অশ্রুবন্দি পর্ব-১৪

0
31

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৪

সৃজাকে পাঁজাকোলে নিয়ে ফেলে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে ইহসান। ভয় পেয়ে সৃজা আঁৎকে উঠছে আর চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে তাকে নামাতে বলছে। কিন্তু ইহসান ওর কথা শুনছেই না। দশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লিথুর মনটা আনন্দে নেচে উঠল। দারুণ উত্তেজিত হয়ে মুখ ফসকে বলে বসল,

“ফেলে দাও, ফেলে দাও ওকে ইহসান…”

উত্তেজিত, মেয়েলি এবং অপছন্দনীয় কণ্ঠস্বরটি শুনে কপাল কুঞ্চন করে পেছন ফিরে তাকাল ইহসান। ঘৃণা ফুটে উঠল চাহনিতে। মন চাইল, সৃজাকে নয় ঐ বেলাজটাকে ছাদ থেকে ফেলে দিতে। ওটার জন্য না বাড়িতে, না সৃজার সাথে দু’দণ্ড কোথাও শান্তিতে কাটাতে পারে। ইহসান চোখমুখ খিঁচিয়ে জোরেসোরে ধমক দিলো,

“রমিজ আলীর ম্যানার্সলেস, নির্লজ্জ মেয়ের কথায় ইহসান শেখ তার বউকে ফেলে দেবে? তার এত দুর্দিন, অধপতন এসেছে?”

লিথু এতক্ষণ উত্তেজিত, আনন্দিত ছিল। কিন্তু ইহসানের কথা শুনে ওর সেই আনন্দে যেন ভাটা পড়ল। চুপসে গিয়ে মুখ কুঁচকাল সে,

“বারে! আমি তো শুধু বললাম, তুমিই তো ওকে ফেলে দিতে যাচ্ছিলে…”

ইহসান দাঁতমুখ খিঁচিয়ে জোরালো গলায় বলল,

“হ্যাঁ, যাচ্ছিলাম। ইচ্ছে হলে দেবও। কিন্তু মিস. লিথু, সেটা তো আপনার কথা অনুসারে না। আপনার এত উত্তেজিত, আনন্দিত হবার কারণ কী?”

লিথু মুখ গোঁজ করে বলল,

“এমন করে কেন বলো, আমি আমি…”

ইহিসান ওকে কথা শেষ করতে দিলো না,

“হ্যাঁ, নির্লজ্জ মহিলা। আপনি এখন চোখের সামনে থেকে দূর হোন। গেট আউট ফ্রম হিয়ার…”

লিথু ধমকে কেঁপে উঠল। ইহসান আরো শক্ত কিছু বলতে যাবে তার আগেই গলা জড়িয়ে থাকা মেয়েলি হাতদুটোর শক্ত চাপ অনুভব করল। রাগ সামলে কিছুটা অবাক হয়ে চাইল সে সৃজার পানে। ইশারায় জিজ্ঞেস করল,

“কী? সব হাওয়া ফুট্টুস?”

সৃজা ভেংচি কেটে আরো শক্ত করে গলা জড়িয়ে
ধরে বলল,

“ঘরে যাব।”

ইহসান হাসি আটকাল প্রচণ্ড কষ্টে। যে মেয়ে এতক্ষণ রাগ দেখাচ্ছিল, জেদ করছিল সে মেয়ে লিথুকে দেখেই সোজা হয়ে গেল? বাহ! বেশ তো! সে অনড় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে ফিসফিস করে বলল,

“তুই তো আদর করলে রাগ করিস, ছুঁলে গাল
ফুলাস। এরচেয়ে যাকে আদর করলে গাল ফুলাবে না তাকে রেখে তোকে ফেলে দিই? কী বলিস?”

সৃজা চোখ গরম করে তাকাল। লালচে ছায়া পড়ল গালে। রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বলল,

“তাহলে একদিক থেকে না, তোমার দিক থেকেও ছোঁকছোঁকানি, তাই না? আমার সামনই সাধু সাজা, বড় বড় কথা? এজন্যই তো বলি ন্যাকুপিসি এত সাহস পায় কোথায়, কেউ ইন্ধন না দিলে তো এত সাহস দেখানোর কথা নয়!”

ইহসান ভীষণ অবাক হবার ভান করে বলল,

“তোর চিন্তাশক্তি তো দারুণ! মানতেই হবে তুই
ইহসান শেখের বউ… ”

সৃজা রেগে নখ বসিয়ে দিলো ওর ঘাড়ে। ইহসান চোখমুখ কুঁচকে ব্যথাতুর শব্দ করে অসহায় মুখ করে বলল,

“আর না, এবার সত্যিই লাগছে। আদর করতে চাইলাম…তুই দিলি না, সরিয়ে দিলি। সকাল সকাল কতটা কষ্ট হয়েছে বুঝিস? অবশ্য তুই বুঝবি কেমন করে! তুই তো মেয়ে। ছেলে হলে ঠিকই বুঝতি এতদূর এগিয়ে নিজেকে সামলানো কতটা কঠিন।”

সৃজা লজ্জা লুকিয়ে মৃদু ধমকে নিচু স্বরে বলল,

“ঘরে চলো নির্লজ্জ, নয়তো তোমার লিথুরাণীর বি’ষ নজরে অতিশ্রীঘ্রই বউহারা হতে চলেছ!”

ইহসানের সম্বিৎ ফিরল। কিছুটা অসন্তুষ্ট দেখাল তাকে। যেন সে ভুলেই বসেছিল লিথু এখানে আছে। সে কপালে ভাঁজ ফেলে বিরক্তিসূচক ‘চ’ কারান্ত শব্দ করে সৃজাকে নিয়ে ওভাবেই ঘরে যাবার উদ্দেশ্য নিয়ে পা বাড়াল। এদিকে লিথু হতবিহ্বল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল গেইটের ওখানে। তার চোখে কাতরতা , হিংস্রতা।
ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল,

“তা তোমার বউয়ের কি পা নেই? এতবড় মেয়েকে কোলে কোলে নিয়ে হাঁটতে হয়? হেঁটে নামলেই তো পারে…”

ইহসানের পা দুটো থেমে গেল। ভেবেছিল কিছু না বলবে না, কিন্তু তিরিক্ষি মেজাজ তাকে শান্ত হতে দিলো না। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে গমগমে স্বরে বলল,

“ইহসান শেখ তার বউকে কোলে নিয়ে, না মাথায় নিয়ে হাঁটবে সেটা একান্তই তার বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত মুহূর্তে নাক না গলিয়ে দয়া করে ম্যানার্সের ক্লাস করে আসুন!”

এরপর কয়েকটা সিঁড়ি নেমে আবারো থেমে দাঁড়াল। ঘৃণাভরা কণ্ঠে বলল,

“আপনি বারবার আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন, ধৈর্যের চ্যুতি ঘটলে কিন্তু ছাড় পাবেন না মিস. লিথু!”

বলে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে নেমে গেল ইহসান।হাতুড়ি পেটালে যেমন শব্দ হয় লিথুর বুকের ভেতরটাতেও যেন সেই শব্দ তোলপাড় চালাতে লাগল৷ অপমানে মুখটা কালবৈশাখীর কালো মেঘের ন্যায় কালচে হয়ে গেল৷ রাগে, হিংসেয় জ্বলে উঠল তার চোখদুটো। রাগে নিজের মাথার চুল খামচে ধরল সে। বিড়বিড় করে বলল,

“তোমার ন্যাকা বউয়ের কি অবস্থা করি দেখো,
জাস্ট ওয়েট এণ্ড সি ইহসান শেখ।”

ইহসান বেশ অনেকক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করে সৃজার এমন আচরণের কারণ উদঘাটন করতে পারল। মহারাণীর পি’রি’য়’ড চলছে, বিধায় হুটহাট তার মুড সুইং হচ্ছে। যদিও সৃজা ব্যাপারটা তাকে বলেনি, তবুও বুঝে যাওয়ায় মনে মনে ইহসানের বেশ হাসল। কিছুক্ষণ পরপরই এটা-সেটার রেশ ধরে গাল ফুলিয়ে থাকা, আবার নিজে থেকেই কফি বানিয়ে এগিয়ে দেওয়া, ভাত খাবার সময় বাহানা করা, সামান্য খুনসুটিতে রেগে যাওয়া সৃজার এ কাণ্ডগুলো উপভোগ করছিল ইহসান। রাতে বাইরে থেকে ফিরে ভুল করে ভেজা তোয়ালে বিছানায় রাখা নিয়ে রচনা শুনানো শেষে ইহসানকে অবাক করে দিয়ে সৃজা নিচতলায় চলে গেল। এ সময়টা তখন ইজহানের দখলে থাকে। নিত্যদিনের মতো আজকেও সে হাত-পা ছড়িয়ে টিভিতে চ্যানেল পাল্টাচ্ছিল। পাশে ইস্মি জুসের গ্লাস ধরে বসা। পায়ের কাছে মকবুল বসে ঝিমুচ্ছে। আচমকা সৃজা সটান ঢুকে সোফায় গিয়ে
মুখ কালো করে বসে পড়ল। বড়বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে বিড়বিড় করে ইহসানের বিছানায় তোয়ালে রাখা নিয়ে বকাঝকা করতে লাগল। ইজহান আর ইস্মির চোখ তখন ওরই দিকে। দু’জনেরই চোখ থেকে কোটর বেরিয়ে আসার উপক্রম। ইজহান ইস্মির দিকে তাকিয়ে বিস্ময় নিয়ে বলল,

“এ এখানে কেন?”

ইস্মি ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল,

“আমি কী করে বলব? আসার ইচ্ছে হয়েছে হয়তো তাই এসেছে। এটা তো ওরও বাড়ি… ”

ইজহান বিরক্তি নিয়ে গমগমে সুরে বলল,

“চলে যেতে বলো, আমি এখানে আছি না? দেখছে না আমি এখানে…”

ইস্মির ইচ্ছে করল ইজহানের মাথায় জুসের গ্লাস দিয়ে বারি দিয়ে ওর সব আক্কেলজ্ঞানহীনতা মনে করিয়ে দিতে। এত বিরক্তিকর মানুষ হয়? ভাইয়ের বউটাকে নিয়ে পর্যন্ত তার সমস্যা! সে হতাশ গলায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বলল,

“আপনি বলেন, আমি বললে ভালো দেখাবে না…”

ইজহানের কপাল কুঞ্চিত হলো। বড়ই দ্বিধান্বিত দেখালো তাকে৷ ইস্মি কোণাচোখে দেখে হাসল বেশ! বস্তুতই ইজহান দোটানায় পড়ে গেছে। সে কী বলবে? কী বলে সম্বোধন করবে? সত্যি বলতে এই মেয়ের সাথে তার এখনো পর্যন্ত কথা হয়নি। অবশ্য হবেই বা কী করে, ইহসান শেখ আর তার বউ কি আলাদা কেউ নাকি? দুটো একই! মনে মনে রাগ হলেও সরাসরি কথা বলতে কেমন একটা লাগছে। তবুও, সে তো ইজহান! তাকে এমন আমতাআমতা করা মানায় না, সে বুক ফুলিয়ে ঘোরাফেরা করে, সামান্য একটা মেয়েকে এখান থেকে চলে যেতে বলতে সে ভয় পাবে কেন? ইজহান গলা খাকারি দিয়ে সৃজার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। কিন্তু তাতে কাজ হলো না৷ এবার একটু রাগান্বিতই হলো ইজহান,

“এই মেয়ে কথা কানে যাচ্ছে না?”

সৃজার মনোযোগ ছিল অন্যদিকে। সে এবার
খানিকটা কেঁপে উঠল ধমকে। অবাক হয়ে বলল,

“আমাকে বলছেন?”

“হ্যাঁ…”

সৃজা স্বাভাবিক সুরে বলল,

“এত জোরে ডাকার দরকার ছিলো না৷ আস্তেধীরে বলুন, কী বলবেন। আমি শুনছি।”

ইজহানের মুখটা ‘হা’ হয়ে গেল বিস্ময়ে ওর কথার ধাঁচ দেখে। নিশ্চয় ইহসান কুকুরটা বউকে শিখিয়ে দিয়েছে তার সাথে এভাবে কথা বলতে। সে কী বলবে ভেবে পেল। পানসে মুখে বলল,

“আমি এখানে রেস্ট করছি, দেখতে পাচ্ছো না? তুমি এখান থেকে যাও…”

সৃজা বিস্মিত হয়ে গেল,

“এটা তো রেস্ট রুম নয় ভাইয়া। এটা বসার ঘর, সবাই বসতে আসে। আমি কেন এখানে বসতে পারব না?”

“আমি বলেছি তাই, পারবে না।”

“এটা তো কোনো কথা হলো না…”

ইজহান ভ্রু কুঁচকে নড়েচড়ে পিঠ সোজা করে বসল। হড়বড়িয়ে বলল,

“আমার সঙ্গে তর্ক জুড়ছ? ইহসান ভেড়াটার মতোনই আচ্ছা বেয়াদব তুমি…”

সৃজা এবার নড়েচড়ে বসল। ভীষণ বিরক্ত হলো সে ইহসানকে নিয়ে কটুক্তি করায়। শক্ত মুখে বলল,

“এখানে বসলাম বলে বেয়াদব হয়ে গেলাম? আচ্ছা, ওকে। আমি কোনো আর্গুমেন্টে যেতে চাচ্ছি না। আপনি যদি যথোপযুক্ত একটা কারণ দেখাতে পারেন আমি সৃজা আর কখনো এখানে আসব না। দেখান একটা কারণ… ”

“কারণ হলো…”

উচ্চস্বরে শব্দদুটো আওড়ে ইজহান চুপ হয়ে গেল। সৃজা উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইল ওর দিকে৷ ইজহান চোরা চোখে দেখল সৃজাকে। অতি ভদ্রতা ফুটে আছে মেয়েটার মুখপানে, ভীষণ নম্র। ইজহান থতমত খেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। বিচলিত হয়ে মস্তিষ্ক আঁতিপাঁতি করে খুঁজে সৃজাকে বলার মতো শক্ত কিছু পেল না। আশ্চর্য হলো ইজহান! এই মেয়েকে শক্ত একটা ধমক দিয়ে সে এখান থেকে বের করে দিতে পারে, মোটেও কঠিন নয়। কিন্তু সে পারছে না।
এদিকে স্বামীর শুকনো এবং দোটানায় ভোগা চেহারাটা দেখে ইস্মি মনে মনে হাসল। বেশ হয়েছে, আচ্ছামত ফেঁসেছ এই লোক! সে নিষ্পাপ মুখশ্রী বানিয়ে স্বামীর হেরে যাওয়া ‘হেরো’ মুখটা দেখতে লাগল! ইজহানের চোখ পড়তেই সে ইস্মিকে নিচু
স্বরে বলল,

“কী বলা যায় এটাকে?”

ইস্মি ভাবার ভান করে বলল,

“আমি তো কোনো যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছি না…”

ইজহান এবার চিড়বিড়িয়ে ধমকে উঠল,

“দুটো পয়েন্ট বলে দিতে পারিস না, কীসের বউ তুই? ফাউল মেয়েমানুষ!”

ইস্মি ভোঁতা মুখে বসে থাকার ভান করল। ভেতরে ভেতরে সে যে হাসিতে ফেটে যাচ্ছে সেটা প্রকাশ করল না। ইজহান মনমতো কিছু না পেয়ে গাই গুই করতে লাগলে সৃজা মনে মনে হাসল। তার কানে কথাগুলো এসেছে। কিছুক্ষণ সময় পেরুতেই সে উঠে এলো। ইজহানের সোফা থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল। এরপর নরম কণ্ঠে বলল,

“আমি খেয়াল করেছি, অবশ্য খেয়াল বলা যায় না কারণ আপনি বাচ্চাদের মতো যেসব কাণ্ডকীর্তি করেন সেগুলো সবারই জানা। আপনি সবার সাথে এমনকি আপনার স্ত্রীর সাথেও খুব খারাপ ব্যবহার করেন। যা মহা অন্যায়। বিরক্তি বা ভয়ে আপনাকে কেউ কিছু বলতে পারে না ঠিক, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপনি যা করেন সব ঠিক। বরং আপনি ভুল, চরম বোকা পুরুষ মানুষ! বোকার মতো ইস্মি ভাবির সাথে খারাপ ব্যবহার করেন, ভাবেনও না আপনার এসব আচরণ ইস্মি ভাবির কেমন লাগে!”

একটু থেমে আবার বলল সৃজা,

“ইস্মি ভাবির কেমন লাগে আমি জানি না, তবে এক্ষুনি আমার সাথে করা আপনার ব্যবহারটা আমার খুবই খারাপ লেগেছে। আপনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে গেছে।
যতটুকু অবশিষ্ট আছে তার পরিপ্রেক্ষিতেই বলছি, আমি আপনার ছোট বোনের মতো। আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবেন না ভাইয়া।”

লম্বা রচনা শুনিয়ে সৃজা বসার ঘর থেকে প্রস্থান করল। পেছনে হতভম্ব হয়ে রইল ইজহান, আর সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে কাহিনী দেখতে থাকা ইহসানের বুক ফুলে উঠল গর্বে!

_______
চলবে…