর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো। এভাবে ওর নারীত্বের বিসর্জন হবে ও কোনোদিন কল্পনাও করেনি। বাবা মায়ের কাছে লুকিয়ে আবেগের বশবর্তী হয়ে যে কাজ ও করতে গেল তা ওকে খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো। যেখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেই মৃত্যু। হঠাৎ ওর মাথায় একটা চিন্তা এলো। এই জীবনকে ও আর বাঁচিয়ে রাখবে না। সে সময় ফোনটা বেজে উঠলো। বাবা ইদ্রিস সরকার ফোন দিয়েছেন।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলেন রানু তুই কোথায়। তোর ফোন বন্ধ ছিলো কেন? সারা রাত কোথায় ছিলি? রানু কোনো কথার উত্তর দিতে পারেনি। শুধু হোটেলের ঠিকানাটা দিয়ে বাবাকে আসতে বলেছিলো।
কিছুক্ষনের মধ্যেই ইদ্রিস সরকার চলে আসলো। রানুর আপাদমস্তক দেখে উনি আর কিছু জিজ্ঞাসা করেননি। মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসলেন। ওর মা জানার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু রানু বলেনি।
কিন্তু এসব কথা তো চাপা থাকে না। আস্তে আস্তে ওর কলেজের শিক্ষক, বন্ধু বান্ধব অভিভাবক , আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশী সবাই জেনে গিয়েছিলো। মানুষের ঘৃণিত দৃষ্টি, বন্ধুবান্ধবদের কটুক্তি ওকে প্রতিনিয়ত আহত করতে লাগলো। কলেজে ওর সাথে কেউ মিশতে চাইতো না। রানুর মাঝে তখন সাইকোলজিক্যাল সমস্যা দেখা দিলো। ওর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। ও সুইসাইডাল স্টেপ নিতে শুরু করলো। প্রথমে হাতের রগ ব্লেড দিয়ে কাটলো। প্রচন্ড ব্লিডিং এ জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। ইদ্রিস সাহেব মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করলেন। অল্পের জন্য রক্ষা পেলো। আরো একটু বেশী সময় ব্লিডিং হলে হয়তো রানুকে বাঁচানো যেতো না। আল্লাহপাক হায়াত রেখেছেন বিধায় বেঁচে গিয়েছে।
একমাত্র মেয়ের এরকম অবস্থায় ইদ্রিস সরকার আর আয়েশা বেগম মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছেন। কাউন্সিলিং এর জন্য রানুকে সাইক্রিয়াটিস্ট এর শরণাপন্ন হলেন। উনার পরামর্শে স্কুল চেইঞ্জ করলেন। নতুন এলাকায় চলে গেলেন। আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে থাকতে শুরু করলেন। শুরু হলো ঐ পরিবারের নতুন লড়াই। রানুর বয়ঃসন্ধিকালের এই ভুলে অনেক বড় মাশুল সেদিন গুনতে হয়েছিলো। এদিকে রানুর নিজেকে খুব খারাপ মানুষ মনে হতে লাগলো। ইদ্রিস সরকার রানুর কাছে মোবাইলও রাখেননি। কেননা রানু ওর আগের কলেজ ছেড়ে আসাতে প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিলো। সেখানে ওর ছোটো বেলার বান্ধবীরাও ছিলো। কিন্তু ওর কলেজে যাওয়ার উপায় ছিলো না। সবাই ওর কাছ থেকে দূরে থাকতো। এমনকি অনেক অভিভাবক ওকে দেখলে ফিস ফিস করে বলতো ও একরাত বাড়ির বাইরে ছিলো। খুব খারাপ মেয়ে বলেই এরকম কাজ করতে পেরেছে। অথচ ওদের মেয়েরা প্রায়ই বয়ফ্রেন্ডের সাথে রুম ডেট করে।
এসব নানা কারনে রানু কলেজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো। রানু নিজের এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করে। একদিন মোবাইলে পুরনো বন্ধুদের ছবি দেখে সহ্য করতে পারলো না। বাথরুমে গিয়ে হারপিক খেয়ে ফেললো। সেসময় আয়েশাবেগম কিচেনে রান্না করছিলেন। রানুর সাড়া না পেয়ে খোঁজ করতে এসে দেখেন ও ঘরে নেই। ওয়াশরুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। আয়েশা বেগম আঁতকে উঠলেন। জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন। কিন্তু রানু দরজা খুলছিলো না। পরে চাবি দিয়ে আয়েশা বেগম লক খুলে দেখেন বাথরুমের মেঝেতে রানু বসে আছে। মুখে হারপিকের বোতল। পুরো ঠোঁট নীল হয়ে আছে। রানু উনার দিকে তাকিয়ে বিভৎসভাবে হাসতে লাগলো। আয়েশা বেগম ওর হাত থেকে হারপিকের বোতলটা কেড়ে নিলেন। কিন্তু ততক্ষণে পুরো বোতল খালি। ইদ্রিস সরকারকে ফোন দিলেন। উনি আয়েশা বেগমকে
রানুকে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে বললেন। আয়েশা বেগম রানুকে নিয়ে একটা সিএনজি ভাড়া করে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিলেন।

চলবে