#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫
ইহসান প্রতুত্তরে কিছুই বলল না। তুচ্ছ ভঙ্গিতে হাসল। যেন সৃজার কামড়ে সে ব্যথা নয়, মজা পেয়েছে। আর এটা বুঝিয়ে দিতেই সে ধীরেধীরে সৃজার কামড় দেওয়া হাতটা তুলে নিজের মুখের কাছে নিলো। এরপর হাতে যেখানে সৃজা কামড় বসিয়েছিল সেখানে নিজের ঠোঁট বসিয়ে চুমু খেল, সৃজার চোখের দিকে তাকিয়ে। এরপর ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বড় ভাইরুপী লোকটাকে মাত্র একদিনের ব্যবধানে এমন লুচো রুপে দেখে সৃজা লজ্জিত, কুণ্ঠিত, হতভম্ব হয়ে গেল। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ভার মুখে আওড়াল,
“ছিহঃ! এসব কী করছ?”
সৃজার গলার শীতলতা, লাজুকতা ধরে ফেলল ইহসান। পরখ করল ওকে বেশ গভীর চোখে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল তবে মুখের ভাবভঙ্গি আগের মতো রেখেই অবাক হবার ভান ধরে বলল,
“কেন, ভালো হয়নি?”
ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল সৃজার কানদুটো। রক্তিম আভা ফুটে উঠল গালে, যেন বুরুশের আঁচ লেগেছে গাঢ়ভাবে।
“খুব নির্লজ্জ তুমি, ইহসান ভাই।”
সহসা আবহাওয়া যেন পাল্টে গেল। আচমকা যেন আকাশ কাঁপিয়ে মেঘ গর্জন করে উঠে ঠিক তেমনিভাবে ইহসানের কানদুটো এবার ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। জানালার ধারে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির রিনরিনে কণ্ঠে বলা “ভাই” ডাকটি যেন কিছুতেই নিজের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছিল না সে৷ তৎক্ষনাৎ চোখমুখ বিকৃত করে সে চাপা ক্ষোভের সহিত কথাটা বলল,
“আর তুই খুব ন্যাকাবতী মহিলা। বিয়েশাদী করে, একঘরে রাত কাটিয়ে তুই তোর হাজব্যান্ডকে এখনো ভাই ডেকে ডেকে তার কলিজা, ফুসফুস ভুনা করে ফেলছিস। শুধু সালাদের সাথে পরিবেশন করাটা বাকি। আচ্ছা, ইহজনমে দেখেছিস কেউ নিজের বিয়ে করা বরকে “ভাই” ডাকে?”
এতবড় রচনা শুনে সৃজা অবাক ও বিস্মিত হয়ে তাকাল ইহসানের দিকে। পরক্ষণেই মাথানিচু করে বলল,
“অনেকেই ডাকে। অভ্যেস।”
ইহসান তিক্ত চেহারা বানিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বলল,
“তোর অভ্যেস বদলা, গালে একটা পড়ার আগে।”
সৃজা নেতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল,
“কী বলব তাহলে? নাম ধরে অন্তত ডাকতে পারব না। গুণে গুণে তুমি আমার আট বছরের বড়।”
“তোরই তো!”
ইহসানের গলাটা অন্যরকম শোনাল। যেন খুব সিরিয়াস সে ব্যাপারটা নিয়ে। সৃজা লজ্জা পেল। ইহসানের দৃষ্টির সামনে পড়ে অসহায় মুখ বানিয়ে বলল,
“এমনতর বেয়াদবি জীবনেও করতে পারব না। তারচেয়ে গালে দুটো চড়ই বসিয়ে দাও। আমি কিছু মনে করব না, সত্যি বলছি।”
ইহসান ভ্রুক্ষেপ করল না সেকথায়। তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় কেউ অবাধ্য হলে, হাত নিশপিশ করে। সৃজার জায়গায় অন্যকেউ হলে এতক্ষণে কয়েকটা পড়তো কানের নিচে। রাগ জেদ সালাম দেওয়া তারজন্য খুব কষ্টকর। এটা বংশগতির ধারা হিসেবে বয়ে এসেছে তার রক্তেও। রক্তটা পেয়েছে সে শেখ বাড়ির পুরুষদের থেকে। এদিক দিয়ে সে ব্যতিক্রম হতে পারেনি তাদের থেকে। ইহসান কঠিন মুখেই কর্কশ স্বরে বলল,
“বাহানা চলবে না। আজ, এই মুহূর্তের পর কোনোভাবেই ভাই ডাকটা আমি এলাউ করব না। মাথায় রাখিস।”
সৃজা বুঝে গেল লোকটা তার কোনো কথাই শুনবে না। একগুঁয়ে জেদ দেখাবে। অহেতুক একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হবে। দোনোমোনো ভাবটা লুকিয়ে সে মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। এত সহজ নাকি কারো প্রতি সম্বোধন পাল্টানো? তাও হঠাৎ করে? সৃজা বুঝে পেল না হুট করে সে “ভাই” ডাক বাদ দিয়ে কী বলে ডাকবে আট বছরের বড় স্বামী নামক লোকটাকে!
ইহসান বেরুবে। বাজারসদাই কিছু করতে হবে। দুপুরের খাবারের আয়োজনে ভালো কিছু পদ থাকতে হবে। গতরাতটা কোনোমতে ডিমভাজা আর সকালে ইন্সট্যান্ট কফি আর ড্রাই কেক দিয়ে নাস্তা সারা হয়েছে। যেটা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না ইহসানের। সৃজাটার নিশ্চয় অসুবিধা হচ্ছে। অথচ বলতে পারছে না। ইহসান ওয়ালেট আর ফোনটা খুঁজে নিয়ে ঘরে থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে থেমে গেল। এরপর দু’সেকেন্ড দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবল!
পিছু ফিরে গম্ভীর মুখে বলল,
“নাম ধরে ডাকতে না পারলে জানপ্রাণ কিছু একটা ডাকিস। আজকাল তো অনেকেই ডাকে।”
বলেই বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেল। আর সৃজা থমকে গিয়ে অসহায়ের ন্যায় মুখ করে বসে রইল।
মনে হচ্ছে ইঁদুর মারার ঔষধ খাইয়ে এই লোকটার হুটহাট নষ্ট হয়ে যাওয়া, মস্তিষ্কের নির্লজ্জ পোকাটাকে মে’রে ফেলতে। যেন এভাবে ওর উপর এত লজ্জাবাণ আর বিধিনিষেধ আরোপ করতে না পারে। ঠিক কী বলে গেল ইহসান ওকে? জানপ্রাণ ডাকতে? ন্যাকান্যাকা কথাটা কীভাবে উচ্চারণ করবে সৃজা?
“ইহসান জান, শুনছ?”
ও মাই গড, সৃজা! তুই নাহয় চারবেলা নিয়ম করে লোকটার শক্ত হাতের থাপ্পড় খাবি, মুখ ঝামটা খাবি। কিন্তু লাজলজ্জা এত দ্রুত বিসর্জন দিস না। এতে তোর মৃ’ত্যু নিশ্চিত! সৃজা অস্থিরতায় মুখ ঢেকে ফেলল।
——
অনেকগুলো আচারের বয়াম নিয়ে ইস্মি ছাদে যাচ্ছিল৷ সৃজার ঘর পেরিয়ে যাওয়ার সময় ভাবল মেয়েটা দু’দিন ধরে বেশিরভাগ সময়ই ঘরে বসে থাকছে। কোথাও বেরুনোর মতো পরিস্থিতি নেই বলে। ইহসান বেরিয়ে যাওয়ার আগে ইস্মিকে বলে গেছিল সৃজার প্রতি খেয়াল রাখতে। একটু সঙ্গ দিতে। সেই ভেবেই ইস্মি সৃজাকে ডেকে সাথে করে ছাদে নিয়ে এসেছিল। ইস্মি অবশ্য বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি। হাতের কাজ ফেলে এসেছে বলে না চাইতেও চলে যেতে চাচ্ছিল সৃজাকে নিয়ে, সৃজাই ওকে বলে কয়ে রয়ে গেল। ইহসান এখনো ফেরেনি৷ একা একা ঘরে বসে বোর হওয়ার চেয়ে ছাদের দোলনায় বসে হাওয়া খেতেই ভালো লাগছিল ওর। ছাদ থেকে পুরো বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। বিশাল তিন তলা বাড়ি। আগেকার দিনের যৌথ পরিবারগুলো যেমন বৃহৎ বাড়িগুলোতে থাকতো, এ বাড়িটাও ঠিক তেমন। সামনে-পেছনে বৃহৎ খালি জায়গা আর মাঝখানে হলুদ রঙ ঘষা দেয়ালের শেখ বাড়িটি নিজের আভিজাত্যতা বজায় রেখে যেন কয়েক যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সামনের বিস্তৃত উঠোনটি গাছগাছালি আর ঘাসে ভরা। অন্দর থেকে মূল গেইট অবধি যেতেই মিনিট দেড়েক হাঁটতে হয়। গতদিন আসার সময় অবশ্য এতকিছু খেয়াল করেনি সৃজা। ছাদ থেকে বাড়ির পেছনে একটাপুকুরও দেখা যাচ্ছে। দেখেই মনে হচ্ছে যত্নহীন। পাড়ে নারকেল গাছের সারি। বাড়িটা বোধহয় লোকালয় থেকে ভেতরের দিকে, আশেপাশে বাড়িঘর কম। বলা যায় শেষপ্রান্তে। কারণ এরপরই সুদীর্ঘ রেললাইন দেখা যাচ্ছে। সৃজার মিশ্র অনুভূতি হলো। বাড়িটা একই সাথে চোখ ধাঁধানো সুন্দর, আবার কেমন গা ছমছমেও। এক কথায় ভয়ংকর সুন্দর।
“রুপ-গুণ যেটুকু আছে ভালই, কিন্তু আমার থেইক্কা বেশি না। চুলগুলাও আমার থেইক্কা কম লম্বা, তাও রং করা নাই। আমি এক সপ্তাহ আগে ষোলো হাজার ট্যাহা দিয়া চুল রঙ করাইছি, কার লাগি জানোস? ইহসানের লাগি। তারজন্য এতকিছু করলাম, এত ভালবাসি তারে অথচ সে আমারে ধোঁকা দিয়া তোরে বিয়া করল? কী দিয়া ভুলাইসোস ইহসানরে? কী এমন দিছোস যেইটা আমি দিতে পারমু না তারে?”
চাপা আর ক্রুদ্ধ স্বরে কথাগুলো ভেসে আসায় ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকাল সৃজা। যাকে দেখল তাকে চিনলো না ও, গতদিন একে দেখেনি। লাল রঙের রাউন্ড জামা পরিহিত সুন্দরী এক মেয়ে সে। যার মুখটা রাগে দপদপ করছে, আর মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে অশ্রাব্য গালি। যেগুলো শুনে সৃজার এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো আর কিছুক্ষণ এসব শুনলে ওর বমি হয়ে যাবে। তবুও বিস্ময়সূচক স্বরে আওড়াল,
“কে আপনি? আমার উপর চটেছেন কেন? আর অহেতুক গালিগালাজই বা করছেন কেন?”
তেড়েফুঁড়ে এলো মেয়েটি। যেন সৃজাকে ধরতে পারলে খু’নই করে ফেলবে এমনই মুখভঙ্গি তার। সৃজা চমকে গেল। মেয়েটি এসে ওর গালে চাপা দিয়ে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে খসখসে গলায় বলল,
“তুই ওর লগে একখাটে ঘুমাস? ওর আদর নিস? ও তোরে ভালোবাসে? কেমনে ছুঁইছে ও তোরে? কোনখানে ছুঁইছে? হারামজাদি কী দিয়া বশ করছোস আমার ইহসানরে? সে কেন আমারে রাইখা তোরে বিয়া করল? আমার জায়গা ছিনায়া নিয়া সুখে ঘর করবি ওর লগে? এত স্বপ্ন তোর হারামির বাচ্চা?”
সৃজা হতভম্ব হবার সুযোগ পেল না। মনে হলো গালের হাড্ডি বুঝি ভেঙে যাবে। ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে যেয়েও পারল না। এরপরই পাগলের মতো সৃজার জামা-ওড়না টানাটানি শুরু করল এবার মেয়েটা। যেন ছিঁড়ে দেখবে কোথায় ইহসান ছুঁয়েছে ওকে। সৃজা মেয়েটাকে সরানোর চেষ্টা করে পারছে না। যেন মেয়েটার গায়ে একশো অসুর ভর করেছে। মুখের অশ্লীল-অশ্রাব্য গালিও থামানোর নাম নেই। সৃজার কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। রাগে বাঁধ ভাঙল সৃজার। থাপ্পড় বসিয়ে মুখ ভেঙে দিতে ইচ্ছে করল। নিজেকে ছাড়ানোর কৌশল হিসেবে পা ব্যবহার করল। অসভ্য মেয়েটির পায়ের ভেতর দিয়ে ডান পা’টা প্যাঁচিয়ে নিয়ে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করতেই মেয়েটার হাত ওর গাল থেকে
ফসকে গেল আর তাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে গেল। কাজটাতে সফল হয়ে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল সৃজার নিজেকে সামলে নিতে। দম টেনে নিয়ে গায়ের ওড়না ভালোভাবে টেনে নিয়ে নিচে পড়ে পা ব্যথা নিয়েও ওর
দিকে তেড়ে আসার চেষ্টা করা মেয়েটার উদ্দেশ্যে হুংকার দিয়ে বলল,
“তুই নিশ্চয় মেজো বউয়ের বোন লিথু? শোন অসভ্য মেয়ে, তোর ইহসান এখন আমার লিখিত স্বামী। সে আর তোর হবে না। তালে এখন ভাই বলে ডাকবি। ছ্যাছড়ার মতো তার পিছু না পড়ে থেকে সুন্দর দেখে একটা ছেলে বিয়ে করে ঘর-সংসার কর। এতেই মঙ্গল। তবে তার আগে অবশ্যই নিজের তারছিঁড়া মাথাটা ঠিকঠাক করার জন্য পাবনা পাগলা গারদ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে মাসখানিকের জন্য নিজের ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করিস। আর স্কুলে ভর্তি হয়ে ভাষা প্রয়োগের সদ্ব্যবহার শিখে নিস। ওকে?”
একপ্রকার শাসিয়ে ছাদ থেকে নেমে এলো সৃজা। পেছনে তখনো লিথু হতভম্ব হয়ে বসে সৃজার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। এ মেয়েটার সাহস দেখে তার পিত্তি জ্বলছে! ওকে ফেলে দিল ল্যাং মেরে? এত্ত সাহস ওর? ইহসান কী দেখল ওর মধ্যে? কেন বিয়ে করল? লিথুর মাথা নষ্ট হয়ে যেতে লাগল বারবার এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে। গতকাল যখন বোনের কাছে শুনল ইহসান বিয়ে করে বউ এনেছে, খবরটা শুনেই লিথু অজ্ঞান হয়ে গেছিল। জ্ঞান ফেরার পর থেকে লিথু পুরোপুরি পাগলামি শুরু করেছে। রাতটা পেরিয়ে সকালেই শেখ বাড়ি আসতে চেয়েছিল, কিন্তু মা-বাবা দেয়নি। পরে নিজেই ওদের সাথে ঝগড়াঝাটি করে বেরিয়ে এসেছে বোনের শ্বশুরবাড়ি। শুধুমাত্র ইহসানের বউকে উচিৎ শিক্ষা দেবে বলে। কী এমন আছে এই মেয়ের মধ্যে যে ইহসান ওকে রেখে একে বিয়ে করল? রাগে-ক্ষোভে যেন অন্ধ হয়ে গেল লিথু। এই মেয়েটা নিশ্চয় রাতে ইহসানের আদর নিয়েছে, ওর বুকে ঘুমিয়েছে!
.
ইহসান ফিরে এসে দেখল সৃজা বারান্দায় বসে আছে। ওকে দেখে কিছুতো বললোই না বরংচ মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। দৃষ্টি দিলো বাইরে। দুপুরের কড়া রোদে মেয়েটা বসে এভাবে ফুলছে কেন ইহসান কিছু বুঝতে পারল না৷ গলা খাকারি দিয়ে বলল,
“একগ্লাস পানি দে তো।”
সৃজা ছোট্ট, ধারাল গলায় জবাব দিল,
“পারব না।”
ইহসান ভ্রু কুঁচকে ফেলল,
“কেন?”
“তোমার সাইকো প্রেমিকাকে ডেকে আনো। সে দেবে।”
ইহসান হতবাক কণ্ঠে বলল,
“ওটা আবার কে?”
“তোমার লিথু।”
________
চলবে…