#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১
ইহসান এখন কিছুটা সুস্থ! তাই আজিজ শেখ নিশ্চিন্ত মনে
তার ব্যবসায়ের কারবার সামলাতে গেছেন। সালেহা বেগমকেও বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার ধারণা, সৃজা তার ছেলেকে সামলাতে পারবে না একা একা। ইহসান যাতে বুঝতে পারে সে ঠিক কতটা ভুল করেছে সেজন্য তিনি এ কাজটা করেছেন। সৃজা ব্যাপারটা বুঝে গেল। ওর অবশ্য তাতে কিছু যায় আসল না। বেশ ভালোভাবেই সবটা সামলে নিলো। দুপুরের তীব্র রোদ উপেক্ষা করে সেদিন এলিজা হাসপাতালে এল। বোরিং সময়টা ইহসান এলিজার সঙ্গে গল্পগুজব করে কাটাল। সৃজাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে ইচ্ছে করেই তাকে রাগানোর চেষ্টা করল। যদিও সৃজা উপর উপর রাগ দেখানোর ভান করল, কিন্তু মনে মনে ওর কোনো রাগ ছিল না। বরং স্বাভাবিকভাবেই ইহসানের দেখভাল করল, মাঝে মাঝে চোখ রাঙাতে অবশ্য ভুলল না। তাদের এই কান্ডকারখানা দেখে এলিজা মুখ টিপে হাসছিল। তার বুঝতে বাকি রইল না, সৃজা ইহসানের সঙ্গ একেবারে মন্দ নেই। ও ভীষণ স্বস্তি পেল। হেসে বলল,
“তুমি আপুকে খুব জ্বালাও, তাই না?”
“সেটা তোর বোনকেই জিজ্ঞেস করে জেনে নে, আমি তো ভালোই আদর টাদর করি, ডিম ভেজে খাওয়াই। তোর বোনটা আমার খেয়াল রাখে না, রাখলে কি আমার জ্বরে পড়তে হয়?”
সৃজা এ কথা শুনে রেগে গেল,
“ভাইয়ের সাথে মারামারি করে জ্বর বাঁধিয়েছ, আর বলছ আমি খেয়াল রাখি না? এলিজ তুই এই পাগল লোকের কথা বিশ্বাস করবি না। ভাইকে যেভাবে মেরেছে দেখলে তুই হতবাক হয়ে যাবি! সে বেচারা এখন কোমড় নিয়ে নড়চড় করতে পারে না।”
ইহসানের চোখের ভেতর যেন আগুন জ্বলে উঠল। শাণিত কণ্ঠে বলল,
“তুই কাকে বেচারা বলছিস? ইজহান শেখ আস্ত একটা লুফার, যে শুধু নিজে স্বার্থটা দেখে। ওটার পক্ষপাতিত্ব করবি না। তুই জানিস না, এর চরিত্র কেমন!”
ইহসান গম্ভীর মুখে বলল কথাটা। সৃজা একটু হকচকিয়ে গেল। ভোঁতা মুখে কিছু বলতে যাবে তখনি কল এলো ইহসানের ফোনে। সৃজা ফোন হাতে তুলে স্ক্রিনে ‘Injan’ নামটি জ্বলজ্বল করছে। সে ফোনটা ইহসানকে এগিয়ে
দিয়ে বলল,
“তোমার ভিডিয়ো কল এসেছে…”
ইহসানের মুখভঙ্গি পাল্টে গেল। কপালে ভাঁজ পড়ল।
অপ্রস্তুত মুখে ফোনটা নিয়ে রেখে দিলো, কাটল না। ফোনটা বাজতে বাজতে একসময় থেমে গেল। ইহসান স্বস্তির শ্বাস ফেলল। তবে সেটা বেশিক্ষণ টিকল না। ফোনটা আবারো নতুন উদ্যমে একনাগাড়ে কল দিতে লাগল। যেন পণ করেছে যতক্ষণ না ফোন রিসিভ হচ্ছে ততক্ষণ সে কল দিয়েই যাবে। সৃজা বিস্মিত হয়ে বলল,
“কলটা ধরো, জরুরি হতে পারে।”
ইহসান মুখ গোঁজ করে জবাব দিল,
“জরুরি না।”
ফোনটা বেজেই গেল একনাগাড়ে। ইহসান ধরল না এবারো। সাইলেন্ট মুড অন করে বালিশের নিচে রেখে দিলো। সৃজা কিছু বলতে যাবে এরমধ্যে দরজা ঠেলে ইহসানের নিজস্ব অ্যাসিস্ট্যান্ট রশিদ হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল। নিজের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে ইহসানকে ভীতু মুখে বললেন,
“ফোন ধরতেছেন না কেন স্যার? ছোটস্যার খুব রাইগা আছে। নেন কথা বলেন…”
বলে ফোন দিয়ে সে বেরিয়ে গেল। ইহসান লাফিয়ে উঠে ফোনটা নিলো। তড়িঘড়ি করে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রাগান্বিত, ক্ষোভিত চেহারাটা ভেসে উঠল,
“ইউ’য়ার নট পিকিং আপ মাই কল? সিরিয়াসলি, ব্রো?”
ইহসান কোণা চোখে দু-বোনকে দেখে নিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে মিথ্যে বলল,
“ঘুমাচ্ছিলাম তাই… ”
“ডোন্ট লাই…ডোন্ট…”
চিবিয়ে চিবিয়ে কথাটা ভেসে এলো। ইহসান কপালে আঙ্গুল চেপে ধরল। চোখদুটো বুজে নিজেকে স্থির করে সৃজা আর এলিজাকে হা হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। ওদেরকে চক্ষু শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কেবিনের বাইরে বের করে দিলো। এরপর ভাইকে বলল,
“মিথ্যে বলছি না, আমি সত্যিই ঘুমাচ্ছিলাম। নয়তো কি ধরতাম না? কখনো কি এমন হয়েছে যে তোর ফোন আমি ধরিনি?”
কিছুটা সময় কেটে গেল। ইহসানের মনে হলো ইনজানের রাগটা কমছে ধীরেধীরে। সে শান্ত গলায় শুধাল,
“কেমন চলছে সবকিছু?”
ইনজানের জবাব এলো,
”অল গুড! বাট হোয়াট অ্যাম আই হিয়ারিং? আর
ইউ সিক, ব্রো? রিয়্যালি?”
ইহসান আবারো অপ্রস্তুত হয়ে গেল। হাসার প্রচেষ্টা করে তাকে বলল,
”আ’ম গুড, অলওয়েজ গুড।”
এরপর আরো কিছু কথা হলো দুই ভাইয়ের মধ্যে। ইহসান যথাসম্ভব কম প্রশ্ন করল ভাইকে, শুধু শুনেই গেল। কারণ, ইনজান জানে না সে সৃজাকে বিয়ে করেছে। তার জানার কথাও নয়৷ কারণ বাড়ির কারোর সাথে ইনজানের যোগাযোগ নেই। একমাত্র ইহসানের সাথেই তার যোগাযোগ হয়, মাঝেমধ্যে তাকে না পেলে রশিদের সাথে যোগাযোগ করে। তারমধ্যে ইহসান ভাইকে জানায়নি সে বিয়ে করেছে, তাই চায় না ইনজান তার বিয়ের খবরটা জেনে ঝামেলা করুক। ফোন রাখার আগে ইনজান বাঁকা হাসি দিয়ে ইহসানকে বলল,
“ইউ’য়ার টু ক্লেভার, ব্রো… ইউ থিঙ্ক ইউ ক্যান হাইড মাই লাইফ ফ্রম মি? ডোন্ট ইভেন ট্রাই…”
ইহসান বোকা বনে গেল। পরক্ষণেই বুঝতে পারল কথাটা। মাথাটা গরম হয়ে গেল তার। চোয়াল শক্ত করে বলল,
“কী বুঝাতে চাইছিস?”
“আমার জানের সুবাস আমি এই ফোনের মধ্যেও পাচ্ছি…”
“তুই একটা পাগল, বিকৃত মানসিকতার নষ্ট ছেলে। তাই পাচ্ছিস! ফোন রাখ কুকুর কোথাকার… ”
ইনজান জ্বালানো ভঙ্গিতে হাসল,
“ল্যাভেন্ডার…”
ইহসান চমকে গেল। মুখ হা হয়ে গেল তার। কথা বলার মতো শব্দ খুঁজে পেল না। অনেক কষ্টে শব্দ গুছিয়ে যখন জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনি ইনজান ফোনটা কেটে দিলো। ইহসান ব্যস্ত ভঙ্গিতে কল ব্যাক করল। কিন্তু শুনতে পেল,
“দ্য নাম্বার ইউ আর ট্রাইং টু রিচ ইজ সোয়িচড অফ।”
ইহসান রাগ সামলানোর চেষ্টা করল। তার ভাইটা কি তার থেকে বড় খেলোয়াড় হওয়ার চেষ্টা করছে?ফোনটা রিসিভ করার পর সৃজা, এলিজা তো চুপচাপ ছিল, শব্দ করেনি। তাহলে ইনজান কীভাবে বুঝল ইহসান তার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না ইহসান। রশিদকে কল দিয়ে ডেকে পাঠাল। সে আসতেই ইহসান আগুন লাল চোখে তাকাল। যেন ভস্ম করে দেবে। গমগমে গলায় জিজ্ঞেস করল,
“খবর পাচার হচ্ছে কীভাবে?”
রশিদ কিছুই বুঝতে পারল না। বেচারা ভয় পেয়ে গেল। শুকনো গলায় কসম কেটে বলল,
“বিশ্বাস করেন, কিচ্ছু কই নাই। আমার কাছে তো
আজই ফোন আসছে।”
“গেট লস্ট…”
ইহসান গর্জে উঠল। রশিদ নিজের ফোনটা নিয়ে বেরুতে গিয়ে দরজায় হুড়মুড় করে পড়ে যেতে যেতে গিয়েও সামলে নিলো নিজেকে। সৃজা আর এলিজা করিডরে ছিল, ছুটে এসে দেখল ইহসান তেজ দীপ্ত গলায় বকছে কথা রশিদকে। সৃজাদের দেখেই সে চুপ করে গেল। রশিদ বেরিয়ে গেল ম্লানমুখে। সে যেতেই সৃজা পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো ইহসানকে,
“নাও।”
ইহসান গ্লাসটা হাতে নিয়ে নিজেকে বহুকষ্টে শান্ত করল। পআনিটা এক চুমুকে শেষ করে এলিজার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“বান্ধবী তো পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে, যাবি কার সাথে?”
এলিজা ছোট্ট করে বলল,
“একা যেতে পারব…”
ইহসান কপালে ভাঁজ ফেলে দ্বিরুক্তি করল,
“একা তো আমি যেতে দেব না…রশিদকে বলে
দিচ্ছি, পৌঁছে দিয়ে আসবে। আর রাস্তাঘাটে সাবধানে চলবি।”
এলিজা দ্বিরুক্তি না করে বলল,
“যথা আজ্ঞা।”
.
হসপিটালে দু’দিন কাটানোর পর বাড়িতে আসার
জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল ইহসান। আর একটা দিনও
সে এখানে কাটাতে পারবে না বলে কথা কাটাকাটি শুরু করল। আজিজ শেখের কাছে খবর গেলে তিনি তার অ্যাসিস্ট্যান্টকে দিয়ে বলে পাঠালেন আরো দু’দিন থাকার পরই তাকে বাড়ি যেতে হবে, এখন সম্ভব না। ইহসানের জেদটা যেন আরো বাড়ল। ঐ লোক কেন তার ব্যাপারে
নাক গলাবে? তাকে হুমকি দেবে? অর্ডার দেবে?
বাবা নামক এই লোকটার কথা মান্য করার মতো বাধ্য ছেলে ইহসান নয়৷ তাছাড়া তার অনেক কাজ, খুব গুরুত্বপূর্ণ। হাসপাতালে বসে হাওয়া খেলে সেসবের
কিছু করতে পারবে না। তাই সে তখনি বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সৃজা ওর এমন আচরণে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। শরীর এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি, দুর্বল
অবস্থায় কীভাবে ইহসান এমন অবুঝের মতো আচরণ করতে পারে? সেদিন ইজহানের সাথে মারামারি কারণে
যে কিল-ঘুষি, লাথি খেয়েছে সেই আঘাতের কারণেই
মূলত জ্বরটা হয়েছে। শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে লালচে হয়ে আছে। ব্যথা যে হয় সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যায়। অথচ ইহসান এমন একটা ভান করছে যেন কিছুই হয়নি। ওর এমন নির্লিপ্ত অবস্থা দেখে সৃজার ভীষণ রাগ হয়
কিন্তু প্রতুত্তরে বলার মতো কঠিন কিছু খুঁজে না
পেয়ে বলে,
“তোমার নাটক এবার কমাও। একেবারে সুস্থ হয়ে গেলেই বাড়ি যাবে। নিজের অবস্থা একবারো দেখেছ? আয়নায় দেখলে চিনতেই পারবে না।”
“তুই চিনলেই চলবে।”
ব্যতিব্যস্ত গলায় কাউকে কল দিতে দিতে কথাটা
বলল ইহসান। শুনে সৃজা রাগান্বিত চোখে চাইল।
______
চলবে…