অশ্রুজলে লেখা পর্ব-০৪

0
17

#বড় গল্প
#অশ্রুজলে লেখা
পর্ব – চার
মাহবুবা বিথী

আয়েশা বেগম তড়িঘড়ি করে রানুকে নিয়ে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে যান।কিন্তু উনারা ওকে ভর্তি করতে রাজী হয় না। আয়েশা বেগম একমাত্র মেয়ের জীবন রক্ষায় ডাক্তারের কাছে অনুনয় বিনয় করতে থাকে। ডাক্তাররা রানুকে সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। ততক্ষণে রানুর বাবা ইদ্রিস সরকার হাসপাতালে চলে আসেন। এদিকে রানু আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়তে শুরু করেছে। এখানকার ডাক্তাররা ওকে তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বললেন। আয়েশা বেগম কাঁদতে কাঁদতে ইদ্রিস সরকারের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—ও রানুর বাবা,আমার রানু বাঁচবে তো?
ইদ্রিস সরকার চিন্তিত হয়ে বললেন,
—-আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করো। এছাড়া আমাদের হাতে করার কিছু নাই।
তারপর একটা সিএনজি ডেকে নিয়ে রানুকে নিয়ে উনারা ঢাকা মেডিকেলের পথে রওয়ানা দিলেন। আর মনে মনে ইদ্রিস সরকার নিজেকেই মেয়ের এই পরিনতির জন্য দায়ী করতে লাগলেন। স্নেহের আতিশয্যে মেয়ের হাতে এতো তাড়াতাড়ি স্মার্ট ফোন তুলে দেওয়া উচিত হয়নি। আর দিয়েছেন যখন তাহলে মেয়ের দিকে কড়া নজর রাখা উচিত ছিলো। রানুকে এভাবে বিশ্বাস করা উনার উচিত হয়নি। মেয়েটার কতোইবা বয়স হবে? এখনই তো ভুল করার সময়। একদিকে হাতে স্মার্ট ফোন তার সাথে জুটে নষ্ট হয়ে যাওয়া কিছু বন্ধুবান্ধবদের সংস্পর্শ। যা রানুকে আজ ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে। রানু সেদিন আধো জাগরনে বাবার সেই অসহায় মুখখানা দেখেছিলো। তখন হঠাৎ ওর মনে হয়েছিলো না ওকে বাঁচতে হবে। এই মানুষটার জন্য ওকে বাঁচতে হবে। ঐ সময় চোখ বন্ধ করে রানু আল্লাহপাকের কাছে ওর জীবন ভিক্ষে চাইলো। আল্লাহপাক ওকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি। বরং ওর যতটুকু প্রাপ্য ছিলো তার থেকে অনেকগুন বেশী দিয়েছেন। ও জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিলো।
আজও ওর সেদিনের কথা মনে হলে হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হয়। আর অন্তর থেকে রানু ওর বাবা মায়ের জন্য দোয়া করে। সেদিন আল্লাহপাকের অশেষ রহমতে ওর বাবা মায়ের মনোবলও শক্ত ছিলো। আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশী অফিসের কলিগ সবার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাবা মা ওর হাত শক্ত করে ধরেছিলো। ঢাকা মেডিকেলে যাওয়ার পর ওর চিকিৎসা শুরু হয়। পাকস্থলী ওয়াশ করে স্যালাইন দেওয়া হয়। তিনদিন হাসপাতালে থেকে বাড়ী ফিরে আসে। এরপর থেকে ওকে নিয়মিত সাইকোথেরাপি দেওয়া হয়। কিছুটা ভালো হলে রানু নিজ ইচ্ছায় আবার কলেজে ভর্তি হয়। নতুন করে জীবন শুরু করে। তবে বন্ধুবান্ধবদের থেকে দূরে থাকতে শুরু করে। দুর্জন বন্ধু যে জীবনে কতো বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে তার বড় উদাহরণ রানু নিজে। সে কারনে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গ রানু এড়িয়ে চলে। আর নিজেকে পড়াশোনা আর ধর্ম কর্মের মাঝে ডুবিয়ে রাখে। আস্তে আস্তে হৃদয়ে এক অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করে। পাশাপাশি মোবাইলের নাম্বার চেইঞ্জ করে ফেলে। কারণ সাব্বির ওকে ক্রমাগত ব্লাকমেইল করতে থাকে। ওকে ক্লাইন্টদের সাথে যোগাযোগ করতে বলে। পাশাপাশি এও বলে ওর নাকি অনেক ডিমান্ড। ও চাইলে এই লাইনে প্রচুর টাকা ইনকাম করতে পারবে। আর ওর কথায় যদি রাজী না হয় তাহলে রানুর কিছু নোংরা ভিডিও ক্লিপ অনলাইনে ছেড়ে দিবে। নাহ্,ঐ শয়তান সাব্বিরের কথায় রানু মনোবল হারায়নি। বরং ওর বাবাকে নিয়ে থানায় গিয়ে সাইবার ক্রাইমে সাব্বিরের নামে মামলা করে দেয়। রানুর কাছে থাকা সাব্বিরের সব ডকুমেন্ট মানে ওর ফেইস বুক আইডি,হোয়াটসঅ্যাপ,ইনস্ট্রগ্রামের সব সুত্র পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এরপর ইদ্রিস সরকারকে বলে, ওর ফোন নাম্বার চেইঞ্জ করে দিতে। আসলে ঘুরে না দাঁড়িয়ে তো উপায় নেই। ওরও যেমন ওর বাবা মা ছাড়া কেউ নেই তেমনি ও ছাড়া ওর বাবা মাকে দেখার কেউ নেই। পরমকরুনাময় আল্লাহপাকের কাছ থেকে এই দায়িত্ব নিয়ে ও পৃথিবীতে এসেছে।
নতুন করে কলেজে ভর্তি হলো। খুব মনোযোগ দিয়ে রানু পড়াশোনা শুরু করে দিলো। এবার আর বাইরে কোচিং করতে যায়নি। ওর বাবা বাসাতেই তিনজন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন। তবে রানুর সাইন্স নিয়ে পড়া হয়নি। কারণ কোচিং এ অনেক দৌড়াতে হবে। সে কারনে মানবিক বিভাগেই পড়া শুরু করে। আসলে লাইফে ঐ ঘটনার পর ওর ঘর থেকে বের হতে বেশী ইচ্ছা হতো না। ছাত্রী ভালো ছিলো বিধায় মানবিক বিভাগ থেকেও জিপিএ ফাইভ পেয়ে এইচএসসি পাশ করে। পরবর্তীতে ঢাকা ভার্সিটিতে ইংরেজী সাহিত্যে অনার্সে চান্স পেয়ে ভর্তি হয়। ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে কৃতিত্বের সাথে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে। যেদিন ওর রেজাল্ট হয় বাবা ওকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে ছিলেন। রানুর চোখেও শ্রাবনের ঢল নেমেছিলো। সেদিন এক অদ্ভূত প্রশান্তিতে রানুর জীবনটা ভরেছিলো। হেরে গিয়ে জিতে ফেরার আনন্দ যে কি সেদিন ও পরিপূর্ণ উপলব্ধি করতে পেরেছিলো।
হঠাৎ অন্ধকার নেমে এলো। রানু একটু অবাক হলো। একটু আগেই তো চাঁদের আলোয় রাতের পরিবেশ ছিলো উদ্ভাসিতো। আকাশের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো মেঘের ছায়া চাঁদের উপর পড়ার সাথে সাথেই রাতের পৃথিবীটা মুহুর্তে অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছে। বেশ কিছুক্ষন পর মেঘটা সরে যাবার পর আবারো চারিদিক আলোকিত হয়ে গেল। ও অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে ভাবে মানুষের জীবনটাও এমনি । কখনও কখনও মেঘের মতো জীবনটাও অন্ধকারে ঢেকে যায়। সেখান থেকে বের হতে গেলে সব থেকে বেশী প্রয়োজন হয় আল্লাহপাকের রহমত। সেদিক থেকে রানু নিজেকে ভাগ্যবানদের একজন মনে করে।
তবে ওর বিয়ে করতে ইচ্ছে হয় না। কারণ ওর যে একটা ভয়ঙ্কর অতীত আছে। বিয়ের পর সেই ভয়ঙ্কর অতীত কখনও ওর সামনে চলে আসে সেটাকে মোকাবেলা করার মতো ওর মানসিক শক্তি নাই। কিভাবে মোকাবেলা করবে। ঐ সত্যি ঘটনাটা ও কিভাবে আড়াল করবে? ওর রুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। অতীতে চিলেকোঠা থেকে রানু বর্তমানে ফিরে আসলো।
বারান্দায় বসেই ও বুঝতে পারছে বাবা ওর ঘর এসেছে। বাবা এটাই করে। রানু যেদিন রাত জাগে সেদিনই ওর বাবা ঘরে এসে ওর খোঁজ খবর করে যায়। ইদ্রিস সরকার ধীর পায়ে বারান্দায় চলে আসলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—রাত তো শেষ হয়ে এলো,ঘুমাবি না?
—-ঘুম যে চোখে আসে না বাবা, কি করি বলতো? আর তুমি কেন জেগে আছো?
—-আমার এক ঘুম হয়ে গেছে। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্য উঠেছি। তোর রুমের দরজা ভেজানো দেখে বুঝলাম,তুই ও ঘুমাসনি। এভাবে রাত জাগলে তো শরীর খারাপ করবে।
রানু চুপচাপ বাবার কথাগুলো শুনলো। এরপর বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আব্বু, আম্মুকে তুমি একটু বুঝাও না। আমার পক্ষে বিয়ে করা কখনও সম্ভব না। কারণ আমার অতীত জানলে কোনো ছেলেই আমাকে বিয়ে করতে চাইবে না। আর আমিও আমার অতীত জানিয়ে বিয়ে করতে চাই। ঐ ঘটনা জানার পর যদি কোনো ছেলে আমাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে আমি বিয়ে করবো। এছাড়া আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়।
—-বিয়ে করবি কি করবি না সেটা একান্তই তোর ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে একটা কথা শুনে রাখ গোপন পাপকে আল্লাহপাক গোপনে রাখতে পছন্দ করেন। তোর জীবনে যা ঘটে গেছে সেটা এখন অতীত। সেটাকে আর কারো সামনে প্রকাশ করার দরকার নাই। আল্লাহপাক গোপন রাখতে পছন্দ করেন। বরং তুই প্রতি মুহুর্তে তোর অযাচিত ভুলের জন্য আল্লাহপাকের কাছে মাফ চেয়ে নিবি।
একথাগুলো বলে ইদ্রিস সরকার রানুর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সত্যি বলতে প্রেম, বিয়ে ভালোবাসা এগুলোর উপর থেকে রানুর বিশ্বাস কিংবা ভরসা সবই উঠে গিয়েছে। মানুষের জীবনে ফার্স্ট লাভ নিয়ে একটা আবেগ ইমোশন কাজ করে। আর ওর ক্ষেত্রে মানসিক ট্রমা শুরু হয়। তারপরও এটা ভেবে ভালো লাগে সাব্বিরের প্রতারণার শিকার হয়তো ওকে হতে হয়েছে কিন্তু নিজেকে তো সেই প্রতারণার জাল থেকে মুক্ত করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এরকম কতো ঘটনা শোনা যায়, প্রতারক প্রেমিকের পাল্লায় পড়ে কতো জীবন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আম্মুর জন্য ওর কষ্ট হয়। কেন যে ওর বিয়ের কথা চিন্তা করে অযথা কষ্ট পায়। অথচ রানুতো ওর বাবা মাকে নিয়ে সুখেই আছে।

চলবে