অশ্রুবন্দি পর্ব-১৬

0
29

#অশ্রুবন্দি
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৬

মাঝরাতে মেয়েলি ছোঁয়ায় আধোঘুম থেকে জাগ্রত হতেই ইজহান দেখল ইস্মি ওর পিঠে মালিশ করে দিচ্ছে! নরম হাতের স্পর্শ সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে ব্যাপারটা অনুভব হতেই ইস্মিকে বুকের উপর এনে ফেলল ইজহান। অস্ফুটস্বরে বলল,

“সারা গায়ে ব্যথা বউ, মনেও…”

ইস্মি গুটিশুটি মেরে ওর বুকে জমে রইল, কিন্তু কিছু বলল না। ইজহান ওর চুলে মুখ ডুবিয়ে সুবাস নিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে,

“সবসময় এমন চুপ মেরে থাকো কেন? কথাবার্তা বললে কি সমস্যা? অন্যদের সাথে তো ভালোই গল্পগুজবে মগ্ন থাকো। আর আমার সামনে এমন ভান করো, যেন আমার দাসীবাঁদী তুমি…”

ইস্মির হাসি পেল, তাচ্ছিল্যের হাসি। ইজহান অবশ্য সেটা দেখল না। সে বউয়ের চুলে আদর দিতে মগ্ন। ইস্মি বলল,

“দাসীবাঁদীই তো…”

ইজহান আদর থামিয়ে চোখ তুলে তাকাল,

“মানে?”

“স্ত্রীরা তো স্বামীর দাসীবাঁদীই হয়, ছোটবেলায় শুনতাম দাদি-নানিরা বলতো…”

“অহ!”

বলে ইজহান ছোট্ট করে ওর কপালে চুমু দিয়ে বলল,

“অন্যরা হয়তো তাদের বউকে দাসীবাঁদী বানিয়ে রাখে, তাই বলে। কিন্তু আমি তো আমার ইস্মিতাকে তেমন রাখি না, বরং আদর করি, আবদার করি। স্বামীর আদর-আবদার মানলে তো কেউ দাসীবাঁদী হয়ে যায় না…তাছাড়া বাড়ির কাজও তো তোমাকে করতে অনুমতি দেইনি আমি, আমার বউ শুধু আমার কাজ করবে। আমার জন্য রান্না করবে, পোশাক ধুয়ে দেবে, যত্ন-আত্তি করবে, পছন্দ-অপছন্দের খেয়াল রাখবে, আমার সব কাজ গুছিয়ে দেবে, আমার অনুমতিবিহীন কোত্থাও যেতে পারবে না আর আমার সব কথার অবাধ্য হবে না…”

ইস্মির চোখে অশ্রু চলে এলো,

“আর আপনার অনুমতি ছাড়া নিঃশ্বাসও নেওয়া যাবে না…”

ইজহান হেসে ওর নাকে নাক ঠেকাল। ফিসফিস করে বলল,

“হ্যাঁ, ঠিক তাই।”

এরপর নাকের ডগায় চুমু খেয়ে গমগমে স্বরে বলল,

“ভালোবাসি বউকে, তার কাছে এটুকু আশা করবই।”

একটু থেমে ইজহান আবারো হিংস্র কণ্ঠে বলে,

“তবে আমাকে ঠকিয়ে অন্যকারো সাথে ঘর বাঁধার
কথা ভাবলে তক্ষুণি যেন তুই মরে যাস, দিবা নিশি আমি তাই প্রার্থনা করি, মাই লাভ!”

এটুকু বলে গভীর শ্বাস ছাড়ল সে। পরপর কয়েকটা চুমু বসাল ইস্মির গলায়। এরপর ঠোঁটের উপর আলতো করে ফুঁ দিয়ে কোমল গলায় বলল,

“দিনদিন এত মিষ্টি হচ্ছো কেন বউ? আমার ডায়াবেটিস হলে তখন কী হবে? এভাবে তো আদর করতে পারব না…”

ইজহানের কপালে তিনটি ভাঁজ পড়ল। সত্যিই চিন্তিত দেখাল ওকে। মুখটা শুকনো দেখাচ্ছে। যেন মহাবিপদ তাড়া করছে ওকে। দৃশ্যটা হাসির, কিন্তু ইস্মি একটুও হাসি পেল না। অবশ্য শেকলে বাঁধা কাঠপুতুলদের হাসি মানায় না। তাদের হাসির জোর থাকে না; অন্যের খুশির জন্যই কেবল মুখে হাসি আনতে হয়। ইস্মি নিরুত্তর, বরাবরের মতো! বলার মতো আসলে ওর কিছুই নেই। এইযে, লোকটা এত ভালোবাসছে, পাগলামি করছে এখন, সকাল হলেই আবারো আগের রুপ ধারণ করবে। সেখানে অধিকারবোধ দেখানোয় ব্যস্ত থাকে এই মানুষটা। কী এমন হয়, যদি ইজহান একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তার সাথে? যেখানে ভালোবাসার পাশাপাশি বিশ্বাস আর ভরসা নামক সম্পর্কের সবচেয়ে মূল্যবান দুটি জিনিস থাকবে!
মানুষটা যতই স্বৈরাচারী, কর্তৃত্বপরায়ণ হোক না কেন ইস্মি তো ভালোবাসে লোকটাকে, সেই বিয়ের পরে যেমন অনুভূতি ছিল, এখনো তেমনি। মাঝখানে সম্পর্কের টানাপোড়েন আর ইজহানের নিগ্রহতায় কিছুটা ধুলোবালি পড়েছে, তবুও একেবারে মলিন হয়ে যায়নি সেই অনুভূতি! এতকিছুর পরও কেন ইজহান তার প্রতি ভরসা স্থাপন করতে পারে না? সারাদিন যে মুখে বুলি ছড়ায়, ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি’ আদৌ কি ভালোবাসলে কেউ নিজের স্ত্রীর সাথে এধরনের নিগ্রহমূলক আচরণ করতে পারে? অতিরিক্ত অধিকারবোধ দেখিয়ে স্ত্রীকে হাতের পুতুল বানিয়ে রাখে? এখানে আস্থার জায়গাটা কোথায়? ইস্মি জবাব খুঁজে পায় না, তাই পারে না সহজ হতে!

ইস্মির চোখদুটো বন্ধ! কী ভাবছে বা ওর মনে কি চলছে তা জানতে আগ্রহবোধ করছে ইজহান। ইস্মির কণ্ঠস্বর শ্রুতিমধুর। কথা বললে শুনতে ভালো লাগে ইজহানের। কিন্তু আজকাল বৌটা মেপে ঝুকে কথা বলছে, ব্যাপারটাতে রাগ হয় ওর। ইস্মির নিশ্চুপতা একদম সহ্য হচ্ছে না এই মুহূর্তেও। সে আদর থামিয়ে গাল চেপে ধরে রাগ নিয়ে বলে,

“এই তাকাস না কেন আমার দিকে? ভাল্লাগে না? অসুন্দর হয়ে গেছি আমি?”

ইস্মি ওর রাগান্বিত কণ্ঠস্বর শুনে চোখ খুলে তাকাতেই
ইজহান ক্যাটকেটে গলায় বলে,

“দেখ আমাকে, চুল কেটে এসেছি! একবারো খেয়াল করেছিস? সারাদিন নাগর নিয়ে ভাবলে আর আমার দিকে তাকানোর সময় পাবি কি করে? আগ্রহ হারাস আমার উপর থেকে, এই মুখ খোল, বল আমায় কোন নাগর তোর মাথায় ঘুরে…”

ইজহান ডেস্পারেট হয়ে গেল। ইস্মির গালে লাল ছাপ পড়ল। ব্যথায় চোয়াল ঝিম ধরে গেল। ইস্মি কান্না, রাগ চাপা দিতে পারছে না। কাঁপছে ওর শরীর। কম্পিত স্বরেই বলে,

“আল্লাহর দোহাই, মিথ্যে সন্দেহ করা বন্ধ করুন। আমার কোনো নাগর ফাগর নেই। না ছিল কখনো। আপনিই একমাত্র, আর কেউ নেই। একটুও খারাপ লাগে না এগুলো মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে? ছিহ, এই আপনি আমায় ভালোবাসেন?”

“আমার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলিস তুই? বাড়ি ফেরার পর থেকে শুকনো মুখে বেড়াচ্ছিস, কথার উত্তর দিচ্ছিস দাঁড়িপাল্লায় মেপে। আমি আজ চুল কেটে এলাম, একবারো খেয়াল করেছিস, না। কারণ তোর খেয়াল থাকে অন্যকোথাও! এমনকি আমাকে দেখলে তোর হাসি পর্যন্ত উবে যায়। এসবের কারণ তোর কোনো নাগরই, আমি জানি…”

ইজহানের উদ্ভট, অবান্তর, অযৌক্তিক কথা শুনে ইস্মি এবার ধৈর্য সামলাতে পারল না। নিজের মতো করে বউয়ের কাল্পনিক নাগর বানিয়ে নিয়েছে কাউকে এই লোক।
ও রক্তিম মুখে চেঁচিয়ে উঠল,

“এসব গল্পগুলো কি আপনি নিজে নিজে বানান? স্বপ্নেও কি এসব দেখেন? তো ঐ নাগরটাকে সচক্ষে কয়বার দেখেছেন আমার সাথে? কয়বার বিছানায় গেছি আমি তার…

ইজহান কথাটুকু শেষ করতে দিলো না। কথার মারপ্যাঁচে পড়ে আঁচড়ে-কামড়ে একাকার করল ইস্মিকে। একপর্যায়ে থামাতে না পেরে কামড় বসিয়ে দিলো ওর ঘাড়ে ইস্মি। ইজহান ব্যথা পেল না। ওর জিম করা বডি, মার খেয়ে অভ্যস্ত। মেয়েমানুষের দু-একটা কামড়ে কিছুই হয় না। উল্টো দু’হাতে ইস্মির মুখ চেপে ধরে প্রশংসা শুনতে চাইল নিজের৷ কোমল গলায় বলতে থাকল,

“এই বউ তাকাও, আমাকে দেখতে কেমন লাগছে…তাকাও না…”

ব্যাকুল হয়ে উঠল ইজহানের কণ্ঠস্বর। ইস্মি হাসবে
না কাঁদবে বুঝতে পারল না, দীর্ঘশ্বাস ফেলল! সদ্য কেটে আসা চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে ধীরস্বরে বলল,

“সুন্দর, সুন্দর লাগছে…”

ইজহানের মুখ এতটুকু আদরেই উজ্জ্বল দেখাল।
ঠোঁট চেপে চুমু খেল সে ইস্মিকে। এরপর শান্ত হলো। ক্লান্ত শুয়ে পড়ল ফুরফুরে মেজাজে। বউ প্রশংসা করবে না, এমন চুলের কাটিং সে কখনোই দেয় না। যদিও ভেড়া মানব ইহসান শেখও তার চুলে সেইম কাটিংই দেয়! মাঝেমাঝে দুঃখ হয় ইজহানের, তারই কেন জমজ একটা ভাই হলো?
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, পাতা নড়ার আওয়াজ হচ্ছে!
সেই শব্দে আর ইস্মির আদরে ইজহান গভীর ঘুমে
ডুব দিলো।

.

বড্ড ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে, অসময়ে শীতে কাবু হয়ে ইহসান ঘুমের ঘোরেই সৃজাকে কাছে টেনে নিলো। এরপর ভালোমতো দু’জনের গায়ে চাদর টেনে নিলো। ঘুমন্ত
সৃজার ঊষ্ণ নিঃশ্বাস ইহসানের নগ্ন বুকে পড়ছে। তার ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছে, ইহসান তার রুক্ষ হাতে নাক টিপে ধরল সৃজার। দম নিতে না পেরে জেগে উঠল মেয়েটা। টেনেটুনে হাত সরাল ইহসানের। ঘুমঘুম গলায় বিরক্তি প্রকাশ করল,

“কি করছ তুমি? শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তো।”

ইহসানের গলা শুকোচ্ছে। ঢোক গিলে বলল,

“সরি রে…”

আধো-অন্ধকারে সবকিছু অস্পষ্ট। শুধু বাইরের বৃষ্টির ঝমঝম আর ঘরের ভেতর থাকা দু’জন মানুষের নিঃশ্বাস, আপাতত শব্দ বলতে এটুকুই! তার মধ্যে ইহসানের ওমন শীতল কণ্ঠস্বরে ‘সরি’ বলা বেশ অদ্ভুত! সৃজা ভালো করে চাইল এবারে,

“কী হয়েছে তোমার?”

“আমার খারাপ হতে ইচ্ছে করছে.. ”

“কীহ?”

অসহায় শোনাল ইহসানের গলা,

“রাতে নিজেকে কন্ট্রোল করে ফেলেছিলাম। কিন্তু এখন সব এলোমেলো লাগছে। সবসময় অমন গোলাপি ঠোঁট নিয়ে ঘুরিস, লোভ লাগবে না? আর ক’টাদিন গেলে আমি জুলুম করে ফেলব তোর উপর, সত্যি সত্যি!”

সৃজার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। বুকের ভেতর অজানা আকাঙ্খা উদয় হলো। আশ্চর্য! হঠাৎ এমন লাগছে কেন? সে সময় ইহসানের গম্ভীর কন্ঠ শোনা গেল,

”দূরে দূরে থাকিস ক’টা দিন…”

সৃজাকে বিভ্রান্ত দেখাল। বিয়ে হয়েছে মাস পেরিয়েছে, ইহসান তার স্বামী। অথচ এখনো সেভাবে কাছাকাছি আসা হয়নি দু’জনের। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হলো সৃজা, বেশিরভাগ সময় জড়তাটা ওরই কাজ করে। ইহসান অবশ্য ওকে যথেষ্ট সাপোর্ট করছে, সময় দিচ্ছে, কখনো এ বিষয়ে জোর করেনি বা বলেওনি। অবশ্য জোর করে এক-দুটো চুমু খেয়েছে কিন্তু জবরদস্তি করে অধিকার নিতে আসেনি। ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে এতদিন নিশ্চয় মানিয়ে নেওয়ার সময় দিতো না, অনেক আগেই নিজের অধিকার বুঝে নিতো। ইহসান নেহাৎই ভদ্রলোক বলেই নেয়নি৷ এসব ভেবে এই ভোর হতে থাকা শেষরাতে, শীতল, বৃষ্টিস্নাত আবহাওয়ায় সৃজার মনে অদ্ভুত ঢেউ খেলে গেল। কিছুটা এগিয়ে পুরুষালি নগ্ন বুকে নাক ঘষল। ইহসান ওর কাণ্ডে প্রচন্ড বিস্মিত হয়ে গেল। মুখ খুলে কিছু বলতে যাবে তখনি আচমকা সৃজা ওর ঠোঁটের কোণে আলতো একটা চুমু খেয়ে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বলল,

“তুমি তোমার অধিকার নিতে পারো, এতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আমি আরও একটু সময় চাই, নিজেকে পুরোপুরি মানিয়ে নিতে, যাতে আমি তোমার সাথে সত্যিকারভাবে একাত্ম হতে পারি। কারণ সম্পর্কের মাঝে আমি কখনো তৃতীয় কাউকে সুযোগ দিতে চাই না। তাছাড়া… উম… আই থিংক… আ’ম ফ’ল্লিং ইন লাভ উইথ ইউ…”

ইহসান বেশ কিছুক্ষণের জন্য চমকাল, থমকাল। বিস্মিত অবস্থাতেই রইল কতক্ষণ! হাসি ফুটল না ঠোঁটের কোণে, শুধু ভার হয়ে থাকা বুক থেকে পাথর নেমে যাওয়ায় সে কিছুটা ধাক্কা খেল। কেমন অদ্ভুত, অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করল বুকের ভেতর। বহুদিনের আকাঙ্খিত নারীটির কথাগুলো তার কর্ণকুহরে অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়াচ্ছে। তৃষ্ণার্ত মনটা সৃজার পূর্ণ ভালোবাসা পাবার লোভেই আর দ্বিমত করল না। সৃজার চুলে আঙুল ডুবিয়ে, এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে সে ম্লান স্বরে বলল,

“গ্র‍্যান্টেড…”

_____

চলবে…