অশ্রুবন্দি পর্ব-০২

0
1

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২

বাঁকা হাসি দিলো ইহসান। এরপর সৃজার গালে যেখানে থাপ্পড় দিয়েছিল সেখানে আঙুল ছুঁয়ে দিল। সৃজা ঠান্ডা হাতের স্পর্শে চমকে উঠতেই সে হাত থেকে তোয়ালে ছুঁড়ে ফেল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ইহসান। সৃজা থমকে বসে রইল তখনো। কী হচ্ছে এসব ওর সাথে?

এরমধ্যে নিচতলায় চিৎকার-চেঁচামেচি শোনা গেল। কয়েকজন পুরুষের রাগী অথচ উচ্চ কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল দোতলার ঘরটায়। মহিলাদের গলাও পাওয়া গেল। এরমধ্যে কানে এলো ইহসানের ক্রোধিত উচ্চস্বর। মারামারির কিন্তু কথাবার্তা বোঝা গেল না পরিষ্কারভাবে। ঝামেলাটা বেশ অনেকক্ষণ গড়াল। ব্যাপারটা যে ওদের বিয়েকেন্দ্রিক এটা সৃজা বুঝতে পারল ঠিকই। ও উদ্বিগ্ন
বোধ করছিল। মারামারির শব্দও শোনা গেল একসময়।
শুনে মনে হলো কোনো হিংস্র জন্তু কাউকে খুবলে খাচ্ছে। সৃজা আর বসে থাকতে পারছিল না ঘরে। বের হতে যাবে বলে মনো স্থির করতেই ইহসান হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল। হাত কেটে গেছে বলে ঘরে এসেছে। দ্রুত ড্রয়ার খুলে ব্যান্ডেজ বেঁধে নিলো। এরপর সৃজাকে বলল,

“ঘর থেকে বেরুবি না।”

সৃজা ধাক্কা সামলে বিচলিত হয়ে বলার চেষ্টা করল,

“মারামারি করেছ? নিচে গন্ডগোলের আওয়াজ শুনলা…”

ইহসান রাগে ফেটে পড়ার মতো করে বলল,

“শুনবি, নষ্ট দুনিয়ায় এখন থেকে রোজই শুনবি। আমায় নিয়ে না ভাবলেই তোর মঙ্গল। বেশি ভাবলে ক্ষতি।”

বলতে বলতে সে বেরিয়ে গেল একটা চেয়ারে লাথি মেরে। এরপর বাইরে থেকে দরজা আটকে দিলো। সৃজা থম মেরে রইল। কেন বাইরে থেকে দরজা আটকে, ওকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করে গেল? লোকটার আচরণ এত রহস্যময় কেন? সৃজা বেশিকিছু ভাবতে পারল না। ভাবার ইচ্ছেও মরে গেছে। ক্লান্ত-বিধস্ত শরীরটাকে আরাম দিতে সে মুখ গুঁজে দিলো বালিশে। নরম তুলতুলে বালিশ। সেখান থেকে আসছে আতরের ঘ্রাণ। নিশ্চয় ইহসান ব্যবহার করে। কিছুক্ষণ ওভাবে শুয়ে থেকে উঠল সৃজা। ঘরটা ঘুরেফিরে দেখল। বইয়ের তাকে অসংখ্য বই দেখে বিস্মিত হলো। ইহসান বইও পড়ে? বাহ! ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়াতেই থমকে গেল নিজের বেহাল অবস্থা দেখে। কি আশ্চর্য! ওর মনেই ছিল না ব্যাপারটা। আর ইহসান একবার বলেওনি ওকে ফ্রেশ হবার কথা! বিরক্ত হয়ে তড়িঘড়ি করে বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে মনে পড়ল সে নতুন বউ। সাথে করে সুতো পর্যন্ত নিয়ে আসেনি। গোসল সেরে পরবে কী? অথচ এক্ষুণি শরীরটা না ভেজালে ঘিনঘিন ভাবটা কাটবেই না। ইহসান কোথায় গেল? কিছু বলে যায়নি কেন? সৃজার তো কাপড় দরকার। অবশ্য এরকমটা হবারই ছিল। লোকটা জিদের বশে এক কাপড়ে বিয়ে তো করে নিয়ে এসেছে, পরে কী হবে তা ভাবেনি। করুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৃজা। হাতমুখ ধুয়ে বসে রইল।

ইহসান ফিরলো রাত দশটায়। বউয়ের জন্য সে টুকটাক কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিল। দরজা খুলে হাতের ব্যাগগুলো নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেখল সৃজা বিছানায় ঘুমিয়ে আছে৷ বুকের উপর আধপড়া একটা বই। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছে। সারাদিনের ধকলের পর একমুঠো ভাতও জুটেনি মেয়েটার। ফর্সা মুখটা শুকিয়ে আছে। ইহসানের পছন্দ হলো না ব্যাপারটা। তখন মেয়েটার জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা আগে করা উচিৎ ছিল। অথচ ব্যাপারটা মাথায়ই আসেনি। সে নিজের উপর বিরক্ত হলো। ডাকল না সৃজাকে। হাতের ব্যাগপত্র রেখে ঝটপট একটা গোসল নিয়ে বেরিয়ে এলো। এরপর দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। ঠিক দশ মিনিটের মাথায় ভাত-তরকারি নিয়ে ঘরে এসে উপস্থিত হলো। সেগুলো টেবিলে রেখে এরপর ধীরেসুস্থে সৃজাকে ডাকতে বসলো।

“এই সৃজা, উঠ।”

ঘুমের মধ্যে কেউ ডাকলে বরাবরই বিরক্ত হয় সৃজা। কপাল কুঁচকে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে। এবারেও তাই হলো। ঘুমের ঘোরে থেকেই বলল,

“উফ! বিরক্ত করবি না এলিজা…”

বলে বিড়বিড় করে অন্যপাশ ঘুরে ঘুমে তলিয়ে গেল মেয়েটা। এদিকে তুইতোকারি শুনে চোখ কপালে উঠে গেল ইহসানের। ছোটদের এধরণের বেয়াদবি একদম নিতে পারে না সে। রেগে সৃজার মুখে কষিয়ে চড় বসাতে ইচ্ছে হলো ওর। কিন্তু বউ বলে ইচ্ছেটা দমন করল। অহেতুক নারী নির্যাতনের কেস খেতে তার পুরুষত্বে লাগবে। নারী হলো ফুল, তাকে আদর-যত্নে রাখতে হয়। নাটক করে হলেও। কপালে দুই আঙ্গুল চেপে বহুকষ্টে নিজের রাগকে সামলে নিলো ইহসান। এরপর গায়ে হাত দিয়ে ঠেলল ঘুম ভাঙাতে। কিন্তু কাজ হলো না। সৃজা গভীর ঘুমে ডুবে যেতে লাগল বারবার। রাগে তখন লুচির ন্যায় ফুলছে ইহসান। ধৈর্যহারা হয়ে সে সৃজার কানের কাছে গিয়ে বলল,

“সৃজার বাচ্চা, এক্ষুনি না উঠলে তোর সাথে বাসর করে ফেলব।”

সৃজা ধরফড়িয়ে উঠে বসল। মুখ দিয়ে আপনাআপনি ভীতু কণ্ঠে প্রশ্ন বেরিয়ে এলো,

“কে?”

ইহসান হেডবোর্ডে মাথা দিয়ে বসে আছে। সৃজা পেছনে চেয়ে ওকে দেখেনি এখনো। রেগে কটমট করে বলল ইহসান,

“তোর পতিদেব।”

সৃজা আঁৎকে উঠল পেছনে ফিরে ওকে দেখে।

“তুমি?”

“আর কাকে আশা করিস?”

“ভয় দেখাচ্ছিলে কেন এতক্ষণ?”

“তোর ম’রার ঘুম আমার সহ্য হচ্ছিল না তাই সাধে পড়ে ভয় দেখিয়েছি।”

ত্যাড়াব্যাকা কথাবার্তা। ফোঁসফোঁস করছে ইহসান। সৃজা বেশ বুঝল রেগে আছে লোকটা। তাই প্রশ্ন বাড়াল না, নিজেই চুপ করে গেল। ইহসান তা দেখে শান্ত হলো। সৃজা বসা থেকে উঠল বাথরুমে যাওয়ার জন্য৷ ইহসান ডেকে বলল,

“এখন হাতমুখ ধুয়ে আয়। খেয়ে এরপর গোসল করে নিবি। আমি তোর জামা এনেছি।”

সৃজা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ল। অদ্ভুত লোকটা! ফ্রেশ এসে বেরুতেই দেখল ইহসান গামছা নিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। চিন্তিত কিছুটা। ওকে দেখে গামছাটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

“শোন, কিছু কথা আছে।”

সৃজা হাতমুখ মুছতে মুছতে বলল,

“বলো।”

ইহসান কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কথা গুছিয়ে এরপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

“আমার পিতা মশাই আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে, তবে মনে হয় না দেবে৷ কিন্তু বাড়িতে রেড এলার্ট জারি করেছে আমার উপর। আজ থেকে এ বাড়িতে আমার খাওয়া বন্ধ। এমনকি যে আমাকে খাতির করবে তারও খাওয়া বন্ধ। এই বন্ধাবন্ধির চক্করে পড়ে আমার অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে। ব্যাপারগুলো তোকে জানিয়ে দেওয়ার ছিল, জানালাম। এখন যদি ভুলেও এসব নিয়ে ‘টু’ শব্দ করিস, তো ম’রবি। যাইহোক, আজ মেন্যুতে শুধু ডিম আর ডাল। ডিম আমি ভেজেছি, কিন্তু ডালটা দারোয়ান চাচার থেকে নিয়েছি। সে ব্যাটা ডালখোর, বারোমাস ডাল খায়। দারুণ রাঁধে। এখন কষ্ট করে চালিয়ে নে। কাল ভালোকিছুর ব্যবস্থা করব। তোর ডিমে কাঁচামরিচ আছে, পেঁয়াজ খাস তুই?”

সৃজার মনে বহু প্রশ্ন উঁকি দিলেও সে চেপে গেল। পাছে না রেগে যায় আবার! সে ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

“না।”

ইহসান ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার স্বস্তি পেল,

“গ্রেট। কখনো খাবিও না। আমি পছন্দ করি না।”

“আচ্ছা।”

ইহসান খাবারের প্লেট নিয়ে এলে সৃজা দেখল শুধু একটা প্লেটেই ভাত, ডিম। ডিমটা অবশ্য আধপোড়া। আর বাটিতে ডাল। ইতস্তত করল সৃজা,

“তুমি খাবে না?”

“তুই খাওয়ার পরে।”

“কেন? না না, একসাথে খাব চলো।”

দৃঢ় শোনাল কথাটা। ইহসান একটুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“প্লেট সংকট। তুই খা, আমি খেয়ে নেব।”

“কিন্তু…”

সৃজাকে একপ্রকার ধমকেই প্লেটে হাতে ধরিয়ে দিলো ইহসান। মেয়েটাও বাধ্য হয়ে নিলো। ইহসান ওর দোনোমনা বুঝল ঠিকই। সৃজা কয়েক লোকমা নিজে খেয়ে এরপর দ্বিধাবোধ নিয়ে সে ইহসানকে বলল,

“তোমার তো হাত কাটা, খেতে গেলে জ্বলবে।
আমি খাইয়ে দিই?”

বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ভাত তুলে ধরল
ওর মুখের সামনে। ইহসান কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে এরপর বিনাবাক্যে ভাতটুকু মুখে নিলো। ভালোই লাগল ওর। হয়তো বউয়ের হাতে খাচ্ছে বলে এক্সট্রা স্বাদ পাচ্ছে। খাওয়ার পর্ব শেষে সৃজা ঠোঁট টিপে হাসি আটকে বলল,

“ডিমভাজায় পরেরবার লবণ দিও। এখন ডাল দিয়ে মেখেছি তাই বোঝা যাচ্ছে না।”

ইহসান হতভম্ব চোখে একবার চেয়ে এরপর গাট্টা মারল ওর মাথায়,

“আগে বলবি না? আমি তো প্রথমবার করলাম।”

“পরের বার মনে রেখো।”

ইহসানের মেজাজ খারাপ। সে বলল,

“নিজের হাতের অখাদ্য খেয়ে অকালে বউ বিধবা করতে চাই না। লোকে আমার পৌরুষবোধ নিয়ে
ঠাট্টা করবে।”

ওর বলার ভঙ্গি দেখে সৃজার হাসি পেল। হেসেও ফেলল। ইহসানের রাগ হলো তা দেখে। চিবিয়ে
চিবিয়ে বলল,

“আর বউকে আদর না করে মরতেও চাই না।”

সৃজার মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল।

_____________

চলবে…