অশ্রুবন্দি পর্ব-০১

0
1

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১

“কবুল বলতে রাজি? নাকি আমার শক্ত হাতের
থা’প্পড় খেয়ে তোর সুন্দর চেহারার নকশা বদলাতে রাজি? ঝটপট বল…”

সৃজা কঠোর কণ্ঠে হুমকি শুনে তৎক্ষনাৎ চাইল
ইহসানের মুখপানে। একপলক দেখেই চোখ সরিয়ে নিলো৷ তার বুক কাঁপছে। মন বিভ্রান্ত হচ্ছে। দিশেহারা লাগছে। সবকিছু অচেনা লাগছে। সবচেয়ে বেশি অচেনা মনে হচ্ছে ইহসানকে। সারাজীবন মাথাগরম আর রাগী হিসেবে এই অস্থির লোকটাকে জেনে এসেছে সে। অথচ এই লোকটাই কিনা আজ তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে? তাও তুচ্ছ কারণে? যদিও সৃজা আর ইহসানের কাছে কারণগুলো তুচ্ছ নয়, তবে বাকি সবার কাছে তুচ্ছই বটে! সৃজা ভাবতে পারছে
না ইহসান সত্যিই বিয়ে করতে নিয়ে এসেছে তাকে। এখন কী জবাব দেবে সে লোকটার এই কঠিন প্রশ্নের? সৃজা
কিছু ভেবে পেল না। মস্তিষ্ক শূন্য লাগছে তার। তবে মন বলছে এই বিয়ে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ঢোক গিলে
বলল,

“আমি যোগ্য না তোমার…”

বলামাত্রই ডানগালে সপাটে একটা চড় পড়ল ওর গালে। আচমকা চারদিক অন্ধকার দেখল সৃজা। ভোঁ ভোঁ করে মাথাটা ঘুরে উঠল। পড়ে যেতে নিলেই ইহসান ধরে ফেলল তাকে। মেঝেতে বসে পড়ল। সৃজাকে ধরে রাখা ব্যক্তিটি এবার ধমকে উঠল,

“বারবার এক কথা! আরেকবার বলে দেখ, তোর কি হাল করি আমি সৃজা…”

সৃজার মস্তিষ্ক সচল হলো, চোখ খুলল সে। টের পেল তাকে ধরে রেখেছে ইহসান। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। রেগে গেছে ভয়ংকরভাবে সেটা বুঝেই সৃজা ঢোক গিলল আবার। ভয়কাতুরে কণ্ঠে বলল,

“তুমি রাগের মাথায় আমায় বিয়ে করতে চাইছ ইহসান ভাই, এটা ঠিক না। ভালো করে ভেবে দেখলেই বুঝবে আমার মতো মেয়ে তোমার জন্য উপযুক্ত না।”

“চুপ। এখন তুই ঠিক করবি কে আমার জন্য উপযুক্ত আর উপযুক্ত না? দেখ, মাথা গরম করাস না। ভালোয় ভালোয় রাজি হয়ে যা।”

একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল ইহসানের বন্ধু-বান্ধবরা। তারা বুঝাতে চাইল কিন্তু ইহসান ধমকে চুপ করে দিলো ওদের। কাজী সাহেবও ভড়কে ছিলেন প্রথম থেকেই। এসব কি
হচ্ছে তার অফিসে তিনি কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। জীবনে বহুবার এমন গুণ্ডামার্কা ঘটনার মাধ্যমে বিয়ে পড়িয়েছেন তিনি। আজকের ঘটনাও হয়তো সেরকম কিছুই। বরাবরই তিনি ভীতু প্রকৃতির মানুষ। এসব
ব্যাপারে নাক গলাতে চান না। কিন্তু চোখের সামনে এমন আদুরে দেখতে মেয়েটির গাল একচড়ে লাল করে ফেলায় তিনি মুখ ফসকে বলেই ফেললেন এবার,

“তোমার মাথা এমনিতেও গরম বাবা, শান্ত হও।”

ইহসান রক্তচক্ষু মেলে চাইল কাজীর দিকে। এরপর সামলে নিলো নিজেকে। সবার সাথে মেজাজ দেখানো উচিৎ নয়। সে শক্ত গলায় শুধু বলল,

“আপনি এসবে মন না দিয়ে পেপার রেডি করেন।
সই কোথায় করতে হবে দেখিয়ে দিন।”

সৃজা এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলল,

“তোমার মেজাজ ঠান্ডা হলেই বুঝবে বেশি বাড়াবাড়ি করছ তুমি। আমি বিয়ে করব না।”

“আমার মেজাজ মাইনাস জিরো ডিগ্রির চেয়েও ঠান্ডা আছে। সেই ঠান্ডা মেজাজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ, এক্ষুনি তুই আর আমি বিয়ে করব।”

ইহসানের দৃঢ় কণ্ঠস্বর শুনে এবার সৃজা করুণ গলায় বলল,

“বোঝার চেষ্টা করো। কেউ মানবে না।”

”মানা মানির ব্যাপার নিয়ে ভাবছিই না আমি। তোরও ভাবতে হবে না। দু’মিনিট সময় দিলাম। ধীরেসুস্থে মত জানা। নয়তো এবার তোকে আর তোর বোনকে যদি আমার সামনে কেউ খু’নও করে ফেলে, আমি ফিরেও তাকাব না তোদের দিকে।”

কথাটা বেশ ধীরস্বরে আওড়াল ইহসান। সৃজা অবাক চোখে চাইল। এরপর মাথা নিচু করে বসে রইল। তার জীবনটা আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয়। সে চায় না তার চালচুলোহীন জীবনটা অন্যের ঘাড়ে সঁপে দিতে। শেখ বাড়ির ছেলে ইহসান৷ বিলাসিতায় বড় হয়েছে। চলনবলন, মেজাজ, ঠাঁটবাট আলাদা ওদের। একনামে সবাই চেনে। সেই শেখ বাড়ির ছেলে ওকে বিয়ে করলে কী পাবে? কিচ্ছু না। এমনকি শ্বশুরবাড়ির জামাই আদরটুকু পর্যন্ত না৷ যেচে পড়ে কেন অন্যের জীবন নষ্ট করবে সে? কিন্তু ইহসান এখন যেসব হুমকি দিচ্ছে আর ওর দিকে রক্তিম চাউনি দিচ্ছে তাতে সৃজা সত্যিই বিভ্রান্ত হচ্ছে। বুঝতে পারছে না ওর কী করা উচিৎ। পাশ থেকে ইহসানের বন্ধুরা সৃজাকে বলছে রাজি হয়ে যেতে। সৃজার কাঁদতে ইচ্ছে করল। ইহসান শেষবার ওর নির্লিপ্ততা দেখে তিরিক্ষি মেজাজে একটা চেয়ার ঠেলে ফেলে দিয়ে বলল,

“আমার মুরোদ নাই, এটাই বুঝাইতে চাস তুই সৃজা?”

সৃজা ভয়ে আঁৎকে উঠে বলে,

“এরকম কিছুই না।”

শীতল শোনাল ইহসানের গলা,

“তাহলে মত দে। শেষবার বলছি…”

সৃজা ভাবার সময় পেল না। আশপাশ থেকে সবাই ঘিরে ধরে ওকে বুঝাতে লাগল। তাদের ভীষণ উৎসাহী দেখাল। অবশ্য উত্তেজিত হবেই, কারণ তাদের প্রাণপ্রিয় আর মাথাগরম বন্ধুটির জীবনে অবশেষে কেউ একজন জায়গা করতে যাচ্ছে। সৃজা বাধ্য হলো মত দিতে। ‘হ্যাঁ’ বলে সে চুপ করে বসে রইল ইহসানের পাশে। বিয়ের তোরজোড় শুরু হলো। সাক্ষী হলো ইহসানের বন্ধুরা। অবাক বিষয়! কাজী অফিসে আলাদা করে কোথা থেকে হুজুর আনা হয়েছে বিয়ে পড়ানোর জন্য। কবুলপর্ব শেষ হলো বেশ নাটকীয়তার মাধ্যমে। এরপর কাজী রেজিষ্ট্রি পেপার এগিয়ে দিলে সৃজা ঘাড় ঘুরিয়ে করুণ চোখে চাইল একবার ইহসানের দিকে। ইহসান গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“সই কর।”

সৃজা সময় নিয়ে কম্পিত হাতে নিজের নাম লিখল। এরপর একটানে ওর থেকে পেপারটা নিয়ে সই করল ইহসান। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে দু’জন জড়িয়ে পড়ল বিয়ে নামক সবচেয়ে কঠিন এক সম্পর্কে। যে সম্পর্কটার ভবিষ্যৎ আদৌ আছে কি-না জানে না সৃজা।

.

গায়ে সাতশো টাকা দামের খয়েরী সুতির সালোয়ার-কামিজ। পায়ে দেড়শো টাকার সস্তার স্যান্ডেল। চোখমুখ বিধস্ত, যেন ঝড় বয়ে গেছে মেয়েটার উপর দিয়ে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সৃজা শেখ বাড়ির বসার ঘরে। ইহসানও তার পাশে দাঁড়ানো। মুখাবয়ব গম্ভীর। দেখেই মনে হচ্ছে মেজাজ ভালো না। নিশ্চিত কোথাও কোনো কান্ড ঘটিয়ে এসেছে। কিন্তু এই মেয়েকে সাথে করে কেন বাড়িতে নিয়ে এসেছে ইহসান? তাহলে কী লোকমুখে শোনা কথাটা সত্যি? সালেহা বেগম বেজায় ভয় পেলেন। সেটা বুঝতে না দিয়ে প্রশ্ন করলেন,

“ও কেন তোমার সাথে আব্বা?”

“বিয়ে করেছি, বউ আমার ও।”

গমগমে কণ্ঠস্বরে বলে উঠল কথাটা ইহসান। শুনে সালেহা বেগম চমকে ওঠলেন। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। আকস্মিক কথাটা শুনে তার মস্তিষ্ক শূন্য লাগছে। তিনি ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বড় দুই পুত্রবধূ তখনো থমকে চেয়ে আছে ইহসানের দিকে। শ্বাশুড়ির অবস্থা দেখেই তাদের টনক নড়ল। বড় ছেলের বউ ইস্মি উৎকণ্ঠিত হয়ে শ্বাশুড়িকে ধরে বলল,

“কী হইসে আপনার? শরীর খারাপ লাগতেছে?”

সালেহা বেগম ডুকরে কেঁদে উঠে আতঙ্কিত গলায় বললেন,

“ও এইডা কী করল বড় বউ? এতবড় সর্বনাশ ঘটাইয়া আইলো কাউরে জানানোর প্রয়োজন মনে করল না? ওর আব্বা শুনলে শেষ, কী করব ওরে জানো তো? মেজো বৌয়ের বাপরে কেমনে মুখ দেখাইব? সব শেষ হয়ে গেল আমার…”

ইহসান এবার গিয়ে সালেহা বেগমকে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

“যাকে আমি চাই না, পছন্দ করি না, ভালোবাসি না, মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে সারাজীবনের জন্য নিজের জীবনে জড়ানোর মতো মহান নই আমি। তাছাড়া আমি তোমাদের আগেই বলে দিয়েছি ঐ মেয়েকে বিয়ে করা সম্ভব না, স্বপ্নেও না। এটা নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি করেছে, এখন দ্বায়ভার তাদের।”

মেজো বৌ মিতু ইহসানের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল,

“আমার বোন কম সুন্দর? রাজকন্যার মতো দেখতে ওয়, সবাই ওরে বিয়ে করার জন্য পাগল। সারা পাড়া-মহল্লার লোকজন কত প্রস্তাব দিসে ওরে বাড়ির বউ করার জন্য, আব্বা দেয় নাই শুধু তোমারে জামাই বানাইব দেইখা।
তুমি তার এই প্রতিদান দিলা ভাইয়া? এই ফালতু মেয়ের জন্য?”

ইহসানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাল মিতুর দিকে। হিসহিসিয়ে বলল,

“আপনার পাড়াবেড়ানি বোনের জন্য সবাই পাগল হলেও আমি না। ওর সব কীর্তি আমার জানা আছে। আর একটা কথা, সৃজা আমার স্ত্রী, এ বাড়ির বউ। বুঝে-শুনে কথা বলবেন। নয়তো আপনার সুন্দরী বোনের হিস্ট্রি দেয়ালে পোস্টার হিসেবে ছাপা হবে।”

মিতু রাগে ফোঁসফোঁস করতে লাগল। তবে বলতে পারল না কিছুই। সৃজার দিকে বি’ষ নজরে তাকাল। এই মেয়ের জন্য আজ এতগুলো কথা শুনতে হলো ওর। যে জায়গাটা ওর বোন লিথুর থাকার কথা, সেটা আজ এই কালনাগিনীর দখলে চলে গেল।

এদিকে সৃজা ওদের বাকবিতণ্ডা দেখে চোখের জল ফেলছিল। আজ ওর জন্য ঝামেলা লাগল একটা
শান্তিপূর্ণ পরিবারে৷ সৃজার নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগল। সবাই নিশ্চয় ওকে দোষী ভাবছে। ইহসান সালেহা বেগমকে জিজ্ঞেস করল,

“বরণটরণ না করলে বলে দাও, ঘরে যাব।”

সালেহা বেগম কিছুই বললেন না। নির্লিপ্ত হয়ে রইলেন। ইহসান যা বুঝার বুঝে নিলো। এসে সৃজার হাত ধরে ওকে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

“তোর পোড়া কপাল, শ্বশুরবাড়ির আদর জুটবে না। বুঝলি, এ বাড়িতে সবার বউয়ের আদর আছে, ইহসানের বউয়ের নেই।”

কথাগুলো সবাই শুনতে পেল। মিতুর গা জ্বলে যাচ্ছে, সে মুখ ভেঙালো। বড়বউ ইস্মি তখন শ্বাশুড়িকে সামলাতে ব্যস্ত। সালেহা বেগম আঁচল চেপে কাঁদছেন। বাড়ির পুরুষরা এখনো ফেরেনি। এরমধ্যে এই কান্ড! আজিজ শেখ বাড়ি ফিরে এসব দেখলে যে বড়সড় গন্ডগোল হবে এটা ভেবেই তিনি আঁৎকে উঠলেন।

.

ইহসানের ঘরটা মাঝারি আকারের। দেয়ালে স্যান্ডস্টোন
রঙ করা৷ দু’পাশে বড় বড় লম্বা শিকওয়ালা কাঠের জানালা। খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, সোফাসেট সবই পুরোনো আমলের। তবে বেশ আভিজাত্য আছে। চকচক করছে সবকিছু। যেন আজই রঙ করা হয়েছে। বিছানার চাদরটা সাদা, তোষকটা পর্যন্ত নরম। সৃজা সবকিছু দেখে ঢোক গিলল। এ ঘরটা এখন তার। এ ঘরের মানুষটাও। কিন্তু সে অন্য কারোর হবার কথা ছিল। অন্য কেউটাকে ইহসান পছন্দ করে না, ভালোবাসে না বলে বিয়ে করতে চায়নি। কিন্তু সৃজাকে একপ্রকার জোর করেই বিয়ে করল। তার মানে কী? প্রশ্নটা মনে আসতেই খট করে দরজা খোলার শব্দ হলো৷ ইহসান গোসল সেরে বেরিয়েছে। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে সে ঠাট্টাভরা গলায় জিজ্ঞেস করল,

“কী? শ্বাশুড়ি বরণ করেনি বলে একা একা দুঃখ বিসর্জন দিচ্ছিলি নাকি? লাভ নেই, চোখ মুছে ফেল।”

সৃজা উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করল,

“আমাকে কেন বিয়ে করলে?”

ইহসান দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছুসময় পর হেসে বলল,

“বিয়ে করতে না করতেই এত জটিল প্রশ্ন মাথায়
ঢুকে গেল? ভালো লক্ষ্মণ।”

সৃজা ওর ঠাট্টা গায়ে মাখলো না,

“কথা এড়াচ্ছ কেন?”

“উত্তর নেই তাই।”

বলে এগিয়ে এলো সৃজার দিকে। একটু চুপ থেকে বলল,

“তবে একটা কথা সত্যি, একজনের পাড়াবেড়ানি বোনের হাত থেকে বেঁচে গেলাম তোকে বিয়ে করে।”

“ব্যবহার করলে?”

“তাই মনে হচ্ছে?”

বাঁকা হাসি দিলো ইহসান। এরপর সৃজার গালে যেখানে থাপ্পড় দিয়েছিল সেখানে আঙুল ছুঁয়ে দিল। সৃজা ঠান্ডা হাতের স্পর্শে চমকে উঠতেই যেন সম্বিৎ ফিরল ইহসানের। হাত থেকে তোয়ালেটা ছুঁড়ে ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। সৃজা থমকে বসে রইল তখনো। কী হচ্ছে এসব ওর সাথে?

_________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]