অশ্রুবন্দি পর্ব-০৯

0
37

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯

ইস্মির হাত ইজহানের নগ্ন পিঠ স্পর্শ কর‍তেই গায়ের গরম ভাবটা টের পেল। ভ্রু কুঁচকে হাতটা ইজহানের কোমড়ে ছোঁয়াতেই সে মৃদু কঁকিয়ে উঠল। ইস্মি চোখ বন্ধ করে ফেলল। এরপরের কাহিনী কী হতে যাচ্ছে তা বুঝতে পেরে ছোট্ট শ্বাস ফেলে সামান্য রাগমিশ্রিত স্বরে বলল,

“কেন মারামারি করতে যান? ব্যথা পেলে কে ভুগে?”

ইজহান ব্যথা পেয়ে গোঙাতে গোঙাতে আওড়ালো,

“ইস্মিতা, আমার বউ!”
.

রাত তখন দেড়টার আশেপাশে হবে। ইহসানের চোখে ঘুম নেই। অস্বস্তিতে ভুগছে অজানা কারণে। হঠাৎ বালিশের পাশে অবহেলিত ভাবে পড়ে থাকা ফোনটা ভোঁ ভোঁ শব্দে কেঁপে উঠল। ইহসানের কানে বিরক্তিকর এ শব্দটি প্রবেশ করতেই কিছুক্ষণ থমকে রইল। হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে দেখল স্ক্রীনে ‘Izhan’ নামে সেইভ করা নাম্বার থেকে অনেকগুলো ম্যাসেজ শো করছে। চোখমুখ কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে স্ক্রীনে টাচ করে পুরোটা ম্যাসেজ অন করে লিখাটা পড়ল সে,

‘Toke mere pute felbo kuttar baccha….Barir pichoner pukure dubiye marbo… Tor bou k
bidhoba baniye carbo….amr komore lathi des tui harami???’

উল্টাপাল্টা, এলোমেলো হাতে টাইপ করা ম্যাসেজ।
একটা নয় অসংখ্য! সবগুলোতেই বাজে ইঙ্গিত,
বাজে ভাষা। আরেকটায় বোল্ড করে লিখা,

‘Accha… tor bow jane j tor power nai, main
jaigai somossa? I’m Powerful Man….Tai to Ismi amake chere jabe na….Powerless Ihsaaaan Vera Sheikh…’

ইহসানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। রাগে শরীর জ্বলে
গেল। আগ্নেয়গিরির ন্যায় জ্বলে উঠে বসল সে৷ শরীরের ম্যাজম্যাজে ব্যথাটা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিলো। এরপর অতি সাবধানে, সৃজার ঘুমের ব্যাঘাত যাতে না ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রেখে ওর উপর ভালোভাবে কাঁথা মেলে দিয়ে, বালিশ ঠিকঠাক করে দিলো সাবধানে। সৃজার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে আঙুল বুলিয়ে দিলো ওর ঠোঁটের উপর। বাঁকা হেসে মনেমনে গালি দিলো ইজহানকে,
‘সময় হলে আমার পাওয়ার আছে কি নেই, বুঝতেই পারবি…’

কথাটুকু আওড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত-পা টানটান করে শরীরটাকে চাঙা করে নিলো সে। এরপর আধো-অন্ধকার ঘরটাতে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে মেডিসিন বক্সটা বের করে ঔষধ গিলে নিলো পানি দ্বারা। অতঃপর সিঁটকিনি খুলে বাইরে থেকে দরজাটা সন্তপর্ণে আটকে দিলো। হাঁটা ধরল বা-দিকের শেষপ্রান্তে ইজহানের ঘরটায়। এক্ষুনি শয়তানটার গালে কষিয়ে একটা চড় বসিয়ে আসবে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ডায়াল লিস্ট থেকে ‘Ismi’ নামে সেইভ করা নাম্বারটিতে কল করল। রিসিভ হতেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

“দরজা খুলেন।”

দুটো শব্দ বলেই ফোনটা কাটল সে। দাঁড়িয়ে রইল কিছু সময়। দরজাটা খুলতে বেশি সময় নিলো না। পাল্লা দুটো সরিয়ে ইস্মি ম্লানমুখে বলল,

“আপনার ভাইয়ের জ্বর এসেছে, তাই উল্টাপাল্টা
ম্যাসেজে লিখেছে। জানেনই তো উনার স্বভাব।”

“জানি বলেই তো গালের হাড্ডি গুঁড়া করতে এসেছি। লুফারটার সাহস হয় কী করে সৃজাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা বলার?”

ইস্মি শুকনো গলায় বলল,

“জ্বরে কাবু সে।

তখনকার মারের ফলে যে ইজহানের জ্বর এসেছে তা বুঝতে সমস্যা হলো না ইহসানের। আইডেন্টিক্যাল টুইনস তারা। প্রায় সমস্ত বিষয়ই এক। ছোটবেলা থেকেই একজন অসুস্থ হলে অন্যজন সেটা অনুভব করতে পারে। তাদের এই টুইন টেলিপ্যাথির ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারে না অনেকেই। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। ইহসান ঠিকই ভেবেছিল। লুফারটা তাহলে জ্বরে পড়েই এসব উল্টাপাল্টা ম্যাসেজ লিখেছে। ইস্মি ওকে শক্ত চোখমুখ করে থাকতে
দেখে ঢোক গিলে বলল,

“এই অবস্থায়ও মারামারি করবেন?”

ইহসান বিরক্তি নিয়ে ইস্মির পানে তাকাল। এই
মেয়ের কথাগুলো শুনলে তার হাত নিশপিশ করে রাগে। ইজহান ওকে এত অত্যাচার করে, এত জ্বালায় তবুও এই মহিয়সী বারংবার লুফারটাকে নিয়েই এত চিন্তা করে। ইস্মি না থাকলে নির্ঘাত এতদিনে লুফারটার দমটুকু সে নিয়ে নিতো। শুধু এই ভদ্রমহিলার কথা বিবেচনা করে সে এটা করতে পারছে না। ইহসান ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

“এখন কী করছে? ঔষধ নিয়েছে?”

ইস্মি হতাশার শ্বাস ফেলে সত্যিটা বলেই দিলো,

“বারান্দায় বসে আছে ফোন নিয়ে। আমাকে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না, কিছু বললেই ক্ষেপে যাচ্ছে। ঔষধ দু’বার দিতে গিয়েছি, সে বাইরে ফেলে দিলো। গালিগালাজ করছে, বলছে আপনাকে মেরেই সে ওষুধ খাবে।”

ইহসান জানতো এরকমই কিছু হবে। সে কিছুক্ষণ ভাবুক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে এরপর বলল,

“আমার ঘরের দরজা খোলা। আপনি গিয়ে সৃজার সাথে শুয়ে পড়েন। ভোরে চলে আসবেন। আমি আপাতত লুফারটাকে দেখছি!”

ইহসান তাচ্ছিল্য করেই বলল কথাটা। ইস্মি দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেল। ইজহানকে এ অবস্থায় ছেড়ে গিয়ে কী ঠিক হবে? কিন্তু থেকেও তো লাভ হচ্ছে না। ইজহান তার কথা তো শুনছেই না, উল্টো জোরাজুরি করতে গেলে পাগলামি করছে, থাপ্পড় দিচ্ছে। আপাতত বেহেড লোকটাকে সামলানোর মতো শক্তি-সামর্থ্য কোনোটাই ইস্মির নেই। ঐ লোকের জ্বরে বেঁহুশের মতো অবস্থা! অথচ ভাইকে মেরে সে ওষুধ খাবে বলে অদ্ভুত জেদ ধরে বসে আছে। কী আশ্চর্য! ইস্মির বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ইহসানের কথা মানলো।
বেরিয়ে আসার আগে অনুরোধের সুরে বলল,

“মারবেন না যেন ওনাকে, কোমড়ে বেশ ব্যথা আছে।”

ইহসান চট করে রেগে গেল,

“সামলাতে এসেছি, মারতে নয়। যদিও একে মারতে আমার দু-মিনিটও লাগবে না। আপনি বিধবা হবেন তাই সেই পথে এগুচ্ছি না।”

ইস্মির মুখে অন্ধকার নেমে আসে,

“নিজের ভাইয়ের সম্বন্ধে এসমস্ত অশুভ কথা বলতে বাঁধে না? আপনাদের দুই ভাইয়ের মাথায়ই সমস্যা আছে। মায়াদয়া বলতে কিচ্ছু নেই।”

“বেশি মায়া দেখানো ভালো না। পরে পস্তাতে হয়, আপনার মতো।”

কথাটা বলে ইস্মির মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো ইহসান৷ এ ঘরটাতে সচরাচর সে আসে না। মাঝেসাঝে যখন ইজহান জ্বরে বেশি কাবু হয়ে যায়, ইস্মি যখন একা পারে না তাকে সামলাতে তখনই
তার আসতে হয় ভাই কম শত্রুটাকে সামলাতে। নিজের উপর বেজায় বিরক্ত হয় ইহসান। এর
প্রতি এত দরদ দেখানোর কোনো মানেই নেই,
অথচ সে এসেছে এটাকে সামলাতে!

.

ইহসানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল যখন দেখল
জ্বরে কাবু হওয়া শরীর নিয়ে ইজহান বারান্দার ফ্লোরে মাদুর পেতে একপাশে কাত হয়ে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। গায়ে কিছু নেই, কোমড়ের নিচে তোয়ালে বাঁধা। পাশে একটা ড্রিংকসের বোতল। গিলেছে কি-না কে জানে! কিছুক্ষণ পরপর জ্বরের ঘোরে বা ড্রিংক করার দরুন অস্ফুটস্বরে এটা-সেটা বলাবলি করছে আর ফোনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছু লিখছে। বেশিরভাগই মা আর ইহসান সম্পর্কিত। বোঝা যাচ্ছে না তবে অস্পষ্ট ভাবে শোনা যাচ্ছে। ইহসান কপালে ভাঁজ ফেলে পানির গ্লাস নিয়ে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল সেদিকে। ঠান্ডা দেয়ালে ঠেস দিয়ে সে বসে পড়ল মাদুরে। ইজহান তখনো লক্ষ্য করেনি তাকে, বুঝেওনি তার অস্তিত্ব। জ্বরের ঘোরে লাল হওয়া মুখটা দেখে ইহসানের ভ্রু কুঁচকে এলো।অবিকল তার চেহারা। চুলের স্টাইলও সেইম। কোথাও একটু অমিল নেই। খুব বিশ্রি কিছু ঘটনার মধ্যে দিয়ে তাদের দুই ভাইয়ের জন্ম এক ঝড়ের রাত্রিতে। সেসময় পরিস্থিতি এত জটিল ছিল যে, তাদের জন্মানোতে কেউই খুশি হতে পারেনি। সেজন্য কে যে ছোট আর কে বড় সেটা কেউ খেয়ালই রাখেনি। তারা দু’ভাই কেউ কারো থেকে কম যেত না। ইহসান সবসময় নিজেকে বড় ভাই ভাবত, ইজহানও! এটা নিয়ে কম ঝামেলা হয়নি তাদের মধ্যে। কেউই নিজেকে ছোট ভাবতে রাজি নয়। ইজহান তো সেজন্য বিয়েটাও আগে করেছে, শুধুমাত্র নিজেকে বড় ভাই প্রমাণিত করবে বলে। ইহসান অবশ্য এসব স্টুপিডিটির ধার ধারে না। সে নিজেকে বড় জানে, মানে এবং ভাবে। আচ্ছা, সৃজা কী কখনো ওদের মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে পারবে? ওকে চিনতে পারবে তো মেয়েটা? কেন জানি ঈর্ষায় বুক জ্বলল ইহসানের। কেন তার চেহারাটাই পেতে হলো ইজহানকে? সৃজা যদি গুলিয়ে ফেলে? কী বিশ্রি কান্ড হবে তাহলে! নাহ! ইহসান ভাবতে চাইল না সেসব৷ আজগুবি চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে একপাশে কাত হয়ে শুয়ে থাকা ইজহানকে সে উদ্দেশ্য করে বলল,

“ঐ ই’বলিশ, এখানে শুয়ে হাওয়া খাচ্ছিস কেন?”

প্রশ্নটা শুনতে পেল ইজহান। চট করে পেছনে ফিরে চাইল। কিন্তু সব তার চোখে ঘোলাটে দেখাচ্ছে৷
দুর্বল স্বরে উত্তর দিলো,

“বাইরে অনেক গরম।”

ইহসান বাঁকা স্বরে বলল,

“শুয়ে তো আছিস সেই বাইরেই ছাগল…”

“আমি আজিজ শেখের ছেলে, নাম ইজহান। বাঘের চেয়ে কম কিছু না। তুই কোথাকার কোন আলু?”

ইহসান বাঁকা হাসলো। বলল,

“তোর জ্বরের ঘোরের প্রাণপ্রিয় আলু! শয়নেস্বপনে যে আলুর নাম জপে চলছিস, ইহসান শেখ৷”

নাম শুনেই জ্বলে উঠল ইজহান। বসা থেকে উঠতে চাইল কিন্তু পারল না। কোমড়ে জোরে চাপ লাগল। সঙ্গে সঙ্গেই আর্তনাদ করে উঠল। কাতরাতে কাতরাতে ফুঁসে উঠে বলল,

“জোচ্চোরটা তো বিয়ে করে ঘরে বউ নিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমাকে মেরে হাড্ডি ভেঙে দিয়েছে। সামনে পেলে কুত্তা দিয়ে মাংস ছিঁড়ব। কোমড় ব্যথায় আমার জ্বর…”

এটুকু বলে হঠাৎ থেমে গেল ইজহান। জুলজুল চোখ করে তাকিয়ে রইল। সামনে বসে কথা বলা মানুষটাকে বড্ড চেনা চেনা লাগছে কিন্তু বুঝতে পারছে না কে সে! দেখতে ইস্মির মতোনই লাগল যেন। ইহসান তার চাহনি লক্ষ্য করে রাগ সামলে নরম স্বরে বলল,

“ঔষধ খাসনি কেন?”

“হারামি ইহসান শেখকে মেরে তার বউকে বিধবা বানিয়ে এরপর খাব। এটাই আমার প্রতিজ্ঞা।”

ইহসানের ইচ্ছে করল ইজহানের মুখ বরাবর ঘুষি বসিয়ে দিতে। অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিলো সে। পকেট থেকে ঔষধ বের করে ইজহানের চোয়াল
চেপে মুখের ভেতর দিয়ে পানির গ্লাস ধরিয়ে বলল,

“গিলে উদ্ধার কর, ইহসান শেখ মরে গেছে।”

ইজহান বিস্মিত হয়ে কথাটা শুনল৷ ইস্মি ভেবে ইহসানকেই জিজ্ঞেস করল,

“বউটাও?”

“জানি না, মনে হয় ফাঁস নেবে। স্বামী মরে গেছে বেচারি আর বেঁচে থেকে কি করবে?”

ইজহান অদ্ভুত ভাবে শুনল কথাটা। ইস্মি ভালো একটা খবর দিয়েছে, এবার ঔষধ খাওয়াই যায়৷ সে মাথা খানিকটা উঁচু করে ঔষধ গিলে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিয়ে আফসোস করে বলল,

“বউটার অবশ্য দোষ ছিল না। সে বেচারি তো আর জানতো না বদমাশটার মূল জায়গায় সমস্যা।”

ইহসান প্রচন্ড রেগে তড়াক করে মুখ চেপে ধরল ইজহানের। রুক্ষ স্বরে বলল,

“মুখ ভেঙে দেব শালা…”

ইজহান বিমূঢ় চোখ করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। ইস্মি এত রেগে গেল কেন হঠাৎ? ও তো রাগে না। আবার মুখও চেপে ধরেছে! বড্ড অবাক হলো সে। ইহসান তাকে ময়লার মতোন ছুঁড়ে বালিশের উপর ফেলে দিলো। ইজহানের মাথাটা ভনভন করছে।।
চোখ জড়িয়ে আসছে। সে দুর্বল কণ্ঠে বলল,

“তোমার হাত এত শক্ত কেন ছেলেদের মতোন?
অনেকটা ইহসান শেখের মতোন। ও কী তোমার মধ্যে ভর করল?”

ইহসান তিরিক্ষি মেজাজে রাগান্বিত স্বরে বলল,

“শালা, ইস্মি ইস্মি করে বুলি কবচাস সারাদিন, অথচ দু-দণ্ড শান্তি দিস না মেয়েটাকে। জ্বরে পড়লেই ভাই অন্তঃপ্রাণ? হিপ্রোকেটের বাচ্চা। এমনিতে তো ইহসান শেখকে পুছতেও চাস না, আর জ্বর হলে তারই সেবা লাগে? ঘোর ভেঙে দেখিস কার পায়ের তলায় এসে মাথা ঠুকাস। হারামি কোথাকার!”

গমগমে, কর্কশ গলার শব্দ শুনে ইজহান জ্বর চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ছেলেরুপী ইস্মির দিকে। তার বউটা মাঝরাতে ছেলেদের পোশাক পরে, ছেলেদের গলার স্বরে কথা বলছে কেন এটা সে কিছুতেই বুঝতে পারল না। এত স্পর্ধা পেলই বা সে কোথায়?

.

ভোর হতেই ইস্মির ঘুম ভেঙে গেল। চারদিকে আলো ফুটতে শুরু করছে। তড়াক করে সে লাফিয়ে নামল বিছানা থেকে। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল দরজা খুলে। ইস্মি চলে যাওয়ার মিনিট খানেক পর ইহসান এলো নিজের ঘরে। তার চোখ রক্তবর্ণ। মাথায় প্রচন্ড ব্যথা। সারাটা রাত একফোঁটা ঘুমাতে পারেনি সে। ইজহান বারান্দায় ওর উরুতে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিল। টেনে-হিঁচড়েও তাকে বিছানায় নিতে পারেনি ইহসান। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকতে থাকতে তার পিঠ পর্যন্ত ব্যথা হয়ে গেছে। ইহসান বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানির ছিঁটেফোটা দিয়ে এসে বিছানায় চলে এলো। কাঁথার ভেতর ঢুকে গেল। একহাত দিয়ে পেছন থেকে আঁকড়ে ধরলো সৃজাকে। মেয়েটা তখনো ঘুমে ডুবে। জানতেই পারেনি ইহসান গত রাতটা কী বেহাল দশায় কাটিয়েছে। সেসময় গিয়ে ইহসানের মনে একটা প্রশ্ন জাগল, সৃজা যদি কখনো তার জন্মবৃত্তান্ত জানতে পারে তাহলে কি মেয়েটা
ওকে ঘৃণা করবে? ছেড়ে চলে যাবে? সবাই তো যায়। কিন্তু এটা তো হতে দেওয়া যাবে না, কিছুতেই না। সৃজাকে তার চাই, যেকোনো মূল্যে। এই মেয়েটার প্রতি সে আসক্ত, যতটুকু আসক্ত হলে কোটিপতি বাবার মেয়ে লিথুকে ছাড়তে পারে ততটুকু। নাহ, তারচেয়েও বেশি। অনেক বেশি! যেটা পরিমাপ করা যাবে না। ইহসানের হাতদুটো আচমকা শক্ত করে জাপ্টে ধরল সৃজাকে। ঘুম ভেঙে গেল সৃজার। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলো। নড়েচড়ে পাশ ফিরতে গিয়ে বুঝল পিছন
থেকে ইহসান তাকে জড়িয়ে রেখেছে। সৃজা তার হাতদুটো ছাড়ানোর চেষ্টা করে অস্ফুটস্বরে ডাকল,

“ছাড়ো আমায়, দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে…”

ইহসান রুক্ষ স্বরে বলল,

“ছাড়ব না।”

“কী আশ্চর্য! ভোরবেলা এমন আচরণ করার মানে কী?”

“তুই কখনো আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?”

সৃজা থমকে গেল এমন প্রশ্নে। বেশ চমকেও গেল।
ইহসানের সাথে চিরকাল তার স্বাভাবিক সম্পর্ক। আপন ভাই-বোনের মতো। সেখানে খুনসুটি পর্যন্ত ছিল না। বরাবরই সেই সম্পর্কে শ্রদ্ধা-স্নেহ, সম্মান ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ের। তাই ইহসান যখন বিয়ের প্রস্তাবটা তুলছিল, সে বড্ড অবাক হয়েছিল। একবার যখন বিয়েটা হয়েই গেছে তখন সম্পর্কটা মেনে নিয়ে সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইহসান এখন এমনভাবে প্রশ্নটা করল সৃজার মনে হলো যুগ যুগ ধরে তাদের মধ্যে প্রেম! অস্বাভাবিক ঠেকল সৃজার কাছে। মৃদুস্বরে বলল,

“এই ভোরে এসব উল্টাপাল্টা প্রশ্ন কেন করছ?”

“তুই উত্তর দে…”

রুক্ষ হয়ে উঠল ইহসানের কণ্ঠস্বর। সৃজা অবাক বনে গেল। আমতাআমতা করে বলল,

“বিয়ে যখন একবার হয়ে গেছে তখন ছেড়ে আর
যাব কীভাবে?”

ইহসান রাশভারি স্বরে বলল,

“তারমানে যাবি না?”

সৃজা গাইগুই করে উত্তর দিলো,

“না।”

ইহসান তখন অদ্ভুত একটা কথা বলল, যেটা শুনে সৃজার চক্ষুচড়ক গাছ হয়ে গেল।

“একটা চুমু খাব?”

সৃজা স্থির হয়ে গেল। লজ্জায় বুঝে উঠতে পারল
কী উত্তর দেবে! ইহসান অবশ্য অপেক্ষা করল না। খয়েরি রঙা ঠোঁটদুটো এগিয়ে আনল, সৃজা ভয়ে, অস্বস্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তবে ইহসানের ঠোঁটদুটো তার ওষ্ঠাধর ছুঁয়ে গেল না। সৃজা পুরুষালি ঠোঁটদুটোর অস্তিত্ব অনুভব করল তার কপালে। কেঁপে উঠল অজানা অনুভূতিতে। আবিষ্ট হয়ে ইহসানের ঘাড়ে এক হাত রেখে অন্য হাতে টি-শার্টের কলার আঁকড়ে ধরল। আর তক্ষুনি অনুভব
হলো গাঢ় তাপে পুড়ে যাচ্ছে তার কপাল, ঘাড়ে রাখা
হাতটা। সৃজা নিদারুণ বিস্ময় নিয়ে বলল,

“জ্বরে পুড়ে যাচ্ছ তুমি।”

কপাল থেকে ঠোঁটজোড়া সরিয়ে ইহসান ঘোলা
চোখে চাইল সৃজার প্রতি। দুর্বল, অস্ফুটস্বরে বলল,

“তুই ছুঁলে সেরে যাবে।”

ইহসানের গাঢ় নিঃশ্বাস পুড়িয়ে দিতে লাগল
সৃজার ঠোঁটমুখ। জানালা গলে আসা হিম স্পর্শী হাওয়া দোলা দিয়ে যেতে লাগল বুকের ভেতর স্পন্দিত হতে থাকা ছোট্ট হৃদপিন্ডটা। অতিরিক্ত জ্বরে ইহসান তার জ্ঞানশূন্য, সৃজা যখন এটা টের পেল ততক্ষণে পূর্ব আকাশ কমলা রোদে ভরে উঠেছে।

_______

চলবে….