#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭
“কারো মুখে ঝামা ঘষতে হবে না। আমি ঠিক আছি। আর দরজা লাগাব না, কান্নাকাটি করব না। কেউ তোমায় নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বললে আমি প্রতিবাদ করব। প্রমিজ করছি। তুমি এখন যাও।”
তবে সৃজার সে অনুরোধ ধোপে টেকেনি। ইহসান নাছোড়বান্দা ছিল। বহুক্ষণ ধরে স্মৃতিচারণ করতে থাকা সৃজা ভাবনার ঘোর কাটলো নিজের বিউটি বোনের উপর ইহসানের হাতের ছোঁয়ায়, তার ঊষ্ণ কণ্ঠের ডাকে,
“সুন্দরী, কী ভাবছিস?”
“তোমাকে।”
সৃজা মুখ ফসকে কথাটা বলে দিয়েই থমকে গেল। খানিকটা লাল হলো তার গাল। মুখটা সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। ইহসান বিস্মিত হয় প্রথমে, কপালে ভাঁজ পড়ে। পরমুহূর্তেই আলো খেলা করে তার মুখে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে আস্তেধীরে মাথাটা নুইয়ে আনে সৃজার কাছাকাছি। ছোটছোট চোখ করে নিচু স্বরে শুধায়,
“আচ্ছা, তাই?”
কেঁপে উঠে সৃজা। ইহসানের কাণ্ড দেখে চমকে যায়। এতটা কাছে সে আশা করেনি ইহসানকে। সৃজা অনুভব করল তার নিঃশ্বাসের গতি পালাক্রমে বাড়ছে। বুক ধুকপুক করছে। পেটের ভেতর যেন একশো প্রজাপতি উড়াউড়ি শুরু করেছে। লোকটা কি ইচ্ছে করেই এমন করে, যাতে সৃজা অপ্রস্তুত হয়ে যায়? আড়ষ্টতায় জমে গিয়ে সে ছোট্ট করে জবাব দিল,
“হুঁ।”
”তা কতটুকু ভাবলি আমায়?”
সৃজার পাংশুটে মুখখানি বিরস দেখালো। মস্তিষ্ক আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কী বলবে সেটা ভেবে পেল না। পরক্ষণেই বুদ্ধি খাটিয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করল।
শান্ত দৃষ্টি ফেলে সংযতভাবে বলল,
“একবার বলেছ পড়শীদের মুখ বন্ধ করার জন্য বিয়েটা করবে, এরপর বলেছ লিথুরাণীকে জীবনে জড়াবে না বলে আমাকে ব্যবহার করেছ। কিন্তু এগজ্যাক্ট কারণটা অন্যকিছু, যেটা তুমি আমাকে ঠিকঠাক বলছই না…”
ইহসান ওর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলেও জবাবের বেলায় সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেল। উল্টো সূক্ষ্ম গলায় আওড়ালো,
“আর কিছু ভাবিসনি?”
সৃজা একপ্রকার হতাশার শ্বাস ফেলল ইহসানের মনোভাব বুঝে। মনের কোনো দ্বিধাদ্বন্দের সমাধান না পেয়ে মসৃণ কপালে বিরক্তি ফুটিয়ে ত্যক্ত স্বরে বলল,
“ভাবার সুযোগ আর পেলাম কই? তুমি তার আগেই বাগড়া দিয়ে বসে আছ। যাও, সরো।”
বলে নিজের চোরামি ঢাকার জন্য ইহসানকে একপ্রকার ঠেলেই দূরে সরিয়ে দিলো। এরপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মনে মনে নিজের অশান্ত মনটাকে খুব বকল, হুট করে কেন এমন আনমনা ভঙ্গি ধরে? মানুষের মন যে বিচিত্র জিনিস, তা কেন ভুলে যায়? এই মনের কারণেই সে এখুনি একপ্রস্ত লজ্জার শিকার হতো রগচটা আর মুখ পাতলা লোকটার কাছে। পরিস্থিতিটা সামলাতে পেরে তাই সে ভীষণ খুশি! মিটিমিটি এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে। ইহসান কোণা চোখে ওকে লক্ষ্য করছিল, মেয়েটা এমন চেপে চেপে হাসছে কেন তার কিছুই সে বুঝতে পারল না। বিড়বিড় করে বলল,
“সৃজাটা অদ্ভুত!”
সৃজা কথাটা শুনেও না শোনার ভঙ্গি করে বিছানাটা ঠিকঠাক করল, ঘরটা ঝাড়ু দিলো। এরপর গোসলে চলে গেল। বেরুলো ঠিক একঘন্টা পর। ইহসান তখন বারান্দায় বসা। চেয়ারের উপর পা তুলে, ফোন কানে নিয়ে সে কারো পিণ্ডি চটকাচ্ছিল! আচমকা সৃজাকে ভেজা কাপড় হাতে বারান্দায় দেখেই ফোনটা অতি সাবধানে কান থেকে নামিয়ে ফেলল। সময় দেখার বাহানা করে বলল,
“আমি তো ভেবেছিলাম গিনেস বুকে তোর নাম উঠবে আজ। এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে রেকর্ডের বারোটা বাজিয়ে দিলি! ধুর…”
সৃজা অবশ্য ওর চোরামিটা ধরতে পারল না। কাপড় মেলে দিতে দিতে সরু গলায় বলল,
“আমার গোসল নিয়ে একদম ঠাট্টা করবে না।”
ইহসান নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে ভাবুক ভঙ্গিতে শান্তভাবে বলল,
“ঠাট্টা করছি না, কৌতূহল বোধ করছি! আচ্ছা, তোদের মেয়েদের গোসলের কী আলাদা কোনো নিয়ম-নীতি আছে যে প্রতিবারই ঘন্টাখানিক সময় এর পেছনে ব্যয় করতে হবে? নইলে গোসল শুদ্ধ হবে না? আছে এরকম কিছু?
ঘন্টা লাগিয়ে কী এমন করিস তোরা বাথরুমে? বুঝে আসে না। আমার তো ভাবতেই দমবন্ধ হয়ে আসে।”
সৃজা এবার ভীষণ বিরক্ত চোখে তাকাল,
“তাহলে ভেবো না প্লিজ। কারো গোসলের খবর জানতে চাওয়াটা শোভনীয় নয়।”
ইহসান ফট করে বলল,
“শোভন করেই বল না।”
“কথাবার্তায় লাগাম টানো। তুমি ছেলেমানুষ, মেয়েদের গোসল নিয়ে…”
কথাটা শেষ হবার আগেই ইহসান চোখ বড়বড় করে ফেলল,
“সিরিয়াসলি? গোসলেও ছেলে-মেয়ের ভেদাভেদ আছে! হায়রে বাঙালি!”
খুব আফসোসের সুরে কথাটা বলল ইহসান। ওর নাটক বুঝে সৃজা দাঁতে দাঁত চেপে এসে পেছন থেকে ইহসানের মাথাভর্তি চুলের গোছা মুষ্টিবদ্ধ করে টেনে ধরল। আচমকা ব্যথা লাগায় অস্ফুটস্বরে আর্তনাদ করে উঠল ইহসান।
সৃজা তবুও দয়া দেখাল না, ছাড়ল না ওর চুল। ইহসানের চোখমুখ ব্যথায় কুঁকড়ে গেল,
“ছাড়…”
সৃজা রেগে জোরালো কণ্ঠে বলল,
“তুমি গোসল বিশেষজ্ঞ নও, না এটা তোমার কাজ। তাই এটা নিয়ে গবেষণা করা বাদ দাও নয়তো সব চুল টেনে উঠিয়ে নেব। বিশ্রি শোনাচ্ছে।”
ইহসান সৃজার জোরালো কণ্ঠ শুনে বাধ্য ছেলের ন্যায় মাথা নাড়ল। যার মানে সে আর এ বিষয়ে কৌতূহল বা গবেষণা কোনোটাই করবে না। সৃজা কথা আদায় করে ওর চুলগুলো ছেড়ে দিতেই ইহসান উঠে ফোনটা ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে চলে যাওয়ার সময় সৃজাকে উদ্দেশ্যে করে বলে গেল,
“অন্যরা তো দেবে না, তুই একদিন সুযোগ দিস তো; জানা দরকার কেন এত সময় লাগে মেয়েদের গোসল করতে। বিষয়টা নিয়ে একটা থিসিস পেপার রেডি করে ফেলব।”
সৃজা পেছন থেকে আগুন চোখে চেয়ে রইল। ইচ্ছে করল ইহসানকে ধাক্কা দিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে নোংরা পুকুরে ফেলে দিতে, মাথাটা ফাটিয়ে দিতে, মুখটা সেলাই করে জবান বন্ধ করে দিতে চরম বেয়াদব লোকটার।
.
ছাইরঙা আকাশ। ম্লান গোধূলি। লিলুয়া বাতাসে
দুলছে গাছের পাতা। গোলাকার তেজহীন সূর্যটা পশ্চিমে ডুবে গেছে। একটা আধো অন্ধকার চারপাশে জমাট বেঁধে মলিনতা ছড়াচ্ছে। পুকুরের শান্ত ভাব, নারকেল পাতার মড়মড় শব্দ আর মিষ্টি এক ফুলের সুবাস ভাসছে বাতাসে। সৃজা জানালার পাশে বসে একমনে প্রকৃতি ও সন্ধ্যা নামা দেখছে। দুপুরের খাবারের পর ইহসান বেরিয়ে গেছে। জরুরি কাজ তার। ফিরতে দেরি হবে। সাবধানে থাকতে বলে গেছে সে সৃজাকে৷ একলা ঘরে একঘুমে বিকেল পার হয়েছে সৃজার। অনেকটা সময় নির্জন ঘরে বসে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। মন খারাপ হচ্ছে এলিজার জন্য।
ছোট্ট বোনটাকে ছাড়া কীভাবে দুটো দিন কাটিয়ে ফেলল সেটা ভেবেই অবাক হয় সৃজা। দুপুরের দিকে অবশ্য কথা হয়েছিল এলিজা আর ফুপির সাথে। তারা ভালো আছে, নাইমুর সাহেবের অবস্থাও আগের চেয়ে একটু ভালো। শুনে সৃজা নিদারুণ স্বস্তি অনুভব করল। অস্থির হয়ে থাকা মনটা খানিকটা প্রশান্তির দেখা পেল। এলিজা আরো কিছু চমকপ্রদ খবরও দিয়েছে। ইহসানের সাথে সৃজার বিয়ের খবরটা ছড়িয়ে পড়ার পর রাতারাতি এলাকার হট টপিকে পরিণত হওয়া সৃজার ব্যাপারটা নিয়ে এখন আগের মতো হৈহৈ রব শোনা যাচ্ছে না। নাইমুর সাহেবের দুই মেয়েকে নিয়ে যদি কেউ কথা ছড়ায়, তাহলে তার ফল ভালো হবে না এমন একটা উড়ন্ত হুমকি ছড়িয়ে পড়ায় হুট করে সকলে কুলুপ এঁটেছে মুখে! তাছাড়া সেদিনের শ্লী’ল’তাহানির ভিডিয়োটাও সোশ্যাল সাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সৃজা বেশ অবাক হলো এসব শুনে। আড়াল থেকে কে
করল এসব?
.
ইহসান নিজের অতি গোপনীয় একটা কাজ সম্পন্ন করে বাড়ি ফেরার জন্য রিকশা ধরল মেডিক্যালের সামনে থেকে। শেখ বাড়িতে যদিও তিনটি গাড়ি আছে ব্যবহারের জন্য, কিন্তু বাপের টাকায় কেনা এসব গাড়ির দিকে সে ফিরেও চায় না। তার কোনো আগ্রহ কাজ করে না এসবের প্রতি। নিজের সামর্থ্য আছে তার। চাইলেই সে গাড়ি কিনতে পারে, কিন্তু বাপের টাকায় কেনা সম্পদের প্রতি তার বিষাক্ত একটা জ্বালাপোড়া কাজ করে। তাই আজকাল যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে সে শেখ বাড়ির বিলাসিতা। বিশাল আকারের বাগান বিলাসের সৌন্দর্য গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে আছে ছাই রঙের গেইটটা। সেখানে রিকশা থামতেই ইহসান চট করে নেমে মানিব্যাগ বের করে ভাড়া মিটিয়ে বিদায় করল রিকশাওয়ালাকে। পকেট গেইটটা ঠেলে ভেতর পা রাখতে যাবে তখনি পেছন থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দে ওর কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড় হলো। কতগুলো গালি জড়ো করে মেজাজ খারাপ করে পেছনে ফিরতেই ইহসান দেখল তার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডোটা। পার্ল হোয়াইট রঙে আবৃত গাড়িটা অন্ধকারেও চকচকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ড্রাইভিং সিটে বসা মিজু, তার পাশে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বসা ইজহান। রাতেও তার চোখে সানগ্লাস, ঠোঁটে ক্রুর হাসি ঝুলানো। ইহসানের রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল ভাইয়ের হাসি দেখে কিন্তু পুরোপুরি উপেক্ষা করল সে। আহাম্মকটার কাহিনী দেখলেই তার রাগ লাগে। সেজন্য কথা না বাড়িয়ে সন্তপর্ণে গেইটের ভেতর প্রবেশ করল সে। পেছনে ফেলে গেল রাগান্বিত চেহারার ইজহানকে।
এদিকে ইহসানের থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে গা জ্বলে গেল ইজহানের। ড্রাইভার মিজু যথারীতি ভীতি নিয়ে প্রশ্ন করল,
“আগাই স্যার?”
কপালে ভাঁজ ফেলে ইজহান তাকাল ব্যক্তিগত ড্রাইভারের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে থমথমে কণ্ঠে বলল,
“ডিসেন্ট ম্যানের কানে বোধহয় শব্দটা যায়নি। তুই আরো জোরে কেন বাজালি না হাঁদারাম? চাকুরির মায়া উবে গেছে নাকি ডিসেন্ট ম্যানের প্রতি মায়া বেশি? আমার থালায় খেয়ে আমার থালাটাই ফুটো করিস না তো আবার?”
ইজহানের কথা শুনে মিজু ঘাবড়ে গেল। বয়স তার ছাব্বিশ। গত চার বছর যাবৎ ইজহানের ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসেবে নিয়োজিত। লোকটার কর্মকাণ্ড সবই তার জানা আছে। সারাদিন আঠার মতো লেগে থাকে অথচ নিজের স্যারকে সে এতদিনেও বুঝতে পারেনি। অকারণে, অহেতুক লোকটা শুধু ঝামেলা বাঁধাতে চায় ইহসানের সাথে। অথচ ইহসান তার জমজ ভাই। ইহজীবনে মিজু দেখেনি, শোনেনি এমন দা-কুমড়া সম্পর্ক হয় একই চেহারার অধিকারী হওয়া দুটো ব্যক্তির! সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত মাথা নেড়ে অসহায় গলায় বলল,
“যতটুকু জোরে করন যায়, ততটুকুই জোরে হর্ণটা বাজাইসি স্যার। কোনো গাফিলতি করি নাই। আপনের নুন খাই, আর আপনের কথা শুনুম না? বেইমানি আমার রক্তে নাই স্যার।”
ইজহান শক্ত মুখে তাকাল। এরপর বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে ধমকি সহকারে বলল,
“গাড়ি ভালোভাবে পরিষ্কার করে এরপর গ্যারেজে রাখবি। একটু ময়লাও যদি থাকে তোর পশ্চাতে লাথি মেরে বউয়ের কাছে পাঠাই দিব, বুঝলি?”
ভাইয়ের পাত্তা না পেয়ে সেই রাগটা ইজহান তার উপর দেখাচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরেই মিজু আর কথা বাড়াল না। বিয়ের দু’মাসও হয়নি। এরমধ্যে নিজের স্যারের থেকে দু’লক্ষবার সে এই কথাটা শুনেছে। সে ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে ছোট্ট করে বলল,
“জি, বুঝেছি।”
দারোয়ান বড় গেইটটা খুলে দিতেই ঘাসে ঢাকা উঠোনে প্রবেশ করল গাড়িটি। ইজহানকে নামিয়ে দিয়ে মিজু গাড়িটি গ্যারেজের দিকে নিয়ে গেল। গাড়ি পরিষ্কার করতে হবে, এই অসময়ে গাড়ি ধুতে কার মন সায় দেয়? অসহ্য লাগে তার, কিন্তু স্যারের ভয়েই সে কিছু বলতে পারে না।
.
ইহসান উপরে না গিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে পানি গ্লাসে ঢালছিল খাওয়ার উদ্দেশ্যে। পানি নিয়ে জগটা জায়গামতো রাখতেই ইজহানের তাচ্ছিল্যের গলা শুনতে পেল,
“বাপের টাকা নিব না, গাড়ি ছুঁব না, কিন্তু তার টাকায় কেনা গ্লাস দিয়ে পানি খাব। আমিতো আবার মহা নির্লজ্জ…”
ব্যস! ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে এক সেকেন্ডও সময়
লাগল না ইহসানের৷ ক্রুদ্ধ অবস্থায় ঘাড় ফিরিয়ে হাতে থাকা গ্লাসের পানিটা সরাসরি ইজহানের মুখের উপর ছুঁড়ে মারল সে।
.
সৃজার চোখ লেগে এসেছিল। আচমকাই কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল ভাঙচুরের শব্দ শুনে। সৃজা একপ্রকার লাফিয়ে উঠল। বুঝে উঠতে পারল না কী হচ্ছে! তবে কিছুসময় পর্যবেক্ষণ করতেই ইহসানের ক্রুদ্ধ গলা কানে এলো। গতদিনের মতো আবারো কোনো ঝামেলা বাঁধায়নি তো ইহসান? মারামারি করে আবার হাত কেটে ফেলবে না তো? সৃজার কেন জানি মন টিকল না ঘরে। হতচকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। কোনোকিছু না ভেবেই সোজা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। করিডোর পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে অর্ধেক সিঁড়িতেই পা আটকে গেল তার। হা হয়ে গেল মুখ! চোখের সামনে দু-দুটো ইহসান। একজন আরেকজনের কলার মুষ্টিবদ্ধ করে একে-অপরকে দেখছে হিংস্র চোখে। সৃজার চোখ কপালে উঠে গেল। ইহসানরুপী দু’জন চেহারাধারীর মধ্যে থেকে নিজের মানুষটাকে চিহ্নিত করতে পারল সে পরণের কাপড় দ্বারা। কিছু ভেবে উঠার আগেই সৃজা চমকে উঠে দেখল রাগ মেটানোর জন্য দু’জনেই সমানতালে মারামারি করছে। একে-অন্যের মুখে ঘুষি বসাচ্ছে, লাথি দিয়ে আঘাত করছে। দু’জনেই র’ক্তা’ক্ত। থামানো উচিত তাদের। কিন্তু কীভাবে? যেভাবে ধস্তাধস্তি চলছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে মেজাজ ঠিক কতটুকু গ্রাস করে নিয়েছে এদের দুই ভাইকে। কী নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে জানা নেই সৃজার! ঠিক বুঝে উঠতে পারল
না এই পরিস্থিতি সামলাতে তার কী করা উচিৎ!
আজিজ শেখ এখনো বাড়ি ফেরেনি। সালেহা বেগমেরও শরীর ভালো না। বাড়ির বেহাল অবস্থা, বাপ-ছেলের বাকবিতন্ডা তার মনকে দুর্বল করে দিয়েছে। প্রেসার ফল করেছে। ঘুমের ঔষধ খেয়ে তিনি ঘুমাচ্ছেন নিজের ঘরে। মেজো বৌ মিতু নিজের স্বামী ইমরান আর বোন লিথুকে নিয়ে শপিংয়ে বেরিয়েছে। উদ্দেশ্য লিথুর মন ভালো করা। বলতে গেলে দুই ভাইকে থামানোর মতো কেউ নেই ইস্মি ছাড়া। বাড়িতে যদিও চাকর-বাকররা আছে, কিন্তু তারাও যে যার মতো মনে একরাশ ভীতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিজেদের জায়গায়। যেচে পড়ে কারো শখ নেই দুই বদমেজাজি ভাইয়ের হাতের থাপ্পড় খেয়ে চেহারার নকশা বদল করার। চেহারায় এক হলেও এদের আচরণ দেখে কে বলবে এরা দু’জন জমজ? যেখানে আত্মার বন্ধন থাকা উচিত, সেখানে এরা খু’নো’খু’নি করতে পারলে যেন শান্তি পাবে। কোনোভাবেই এরা একে-অপরকে সহ্য করতে পারে না। সামনা-সামনি পড়লেই কোনো না কোনো বিষয়ে খোঁটা চালাচালি করে মারামারি শুরু করে। তবে বরাবরই আগ বাড়িয়ে ঝামেলার শুরুটা করে ইজহান। ইহসানকে মারতে গিয়ে নিজেও বেদম মার খায়। তবুও খোঁচা দেওয়ার স্বভাবটা সে ছাড়তে পারে না। এসব এ বাড়ির নিত্য দিনের কাহিনী। সকলের জানা কথা।
একাই দুই ভাইকে থামানোর চেষ্টা করছে ইস্মি। কিন্তু ব্যর্থ সে। ইহসান ছাড় দিতে চাইলেও ইজহান যেচে পড়েই ওকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টা করছে। বিপুল উৎসাহে সে ইহসানকে মারছে আবার ইহসানের হাতে মারও খাচ্ছে। ইস্মি মাঝখানে বারবার বাগড়া দেওয়ায় একপর্যায়ে ইজহানের মেজাজ চড়ল ওর উপর। প্রচন্ড রেগে এক রাম ধমক দিয়ে সরতে বলল নিজের বউকে। কিন্তু ইস্মি না শোনায় এবার সে অত্যন্ত বিশ্রি, কদর্যপূর্ণ একটা গালি দিয়ে বসল। বাড়িভর্তি কাজের লোক আর ইহসানের সামনে নিজের স্বামীর থেকে এরকম বিশ্রি অপমান আশা করেনি ইস্মি। সে হতভম্ব হয়ে লজ্জায় মুখ নিচু করে সরে গেল। চোখ বেয়ে বড় বড় ফোঁটায় গড়াতে থাকলো অশ্রুবিন্দু। এদিকে ইস্মিকে দেওয়া ইজহানের দেওয়া অশ্রাব্য গালিটা শুনেই র’ক্ত গরম হয়ে গেল ইহসানের। নিজের উপর আসা আঘাতটা প্রতিহত করে ভাইয়ের হাতটা মুচড়ে ধরে ঠেসে ধরল দেয়ালে। এরপর নাকে ঘুসি বসিয়ে ডানহাতে মুখ চেপে, পায়ে পারা দিয়ে ধরল সে নিজের ভাইকে। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল ইজহান। শুনে ইহসান যেন শান্তি পেল। ঘৃণাভরা গলায় বলল,
“জা’নো’য়া’র! তোর সাহস হলো কী করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে অশ্রাব্য গালি দেওয়ার? তোর মুখ আজ আমি ভেঙে দেব কু’কু’র, কোনোদিন যাতে এই গলা দিয়ে আওয়াজ না বেরুয় তার ব্যবস্থা করব…”
রাগে ফোঁসফোঁস করছে ইহসান। শক্ত হাতে গলা চেপে ধরল সে ভাইয়ের। ইস্মি কাণ্ড দেখে চিৎকার দিয়ে উঠল। স্বামীর নিগ্রহের শিকার হলেও সে ইজহানের প্রতি নিজের দায়িত্বটুকু ভুলে যেতে পারল না। ছুটে গিয়ে ইহসানকে অনুরোধ করতে লাগল তার স্বামীকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ইহসান যেন আজ নাছোড়বান্দা। ইজহানকে সে মেরেই ফেলবে এমন একটা ভাব! ইস্মি উপায় না পেয়ে এবার সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সৃজাকে দেখে ওর কাছেই ছুটে এলো। কান্নারত স্বরে বলল,
“সৃজা, তুমি একবার বলে দেখো না, যদি ছেড়ে দেয়?
এভাবে ধরে রাখলে তো মরে যাবে। বলো না গিয়ে ওকে ছেড়ে দিতে…”
সৃজার তখনো হতভম্ব! ইস্মির কান্না শুনে তার ঘোর কেটেছে। ইজহানকে দেখছে সে বিরক্ত চোখে, যে লোক তার স্ত্রীকে ভরা মজলিশে অশ্রাব্য গালি দিতে পারে তার আরো কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু ইস্মির মুখের দিকে তাকিয়ে ওর বেশ মায়া হচ্ছিল বিধায় ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে সে মাথায় ওড়না টেনে নিলো। এরপর সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে নেমে এলো বৈঠকখানায়। নিঃশব্দে ইহসানের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। ধীরস্বরে অনুরোধ করল,
“যথেষ্ট হয়েছে, এবার ছেড়ে দাও।”
ইহসান সৃজাকে লক্ষ্য করেনি। রাগে তখনো মাথা গরম ওর। ইচ্ছে করছিল ইজহানকে টেনে ছিঁড়ে পশুকে খাইয়ে দিতে। এর মতো নিকৃষ্টের বেঁচে থাকারই দরকার নেই। এগুলো পৃথিবীতে আসেই শুধু অন্যকে যন্ত্রণা দিতে। এসব ভেবেই চোয়াল শক্ত হচ্ছিল ওর, বাড়ছিল হাতের চাপও। কিন্তু আচমকা সৃজার কণ্ঠস্বর শুনে সে রক্তাভ চোখজোড়া মেলে পিছনে ফিরে তাকাল। রাশভারি স্বরে ধমকে উঠল তৎক্ষনাৎ,
“তোকে এখানে মাতব্বরি করতে কে বলেছে? ঘরে যা।”
সৃজা ওর রাগের উত্তাপ টের পাচ্ছিল। তবুও ভয় গিলে সে ইহসানের বাহু টেনে ধরে বলল,
“যাব, তুমিও ঘরে চলো।”
গম্ভীরতার ঠাঁট মুখে বজায় রেখেই ইহসান স্থুল
কণ্ঠে বলল,
“এটাকে মেরে যাব।”
সৃজার চোখে এবার রাগ নামলো। দৃঢ়, শক্ত
কণ্ঠে বলল,
“এখন মারামারির সময় নয়, ছাড়ো। ইস্মি ভাবি কাঁদছে।”
সৃজার বাড়াবাড়ি দেখে, ওর কণ্ঠের গাম্ভীর্যতা টের পেতেই ইহসানের হাতটা আলগা হয়ে এলো। ছেড়ে দিলো সে ইজহানকে। চোয়াল চেপে ধরে বলল,
“দমটুকু এখনই নিয়ে নিতাম। ভাগ্য ভালো থাকায়
পার পেয়ে গেলি। কৈ মাছের প্রাণ তোর।”
ছাড়া পেয়ে ইজহান বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে আর ঘর কাঁপিয়ে কাশছে। রক্ত বেয়ে পড়ছে ঠোঁট দিয়ে। ইস্মি ছুটে গিয়ে ধরল ওকে, সামলাতে চাইল। কিন্তু শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তেজ বয়ে চলা ইজহান ওকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলো। কাশতে কাশতেই ইহসানকে উদ্দেশ্য করে ব্যঙ্গ করে বলল,
“বউ পেয়ে এক্সট্রা এনার্জি সঞ্চয় করছিস নাকি?
আগের চেয়ে হাতের জোর বেড়েছে তোর! বাহ বাহ,
দারুণ উন্নতি! এইযে বউয়ের আঁচল ধরেই ঘুরঘুর
করছিস, এতেই মানাচ্ছে তোকে৷ ভেড়া একটা…”
সৃজা রাগান্বিত ইহসানের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে ওকে নিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছিল৷ কিন্তু পেছন থেকে ভাইয়ের কথার ধরণ শুনে প্রচন্ড রেগে গেল ইহসান। দু’পা পিছিয়ে ইজহানের কোমড় বরাবর সজোড়ে একটা লাথি বসিয়ে বলল,
“আমি ভেড়া হলে তুই নিম্ন মানের কাপুরুষ শালা…”
__________
চলবে…