#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২
একপ্রকার জেদ করেই দু’দিনের মাথায় হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ নিয়ে বাড়ি চলে আসে ইহসান। তবে অবাক ব্যাপার, সেদিন রাতেই আবার জ্বরে আক্রান্ত হলো সে।
সৃজা হতভম্ব হবে কি রাগে বাকহীন হয়ে গেল। আজিজ শেখ রাতে বাড়ি ফিরে পুত্রের অবাধ্য কাণ্ডকারখানা দেখে বাড়ি মাথায় করলেন। সালেহা বেগম কিছু না বলেও থাপ্পড় খেলেন। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ইজহান কোমড় ব্যথা
নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে বাপের সাথে তাল মিলিয়ে গালিগালাজ ছুঁড়তে লাগল। ইস্মি তাকে থামাতে পারল না, অসহ্য হয়ে ঘরে বসে নিজের কপাল চাপড়াল। আর সৃজা একরাশ তিক্ত অনুভূতি আর জলভরা চোখে জেদ নিয়ে ইহসানের সেবা করে গেল সারারাত। ভোরের দিকে তার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসল। চেষ্টা করেও জেগে থাকতে পারল না সৃজা। ঘুমের নেশায় ডুবে গেল। সকালের দিকে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল ইহসানের। ঘর্মাক্ত শরীর
অস্বস্তি দিচ্ছিল তাকে। নেচে বেড়ানো রোদের কুচি চোখ ছুঁতেই হুঁশ হারা গাঢ় ঘুমটা হালকা হলো তার। বুকের উপর ভার ভার অনুভূতি টের পেতেই ভ্রু কুঞ্চন করে মাথা খানিকটা উঁচু করে তাকাতেই সৃজার মুখখানি নজরে পড়ল। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে ইহসানের বুকের উপর। কাচের জানালা দিয়ে আসা নরম রোদ চিকচিক করছে, মিষ্টি এক সুঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। ইহসানের ভেতরটা ঊষ্ণ শিহরণে ছেয়ে
গেল! ঘনকালো চুলের আছড়ে থাকা সৌন্দর্য, ফর্সা মসৃণ গালের মলিন আভা, গোলাপি ওষ্ঠপুটের অকৃত্রিমতা ইহসানকে থমকে দিলো এই সুন্দর সকালে। ইচ্ছে করল ঐ ওষ্ঠাধরের সুধা পান করে শুকনো, খরখরে মনটা ভিজিয়ে নিতে৷ ঊষ্ণ আলিঙ্গনে বাঁধনহারা হতে, ভালোবাসা ছুঁয়ে দিতে।শেষপর্যন্ত অনুভূতির তাড়নায় হার মেনে সম্মোহিতের মতো সে হাত বাড়িয়ে ঘুমন্ত সৃজার ঊষ্ণ অধরে আঙুল ছুঁয়ে ঘোরগ্রস্তের মতো বলে উঠল,
“যার বুকে পড়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিস, সেই অধম তো এত ভালো লোক নয় রে, বড্ড লোভী! এই লোভী লোকটা খারাপ কিছু করার আগেই পুরোপুরি তার হয়ে যা না… অধমের তৃষিত, পিপাসার্ত বুকটাকে একটু শান্তি দে না জান! তোর উন্মত্ত ভালোবাসা পাওয়ার লোভে সে ডুবে মরতেও রাজি…”
ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শে সৃজা ঘুমের ঘোরে নড়েচড়ে অস্ফুট শব্দ করে উঠতেই ইহসান ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো। গোলাপি নরম অধর ছুঁয়ে থাকা হাতটা আলগোছে সরিয়ে নিয়ে নিজের ঠোঁটে ছুঁইয়ে, চোখ বন্ধ করে অনুভব করা চেষ্টা করল। দীর্ঘক্ষণ কেটে গেল ওভাবেই৷ সমুদ্রের তরোঙ্গচ্ছ্বাসের মতোন করে হৃদযন্ত্রটা তোলপাড় চালাতে লাগল। আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতোন একবুক প্রশান্তিতে ভরে উঠল তার ঘামে জবজবে দেহ-মন৷ ইহসান ডাকল না সৃজাকে। অনিমেষ, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দেখে গেল। মেয়েটা সারারাত ঘুমায়নি তার জন্য। সেবা করে গেছে অবিরাম। ইহসান জ্বর নিয়ে ওর চোখ দেখেছে, সেই চোখে মিশে ছিল অনুরাগ আর তার সর্বনাশ!
.
জ্বর থেকে পুরোপুরি সুস্থ হতে সপ্তাহখানিক লেগে গেল ইহসানের। তবুও এই অসুস্থতা নিয়েই সে নিজের যাবতীয় কাজ সামলেছে৷ সৃজার সমস্ত নোটস জোগাড় করে এনে দিয়েছে, ওর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এনেছে, বাজারসদাই করেছে। আজিজ শেখ একদিন সৃজাকে কটুক্তি করায় বাপকে সে প্রচণ্ড ধানাইপানাই করেছে, ভদ্রতার ধার ধারেনি। রান্নাঘরে সৃজার যাওয়া নিয়ে খোঁটা দেওয়ায় ইহসান রেগে গিয়ে লোক দিয়ে ছাদে উঠার সিঁড়ির পাশে খোলা জায়গায় একটা আলাদা রান্নাঘরই তৈরি করতে চেয়েছিল, কিন্তু সৃজা সেটা করতে তাকে আটকেছে।
এতটা বিশ্রি কাণ্ড হতে দিতে পারে না সে! তাই আজিজ শেখের খোঁচামিপনা যাতে সহ্য করতে না হয় সেজন্য বাড়ির বুয়া শেফালিকে রেখে দিয়েছে রান্নার কাজে। এসবের পাশাপাশি সে তার রেস্তোরাঁ ও ক্যাফে চেইনের ব্যবসাটাও সামলেছে। সৃজা এ ক’দিন শুধু বিস্মিত হয়ে অবলোকন করে গেছে ইহসানের প্রতিটি কাজকর্ম! দিনের বেশিরভাগ সময়টাতে সে বাইরে থাকে, মাঝেমধ্যে বাড়িতে এসে সৃজার সঙ্গে দুপুরে খেয়ে যায় এরপর রাত আটটার দিকে ফেরে।
সেসময় টাতে ইজহান বৈঠকখানার নরম গদিতে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে, বসে টিভি দেখে। দারোয়ানের ছেলে মকবুলকে দিয়ে হাত-পা টেপায়, মনমতো না হলে গালি দেয়। আর পাশে ইস্মি ভাতের থালায় কষা মাংস দিয়ে ভাত মেখে তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। নিত্যদিনের রুটিন।
ইহসানকে দেখলেই পেছনে থেকে ‘ফকির’ নয়তো ‘ভেড়া’ বলে টিজ করে। কখনোসখনো তারচেয়ে ভয়াবহ কোনো গালি দিয়েও বসে। কারণ ইহসান সবসময় সৃজার সুবিধা-অসুবিধার দিকে তীক্ষ্ণ খেয়াল রেখে কাজ করে, ওকে বিশ্বাস করে। উঁচু গলায়, বাড়ি কাঁপিয়ে বউকে ধমক দেয় না, মারধর করে না, খাটিয়ে মারে না। সবচেয়ে বড় কথা, ইহসান শেখ বউয়ের সাথে সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ ভাব বজায় রাখে, বউকে কেউ কটু কথা বললেই খ্যাঁক করে উঠে। ইহসানের এসব কাজ পুরুষত্বের অবমাননা বলে
মনে করে ইজহান। বউয়ের কাছে এত নরম হবার কী আছে? বউকে সোজা রাখতে গেলে সবসময় টাইটে রাখতে হয়, এটা নির্বোধ ইহসান শেখ জানেই না। তার কাছে ইহসান শেখ একটা কাপুরুষ, ভেড়া! তবে সৃজা এ বাড়ির পার্মানেন্ট সদস্য হয়ে যাওয়ার পর থেকে ইহসান নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে, বেশিরভাগ সময়ই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ইজহানকে। কিন্তু সারাদিন বাইরে খাটুনি করে মেজাজ ঠিক রাখতে বহু কষ্ট হয় তার। অনেক সময় ধৈর্যচ্যুতি ঘটলে গ্লাসের পানি ছুঁড়ে মারে নয়তো ভাতের থালা ইজহানের মাথায় ঢেলে উপরে চলে আসে। ইজহান ক্ষেপে বকবক করতে থাকে, কিন্তু ইহসান গা করে না সেসবে। ইজহানকে সে মাথাখারাপ, পাগল বলেই মানে। এদিকে তাদের দু-ভাইয়ের নাটকে ইস্মি যেন দর্শক! সে চুপচাপ বসে এসব দেখবে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে প্রার্থনা করবে এই অনাসৃষ্টি কান্ড কীর্তি থেকে সে যেন অতি শ্রীঘ্রই রেহাই পায়।
আজকের কাহিনীও অনেক সেরকম। ইজহান
‘ফকিন্নির পুত’ গালি দিয়ে ঠাট্টা শুরু করলে সহ্য করতে না পেরে ওর চোয়াল চেপে ধরে মুখের ভেতর রুমাল গুঁজে, পানিটা ওর মাথায় ঢেলে দিয়ে উপরে আসে ইহসান। সৃজা তখন বিছানায় শুয়ে বই পড়ছে, ভাইদের বাকবিতন্ডা তার কানে এসেছে। উঠে বসতে যাবে তখনি ইহসান ঘরে ঢুকল। সৃজা স্বস্তির শ্বাস ফেলে বিছানা থেকে নেমে ঘরের এককোণে রাখা ছোট্ট ফ্রিজ থেকে লেবুর শরবত নিয়ে ছুটে এলো। ইহসান সোফায় বসে গা এলিয়ে শার্টের দুটো বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
“যত্নআত্তি করছিস যখন একেবারে মুখে তুলে
খাইয়ে দে।”
সৃজা ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“তুমি কি সবসময় ফাজলামোর মুডে থাকো?”
“এটা তোর কাছে মজা কেন মনে হলো?”
“তুমি তো মজা করেই বলো, তাই আরকি!”
ইহসান চোখ গরম করল,
“আমি তো কমেডিয়ান, সারাবছর তোর সাথে মজা করে যাব! বলেছি মুখে তুলে খাইয়ে দিতে, তা না হাজারটা অবান্তর প্রশ্ন! তোর ইচ্ছে হলে দিবি নয়তো না। আমার ইচ্ছে হলে আমি অন্য কাউকে নিয়ে আসব, সে মুখে তুলে খাইয়ে দেবে। যত্তসব!
যা ভাগ…”
সৃজা দু-সেকেন্ড থমকে থেকে মুখ কালো করে গ্লাসটা টি-টেবিলে রেখে ড্রয়ার থেকে ওর পরণের কাপড়চোপড় বের করে সামনে রেখে চুপচাপ প্রস্থান করল সামনে থেকে। ভার মুখ নিয়ে বিছানায় পা উঠিয়ে, গায়ে পাতলা চাদর টেনে আধখোলা বইটা মুখের সামনে ধরে পড়তে বসে গেল। ইহসান ওর কার্যবিধি পরখ করল আড়চোখে। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“আরে, কি সমস্যা? রাগ দেখাচ্ছিস কেন?”
সৃজা উত্তর দিলো না। ইহসান দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করল,
“যেখানে আমার রাগ দেখানোর কথা, সেখানে তুই রাগ দেখাচ্ছিস? নট ফেয়ার!”
এবারেও জবাব দিলো না সৃজা। চুপ করে বই পড়ার ভান করে কথা শুনে গেল। ভীষণ মেজাজ খারাপ হচ্ছে ওর, অভিমান হচ্ছে। ইহসান কেন ওর সাথে
এই টোনে কথা বলবে? সে কী যেচে পড়ে তার
জীবনে এসেছে না আসতে চেয়েছিল? তাহলে
কেন এতগুলো কথা শুনিয়ে দিল? ধমকের সুরে
কেন বলল?”
এদিকে ওর জবাব না পেয়ে কপালে আঙুল ঠেকিয়ে রইল ইহসান। কি এমন বলল সে যে মহারাণী ফুলে আগুন হয়ে গেছে? মজা তো সে আগেও করেছে,
কই কখনো তো এমন করে না। তার বুক জ্বলতে
শুরু করল। অনেকক্ষণ পর অস্থির কণ্ঠে বলল,
“কথা না বলার পণ করেছিস নাকি? করলাম টা কী
রে বাবা?”
সৃজা তবুও কথা বলল না, আগ্রহও দেখাল না। মনোযোগ পুরোপুরি বইয়ে রেখে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে উপন্যাসের বই পড়ে গেল। ইহসান থমকিত, চমকিত মুখে আধখোলা শার্টে বসে রইল সেভাবেই। শরবত মুখে নিতে ভুলে গেল। বুকের ভেতর পীড়ন অনুভব হলো। রক্তাভ হয়ে গেল চোখজোড়া। আগুন উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল সারা গায়ে।
তীব্র অসন্তোষ নিয়ে আচমকা উঠে গিয়ে সৃজার হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘরে পরার ট্রাউজার, টি-শার্ট নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
_____
চলবে…