#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩
ইহসানের মেজাজ খারাপ। সে বলল,
“নিজের হাতের অখাদ্য খেয়ে অকালে বউ বিধবা করতে চাই না। লোকে আমার পৌরুষবোধ নিয়ে
ঠাট্টা করবে।”
ওর বলার ভঙ্গি দেখে সৃজার হাসি পেল। হেসেও ফেলল। ইহসানের রাগ হলো তা দেখে। চিবিয়ে
চিবিয়ে বলল,
“আর বউকে আদর না করে মরতেও চাই না।”
সৃজার মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল। মুখ ফিরিয়ে নিলো অন্যদিকে। আড়ষ্টতা এসে ভর করল আচমকাই। ওড়না মুঠোয় নিয়ে বসে রইল চুপচাপ। এদিকে কথাটা বলে নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে ইহসান৷ সে তো এমন কিছু বলতে চায়নি, তার তেমন কোনো ইনটেনশনও নেই। সৃজা কী ওকে খারাপ ভাবল? ইহসান পরিস্থিতি স্বাভাবিক
করতে সৃজাকে বলল,
“রাত বাড়ছে, গোসলটা সেরে নে। ব্যাগে জামাকাপড় আছে। যেটা পছন্দ পরে নে।”
সৃজা যেন অনুমতির অপেক্ষায় ছিল। সঙ্গেসঙ্গেই উঠে দাঁড়াল। পা বাড়াতেই ইহসান পেছন থেকে ডেকে ধীর স্বরে বলল,
“সাইজে কমবেশ হতে পারে, আপাতত মানিয়ে পর। পরেরবার কেনাকাটা করতে গেলে সাইজ বলে দিস।”
সৃজা বেশ অপ্রস্তুত বোধ করছিল। চাইছিল ইহসানের দৃষ্টির আড়াল হতে। তাই কোনোমতে মাথা নেড়ে জামাকাপড় নিয়ে চলে গেল বাথরুমে। ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলল ইহসান। জীবনটা কেমন হুট করেই পাল্টে গেল। কখনো প্রেম-ভালোবাসা, বিয়ে-শাদি নিয়ে না ভাবা জীবনটাতে সৃজার আগমন ইহসানের জীবনের সবচেয়ে অকল্পনীয় এক অধ্যায়। আচ্ছা, খুব তো মেয়েটাকে সে নিজের জীবনে জড়াল। একবারও তো ভাবল না মেয়েটা ওর কাছে সেইফ থাকবে কি-না, ভালো থাকবে কি-না! সে যদি এদুটো গুরু দায়িত্ব পালন করতে না পারে তাহলে? সৃজাকে যদি সে প্রটেক্ট করতে না পারে তাহলে নিজের কাছেই সে ছোট হয়ে যাবে। আর নিজেকে কাপুরুষ সে ভাবতে পারে না, চায়ও না। এরথেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে সে ভালোবাসবে।
সন্ধ্যায় বাবা আর ভাইদের সাথে তার হওয়া ঝামেলা আর বাকবিতন্ডা থেকেই সে বুঝে গেছে বিয়ের ব্যাপারটা তারা এত সহজে মানবেন না। কোনো না কোনো ঘট পাকাবেই। আসলে, নিজের রক্তের মানুষগুলোকে শিরায় শিরায় চেনা আছে ইহসানের। স্বার্থে আঘাত পড়লে বা তাদের অবাধ্য হলে যেকোনো জঘন্য কাজ তারা বিনা দ্বিধায় করে ফেলে। আপন-পর মানে না। বাইরের দুনিয়ার মানুষ ভাবে শেখ বাড়ি হলো শান্তি আর পুণ্যের ঘর। অথচ চৌকাঠের ভেতর থাকা মানুষগুলোই জানে এ বাড়ির লোকেরা কতটা নিকৃষ্ট! এই নিকৃষ্টদের নষ্ট দৃষ্টি থেকে সৃজাকে রক্ষা করতে পারবে তো সে? ইহসানের মস্তিষ্কটা হাজারো চিন্তায় বিভ্রান্ত হতে লাগল৷ বুকের ভেতর অদৃশ্য হাঁসফাঁস। আচমকাই শক্তপোক্ত, বলিষ্ঠ শরীরটাতে কোনো বল পাচ্ছিল না সে৷ মেরুদণ্ডে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। তখনকার মারামারির ফল এটা। অবসাদে ভেঙে আসছে শরীর। ব্যথায় তাড়নায় মুখটা বিকৃত হলো ইহসানের। কোনোমতে একটা পেইন কিলার খেয়ে নিয়ে সে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। শুতেই ব্যথাটা যেন কড়মড়িয়ে উঠল। সহ্য করে নেয়ার চেষ্টা চালাল ইহসান। তাতে কাজ হলো। সময় নিয়ে ব্যথাটা কমল। অন্যসব দিন এই রাত বারোটার সময় সে ঘুমে থাকতো।
তার জীবনটা খুব গোছানো। সময় মেনে চলে। কিন্তু গত কয়েকদিনের কর্মকান্ডে সে বুঝে গেছে তার জীবনটা আর কখনো আগের মতো স্বাভাবিক হবে না, গোছানো হবে না।
সৃজা গোসল সেরে বেরিয়ে দেখল ইহসান ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথার নিচে দুটো বালিশ দেয়া। ঘাড়টা একপাশে কাত হয়ে আছে। ঘাড় ব্যথা হতে বাধ্য৷ সৃজা একবার ভাবল ডাকবে কি-না! পরক্ষণেই মন না বলল। সারাদিনের ধকলের পর এই অস্থির লোক আবার মারামারিও করেছে। শরীর নিশ্চয় অবসাদগ্রস্ত। এখন ডেকে ঘুম ভাঙানো উচিৎ হবে
না। ফলে নিজেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব ত্যাগ করে বালিশ ঠিক করে দেবে বলে ভাবল। কিন্তু একজন শক্ত-সামর্থ্য পুরুষ মানুষকে ঘুমন্ত অবস্থায় এক চুল পরিমাণ নাড়ানো যে অসম্ভব ব্যাপার, সেটা ভাবেনি। দিকে কোথা থেকে আসা পানির ছিটেফোঁটা, বরফ ঠান্ডা কোমল হাতের স্পর্শ আর খুব কাছ থেকে পাওয়া এক ধরণের মিষ্টি সুবাস নাসারন্ধ্রে
ধাক্কা দিতেই সটান চোখ খুলে গেল ইহসানের।
কয়েক পল তাকিয়ে থাকার পর যেন মস্তিষ্ক সচল হলো তার। সৃজাকে মুখের উপর ঝুঁকে থাকতে দেখে বিস্মিত হয়ে গেল। নড়েচড়ে উঠে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“এখানে কী করছিস?”
সৃজা লাফিয়ে উঠে দূরে সরে গেল। আমতাআমতা করে বলল,
“বেকায়দায় দুটো বালিশে ঘুমাচ্ছ, ঘাড় বাঁকা হয়েছিল। তাই ঠিক করতে চেয়েছিলাম…”
“আমাকে ডাকলেই হতো।”
“কাঁচা ঘুম থেকে ডেকে তোলা ঠিক নয়৷”
সৃজার মুখটা স্নিগ্ধতায় ভরা। ভেজা চুলের পানি টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটা আলতো হাতে চুলগুলো সামলাচ্ছে। ভালো লাগছে দেখতে। তবে ইহসান বেশিক্ষণ তাকাল না। চোখ ঘুরিয়ে একপাশে কাত হয়ে শুতে শুতে প্রসঙ্গ বদলাল,
“আলোটা নিভিয়ে দে।”
সৃজা আলো নিভিয়ে দিতেই বাইরে থেকে আসা
আধো সোনালী আলো ঘরে কুচি বিছিয়ে ছড়িয়ে পড়ল। অন্ধকার আর পুরোপুরি হলো না। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সৃজার কানে এলো ইহসানের কণ্ঠস্বর,
“রাত অনেক হয়েছে। শুয়ে পড়।”
সৃজা চট করে মুখ নামিয়ে বলল,
“কোথায় শোব?”
ইহসান চোখ পাকিয়ে তাকাল। এরপর একপাশে সরে গিয়ে বিছানার অন্য পাশটা খালি করে দিলো। মাথাটা একটু উঁচিয়ে রেখে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“শুটিং স্পটে নেই তুই, সিনেমা না এটা। না তুই হিরোইন, আমি হিরো। থাপ্পড় আরেকটা গালে পড়ার আগে বুঝে নে তোর জায়গাটা কোথায়।”
সৃজা আর কথা বাড়াল না। একরাশ লজ্জা, ভয়
আর সিডরের গতিতে চলা হৃদ স্পন্দন নিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল ইহসানের পাশে ফাঁকা অংশটাতে। এরপর একে একে কেটে গেল অনেকটা ক্ষণ। ঘড়ির কাঁটা জানান দিল সময় এখন মধ্যরাত। সৃজার হাঁসফাঁস লাগছে, কিছুতেই চোখের পাতা এক হচ্ছে না। এলিজার কথা মনে হচ্ছে। মেয়েটা এখন কি করছে? ঘুমাচ্ছে নাকি পড়ছে? সামনে এইচএসসি পরীক্ষা মেয়েটার। এখন টেস্ট চলছে। মেয়েটার তো আবার রাতজেগে পড়ার অভ্যাস। কিছু কি খেয়েছে? সৃজাকে কি মিস করছে? সৃজা তো খুব করছে।
ইচ্ছে করছে এক্ষুনি ছুটে চলে যেতে। ছোট বোনটাকে ছাড়া কখনো ঘুমিয়েছে সে? কভু না৷ কি থেকে কি হয়ে গেল একটা দিনের ব্যবধানে! সৃজা কি গতরাতেও ভেবেছিল, চিরকাল যাকে নিজের বড়ভাইয়ের চোখে দেখে এসেছে আজ তার বউ হয়ে নিজের বাবা-বোন, ফুপিটাকে ছেড়ে চলে আসবে? কখনো ভাবেনি। অথচ পরিস্থিতি বাধ্য করেছে। আঁধারে সৃজার চোখ জলে ভরে উঠল। নাক টানল অনবরত। আচমকা টের পেল কেউ ওকে টেনে নিচ্ছে বিছানার অন্যপাশে। সৃজা ভড়কে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিজেকে পাশের পুরুষের বুকে আবিষ্কার করল। পুরুষালি কণ্ঠটি ধীরে ধীরে নেমে এলো ওর কানের কাছে। নিম্ন স্বরে বলল,
“ঘুম আসছে না? এলিজ বুড়ির কথা মনে পড়ছে?”
ইহসানের গলায় আহ্লাদ খুঁজে পেয়ে সৃজা এবার ফুঁপিয়ে উঠল একপ্রকার,
“আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারব না।”
ইহসান ওর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অস্থির কণ্ঠে বলল,
“হুঁশ, কাঁদে না।”
“আমি ওকে মিস করছি, বুঝতে পারছ তুমি?”
“পারছি। ওকে নিয়ে ভাবিস না, ভালো আছে। আসার সময় দেখে এসেছি।”
সৃজা মুখ তুলে চাইল ইহসানের দিকে। ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“খারাপ তুমি আসলেই। বলোনি কেন?”
ইহসান বলল,
“কারণ, তুই কাঁদুনি৷ বুড়ি তোর মতো না৷ যথেষ্ট স্ট্রং। এক্সাম আছে পরশু, পড়ছে। আমি তো আসতে বলেছিলাম, রাজি হলো না। বলল এক্সামের প্যারা শেষ হলে দেখা যাবে। তাছাড়া তোর ফুপিকে বলে এসেছি। খেয়াল রাখবে।”
“আর বাবা? ঔষধ নিয়েছে ঠিকঠাক?”
“নিজ হাতে খাইয়ে এলাম। চিন্তা করিস না সব ঠিক আছে, সবাই ঠিক আছে।”
সৃজা একটু শান্তি পেল যেন। ইহসান এবার ওর মনোযোগ ঘুরাতে বলল,
“মাঝেমধ্যে মনে হয় এলিজ না তুই বাচ্চা। এলিজের মতো হ। মাত্রাতিরিক্ত টান ওর প্রতি, কমা একটু। আশেপাশের কাউকে ওখান থেকে কিছু টান বিলিয়ে দিলে বেশি ক্ষতি তো হবে না।”
সৃজা ক্ষেপে গেল,
“ছোট থেকে ওকে বড় করেছি আমি। ও আমার বোন কম মেয়ে বেশি। তুমি কীভাবে ওসব বলছ?”
ইহসান ওর রাগ বুঝে অন্ধাকারে ঠোঁট চেপে হাসল। বলল,
“আচ্ছা, আর বলব না। ঘুমা।”
“আসছে না।”
“কী করলে আসবে?”
সৃজা ভার স্বরে বলল,
“এলিজাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমালে।”
ইহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,
“বউ না শত্রু?”
কিন্তু মুখে বলল,
“এখন তো সম্ভব হচ্ছে না। যখন সম্ভব হবে তখন এনে দেব ওকে। এখন চোখদুটো বন্ধ করে নিজেও ঘুমা, আমাকেও ঘুমাতে দে। দয়া কর।”
সৃজার অভিমানে গাল ভারী হলো। ইহসানের বুক থেকে ছাড়া পেতে চাইল। কিন্তু ছাড় পেল না। উল্টো শক্ত দুটো হাত ওকে আরো জাপ্টে ধরল। সৃজার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল৷ একটুখানি মুক্ত হয়ে অক্সিজেন নেওয়ার জন্য ছুটোছুটি শুরু করতেই ইহসান ধমক দিয়ে বলল,
“চুপ করে ঘুমা। আর জ্বালাস না।”
সৃজা শান্ত হয়ে মুখফুটে বলল,
“শ্বাস নেব।”
ইহসান একটু আলগা করল হাতের বাঁধন তবে ছাড়ল না। সৃজা এতক্ষণে একটু স্বস্তি পেল৷ বুকভরে শ্বাস নিয়ে সে হতাশ গলায় শুধাল,
“ছাড়বে না?”
ইহসান রুক্ষ স্বরে বলল,
“ছাড়ার জন্য তো ধরিনি।”
____
চলবে…