#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬
ইহসান ফিরে এসে দেখল সৃজা বারান্দায় বসে আছে। ওকে দেখে কিছুতো বললোই না বরংচ মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। দৃষ্টি দিলো বাইরে। দুপুরের কড়া রোদে মেয়েটা বসে এভাবে ফুলছে কেন ইহসান কিছু বুঝতে পারল না৷ গলা খাকারি দিয়ে বলল,
“একগ্লাস পানি দে তো।”
সৃজা ছোট্ট, ধারাল গলায় জবাব দিল,
“পারব না।”
ইহসান ভ্রু কুঁচকে ফেলল,
“কেন?”
“তোমার সাইকো প্রেমিকাকে ডেকে আনো। সে দেবে।”
ইহসান হতবাক কণ্ঠে বলল,
“ওটা আবার কে?”
“তোমার লিথু।”
লিথু’র নাম শুনে ইহসানের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। হাতে থাকা কাপড়টা পড়ে গেল বিছানায়। সৃজা তো একে চেনে না, তাহলে হঠাৎ এর নাম মুখে নিলো কেন? কাহিনী কি! ইহসান বারান্দায় গিয়ে সৃজার মুখোমুখি হয়ে বসল। মেয়েটা তাকাল না। আগের ন্যায়ই মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। প্রাঞ্জল ভাবটুকু হারিয়ে গেছে যেন হুট করে। ইহসান সতর্ক চোখে সৃজাকে অবলোকন করে এরপর থমথমে স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
“ঘটনা কী, খুলে বল।”
“কিছু না।”
বাইরে দৃষ্টি রেখেই ভার গলায় উত্তরটা দিলো সৃজা। ইহসান ছোট্ট শ্বাস ফেলে চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসল এবার। যেন নিজের রাগ সামাল দিচ্ছে। সৃজা দৃষ্টি তুলে একবার দেখে এরপর বেশ ঘৃণাভরে জিজ্ঞেস করল,
“ওটাকে বিয়ে করলে না কেন?”
“আমার ইচ্ছে।”
“আমাকে করলে কেন?”
ইহসান এবারেও গমগমে কণ্ঠে আওড়াল,
“আমার ইচ্ছে।”
সৃজা এবার বেশ চটে গিয়ে বলল,
“কথা বলাই বৃথা তোমার সাথে।”
“তবুও বলতে হবে।”
বলেই ইহসান এবার চোখদুটো খুলে সরাসরি তাকাল। কঠোর দৃষ্টি। সৃজা কুঁকড়ে গেল, পড়তে পারল চোখের ভাষা। ঢোক গিলল কিছুটা ভয়ে। নিচের ঠোঁটটা হালকা কামড়ে ভীতু দৃষ্টি ছুঁড়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে,
“লিথু মেয়েটা তো সুন্দরী, তোমার জন্য ষোলো হাজার টাকা দিয়ে চুলে রঙ করিয়েছে। বেচারিকে কেন ধোঁকাটা দিলে?”
ইহসানের চোখের দৃষ্টি শীতল হয়ে এলো। তবে ক্ষ্যাপাটে গলায় বলল,
“মুখ ধুয়ে তোর সামনে এসেছিল তো?”
সৃজা থতমত খেয়ে বলে,
“মানে?”
ইহসান তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
“বুঝেছি, মুখ ধুয়ে তোর সামনে আসেনি। তাহলে অবশ্যই তাকে সুন্দরী না বলে বান্দরী বলতি। আর শোন, চুলে রঙ দেওয়া বিলাতি বান্দর আমার একদম রুঁচবে না, নিয়ম করে প্রতিবেলা বমি করতে হতো। বমির যন্ত্রণা থেকে শরীরকে মুক্তি দিতেই পিওর একটা মেয়ে খুঁজছিলাম, যে কাঁদলে গালে দেওয়া মেকআপের প্রলেপ খসে পড়বে না। খুঁজে খুঁজে তোকে পেয়ে গেলাম, তাই ধরে বেঁধে বিয়ে করে নিয়েছি। বুঝলি?”
সৃজাকে আহাম্মক বানিয়ে উঠে চলে গেল ফ্রেশ হতে চলে গেল ইহসান। সৃজা নিজেও ঘরে চলে এলো। এরপরই ওর মাথায় কথাগুলোর মানে ধরা দিলো। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল বিচিত্র হাসি। ইহসান ফ্রেশ হয়ে বেরুতেই দেখল সৃজা দরজার সামনে গামছা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে অবাক ভঙ্গিতে গামছাটা নিয়ে মাথা মুছতে গেলে আচমকাই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়ল সৃজার গলার বিউটি বোনের দিকে। থমকে গিয়ে সে জিজ্ঞেস করল,
“ব্যাপার কী? ওখানে আঁচড় দিলো কে? আমি তো কিছু করিনি।”
সৃজার কান গরম হয়ে গেল। চমকে উঠে ওড়না দিয়ে ঢাকতে ঢাকতে বলল,
“নির্লজ্জতার সীমা অতিক্রম করো না। আমি কিন্তু তোমার নাকেমুখে দু-চার ঘা লাগাতে পারি।”
ইহসান সোজা হয়ে দাঁড়াল। রুক্ষ স্বরে বলল,
“কে করেছে?”
সৃজা মুখ নামিয়ে বলল,
“লিথু।”
ইহসানের কপালে ভাঁজ পড়ল,
“কেন?”
“তোমার জন্য।”
বাকিটা আর বলতে হলো না সৃজাকে৷ বুঝে নিলো ইহসান। রক্তাভ হয়ে এলো ওর চোখজোড়া, মুখে ফুটে উঠল কঠোরতা। ভেজা চুলগুলো একহাতে পেছনে ঠেলে দিয়ে গামছাটা ছুঁড়ে মারল টেবিলের উপর। এরপর তিরিক্ষি মেজাজে ফোন হাতে বারান্দায় চলে গেল। কাউকে ফোন করার উদ্দেশ্যে। সৃজা চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল ওর কর্মকাণ্ড। পরিস্থিতি কোথায়, কোনদিকে যাচ্ছে, কাহিনী-উদ্দেশ্য কী বুঝতে পারছিল না। কান পেতে শুনলো ইহসান ফোনে কাউকে বলছে,
“আমার সামনে পড়লে মেকআপের নিচে থাকা কুৎসিত মুখটা টেনে ছিঁড়ে ফেলব। সামলা শালিকে। ওয়ার্নিং রইল।”
এরপর আরো কিছু বলল ইহসান। কিন্তু সৃজা আর কান পাতলো না। আনমনে হেসে ফেলল৷ বুকের ভেতর কীসের একটা ঢেউ প্রফুল্লতা ছড়িয়ে গেল! ইহসানের রক্তাভ মুখপানের দিকে চেয়ে মনে হলো, এই রগচটা, মাথাগরম লোকটার কাছে সে নিরাপদ!
বিয়ের দিনের কুৎসিত স্মৃতিগুলো এক লহমায় যেমন নষ্ট করে দিয়েছিল, তেমনি লিথু নামক উটকো ঝামেলাটাকেও কেমন ঝেড়েমুছে দিচ্ছে!
সৃজা চোখ বুজল প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ভাবল দু’দিন আগের কাণ্ডগুলো। মাতৃহীন দুই বোন তারা। সৃজা আর এলিজা। ফুপু নীলু বেগম সেই চার বছর বয়স থেকে মানুষ করছে তাদের। এদিকে তাদের বাবা নাইমুর সাহেব স্ত্রী বিয়োগের শোক সইতে না পারার পর থেকেই ব্রেনস্ট্রোক করে প্যারালাইজড মানুষ। ইদানীং আরো একবার স্ট্রোক করে আরো কাহিল হয়ে পড়েছেন। এই অসুস্থতার দরুন ওদের বাড়িতে ইদানীং ঘনঘন যাতায়াত হচ্ছিল ইহসানের, যেটা আশেপাশের ফ্ল্যাটের মানুষজন ভালোভাবে দেখছিল না। মা-হারা দুটো মেয়ের বাড়িতে একটা ছেলে রাতবিরেতে ঘনঘন যাচ্ছে এটা তারা ভালো চোখে নেয়নি। বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য আর বানানো কাহিনী ছড়িয়ে দিয়েছিল এলাকাতে। যার কারণে ঘর থেকে বের হওয়াটা মুশকিল হয়ে পড়ছিল ওদের ফুপু আর দুই বোনের জন্য। এলিজা যদিও মুখের উপর জবাব দিয়ে অনেককে চুপ করে দিয়েছিল কিন্তু সৃজা প্রতিবাদ করেও রেহাই পায়নি। সেদিন ভার্সিটির ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার পথে এলাকার কিছু দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে ওকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিল, সৃজা যখন নিজেকে রক্ষা করতে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিতে থাকা মুরুব্বিদের সাহায্য চাইতে গিয়েছিল তখন তারা মুখের উপর কটাক্ষ করে বলে,
“তুমি নাইমুরের মাইয়া না? যাগো বাসায় লম্বা কইরা একটা পোলা দিন-রাইত বিবেচনা না কইরাই আহে? তোমাগো বাসা-বাড়িতে তো এইসবই চলে। ভালো মানুষগো বাসায় তো ছেলেমানুষ আসে না। বাজারী মাইয়াগো রাস্তাঘাটে একটুআকটু এইগুলা সহ্য করনই লাগে, অস্বাভাবিক কিছু না। পোলাপান তোমাগো দেখলে এইগুলা করবই।”
ইহসানকে ইঙ্গিত করে কথাগুলো বলা হচ্ছে এটা যখন সৃজা যখন বুঝতে পারল তখন সে আহাম্মক হয়ে গেছিল। কেন জানে না, রাগে জ্বলে উঠছিল শরীরের প্রতিটি কোষ। একটা বিপদগ্রস্ত মেয়েকে কোথায় ওরা সাহায্য করবে তা না, উল্টো ওকেই বাজারী মেয়ে বানিয়ে দিল? ঘৃণা মেশানো কণ্ঠস্বরে সৃজা শুধু বলেছিল,
“যাকে নিয়ে আপনারা এসব বানোয়াট কথা ছড়াচ্ছেন, সে আমার বড় ভাইয়ের মতো। তাকে আমরা সম্মানের চোখের দেখে এসেছি সবসময়। ভাই-বোনের সম্পর্ককে আপনারা এতটা নিচুস্তরে নামিয়ে নিয়েছেন, ছিঃ! আল্লাহ হেদায়েত দান করুক আপনাদের।”
কথাগুলো বলার পর হাসিঠাট্টা ছাড়া আর কিছুই পায়নি সৃজা মুরুব্বিদের থেকে। কান্নাভরা চোখ আর বিধস্ত মন-মস্তিষ্ক নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। এলিজা তখন বাড়িতে ছিল না। গেছিল কোচিংয়ে। হঠাৎ সৃজাকে এমন অবস্থায় দেখে নীলু বেগম ঘাবড়ে গেছিলেন সেদিন। সৃজাকে জোর করেও কিছু জানতে পারছিলেন না তিনি। মেয়েটা ফুপুকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদছিল। এমন সময়ই কলিংবেল বেজে উঠে। নীলু বেগম ভেবেছিল এলিজা ফিরেছে, সৃজাকে রেখেই কে এসেছে দেখতে যান। পিপহোল না দেখেই তিনি মেইন ডোর খুলে দেন। আর দেখেন পাশের বাড়ির মালিক আর তার স্ত্রীকে শাণমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে। নীলু বেগম কিছুই বুঝতে পারেন না এই দুই কুচুটে বর-বউ অসময়ে কেন তাদের বাড়িতে! তবুও তিনি ভদ্রতাসূচক হেসে ভেতরে আসতে বলতেই মালিকের স্ত্রী বাঁকা চাহনি নিক্ষেপ করে একটি ফোন এগিয়ে ধরে তার দিকে। নীলু বেগম কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাতেই বলে,
“আপনাগো বড় মাইয়ার কাণ্ডকীর্তি দেখেন।”
নীলু বেগম অবুঝ চোখে ফোনের স্ক্রীনে দৃষ্টি দিতেই দেখেন গলির মুখে কয়েকটা ছেলের সামনে ওড়নাবিহীন দাঁড়িয়ে আছে সৃজা। বুকে আড়াআড়ি হাত রেখে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে ছেলেগুলোকে বলছে তার ওড়না ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, কিন্তু ছেলেরা তার কথা না শুনে মজা আওড়াচ্ছে, আকারে-ইঙ্গিতে অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করছে। বাজারী মেয়ে আখ্যা দিচ্ছে। আর আমজনতা মজা গিলছে! ভিডিয়োটা দেখে নীলু বেগমের মাথার তালু গরম হয়ে গেল। সৃজা তাহলে এজন্যই কাঁদছে? অথচ মুখফুটে কিছু বলছে না? পথেঘাটে এভাবে অপদস্থ করা হচ্ছে নির্দোষ মেয়েটাকে আর সবাই দাঁড়িয়ে মজা আওড়াচ্ছে, কেউ এগিয়ে দুটো প্রতিবাদও করল না? নীলু বেগমকে এভাবে বোবার মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশের বাড়ির মালিক এবার কেশে উঠলেন,
“অনেক আগেই কইছিলাম মাইয়াগো বিয়া দিয়া ফালাইন, এত পড়ালেহার দরহার নাই। কিন্তু আমাগো কথা হুনেন নাই৷ এহন দেখলেন তো কার কথা ফলল? এই বাড়ির মাইয়াগো আর কেউ ফিরি’তে দিলেও নিব না৷ তয় আমি নিমু, কারণ আমার পোলা এহনো পাগল সৃজার জইন্য। মানতাছি হের পড়ালেহা কম। তাতে কী? পোলাপানগো অতকিছুর দরহার নাই, ট্যাহাপয়সাই আসল। হ্যায় ইতালি নিয়া যাইব ওরে বিয়ার পর। এইবার একটু দ্যামাগ কমাইয়া প্রস্তাবটা ভাইবা দেইখেন আফা।”
নীলু বেগমের শরীর জ্বলে উঠে কথাগুলো শুনে। তৎক্ষনাৎ বলে উঠেন,
“আপনারা আসতে পারেন।”
পাশের বাড়ির মালিক আর স্ত্রী রেগে যেতে গিয়েও সামলে নেন নিজেদের। হেসে হেসে বলেন,
“মাইয়ার মানসম্মান এহন কিছুই নাই, ভাইব্বা দেইখেন আফা। সারাজীবন আইবুড়ো হইয়া থাকব, নয়তো অন্যের মনোরঞ্জন করব। ঐ একটা পোলা আহে না রাইত-বিরেতে? তার। আইচ্ছা, ঐ পোলার কি মুরোদ নাই বিয়া করনের? খালি মজামাস্তি করনের লাগিই আয়ে? নাকি আপনেই ভাইঝিগো দিয়া ব্যবসা করান? অবশ্য আফনের নিজেরও তো সংসার হয় নাই। ফুপু-ভাতিজি সব এক ক্যাটাগরিতে নাম লিখানের আগে আগেই সৃজা মা’রে আমাগো ঘরে তুইলা দিবেন এই আশায় রইলাম। ওর দোষগুলা মাফ কইরা দিয়াই ওরে নিমু।”
বলে তারা বিদায় নেয়। নীলু বেগম স্তব্ধ হয়ে যান! এত কুরুচিপূর্ণ কথা কীভাবে মুখ দিয়ে বের করল তারা? ইহসানকে তিনি ছেলের চোখে দেখেন, আর সেই ছেলে আর নিজের ভাইঝিদের দিয়ে তিনি ব্যবসা করান? ছিহ! এমনকিছু বলার আগে তাদের মুখের জবান বন্ধ হয়ে গেল না কেন? তিনি বেশ ঘাবড়ে যান। সন্তানহীনা তিনি স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে ভাইয়ের সংসারেই আছেন। তার মা মরা মেয়ে দুটোকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন, কখনো কুশিক্ষা দেননি, বিপথে যেতে দেননি। সুশিক্ষায় বড় করেছেন। আদব-কায়দা শিখিয়েছেন। সেই নম্র-ভদ্র মেয়ে দুটোকে নিয়ে এলাকায় এত গুঞ্জন রটে গেছে, এটা তো ভালো লক্ষ্মণ নয়! তাছাড়া নীলু বেগম জানেন, এরা কেন সৃজাকে পুত্রবধূ করতে চায়। এই চারতলা বাড়িটি হাতিয়ে নিয়ে নিজেদের সীমানা-সম্পত্তি বাড়ানোর জন্য। এছাড়াও তাদের মূর্খ-নেশাখোর ছেলেটির জন্য কোনো ভালো আর ভদ্র ঘর থেকে প্রস্তাব পাচ্ছে না বলেই গত দু’টি বছর ধরে ওরা সৃজার পেছনে পড়ে আছে। তাদের মা নেই, বাবা প্যারালাইজড বলতে গেলে একপ্রকার অভিভাবকহীনই। এই চারতলা বিশাল বাড়ি ছাড়াও জায়গা-জমিও আছে। সব পাবে এই দুই মেয়ে। এসব ভেবেই হাত ধুয়ে লেগে আছে ওদের পেছনে! নীলু বেগম চিন্তায় চিন্তায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন মানুষ এত খারাপ কেন? সুযোগ-সন্ধানী কেন? কিছুতে না পেরে অনায়সেই অন্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কেন টানাহেঁচড়া শুরু করে? অবশ্যই সৃজা-এলিজা ভবিষ্যতে অনেক অনেক ভালো থাকবে। তার মতো পোড়াকপালি ভাগ্য হবে না। মেয়ে দুটো ছোট থেকেই কষ্টেসৃষ্টে বড় হচ্ছে, এখন যদি পড়শীরাই এমন অতিষ্ঠ করে তুলে তাদের জীবন তাহলে কীভাবে ভালো থাকবে এরা? এসব ভেবেই তিনি কাঁদতে বসেন৷ সৃজা সবই শুনছিল, নিজের অপদস্ত অবস্থাটি কেউ ভিডিয়ো করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে, ফুপু আর ইহসানের মতো মানুষকে কুৎসিত ইঙ্গিত করে অপমান করছে এসব শুনে ওর সকল মনের জোর যেন কোথায় হুট করে হারিয়ে গেল! লজ্জা আর ঘৃণায় কাউকে নিজের মুখ দেখানোর ইচ্ছেটাও মরে গেল। রাগে-দুঃখে একাকী নিজের ঘরের দোর বন্ধ করে সে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিল। আর তাতে মনের জোর হু হু করে কমছিল। এলিজা বাড়ি ফিরে সব জেনে বেশ রেগে যায়৷ ফুপুর সাথে মিলে বড় বোনকে দরজা খুলার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু সৃজা শুনছিল না কিছুই। হাজারো ডাক অমান্য করেও যখন দরজা খুলছিল না তখন তারা বাধ্য হয়ে ইহসানকে ফোন দিয়ে সবটা জানায়, আর কিছু একটা করতে বলে। ইহসান এসেছিল সৃজাকে বোঝাতে। কিন্তু সে বুঝছিল না কিছুতেই, এমনকি দরজাও খুলছিল না। ঘন্টা দু’য়েক পর যখন ধৈর্যচ্যুতি ঘটে ইহসানের, তখনি সে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে। দরজা ভাঙার ব্যবস্থা করে। সেই কথা শুনে আঁৎকে উঠে সৃজা, অনেকটা ভয় পেয়েই দরজা খুলে দেয়। খোলার পরপরই সপাটে গালে থাপ্পড় পড়ে। মাথাটা এলোমেলো লাগে সৃজার। দরজা ধরে নিজের ভর সামাল দিয়ে যখন সে ইহসানের দিকে তাকায় তখনই ওর চোখের ক্ষুদ্ধ, ভয়াল দৃষ্টির সাথে সাক্ষাৎ ঘটে সৃজার। থমথমে, রাগী গলায় সে নির্দেশ ছুঁড়ে,
“চল, বেরুবি আমার সাথে।”
সৃজা অশ্রু মুছে ভীতু চোখে তাকায়,
“আমি কোথাও যাব না।”
“কেন?”
“সবাই বাজে কথা বলে তোমায় নিয়ে।”
“কারা বলে?”
“আশেপাশের সবাই।”
“তাদের মুখে ঝামা ঘষে দিতে হবে।”
সৃজা কিছু বুঝতে পারে না,
“মানে?”
“বিয়ে করব তোকে!”
সৃজা হতবাক হয়ে যায়। স্থির হয়ে পড়ে পা দু’টো। অশ্রু শুকিয়ে তখন লেপ্টে আছে গালে। ইহসান ওর হাত ধরে সুধীর, শাণিত কণ্ঠে বলে,
“তোর জন্যই তোকে বিয়ে করব।”
সৃজা তৎক্ষনাৎ নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। সোজা হেঁটে বিছানার উপর বসে পড়ে শক্ত হয়ে। কাঠখোট্টা স্বরে বলে দেয়,
“আমি ঠিক আছি। আর দরজা লাগাব না, কান্নাকাটি করব না। কেউ তোমায় নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বললে আমি প্রতিবাদ করব। প্রমিজ করছি। তুমি এখন যাও।”
তবে সৃজার সে অনুরোধ ধোপে টেকেনি। ইহসান নাছোড়বান্দা ছিল। বহুক্ষণ ধরে স্মৃতিচারণ করতে থাকা সৃজা ভাবনার ঘোর কাটলো নিজের বিউটি বোনের উপর ইহসানের হাতের ছোঁয়ায়, তার ঊষ্ণ কণ্ঠের ডাকে,
“সুন্দরী, কী ভাবছিস?”
“তোমাকে।”
_____
চলবে…