#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮
“বউ পেয়ে এক্সট্রা এনার্জি সঞ্চয় করছিস নাকি?
আগের চেয়ে হাতের জোর বেড়েছে তোর! বাহ বাহ, দারুণ উন্নতি! এইযে বউয়ের আঁচল ধরেই ঘুরঘুর করছিস, এতেই মানাচ্ছে তোকে৷ ভেড়া একটা…”
সৃজা রাগান্বিত ইহসানের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে ওকে নিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছিল৷ কিন্তু পেছন থেকে ভাইয়ের কথার ধরণ শুনে প্রচন্ড রেগে গেল ইহসান। দু’পা পিছিয়ে ইজহানের কোমড় বরাবর সজোড়ে একটা লাথি বসিয়ে বলল,
“আমি ভেড়া হলে তুই নিম্ন মানের কাপুরুষ শালা…”
__________
আজিজ শেখ বাড়ি ফিরে দুই ছেলের দ্বন্ধের কথা শুনে বেজায় ক্ষেপে তাদের গালাগালি করেছেন। তবে বেশি শুনিয়েছেন ইহসানকে। আজেবাজে, খোঁচা দেওয়া কথা বলেছেন ইহসানকে। সালেহা বেগমকে দিয়েছেন থাপ্পড়।
এই নিয়ে বাবার সাথে একপ্রস্ত কথা কাটাকাটি করে ঘরে ফিরে চোখমুখ শক্ত করে বসে আছে ইহসান। ক্ষণে ক্ষণে জোরেশোরে শ্বাস ফেলছে। তার হাত মুষ্টিবদ্ধ, মুখ লাল। ঠোঁটে ঘুষি পড়ায় তা ফুলে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। ঠিকঠাক রাগ প্রকাশ করতে পারছে না বলে ভেতরটা তার অগ্নিদ্বগ্ধ হচ্ছে। সৃজা কাঁটাছেড়া জায়গা ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে নিশ্চুপ চোখে তাকে অবলোকন করছে। কোনো প্রশ্ন করেনি, জানতে চায়নি দুই ভাইয়ের সম্পর্কের এমন দৈন্যদশার পেছনের কারণ কী! আরো কিছুসময় পর ইহসানের রাগের পারদ বুঝে ছোট্ট শ্বাস ফেলে একগ্লাস পানি সামনে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ব্যথা হচ্ছে কোথাও?”
ইহসান পানি খেয়ে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
“না।”
“রাগ কমেছে?”
ইহসান অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। প্রশ্নটা কানে গেলেও উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে জাগল না তার। ছোট্ট, কঠিন স্বরে বলল,
“ঘুমাব।”
সৃজা বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“খাবে না?”
“তুই খেয়ে নে।”
বলে সটান শুয়ে পড়ল বিছানায়। আর একটা বাড়তি কথাও বলল না। সৃজা মুখগোঁজ করে সোফায় বসে রইল। তার পেটে ক্ষিধে আছে, কিন্তু ইহসানকে ছাড়া সে কীভাবে খাবে? এতটা অমানবিক আর অশোভন কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। একবার ভাবল জোর করবে ইহসানকে, পরক্ষণে ভাবল বেশি জোরাজুরি করাটা এ মুহূর্তে উচিৎ হবে না। এমনিতেই নিচে যা কাণ্ড হলো তাতে মুড ভালো থাকার কথা নয়। ঝামেলা বাড়াতে ইচ্ছে করল না বলে ক্ষিধেটা চেপে গেল সে। ঘড়িতে সময় রাত এগারোটা। দুপুরে ঘুমানোর ফলে আজ দ্রুত চোখে ঘুম ধরা দেবে না ভালোভাবেই জানে সৃজা। সোফার উপর পা তুলে গুটিশুটি মেরে বসে একটা ম্যাগাজিনে চোখ বুলাতে লাগল। এরমধ্যে দশ মিনিটও পেরুয়নি, আচমকা দরজায় করাঘাত পড়ল। সৃজার মনোযোগ ছিল ম্যাগাজিনে, সে এমন জোরালো শব্দে চমকে উঠল। ইহসানের ঘুমও ভেঙে গেল। বেশ বিরক্ত হলো সে। ঘাড় উঁচিয়ে সৃজাকে নির্দেশসূচক বলল,
“দেখ তো কোন হারা…ফাজিল।”
ঝোঁকের মাথায় গালিটা দিতে গিয়েও সামলে নিলো নিজেকে ইহসান। সৃজা ভ্রু কুঁচকে ফেললেও ধাক্কাধাক্কি বেড়ে যাওয়ায় দরজার সিঁটকিনি খুলল। পাল্লাদুটো সরাতে নেবে কিন্তু তাকে সে সুযোগ দেওয়া হলো না। তার আগেই বাইরে থাকা ব্যক্তিটা সেগুলো একটানে সরিয়ে নিলো। এরপর অনুমতি বিহীনই অসভ্যের ন্যায় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ঘরে। সৃজা বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখল ওটা অন্য কেউ না— স্বয়ং লিথু!
লিথুকে এইসময় এখানে দেখে সৃজার চেয়ে বেশি অবাক হলো ইহসান। সেই সঙ্গে তার রাগও হলো। চট করে শোয়া থেকে উঠে বসল বিছানায়। লিথুর ভাবভঙ্গি কাঁদোকাঁদো। যেন এক্ষুনি কেঁদে ভাসাবে সে। তার চোখদুটো ইহসানের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানগুলোতে নজর বুলিয়ে যাচ্ছে। দেখা শেষ করে বিস্মিত নয়নে ঠোঁট কামড়ে একপ্রকার ছুটে গিয়ে বসল ইহসানের পাশে। কেঁদে কেঁদে বলল,
“হায় আল্লাহ! এইসব কী অবস্থা হইসে তোমার?
ইহজান ভাই কী মানুষ না? এইভাবে কেউ মারে কাউরে? এতটা ব্যথা দেয়? তুমি কিছু কর…”
বলতে বলতে আনমনা ভঙ্গি করে ছুঁতে গেল ইহসানকে।
গা ঘিনঘিন করে উঠল ইহসানের। তৎক্ষনাৎ দূরে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তিক্ত মেজাজে ভাবল কতবড় সাহস মেয়েটার যে তাকে ছুঁতে আসে? হাতটা মুচড়ে ভাঙ্গতে মিনিটও লাগবে না তার। এত রাতে, একজন বিবাহিত পুরুষের ঘরে এভাবে ঢুকে এমনিতেই মেজাজ চড়িয়ে দিয়েছে। তার উপর সৃজার সামনেই ঘেঁষাঘেঁষি করতে চাইছে! নূন্যতম লাজলজ্জা নেই বেহায়াটার। চোখ বন্ধ
করে মনে মনে হাজারো গালি আওড়ে ফেলল ইহসান।
আর তখনি কানে এলো লিথুর ক্ষোভে ভরা
অভিমানী স্বর,
“এমন করলা ক্যান? আমি ছুঁইলে কী ফোস্কা পড়ব তোমার গায়ে? অন্যকেউ ছুঁইলে বুঝি ভাল্লাগব?”
নিজের বিশ্রি, কদর্যরূপ দেখিয়ে দিলো লিথু। সৃজার ইচ্ছে করল বেহায়াটার চুলের মুঠি ধরে কয়েকটা বসিয়ে দিতে। এতক্ষণে বোঝা হয়ে গেছে এই মেয়ের চরিত্র! শক্ত কিছু কথা বলতে যাবে তার আগেই আচমকা ইহসানের ভয়ংকর স্বরে পুরো ঘরটা যেন কেঁপে উঠল,
“কারো ঘরে ঢোকার আগে তার অনুমতি নিতে হয় সেসব শিক্ষা কেউ দেয়নি? আচ্ছা মানলাম দেয়নি! কিন্তু আমাকে ছুঁতে চাইলে যে নিজের হাতদুটো খোয়াতে হবে, তা জানা নেই? প্র্যাকটিক্যালি দেখতে চান নাকি, মেজো বৌয়ের ছোটবোন?”
লিথুসহ সৃজাও কেঁপে উঠল। সে বড়বড় চোখ মেলে চাইল। বুঝতে চাইছে, আদৌ তার সাথে ঠাট্টা করা, রগচটা লোকটাই কী সে? নাকি তার মধ্যে কোনো আত্মা ভর করেছে, যে এভাবেও চিৎকার করে উঠতে পারে? সৃজা প্রসন্ন চোখে নিঃশব্দে পরখ করল। ইহসানের চোখে তখন আগুনের দৃষ্টি। এমনভাবে সে তার দৃষ্টি ফেলছে যেন তার ঘরে কোনো নোংরা বস্তু প্রবেশ করেছে।। মাথার চুল মুঠোয় টেনে মেজাজ খারাপ করে প্রচন্ড তেঁতে উঠে সে বলল,
”নোংরাটাকে বের কর এক্ষুনি।”
সৃজা হতবিহ্বল হলেও সময় নষ্ট করল না। লিথুকে চোখের ইশারায় বোঝাল ভালোয় ভালোয় কেটে পড়তে।
লিথু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। তার চোখ ছলছল করছে। এইযে, গোলাপি জামা গায়ে, ম্যাক রুবি উই’য়ের ক্লাসিক রেড লিপস্টিক ঠোঁটে তাকে যে রাত পরীর মতো সুন্দর লাগছে সেটা ইহসান দেখেনি। জামাটা সে আজ শপিং করতে
গিয়ে ছয় হাজার টাকার ব্যয় করে কিনে এনেছে, শুধুমাত্র ইহসানের চোখে নিজের জন্য মুগ্ধতা দেখবে বলে, তাকে প্রলুব্ধ করবে বলে। অথচ ইহসান তাকে চোখ ফিরিয়েও দেখেনি। উল্টো অপমান করছে৷ অপমান সে আগেও পেয়েছে ইহসানের থেকে। কিন্তু সৃজার সামনে এমন আজেবাজে ভাষায় অপমান করাটা তার সহ্য হলো না। সৃজার ঠোঁটের কোণে অদৃশ্য হাসি ঝুলছে৷ সেটা আটকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে। দেখে হিংসেয় জ্বলেপুড়ে খাঁক হতে লাগল লিথু৷ ছলাকলা ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসতে লাগল তার স্বত্ত্বা। গটগট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সৃজা সন্তপর্ণে দরজাটা আটকে দিলো। ইহসানকে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। সৃজার সামনে লিথুর বেহায়ামির ব্যাপারটা গিলতে কষ্ট হচ্ছে তার। পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করার আশায় সে অধৈর্যশীল কন্ঠে বলল,
“ভাত মেখে খাইয়ে দিবি?”
সৃজা তার অস্বস্তিটা বুঝতে পারছিল। কিছুক্ষণ আগের জাঁদরেল মুখটা এখন শুকনো দেখাচ্ছে।
কেন জানি হাসি পেল তার। ঠোঁট চেপে হাসি আটকে নিজের সুকোমল মসৃণ কপালে ভাঁজ ফেলে ঠাট্টামিশ্রিত সুরে বলল,
“লিথুকে ডাকি?”
ঠাট্টা মিশ্রিত কণ্ঠস্বরটা ধরতে পারল ইহসান। কেন জানি খাবার ইচ্ছেটা নষ্ট হয়ে গেল। থমথমে মুখ করে কিছু না বলে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়—
“আলোটা নিভিয়ে দে।”
“খাবার বাড়ব না?”
ভারি গলাটা বেশ তির্যক দীপ্তস্বরে বলল,
“না।”
চট করে জিভে কামড় বসাল সৃজা। চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। জানে ইহসানের মন বিষন্ন। এই সময় মজাটা না করলেই কী চলছিল না? আহাম্মক সে
মুখ নিচু করে বলল,
“সরি।”
“ইট’স ওকে।”
“খাবার আনি?”
নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব এলো,
“ভালো লাগছে না, ঘুমাব।”
সৃজা মনমরা কণ্ঠে বলল এবার,
“আমার উপর রাগ করে খাবে না বলছ?”
ইহসান রুদ্ধ স্বরে জবাব দিলো,
“ঘুমাব বলছি তো, কথা বাড়াস না। প্লিজ।”
সৃজার নিজের উপর রাগ হচ্ছে। অহেতুক কেন বাচ্চাদের মতো ঠাট্টা করে একজনের মুড নষ্ট করে দিলো? নিজে থেকেই তো খেতে চেয়েছিল ইহসান তার কাছে। এভাবে ক্ষুধার্ত কারো আবদারের বিনিময়ে ঠাট্টার মতো বিশ্রি, জঘন্য কাজটা কীভাবে করতে পারল সে? নিজের প্রতি লজ্জায় সৃজার চোখদুটো ভিজে উঠল। আলো নিভিয়ে দিয়ে ইহসানের মাথার পাশেই হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে
রইল। ধোঁয়াটে অন্ধকারে ইহসান দেখল হুট করে
তার জীবনে আসা ফিনফিনে দেহের মেয়েটি হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। তার দীঘল কালো চুলগুলো হাত খোঁপা থেকে মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পিঠে। মুহূর্তের মধ্যে বুকের পাশটা কেমন অদ্ভুত অনুভূতিতে ব্যকুল হয়ে উঠল তার, নিঃশ্বাসের গতি দ্রুত হলো। অশান্ত, ব্যগ্রপ্রতিভ হয়ে উঠল তার ব্যথাতুর দেহ, বিষন্ন মন। ঠোঁটের কোণে প্রসন্ন হাসি ছেয়ে গেল। নিদ্বির্ধায় উঠে বসল সে৷ অসাড় হয়ে থাকা ডানহাতে সৃজার ঢেকে দেওয়া মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে কানের পিঠে গুঁজে দিলো সে। সৃজা হতচকিত ও স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরক্ষণেই শান্ত হয়ে গেল। ভীষণ ক্ষীণ স্বরে বলল,
“সরি বলেছি তো।”
ইহসান ওর ঠোঁটে আঙ্গুল চাপা দিয়ে ধাতস্থ স্বরে বলল,
“শুনেছি, বারবার বলতে হবে না।”
নিজের মহত্ত্বটুকু বুঝিয়ে নিরুত্তর রইল সে।
তবুও বার কয়েক ইনিয়েবিনিয়ে নিজের আচরণের জন্য মাফ চাইতে লাগল সৃজা। ইহসানের হৃদপিণ্ড আন্দোলিত হলো। আচমকা একটানে সৃজাকে নিজের বুকে এনে ফেলল৷ সৃজা হতভম্ব! তড়িৎগতিতে ছুটতে শুরু করল
তার হৃদস্পন্দন। গলা দিয়ে শব্দ বেরুতে চাইছে না তার। বহুক্ষণ পর আটকে আটকে শুধাল,
“ইহসান ভা..ই…”
পরেরটুকু বলার সুযোগ হলো না। ইহসান দু’হাতে আবদ্ধ করে কথা আটকে দিলো তার। কানের পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে শিথিল কণ্ঠে বলল,
“আই অ্যাম ইয়োর হ্যাজব্যান্ড, প্লিজ ডু নট কল মি ব্রাদার। ইট ডাজ’নট সাউন্ড রাইট।”
সৃজা কেঁপে উঠল সংকোচে। মনে অদ্ভুত শীতল বাতাস। জমে কুঁকড়ে গেল সে ইহসানের বুকের ভেতর। মুখ নুইয়ে কপাল ঠেকাল প্রশস্ত বুকটাতে। গালে পড়া রক্তাভ আভা লুকানোর চেষ্টায় রত হলো নির্বিঘ্নে। ইহসান মন্থর কণ্ঠে বলল,
“ঘুমা…”
সৃজা অনুভব করল তার হাত-পা অসাড় হয়ে গেছে। বুকের ভেতর সূক্ষ্ম এক প্রশান্তি আলোড়ন তুলেছে। দু-চোখ জুড়ে আচমকাই ঘুমের বন্যা নেমেছে। জাদুর মতো! বাধ্য মেয়ের মতোন সে ঘুমে ডুবে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে। ইহসান ধীরেধীরে ওকে বালিশে শুইয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আলগোছে। অস্ফুটস্বরে বলল,
“বহু আকাঙ্খিত আমার তুই।”
ঘুমন্ত সৃজা শুনতে পেল না সেটা। আবছা অন্ধকার ঘরটাতে শুধু তার ঘুমন্ত, গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ রজনীর নিঃস্তব্ধতাকে ভেঙে খানখান করে দিতে লাগল। ব্যাপারটা অনুভব করতে করতেই ইহসান টের পেল শরীর ভেঙ্গে দেওয়া ম্যাজম্যাজে এক ধরনের ব্যথা তার পুরো দেহ আস্তে-ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে। গায়ের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক ঠেকছে। ইহসান
মনে মনে উদ্বিগ্ন হলো। কপালে চিন্তার রেখা ফুটল।
নিজেকে নিয়ে বেশি ভাবে না সে। কিন্তু অন্যকে নিয়ে
ভাবে। অন্য কেউটা তার বড্ড অপছন্দের। তবুও
মাঝরাতে তাকে সামলাতে ডাক পড়বে ইহসানেরই।
অপছন্দের তালিকায় থাকা মানুষগুলোর মুখোমুখি
যে কেন পড়তে হয় বারবার, ইহসান ভেবে পায় না!
.
উদোম গায়ে ঘরের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে ইজহান। পরণে সাদা একটা তোয়ালে। সেটাও ঢিলে হয়ে কোমড়ে এমনভাবে এঁটে আছে যেকোনো মুহূর্তে বিপদসীমা অতিক্রম করে মানসম্মানের ইতি ঘটাতে পারে। ইস্মি তুলো দিয়ে ওর পিঠের ক্ষতে অ্যান্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিতে দিতে ধীর স্বরে বলল,
“তোয়ালে খুলে যাচ্ছে…”
ইজহান বিরক্ত চোখে তাকাল স্ত্রী’র দিকে। ঝাঁঝালো স্বরে ধমকে উঠল,
“তাতে আমার কোন শ্বশুরবাড়ির ক্ষতিটা হয়েছে? আমি মরছি কোমড় ব্যথায়, তিনি আছেন তোয়ালে নিয়ে!”
ইস্মি চুপ করে গেল। এই লোকের সাথে কথা বলা বৃথা। সে মনোযোগ দিয়ে ক্ষতগুলোতে চোখ বুলাচ্ছে আর ঔষধ লাগাচ্ছে। তার কান্না পাচ্ছে। বুক পুড়ছে। কার ভালো লাগে নিজের স্বামীকে এভাবে দেখতে? অথচ এই লোকের এ অবস্থার পেছনে সে নিজেই দায়ী। সারা শরীরে মারের দাগ, কোমড় সোজা করে দাঁড়ানোই যেখানে মুশকিল সেখানে এই লোক নিজেকে শক্তিশালী পুরুষ প্রমাণ করবে বলে কোমড়ের ব্যথাকে অগ্রাহ্য করে সটান দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতে সামান্য রোদ, বৃষ্টি, কুয়াশা বেশিকিছুই তার সহ্য হয় না। জ্বর-ঠান্ডা তো বারোমাসের সঙ্গী। তার উপর এর, ওর সাথে মারামারি করে করে শরীরটাকে সে পঁচিয়ে ফেলছে। ইস্মির রাগ হয় মনে মনে৷ আনমনা হয়ে জিদের চোটে ঘাড়ের কাছে তুলোটা চেপে ধরতেই ইজহান চেঁচিয়ে উঠে,
“সব ষড়যন্ত্রকারী একত্রিত হয়েছিস আমাকে মারতে, মারবিই তো। স্বামীকে মেরে কোনো এক কু’ত্তা’র
বাচ্চার সাথে ভাগবি এটা তো জানা কথা। ছলনাময়ী কোথাকার…”
বলে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো ইস্মিকে। সে হতবিহ্বল হয়ে দূরে সরে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“এমনকিছু করব না।”
ইজহান রক্তচোখে তাকাল। কোমড়ের ব্যথায় তার মাথার তার ছিঁড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েলোকের কাছে নিজেকে এতটা দুর্বল দেখাতে বাঁধছে তার। একটা হাত কোমড়ে রেখে অন্য হাত ঘাড়ে বুলাতে বুলাতে সে অতিকষ্টে দাঁড়িয়ে রইল। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল,
“করবি, সেজন্যই তো চেপে ধরেছিলি যাতে আমি মরে যাই। আর আমার সব সম্পত্তি, টাকাপয়সা নিয়ে তুই ভাগবি…”
ইস্মি এবার কেঁদে ফেলল,
“এসবকিছু স্বপ্নেও ভাবি না। আঘাতটা ভুলে হয়ে গেছে। আপনি কী আমাকে বিশ্বাস করবেন না আজীবনেও?”
ইজহান শান্ত হলো স্ত্রীর চোখের পানি দেখে। মনটা আনন্দে উদ্বেলিত হয় তার। বাঁকা হেসে বলে,
“ভুল করলে শাস্তি পেতে হয় সোনা।”
ইস্মি দ্বিধান্বিত নজরে তাকাল। আবারো হেয়ালিপনা করছে লোকটা। তার ভালো লাগে না এসব। মনের ভেতর উত্থাল করা অভিব্যক্তিটুকু চেপে গিয়ে
ভার কণ্ঠে শুধায়,
“কী শাস্তি?”
“একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।”
ইস্মি প্রবল বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“সারারাত?”
“হু সোনা, প্রুফ করতে হবে তুমি আমাকে বোকা বানিয়ে অন্য কোনো ফকিন্নির বাচ্চার সাথে পালাবে না।”
ইস্মির রুচি হলো না আর কোনো কথা বাড়াতে। নিজের স্বামীর এই সন্দেহবাতিক মনোভাবের শিকার হয়ে আসছে বিয়ের পরদিন থেকেই। অহেতুক সন্দেহ করবে, মা’রবে, কথার বাণে ভেতরটা শেষ করে ফেলবে। আবার নিজের মনমর্জি ভালো থাকলে এমনভাবে ভালোবাসবে, ইস্মি চিনতেই পারে না লোকটাকে! তবে কখনোই নিজের ভুল বা অন্যায় থাকা স্বত্তেও সেসব স্বীকার করবে না, ক্ষমা চাইবে না। যেমন আজ সকলের সামনে কদর্যপূর্ণ গালিটা দেওয়ার পর একবারও মাফ চায়নি, না চাইবে।
এসব ভাবলে ইস্মির দমবন্ধ হয়ে আসে! ইজহানের এই দু’মুখো রুপ নিতে না পেরে কতবার সে বিয়েটা ভাঙতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি! ইজহান হতে দেয়নি তা।
ইস্মিকে শাস্তিসরুপ একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়ে ইজহান কোমড় ব্যথা নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ডানহাতের তালুতে মাথার ভর রেখে ইস্মির পানে তাকাল, যেন ইস্মিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারে৷ ঘুষি খেয়ে ফুলে যাওয়া ঠোঁট দেখতে অদ্ভুত লাগছে! তবুও সেখানে বরাবরের মতো বক্র হাসি ঝুলছে। ইস্মি গোপনে নিঃশ্বাস ফেলল। একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর, অমানবিক। তার পা ব্যথা করছে। ইস্মি দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেও পারল না। ইজহান আবার শুরু থেকে করার নির্দেশ দিলো। ইস্মির ফর্সা, কান্নারত মুখ তখন লালচে আভায় জ্বলজ্বল করছে। তবুও কান্নার শব্দ হচ্ছে না। স্বামীর আদেশ পালন করছে মুখ বুজে। নয়বারের মাথায় ইজহান ব্যথাযুক্ত কোমড় নিয়েই পা টেনে টেনে বিছানা থেকে নেমে এলো। ধীরপায়ে এগিয়ে ঝট করে আচমকা কোলে তুলে নিলো। ভড়কে গিয়ে ইস্মি তার গলা জড়িয়ে ধরল। ইজহান তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। এরপর ওর শাড়ির আঁচল সরিয়ে মুখ ডুবিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল ইস্মির উপর। মুখ ঘষলো ওর গলায়৷ অস্ফুটস্বরে বলল,
“ইহসানটার কোমড়ে একটা লাথি দেব, মনে করিয়ে দিবে পরেরবার মারামারির সময়। নয়তো কাঁচা গিলে খেয়ে ফেলব।”
কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে দাঁত বসিয়ে দিলো ইস্মির ঘাড়ে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল ইস্মি। ইজহান এরপর সেখানে ছোট ছোট চুমু বসাল। ধীর স্বরে বলল,
“এভাবে।”
ইস্মি ব্যথা গিলে নিলো কিন্তু কথা বলল না। কারণ স্বামীর এ আচরণের সাথে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। জানে এখন ইনিয়েবিনিয়ে তাকে এপ্রোচ করবে, আদর করে দেওয়ার জন্য! আবার এমনও হতে পারে শরীরের ব্যথা বেড়েছে তাই উল্টাপাল্টা বকছে! ইস্মির হাত ইজহানের নগ্ন পিঠ স্পর্শ করতেই গায়ের গরম ভাবটা টের পেল। ভ্রু কুঁচকে হাতটা ইজহানের কোমড়ে ছোঁয়াতেই সে মৃদু কঁকিয়ে উঠল। ইস্মি চোখ বন্ধ করে ফেলল। এরপরের কাহিনী কী হতে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরে ছোট্ট শ্বাস ফেলে সামান্য রাগমিশ্রিত স্বরে বলল,
“কেন মারামারি করতে যান? ব্যথা পেলে কে ভুগে?”
ইজহান ব্যথা পেয়ে গোঙাতে গোঙাতে আওড়ালো,
“ইস্মিতা, আমার বউ!”
___________
চলবে…